মেঘের বাড়ি - পর্ব ০২ - ফারহানা ছবি - ধারাবাহিক গল্প

পড়ুন ফারহানা আক্তার ছবি'র লেখা একটি সামাজিক ধারাবাহিক গল্প মেঘের বাড়ি
মেঘের বাড়ি
মেঘের বাড়ি

"সোহেল আমি আমার বোনের কাছ থেকে সবটা শুনেছি৷ এখন তোমার কী কিছু বলার আছে?"

সোহেল এবার মাথা তুলে মেঘের দিকে একনজর তাকিয়ে বলে উঠলো,

"দেখুন ভাইয়া মেঘ আপনাদের কী বলেছে আর কী বলেনি সেটা আমি জানি না তবে আমি বলবো মেঘ যা বলছে পুরোটাই বানোয়াট কথা কারণ আপনারাই দেখছেন আমার আম্মাকে? আমার আম্মা একদম মাটির মানুষ তিনি বা আমার বোন ভাই এমন টা কখনো করতেই পারে না।"

সোহেলের কথা শুনে মেঘ ত্যাচ্ছিল্যর হাসি দিয়ে বললো,

"দাদা তার মা বোন ভাই এতই ভালো যখন তখন একবার জ্বিজ্ঞাসা করো তো প্রথম রাতে তার বোন আর ভাইয়ের স্ত্রী মিলে তোমাদের দেওয়া সব জামা কাপড় গহনা না বলে কী করে নিয়ে যায়! দ্বিতীয় দিন নতুন বউয়ের শাড়ি লুকিয়ে রেখে ছ্যাড়া শাড়ি পড়তে দেয়? জ্বিজ্ঞাসা করো কোন ছোট জা এসে আমাকে আজেবাজে কথা বলে? এমনকি তাদের ছোট ছোট বাচ্চাদের ও উল্টো পাল্টা কথা শিখিয়ে দেয়। আমার সাথে কাজের লোকের থেকেও বাজে আচরন করে।"

মেঘ আর কিছু বলতে যাবে তার আগে মেঘের ছোট ভাই আকাশ মেঘের বরের দিকে তেরে যেতে নিলে মেঘ আটকে দিয়ে ইশারায় বারণ করে। আকাশ দাঁতে দাঁত চেপে আগুন দৃষ্টিতে সোহেলের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বি*শ্রি কিছু গা*লি দিলো। এদিকে মেঘের ভাইয়েরা সবটা শুনে প্রচন্ড রেগে গেলেন। সোহেল এখনো আগের মত নির্বিকার হয়ে বসে আছে। চোখ মুখ একে বারে শান্ত। সোহেলের ভেতরে কি চলছে তা মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই।

মেঘের সেজভাই আবদুল্লাহ কিছুক্ষণ চুপ থেকে সোহেলকে বলতে লাগলো,

"শোন সোহেল বোনকে বিয়ে দিয়ে ভাসিয়ে দিইনি। আমাদের তিন বোন আমাদের কলিজা। তাদের বিন্দুমাত্র কষ্ট আমরা সহ্য করবো না। আমরা একপাক্ষিক বিচার করবো না। আমরা তোমার বাবা মায়ের সাথে কথা বলবো। এই সমস্যার সমাধান করা অত্যান্ত জরুরী।"

আবদুল্লাহর কথা শেষ হতে মেজভাই(তাজুল) বলে উঠলো,

"আপাতত মেঘ এখানে থাকবে যতদিন না সমস্যার সমাধান হয়।"

মেজভাইয়ের কথা শুনে সোহেল ক্ষিপ্ত হয়ে বলে ওঠে,

"এটাই যদি আপনাদের সিদ্ধান্ত হয় তাহলে আজ আমিও আপনাদের একটা কথা পরিষ্কার করে বলে দিচ্ছি কাল যদি মেঘ আমার সাথে ও বাড়ি না ফেরে যায় তাহলে মেঘের জন্য ও বাড়ির দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে।"

সোহেলের কথা শেষ হতে না হতে মেঘের ছোট ভাই সোহাগ তেরে সোহেল কে আঘাত করতে নিলে মেঘ সহ বাকি চার ভাই সোহাগ কে আটকে ফেলে।

"ছোট ভাই কি করছো? শান্ত হও।"

"মেঘ তুই আমাকে শান্ত হতে বলছিস? ওই শু*** বা** কত বড় সাহস আমার সামনে বলে ওবাড়ি ফিরে না গেলে চিরদিনের জন্য দরজা বন্ধ হয়ে যাবে।"

সোহাগ সোহেলের দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে আঙ্গুল তুলে বলতে লাগলো,

"আজ তুই আমার বোনের জন্য বেঁচে গেলি কিন্তু তুই কী করে আমার বোন কে ওই বাড়িতে ঢুকতে না দিস সেটা আমিও দেখবো। আমাকে চিনিস নি এখনো, ভান্ডারিয়া গিয়ে জ্বিজ্ঞাসা কর সোহাগ কে? বলে দিবে। এই সোহাগ কে এবং কী করতে পারে। তোকে তো আমি দেখে নিবো সাথে তোর পরিবারকেও।"

"কি হচ্ছে কি সোহাগ? আমরা কথা বলছি তো?"

চেঁচিয়ে বলে উঠলো নাজমুল। সোহাগ হাত ছাড়িয়ে শান্ত কন্ঠে বলতে লাগলো,

"দুঃখিত দাদা তোমার সামনে এভাবে ব্যবহার করার জন্য, কিন্তু তুমি যদি আমাকে বিশ্বাস করো তাহলে এই সমস্যার সমাধান আমাকে করতে দাও। কথা দিচ্ছি সোহেল আর ওর পরিবারকে যদি সোজা করতে না পারি তাহলে আমি সোহাগ না।"

"সোহাগ আমরা কথা বলছি তো তুই চুপ থাক।" (তাজুল)

সবার কথা শুনে সোহেল বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো,

"আপনাদের সবার কথা শুনেছি এখন আমার কথা আপনারা শুনুন। আমি এই মুহূর্তে এ বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাবো আর আপনাদের বোন যদি সংসার করতে চায় তাহলে যেন আমার সাথে এই মুহূর্তে এ বাড়ি ত্যাগ করে নাহলে ......"

আর কিছু বলেনি সোহেল গট গট করে হেটে রুমে চলে গেল। এতক্ষণ আলিয়া দরজায় দাড়িয়ে সবার কথাই শুনলো। তবে ভেতরে আর প্রবেশ করলো না কারণ এখন সবার মাথা গরম ভেতরে গেলে হয়তো প্রত্যেকে বকা দিবে। সে ভয়ে আর ভেতরে না ঢুকে রান্না ঘরের দিকে ছুট লাগালো।

(৪)

পুরো বাড়ি আজ থম মেরে আসে মেঘের মা শেফালী বেগম আহাজারি করে কান্না করতে করতে জ্ঞান হারাচ্ছে বার বার। মেঘ সব টা দেখেও কিছু করতে পারছে না কারণ ঘন্টাখানিক আগে সোহেল বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেছে। সোহেল বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত মেঘ অন্য রুমে দরজা সেটে গাট হয়ে বসে ছিলো। সোহেল বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার পর পর আলিয়া দরজায় নক করে সোহেলের চলে যাওয়ার কথা জানাতে মেঘ দরজা খুলে বাইরে বের হতে শেফালী বেগম মেঘের গালে কয়েকটা থাপ্পর মেরে আহাজারি করে কান্না শুরু করেছে তার আর থামার নাম গন্ধ নেই।

রাতে কারও আর খাওয়া হলো না। ছোটরা খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু ঘুম নেই মেঘের চোখের কোণে। চোখের সামনে এখন বিয়ের সেই মুহূর্ত টা চোখে ভাসছে। তারপর পর ভেসে উঠছে সেই বাজে ব্যবহারের কথা। কিছুতেই সেই বাজে ব্যবহারের কথা ভুলতে পারছে না। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে মেঘের।

অন্যদিকে সোহেল বাড়ি ফিরে তার বাবা মা বোন ভাইদের সবটা জানাতে তারা অকথ্য ভাষায় মেঘ কে গা*লি গালাজ করতে লাগলো। সোহেল অবাক চোখে তাকিয়ে রইল তার মায়ের দিকে, এ কোন রুপ দেখছে তার মায়ের? কি জঘন্য ভাষায় মেঘ কে গা*লি*গা*লাজ করছে। সোহেল ধীর পায়ে নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। এদিকে সোহেলের তিন বোন তার মায়ের সাথে মেঘকে চিরতরে তাড়ানোর প্লান করছে।

"আম্মা ভাবিরে আর এই বাড়ি ঢুকতে দেওয়া যাইবো না।"

বড় মেয়ে আখি বলে উঠলো। আখির কথা শুনে মেজ মেয়ে সাথী বলে উঠলো,

"হ আম্মা বড় আপা ঠিক কথা বলছে। ভাবি এমনিতে শিক্ষিত মাইয়া, ভাইয়ের সব জমিজমা টাকা পয়সার সব হিসাব নিবে। আমরা যে এতদিন ধরে ভাইয়ের টাকা পয়সা দিয়া আমাগো নামে জমি রাখছি। সে কথাও জেনে ফেলবো তখন ভাই তো আমাগো ভুল বুঝবো। আমাগো আর বিশ্বাস করবো না।"

"তোরা থামবি? তোগো মাথায় কী গোবর ভরা? এখন যদি বউ বাড়ি না আহে আর ওই বাড়ি থাইকা যায় তাইলে ও বাড়ি দিয়া যে মাল জিনিস আইসে সেগুলা তো দেওন লাগবো।"

মায়ের কথা শুনে দুবোন চুপ হলেও ছোট বোন মিলা চুপ থাকলো না।

"আম্মা মাল জিনিস কিছুই ভাবিরে দিমু না। তার চাইতে আমাগো অন্য কিছু ভাবতে হইবো।"

"হ আমা মিলা ঠিক কয়ছে। আমার দেবরকে দিয়া ভাবির বাড়ি আশে পাশে খোঁজ লইয়া দেখি কোন খবর পাই কীনা? যে খবর দিয়া ভাবিরে কিস্তিমাত করা যাইবো। কিন্তু আম্মা তোমারে আগেও কইছিলাম ভাইয়ার জন্য অশিক্ষিত মাইয়া আনতে কিন্তু আমার কথা শুনলা না এখন দেখতাছো কী ভোগান্তিতে পড়তে হইতাছে।"

"হ আপা ঠিক কইছিস ওই সা* আলমগীর এই বিয়ার প্রস্তাব আনছে সা*লারে হাতের কাছে পাইলে চটকানি দিতাম।"

"এহন এইসব কথা বাদ দিয়া খাওন বার, সবাইরে খাওন দিতে হইবো তো।"

মায়ের কথা শুনে তিন মেয়ে উঠে গেল খাবার বাড়তে অন্যদিকে সোহেল মাথায় হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। ও বাড়ি থেকে আসার পর থেকে কোন কিছুই ভালো লাগছে না সোহেলের। মেঘের মায়াবী মুখটা বার বার মনে পড়ছে। মুখে যাই বলুক না কেন এই কয়েক দিনে সোহেল মেঘকে প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলেছে। এক মুহূর্তের জন্য ও মেঘকে চোখের আড়াল হতে দিতে মন চায় না সোহেলের, কিন্ত পরক্ষণে আজকে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা মনে পড়তে রাগে কপালের রগ গুলো ফুলে ফেঁপে উঠলো। সোহেল চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,

"আজ যা হলো তার মূল্য তোমাদের দিতে হবে মেঘ। এর সমাধান না করে তোমাকে আমি ঘরে তুলবো না।"

রাতে খাবার খাওয়ার সময় সোহেল কে অনেক ডাকাডাকি করেও রুম থেকে বের করতে পারেনি কেউ। তবে এই নিয়ে বিশেষ কোন মাথা ব্যাথা নেই কারোর। সবাই যার যার মত খেয়ে উঠে গেছে।

পরেরদিন দিন সকাল বেলা সোহাগ একাই সোহেলের গ্রামে গিয়ে হাজির হয়। সেখান কার মাতব্বর মোহাম্মদ গাজীর সাথে মেঘের বিষয় কথা বলে। সবটা শুনে মোহাম্মদ গাজী ভিষণ রেগে যায় তার ভাইপো সোহেলের উপর। তিনি এই গ্রামের মাতব্বর আর তার গ্রামে তার রক্ত এমন অবিচার করছে সেটা শুনে প্রচন্ড রেগে যায়।

অন্যদিকে আখির দেবর রানাকে আখি মেঘের গ্রামে পাঠায়। সেখানে রানা এমন একটা খবর পেলো তা শুনে এক মুহূর্ত দেরি না করে বাড়ি ফিরে গেল।

(৫)

দুপুর দুইটায় রানা সোহেলদের বাড়ি পৌছানো মাত্র তিন বোন রানাকে ঘিরে ধরে।

"রানা কিছু জানতে পেরেছিস?"

"হ ভাবি এমন একটা খবর আছে যেটা শুনলে তুমি খুশিতে নেচে উঠবে।"

"কি খবর দ্রুত বল রানা। আমার আর তর সয় না।"

রানা তিন ঢোকে পানি খেয়ে বলতে লাগলো...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন