নাইওরি |
সপ্তাহখানেক বাদেই অনুষ্ঠান করে জেসমিনকে শ্বশুরবাড়ি পাঠালেন জয়নাল মির্জা। এরকম কোনো সুযোগ আসবে তা তিনি কল্পনাও করেননি। হারুন ব্যাপারী বুদ্ধিমান লোক হলেও ছেলের প্রতি ভালোবাসায় অন্ধ। নাহলে কেউ এমন প্রস্তাব দেয়! সালিশে তার ছেলের কী বা শাস্তি হতো! এইটুকু তিনি মেনে নিতে পারলেন না! শত্রুর সাথে আত্মীয়তা বড় কঠিন জিনিস। ছেলেকে বাঁচানোর জন্য তিনি এই কঠিন পথ বেছে নিলেন। অবশ্য একমাত্র ছেলের প্রতি অন্ধ ভালোবাসা থাকা অস্বাভাবিক না।
তবে এই আত্মীয়তা হলে হারুণ ব্যাপারী ছাড় দিতে বাধ্য। এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি জয়নাল মির্জা। এক কথাতেই রাজী হলে সেটা অনেকের চোখে পড়তো তাই সে প্রথমে ভেবে দেখার কথা বলেছিল। একটু তো গাইগুই করতেই হয়।
জেসমিন শ্বশুরবাড়ি যেতেই বউ দেখার ঢল নামলো রঞ্জুদের বাড়িতে। সূর্যমনি গ্রামের কোনো বাড়ির মহিলারা বাদ রইলো না। গ্রামের সবচেয়ে শিক্ষিত ছেলে রঞ্জু। এবং সে-ই একমাত্র যে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। তার বউখানা কেমন হলো তা না দেখলে গ্রামবাসীর চলবে কীভাবে! জেসমিনের শাশুড়ি রহিমা বেগম তাদের আপ্যায়নের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। পুতুলের মত একটা বউ আসাতে সে ভীষণ আনন্দিত।
সন্ধ্যার পর থেকেই প্রচন্ড ঝোড়োহাওয়া বইতে লাগলো। দূর আকাশ থেকে ভেসে আসতে লাগলো মেঘমালা। ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বারান্দার দরজার কপাট বারবার বাড়ি খাচ্ছে। রঞ্জু বারান্দার দরজা আটকাতে গেলে জেসমিন বলে,
"আমারে কামিনী ফুলের গাছটা দেহাইলা না যে?"
"এত মানুষ ছিল এতক্ষণ কীভাবে দেখাব বলো? কাল দেখো।"
"আমি এহনই দেখমু।"
রঞ্জু অবাক হয়ে বলল,
"বলে কী মেয়ে! ঝড় শুরু হয়েছে দেখো না? বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।"
"তাতে আমার কী? আমি দেখমু।"
জেসমিন এগিয়ে গেল দরজার কাছে। রঞ্জু তার দুই বাহু ধরে আটকালো। বলল,
"পাগলামি করে না। কাল সকালে দেখো। এখন দরজা জানালা সব আটকে দেয়া উচিৎ। ঝড় শুরু হয়ে গেছে।"
জেসমিন একটু অভিমান করে বলল,
"হুম আমারে দেহাবা ক্যা? কার লাইগা জানি গাছখান লাগাইছো, হেরেই দেহাইয়ো। আমি কেডা!"
ফিরে এসে বিছানার উপর বসলো সে। রঞ্জু দরজা লাগিয়ে এসে তার পাশে বসে মুখটা ধরে বলল,
তুমি আমার একলা আকাশ,
দখিন দ্বারের বাউলা বাতাস।
কদম ফুলের ঘ্রাণ,
তুমি আমার জল জোছনা,
আর... অন্ধকারের গান।।
কবিতা শুনে জেসমিনের অভিমান নিমিষেই উধাও। সে বলল,
"এই কবিতাটা আমারে চিডিতে দেও নাই তো?"
"এটা তো এই মাত্রই বানালাম।"
জেসমিন মুগ্ধ চোখে জানতে চাইলো,
"তুমি কেমনে এমন কথায় কথায় কবিতা বানাও?"
রঞ্জু হেসে বলল,
"তোমার চাঁদমুখটা দেখলেই আমার কবিতা পায়।"
জেসমিন লজ্জা পেয়ে হাসলো। পরক্ষণেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
"কিন্তু অন্ধকারের আবার গান কেমনে হয়?"
"অন্ধকারের গান অনেক রকম হয়। মন খারাপের হয়, খুশির হয়। আরও কত রকমের!"
"আমি তোমার কেমন অন্ধকারের গান?"
বিছানার পাশেই হারিকেন। রঞ্জু সেটা নিভিয়ে কাছে এসে নিচু গলায় বলল,
"চলো দেখাই তুমি আমার কেমন অন্ধকারের গান।"