নাইওরি - পর্ব ০৫ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প

পড়ুন মৌরি মরিয়ম'এর লেখা একটি ছোটো ধারাবাহিক গল্প নাইওরি
নাইওরি
নাইওরি

হারাধন চক্রবর্তী উত্তরাধিকার সূত্রে বাপ দাদার অনেক জমিজমা পেয়েছিলেন। কিন্তু তার নগদ অর্থ ছিল না। তিনি অলস ও ভীরু প্রকৃতির হওয়াতে নিজে চাষবাস করতে পারতেন না। বর্গা দিয়ে দিতেন। পাকিস্তান আমলে একবার তার স্ত্রীর কঠিন অসুখ হয়। চিকিৎসার জন্য ভারত যেতে হবে। প্রচুর নগদ অর্থ প্রয়োজন। তিনি ছুটে গেলেন বিত্তশালী জয়নাল মির্জার কাছে। হারাধন চক্রবর্তীর জমিজমা সব এক দাগে কালিশুরিতে। এই কারণেই জয়নাল মির্জা কিনে নিতে চাইলেন। কিন্তু হারাধন চক্রবর্তী বিক্রি করতে নারাজ। তিনি জমি বন্ধকী দিয়ে কিছু টাকা নিতে চান। জয়নাল মির্জা বন্ধকী দলিলে হারাধন চক্রবর্তীর টিপসই নিয়ে টাকা দিলেন। জয়নাল মির্জা সেই জায়গা ভোগদখল করতে শুরু করলেন। বছর কয়েক বাদে হারাধন চক্রবর্তী টাকা ফেরত দিতে এলেন।

জয়নাল মির্জা বললেন,

"আরে মিয়া রাখো তোমার টাকা। এই টাকার লগে আরো কিছু দেই আমি। জমি আমার ধারে বেইচা দাও। এমনেও এই জমি তুমি কামে লাগাও না। বর্গা দিয়া রাহো। তারচেয়ে নগদ ট্যাকা পাইলে তোমার কামে লাগব।"

হারাধন চক্রবর্তী আতংকিত হয়ে বললেন,

"জয়নাল ভাই, আমার টাকার অনেক দরকার আছিল তখন এই কথা সত্য। আমনের কাছে আমি ঋণী। কিন্তু বাপ দাদার জমি আমি বেচতে চাইনা দেইখাই বন্ধক রাখছিলাম। আমারে ক্ষ্যামা করেন।"

কিন্তু লাভ হয়নি। জয়নাল মির্জা টাকাও নেননি। জমির দখলও ছাড়েননি। এই জমির জন্য হারাধন চক্রবর্তী অনেক ঘুরেছেন জয়নাল মির্জার পেছনে। স্বাধীনতার পর তিনি চেয়ারম্যান হলেন। তার ক্ষমতা আরও বেড়ে গেল। কিছুতেই তার সাথে পেরে উঠলেন না হারাধন চক্রবর্তী। অবশেষে ভাবলেন জমি বিক্রিই করে দিবেন। কিন্তু জয়নাল মির্জা দাম বলেন নিতান্তই কম। ১০ ভাগের এক ভাগ। তারপর বিভিন্ন ধরনের হুমকিধামকি তো আছেই।

এরমধ্যেই হারাধনের পরিচয় হয় হারুন ব্যাপারীর সাথে। সে ঢাকার লোক। মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবার নিয়ে পালিয়ে এসেছেন। এখানে তার এক বন্ধু ছিলেন তিনিই তখন থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। এখানে থাকতে থাকতে এই জায়গার প্রতি তার প্রগাঢ় এক মায়া জন্ম নেয়। তিনি এখানেই স্থায়ী হতে চান। ঢাকা শহরের বাড়ি বিক্রি করে আসায় তার কাছে ম্যালা নগদ অর্থ। এখানে ভিটাবাড়িসহ কিছু জমিজমা ক্র‍য় করতে ইচ্ছুক। হারাধন চক্রবর্তী খবর পেয়ে তার ভিটাবাড়ি সব বিক্রি করে পাকাপাকিভাবে ভারত চলে গেলেন। সেখানে তার নানাবাড়ি।

হারুণ ব্যাপারী হারাধনের ভিটেবাড়িতে উঠলেন। সেখানে কোনো সমস্যা হলো না। কিন্তু ভেজালটা লাগলো কালিশুরির জমির বেলায়। জমিদখল নিতে এলে জয়নাল মির্জা হারাধনের টিপসই দেয়া দলিল বের করলেন। দলিলে স্পষ্ট যে ক্রয়সূত্রে এই জমির মালিক জয়নাল মির্জা। হারাধন লোক ছিল সোজা, পড়াশোনা জানতেন না। জয়নাল মির্জাকে বিশ্বাস করে দলিলে টিপসই দিয়েছিলেন। তার স্ত্রী তখন মৃত্যুর সাথে লড়াই করছেন তাই যাচাই বাছাইয়ের সময়ও তার ছিল না।

অন্যদিকে হারুণ ব্যাপারীর কাছেও ক্রয়সূত্রে পাওয়া দলিল রয়েছে। হারাধন চক্রবর্তীর সাথে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে হারাধনের বন্ধুর কাছ থেকে হারুণ ব্যাপারী জয়নাল মির্জার কারসাজির কথা জানতে পেরেছিলেন। তারপর থেকেই জয়নাল মির্জার সাথে হারুন ব্যাপারীর বিরোধ। সামনাসামনি তাদের সম্পর্ক মধুর। ভাবখানা এমন যে দুজনেই একই ব্যক্তি দ্বারা ঠকেছেন। তবে হারুন ব্যাপারীও ঝানু লোক। সে তার নগদ অর্থে কেনা জমি এত সহজে ছাড়বেন না।

মানিক গরিব ঘরের ছেলে। অল্প বয়স থেকেই সে খেয়াঘাটের মাঝি। প্রথমে বর্গা নৌকা চালাতো৷ বছরখানেক হলো নিজের নৌকা হয়েছে। বাপ বর্গাচাষী ছিল। এখন অসুস্থতার জন্য তিনি কাজ করতে পারেন না। ছোট ছোট ৫ ভাইবোন। সুতরাং পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মানিক। দিন আনি দিন খাই অবস্থা। জেসমিন রঞ্জুর প্রত্যেকবার দেখা করার সময় পাহাড়াদার হিসেবে থাকতে হয় তার। গরিবের ক্ষমতা সীমিত তাই ভয় অধিক। মানিকও তার ব্যতিক্রম নয়। চেয়ারম্যান সাহেব জানতে পারলে রঞ্জুর সাথে সাথে তার পরাণ টাও যাবে।

জেসমিন আজ ক্লাস না করে স্কুলের পেছনের খেয়াঘাট থেকে মানিকের নৌকায় উঠেছে। নৌকা কেশবপুরের সীমানার বাইরে যাওয়ার পর রঞ্জু নৌকায় উঠবে। এমনই পরিকল্পনা হয়েছে চিঠিতে।। মানিক দ্রুতহাতে বৈঠা বেয়ে পাড় থেকে দূরে চলে গেল। তবে এরজন্য বেশ কসরত করতে হলো। কারণ এখন ভাটার সময়। স্রোতের প্রতিকূলে দাঁড় টানতে হচ্ছে। তার জীবনের কোনোকিছুই স্রোতের অনুকূলে থাকেনা। আর এ তো নদীর স্রোত। এ আর কী!

জেসমিন গুনগুন করে কোনো একটা গান গাইছিল বোধহয়। রঞ্জু নৌকায় ওঠার আগেই মানিকের কথা সেড়ে ফেলা উচিত। জেসমিন বয়সে তারচেয়ে অনেক ছোট। তার ছোটবোনের সাথে এক ক্লাসে পড়ে। একই গ্রামের বাসিন্দা। কাছাকাছি বাড়ি। ছোট থেকে বড় হতে দেখেছে।

আচমকাই কথা শুরু করল মানিক,

"জেসমিন তোর ডর লাগে না?"

জেসমিন খুব স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিল,

"ইট্টু সাহস না থাকলে তো প্রেমে ডুব দিতাম না মানিক ভাই।"

মানিকের চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল জেসমিন। যেন এমন প্রশ্ন আসতে পারে জেনে উত্তরটা তৈরি রেখেছিল সে। এমন দৃঢ় দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকা যায় না। মানিক এমনিতেও মেয়েছেলের দিকে তাকাতে অস্বস্তিবোধ করে। সে নদীর পানে চেয়ে দাঁড় বাইতে বাইতে বলল,

"সাহস ভালো। তয় সবকিছুতে না। লোক জানাজানি হইলে কেলেঙ্কারি লাগবে, তোর বদনাম হইবে জেসমিন।"

জেসমিন খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। মানিক বিরক্ত মুখে তাকালো। জেসমিন হাসতে হাসতেই বলল,

"চান্দেরও কলঙ্ক থাকে মানিক ভাই। আমিও তো চান্দের লাহান সুন্দর। আমার একটু কলঙ্ক না থাকলে কেমনে হয় কন ত?"

আজকের সূর্যের বড় তেজ। মানিকের ঘিলু যেন গলে পড়বে মনে হচ্ছে। দুশ্চিন্তায় আজ সে গামছা আনতে ভুলে গেছে। গামছা আনলে মাথাটা ঢেকে নিতে পারত। সে কিছুটা বিরক্ত মুখে বলল,

"তোগো দুইডার একটারও ডর ভয় বইলা কিছু নাই। একবার ভাবছোস চেয়ারম্যান চাচা জানতে পারলে কী হইব?"

"আমনে এক কাজ করেন মানিক ভাই। বন্ধুরে তালাক দিয়া দেন। তাইলে আর আপনের ফাঁসার চান্স নাই। যা যাইবো আমাগো উপর দিয়া যাইবো।"

মানিক জবাব দিল না। সে এমনিতেও কথা কম বলে।

নৌকা নদীর পাড়ে ভেড়ালো মানিক। রঞ্জুকে সেখানে একটা গাছের শেকড়ের উপর বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। নৌকা ভিরতেই রঞ্জু দ্রুত নৌকায় উঠে সোজা ছইয়ের ভেতর চলে গেল। মানিক নিজের মাথায় একটু পানি দিলো। তারপর আবার নৌকা ভাসালো। বৈঠা বাইতে শুরু করলো অজানার উদ্দেশ্যে। তার হাতে এখন অফুরন্ত সময়, যাওয়ার নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই। স্কুল ছুটির সময় হলে রঞ্জুকে আবার এখানে নামিয়ে তারা ফিরে যাবে। এই সময়টায় তার যা আয় হত তা রঞ্জু দিয়ে দেবে।

জেসমিন নৌকায় উঠেই শাড়ির আঁচল দিয়ে লম্বা ঘোমটা দিয়ে ফেলেছিল, যাতে বাইরে থেকে দেখলে কেউ চিনে না ফেলে। রঞ্জু তাকে এভাবে দেখে বলল,

"তোমাকে কিন্তু নতুন বউয়ের মত লাগছে ফুল।"

জেসমিন মুখ টিপে হেসে বলল,

"তাইলে বাড়ি লইয়া লও।"

"তুমি কি এখনই যেতে চাও? তাহলে বাবাকে বলে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাই?"

জেসমিন চোখ বড় বড় করে বলল,

"তুমি কি পাগল? আমি এমনেই তামশা করছি। আমার আব্বা এইসব টের পাইলে কাইট্টা ফালাইব।"

"ওমা তাহলে কি আমরা সারাজীবন এভাবে লুকিয়ে চুরিয়ে দেখা করে যাব?"

"না, আগে কাজকাম করো। বেকার পোলার কাছে আমার বাপে মাইয়া দেবে না।"

"দাঁড়াও দ্রুত বেকারত্ব ঘোচাচ্ছি। পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করব। তার আগ পর্যন্ত বাবার সাথে ব্যবসায় কাজ করি।"

রঞ্জু সত্যি সত্যিই তার বাবার সাথে ব্যবসায় কাজ করা শুরু করলো। তার বাবার বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা রয়েছে। যখনই ছেলে কাজ করতে চাইলো তিনি ভীষণ খুশি হয়ে ছেলেকে কাজে লাগিয়ে দিলেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন