নাইওরি |
কেশবপুর গ্রামের সর্বদক্ষিনে মির্জা বাড়ি। বাড়ির মালিক জয়নাল মির্জা উক্ত এলাকার জনপ্রিয় চেয়ারম্যান। প্রভাবশালী লোক। লোকে তাকে সম্মান করে, মেনে চলে, ভয়ও পায়। তার জনপ্রিয়তার কারণ সে অত্র এলাকার উন্নয়নের জন্য যেসকল কাজ করেছেন তা বিগত বৎসরগুলোতে অন্য কোনো চেয়ারম্যান করে যেতে পারেননি। এছাড়াও তিনি দিলদরিয়া মানুষ। লোকমুখে প্রচলিত আছে, জয়নাল মির্জার কাছে সাহায্যের হাত পেতে কেউ কোনোদিন ফিরে যায় নি। তা সে যে সাহায্যই হোক না কেন!
জয়নাল মির্জার বিভিন্নরকম ফসলের ক্ষেত আছে। সেসব ফসল বিক্রি বাবদ তার ভালো রকম আয় হয়। স্ত্রী কোহিনূর বানু, একমাত্র কন্যা জেসমিন, দুই পুত্র জালাল, জব্বার এবং দুই পুত্রবধূ আসমা ও মিনু কে নিয়ে তার সংসার।
আষাঢ় মাস, ১৯৭৪ সাল। আজ সন্ধ্যার পর জয়নাল মির্জার কাচারি ঘরে আসর বসেছে। এধরনের আসর প্রায়ই বসে। এই আসরে কোনোদিন চলে কলের গান, কোনোদিন চলে রেডিও। আজ রেডিওতে "মধুমালা মদন কুমার" নাটক সম্প্রচারিত হবে তাই লোকজনের আনাগোনা বেশি। কাচারি ঘরে সকলের জায়গা হচ্ছেনা। গাদাগাদি করে বসার পরেও অনেক লোক সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। সারাদিন ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হওয়ায় উঠানজুড়ে প্যাঁচপ্যাঁচে কাদা, নাহলে উঠানেও লোকজনের বসার ব্যবস্থা করা হতো।
এ নাটক যে আগে কেউ শোনেনি ব্যাপারখানা তা নয়। রেডিওতে একই নাটক বারবার সম্প্রচারিত হয়। একাধিক বার শোনার পরেও নাটক শোনার ব্যাপারে গ্রামবাসীর আগ্রহের শেষ নেই। এছাড়া যেদিন ভানুর কৌতুক শোনায় সেদিনও বেশ ভীড় হয়।
লম্বা কাচারি ঘরের এক দিকে একটা চৌকি পাতা। কোনো বহিরাগত অতিথি এলে এখানেই ঠাঁই হয়। ঘরের অন্য দিকে দুইপাশে লম্বা লম্বা দুটো বেঞ্চ পাতা। গ্রামের গণ্যমান্য লোকেরা এই বেঞ্চে বসেন। আর নিচু জাতের লোকেদের জায়গা হয় মাটিতে পাটির উপরে যাকে স্থানীয় ভাষায় হোগলা বলা হয়। চেয়ারম্যান সাহেবের বসার জন্য একখানা গদির ব্যবস্থা আছে বৈকি। তিনি সেখানেই বসেন। কাচারি ঘরে মহিলাদের আসা সম্পূর্ণ নিষেধ। কিন্তু চেয়ারম্যান সাহেবের ষোড়শী কন্যা জেসমিনের নাটক শোনার খুব শখ। তার খুব জানতে ইচ্ছে হয় নাটকে কী হয়? কেন এত মানুষ ছুটে আসে এই নাটক শুনতে? বছরখানেক ধরে সে তার বাপ-ভাইদের কাছে নাটক শোনার জন্য বায়না করে আসছে। অবশেষে এতদিনের বায়নার পর চেয়ারম্যান সাহেব কাচারি ঘরের পেছন দিকে একটা বারান্দা দিয়েছেন যাতে জেসমিনসহ অন্যান্য মহিলারাও নাটক শুনতে পারেন।
নাটক শেষে ধীরে ধীরে কাচারি ঘর খালি হতে লাগলো। জয়নাল মির্জার যখন উঠে যাচ্ছিলেন তখন তার ছোটপুত্র জব্বার মির্জা তাকে ইশারা করল বসার জন্য। সম্ভবত তার কিছু বলার আছে। তিনি বসলেন। ঘর খালি হলে জব্বার বড়ভাই জালালকে নিয়ে বাবার পাশে এসে বসল।
জয়নাল মির্জা বললেন,
"বিষয় কী?"
জব্বার বলল,
"আব্বা হারুন ব্যাপারীর বিষয়।"
জয়নাল মির্জা বিরক্ত হয়ে বললেন,
"এখন এইসব বলার সময় না। আমার ঘুমের সময় হইছে। এইসব বইলা মেজাজ খারাপ করবা না জব্বার।"
জয়নাল মির্জা ছেলেদেরকে আর কথা বাড়ানোর সুযোগ দিলেন না। তিনি খাবার ঘরের দিকে গেলেন। অন্যান্য দিন এতক্ষণে রাতের খাবার খেয়ে এক ঘুম হয়েও যায়। আজ নাটক শুনতে শুনতে দেরি হয়ে গেছে।
'যেদিন সমুদ্র আমায় ইশারা করেছিল, রৌদ্রময় দিনের স্তব্ধতা...' এটুকু লিখে রঞ্জু পৃষ্ঠাটা ছিঁড়ে ফেলে দিল। কী লিখছে সে এসব? কিসের ইশারা! সমুদ্র কেন ইশারা করবে, ধুর! পৃষ্ঠা ছিড়তে ছিড়তে ডায়েরির অর্ধেক খালি হয়ে গেছে। ডায়েরির এমন বেহাল দশা দেখে আপাতত কবিতা লেখা বাদ দিল সে। বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও ছোটবেলা থেকেই তার বেশ সাহিত্যপ্রেম রয়েছে। মাঝেমাঝে কবিতা লেখে। কবিতা লিখলে তার বেশ একটা সুখ সুখ অনুভূতি হয়। কিন্তু ইদানীং শত চেষ্টা করেও ভালো কিছু লিখতে পারছে না। যা লিখছে সেটা তার নিজের-ই পছন্দ হচ্ছে না। কাঠের দোতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় তার শোবার ঘর। সেই ঘরের সামনে খোলা বারান্দা। বারান্দার এক পাশে সে এখন পা ছড়িয়ে বসে আছে। দৃষ্টির সীমানায় সূর্যমনি গ্রাম, এই বাড়ি, বাড়ির উঠোন, উঠোন পেরিয়ে পুকুর। বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে সরু খাল। খালের পাশে পানের বর। বাড়িতে ঢোকার পথে সারি সারি সুপারি গাছ। পিছনে মেহগনি বাগান। রান্নাঘরের পাশে ঝিঙে কাঁকরোলের মাচায় ফুল ধরেছে। বৃষ্টিতে ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ বাতাস বয়ে নিয়ে আসছে এই বারান্দাতে। এই সবকিছুই তার নিজের। কিন্তু এসব কিছুই তার ভালো লাগে না। তার মন পড়ে রয়েছে মহসিন হলের ২০৭ নম্বর ঘরে, রেসকোর্স ময়দানে, শহিদ মিনারে, মধুর ক্যান্টিনে এবং পাবলিক লাইব্রেরির বইয়ের ভাঁজে ভাঁজে।
মাসকয়েক হলো সূর্যমনি এসেছে রঞ্জু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে পড়ে সে। মহসিন হলে থাকে। কিছুদিন আগে তার হলেরই চার ছাত্র আকস্মিকভাবে খুন হয়। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। খবর পেয়ে তার বাবা গ্রামে ফিরে আসার আদেশ করেন। রঞ্জুও আদেশমত গ্রামে চলে আসে। পড়াশোনার বাইরে অন্য কোনো কিছুতে সে নিজেও জড়াতে চায় না। তার কয়েকদিন পরেই ইউনিভার্সিটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে। কবে সব স্বাভাবিক হবে, কবে সে ফিরে যাবে তার প্রিয় শহরে সেই অপেক্ষায় প্রতিটি প্রহর গুনছে।