নাইওরি |
পটুয়াখালী জজ কোর্টের জাঁদরেল উকিল আলমগীর মৃধা। জনশ্রুতি আছে ফাঁসির আসামিকেও নির্দোষ প্রমাণ করে মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরত নিয়ে এসেছেন তিনি। হারুন ব্যাপারী তার শরণাপন্ন হয়ে মামলা করেছেন জয়নাল মির্জার নামে। তিনি তার জমি পুনরুদ্ধারের জন্য আর্জি দাখিলের পর জয়নাল মির্জার নামে একটি সমন জারি হলো।
সমনপত্র গ্রহন করে কাচারি ঘরে বসে আছেন জয়নাল মির্জা। জালাল বাড়ি নেই। জব্বার আছে সাথে। সে বলল,
"দেখলেন তো আব্বা। আমি কইছিলাম হারুন ব্যাপারীর মতলব ভালো না। আমি হেরে উকিলের কাছে যাইতে দেখছি হেই কতাখানও কইছিলাম। আমনে তো আমার কতা আমলেই লন নাই।"
"কিন্তু জব্বার তুমি হেরে উকিলের কাছে যাইতে দ্যাখছো আরও ৪/৫ মাস আগে। হেকালে মামলা না কইরা এহন করলো ক্যা কও দেহি?"
"হেইয়া আমি ক্যামনে কমু?"
"এই ঘিলু লইয়া রাজনীতি করবা?"
জব্বার মুখ কুচকে ফেলল। পান থেকে চুন খসলেই বাবা তাকে এই খোটাখানা দেয়। যা তার একেবারেই অপছন্দ। জয়নাল মির্জা পানের পিক ফেলে বললেন,
"হারুন ব্যাপারী তহন মামলা করনের লাইগা যায় নাই। হে গেছে তথ্য জোগাড় করতে। মামলা করার প্রস্তুতি নিতেছিল। মাঝখান দিয়া রঞ্জু জেসমিনের ঘটনা আসায় সে ভাবছিল আত্মীয়তা কইরা ঝামেলা মিটাইবে। এইজন্যে এতদিন থাইমা আছিল। কিন্তু এহন যহন দ্যাখলো আত্মীয়তা কামে লাগান যাইতেয়াছেনা, অমনে যাইয়া মামলা দিল।"
"আব্বা আমনে কি আগেইত্যাই জানতেন হে মামলা দেবে?"
"জানতাম। কইতে পারো আমি অপেক্ষাই করতেয়াছিলাম। কারণ সে মামলা না দিলে আমি আমার চাল ডা দিতে পারতেয়াছিলাম না।"
"তহেলে জেসমিনরে ওইবাড়ি বিয়া দেলেন ক্যা?"
"ভাবছিলাম আত্মীয়তা কইরা ঝামেলা মিটামু, ব্যাপারীও যে একই চিন্তা করছে হেইয়া তো আমি বোজতে পারিনাই।"
"আব্বা অরা যদি জেসমিনরে অত্যাচার করে?"
"মাইয়া আমার ধানি মরিচ। অরে কেউ অত্যাচার করতে পারবে না। রঞ্জু জেসমিন আশা করি নিজেগো সামলাইয়া লইতে পারবে। রঞ্জুর মত জামাই লাখে একটা, আশেপাশের চাইর গেরামেও এমন শিক্ষিত পোলা নাই এই কথা সত্য। হেরপরেও সমেস্যা অইলে বিবাহ ভাঙতে কতক্ষণ? জেসমিনরে শহরে নিয়া আরও ভালো আরও শিক্ষিত পোলার লগে বিবাহ দিমু। এই বয়সী পোলাপানের প্রেম ভাঙা মুশকিল, আবেগ বেশি। কিন্তু বিবাহ হইলেই আবেগটা কইম্যা যায়। বিবাহ ভাঙা কোনো বিষয় না। চুলদাড়ি তো বাতাসে পাকে নাই বাজান।"
আলমগীর মৃধার চেম্বারে বসে আছেন জয়নাল মির্জা। তিনি গোপনীয়তা চান। চেম্বারের সকলকে বের করে দিলেন আলমগীর মৃধা। জয়নাল মির্জা বললেন,
"হারুন ব্যাপারী কত দিছে? আমি তার চেয়ে বেশি দিমু। মামলায় আমারে জিতাইয়া দিবেন।"
আলমগীর মৃধা হেসে বললেন,
"হারুন ব্যাপারী কত দিছে জাইন্যা আমনে কী করবেন? আমনে ৫ হাজার দেবেন। আমি কেস এমনভাবে সাজামু যাতে আমি হারি, আমনের উকিল জেতে। ব্যাপারডা বোজ্জেন?"
টাকার অংক শুনে জয়নাল মির্জার মেজাজ বিগড়ে গেছে। বিরক্তমুখে সে বলল,
"উকিলসাব আমনের কি মাতা আউলাইয়া গ্যাছে? ৫ হাজার টাহা কি ভাইস্যা আহে?"
"টাহা ক্যামনে আইবে হেইডা আমনের বিষয়। না দেতারলে বাড়ি যান। এ কেস আমনে এমনেও হারবেন। সমন পাইয়াও কোর্টে আহেন না। ওদিকে বাদীপক্ষ নিয়মিত কোর্টে আহে। তথ্য প্রমাণ সব আমনের বিপক্ষে নেওয়া আমার দুই মিনিটের কাম। আমনের দারে যে একখান জাল দলিল আছে হেইয়া কোর্টে পেশ করলে আমনের উল্টা জেল হবে। আমনের বাঁচার একমাত্র উপায় আমার ইচ্ছাকৃত হারা। কেস হারলে হেইডা আমার রেপুটেশনের ব্যাপার। ৫ হাজার না হইলে পোষায় না।"
জয়নাল মির্জা আর কথা বাড়ালো না। এই সামান্য কাজে ৫ হাজার টাকা খরচ করার কোনো মানেই হয় না। এরচেয়ে সহজ সমাধান তার জানা আছে।
রঞ্জু ক্লাস করে হলে ফিরতেই জেসমিনের চিঠি পেল। রুম পর্যন্ত যাওয়ার ধৈর্য নেই। হলের সামনেই মাঠে বসে চিঠি খুলল।
পর সমাচার এই যে, আমি এখনো আমাদের বাড়িতেই আছি। বাবা বলতেছেন, তোমাদের বাড়িতে একা গিয়ে কী করব, তুমি আসলে যেন যাই। মাঝে আমার আব্বাকে না জানিয়ে একদিন তোমাদের বাড়ি গেছিলাম। বাবা মায়ের সাথে দেখা করে আসছি। আমি যাওয়াতে তারা খুব খুশি হইছিলেন। কামিনী ফুলের গাছটার কাছেও গেছিলাম। ওই গাছে এখন আর ফুল ফুটে না। আমি জিগাইলাম, কী গো কামিনী ফুল দেও না ক্যা? কামিনী কইলো, তোমরা নাই তাই ফুল দেইনা। তোমরা আসো, ভালোবাসায় ভরায়া রাখো এই ঘরখান। তোমাদের ভালোবাসার সুবাস আবার যখন পাব তখনই ফুল দিব।
এক মাস হইয়া গেল তোমারে দেখি না। আর কতদিন না দেখে থাকতে হবে? তুমি কবে ফিরবা? তোমার ওই পাষাণ মন কি কাঁদে না তোমার ফুলের জন্য? পড়াশোনা বাদ দিয়া চইলা আসো। নাইলে আমারে ঢাকা নিয়া যাও। তোমারে ছাড়া একটা দিনও থাকতে পারমু না আর। বাড়ি আসো। বাড়ি আসো। বাড়ি আসো। বাড়ি আসো। বাড়ি আসো। আমার নাইওর আর শেষ হয় না।
তোমার ফুল