ওরা মনের গোপন চিনে না - নৌশিন আহমেদ রোদেলা - অনু গল্প

পড়ুন নৌশিন আহমেদ রোদেলা'র লেখা একটি অনু গল্প ওরা মনের গোপন চিনে না
ওরা মনের গোপন চিনে না
ওরা মনের গোপন চিনে না by নৌশিন আহমেদ রোদেলা

জয়ীতা আর রঞ্জনের সম্পর্কটা ছিলো অনেকটা মধুর স্বাদে গরলের মতো। ডিপার্টমেন্টের দুই হাড্ডা-হাড্ডি প্রতিযোগীর সম্পর্কটা যেমন হওয়া উচিত , ঠিক সেরকম। ছোট্ট কথায়, একে অপরের অঘোষিত শত্রু। কথা নেই, আলাপ নেই অথচ বিশদ যুদ্ধ। এই যুদ্ধটা তাদের মনে মনে। মেধায় মেধায়। ইউনিভার্সিটির দীর্ঘ চার বছরে জয়ীতা আর রঞ্জনের কথা হয়েছিলো মোটে দুই বার। একবার জয়িতা ক্যাফেটেরিয়াতে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ কোথা থেকে রঞ্জন এলো। পেছন থেকে বলল,

'এক্সকিউজ মি?'

যাদের সাথে ভূত- বর্তমান- ভবিষ্যতে কখনোই কথা হওয়ার কথা নয় অথচ উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব; হঠাৎ তাদের মুখোমুখি হলে চমকে উঠতে হয়। জয়ীতাও চমকে উঠলো। থতমত খেয়ে চাইতেই রঞ্জন বড়ো সাধারণ কণ্ঠে বলল,

'রাস্তার মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে আছিস। একটু সরে দাঁড়া।'

জয়ীতা সরে দাঁড়ালো। ব্যস! এটাই ছিলো তাদের প্রথম কথোপকথন। এই ছোট্ট ঘটনাকে যদিও ঠিক কথোপকথন বলা চলে না। কথোপকথন হতে হয় দু'পাক্ষিক। রঞ্জনের একা একা বকে যাওয়া বাক্যচ্ছটাকে বড়ো জোর একপাক্ষিক বাক্যালাপ বলা যায়; জয়ীতা নিজ পক্ষ বিচারে 'টু' শব্দটি পর্যন্ত করেনি। তবুও! রঞ্জনের পক্ষ থেকে এই'ই তো ছিলো প্রথম বাক্যালাপ! তাদের দ্বিতীয়বারের কথোপকথন ছিলো বাসে। জয়ীতার খুব মনে আছে, তখন ছিলো বর্ষাকাল। সেমিস্টার গ্যাপ চলছে। জয়ীতা নিউমার্কেট থেকে সাভারের বাস ধরবে এমন সময় শুরু হলো ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। জয়ীতা দৌঁড়ে গিয়ে একটা বাসে উঠলো। বাস ধরতে ধরতেই জামার অর্ধেকটা ভিজে গেলো। গায়ের জামা ঝাড়তে-ঝাড়তে জয়ীতা যে সীটটাতে বসলো তার পাশের সারিতেই বসেছিলো রঞ্জন। বসতেই চোখাচোখি হলো। পরিচিতের একটা অঘোষিত বিধি হলো, অপরিচিত মহলে পরিচিতকে দেখলে আপ্লুত হতে হয়। খুশি হতে হয়। কথা-বার্তা বলতে হয়। রঞ্জন-জয়ীতা পরিচিত-অপরিচিতের বিধিটাকে শেষ অব্দি লঙ্ঘন করতে পারল না। দু'জন দু'জনের দিকে চেয়ে পরিচিতের স্মিত হাসি হাসলো। রঞ্জন শুধালো,

'যাচ্ছিস কোথায়?'

জয়ীতার ছোট্ট উত্তর,

'সাভারে।'

'সেমিস্টার গ্যাপে বাড়ি যাসনি?'

'উঁহু। কিছু নোটস্ করা বাকি ছিলো।'

রঞ্জন মাথা নাড়ল,

'ওহ।'

ব্যস! আর কেউ কথা এগোয়নি। ইউনিভার্সিটির দীর্ঘ চার বছরে এই দুটো কথোপকথনকে সম্বল করেই খুব সচেতনভাবে সহপাঠী ও ঠান্ডা যুদ্ধের ব্যাপারটাকে সচল রেখেছে তারা। সেই রঞ্জনের সাথে জয়ীতার দেখা হলো দীর্ঘ ছয় বছর পর। ইউনিভার্সিটির শত বর্ষের অনুষ্ঠানে এসে ডিপার্টমেন্টের সকলের মতো রঞ্জনের সাথেও দেখাটা হয়ে গেলো তার। জয়ীতা ততদিনে ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে বিসিএস টপকে সরকারি কলেজে ঢুকেছে। শুনেছে, রঞ্জন আছে প্রসাশনে। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট। অনুষ্ঠানের সন্ধ্যে সন্ধ্যে সময়ে ডিপার্টমেন্টের সবাই গোটা দুই টেবিল ঘিরে বসতেই জানা গেল, জয়িতা আর রঞ্জন ব্যতিরেকে সকলেরই এখন জোড়ায় জোড়ায় হাত। কারও কারও আবার পুচকো টুচকো হয়ে হেট্রিক। শুরু হলো হাসি-তামাশা। আড্ডার বিষয়বস্তু হয়ে উঠলো রঞ্জন- জয়িতার বিয়ে। প্রথমটাই দুজনের আলাদা আলাদা বিয়ের আলাপ চললেও হুট করেই কী জানি কী করে পাশাপাশি জুড়ে গেল দুজনার নাম। শাম্মি হেসে বলল,

'পাত্র-পাত্রী খোঁজা বাদ। তোরা দুজনে বিয়ে করে নিলেই তো পারিস ভাই। ডিপার্টমেন্টের বাঘা বাঘা দুজনের বিয়ে হলে খারাপ কী?'

শাম্মীর মন্তব্যে লজ্জায় গাল গরম হয়ে গেল জয়ীতার। ফরসা গালে লালিমা নিয়ে অপ্রস্তুত চোখে চাইল। ঠিক একই সময় রঞ্জনও চাইলো তার দিকে। চোখে চোখ পড়ল। জয়ীতা এই প্রথম খেয়াল করল, ছেলেটা দেখতে খারাপ নয়। শ্যামলা চেহারায় চাপ দাঁড়ি আর গভীর দুটো চোখে সরকারি অফিসার হিসেবে বেশ মানিয়ে যাচ্ছে তাকে। লম্বাতেও ঠিকঠাক। সত্যি তো, খারাপ কী? কথাগুলো ভেবে আরও অপ্রস্তুত হলো জয়ীতা। চোখ-মুখ গম্ভীর করে বসে রইলো। বন্ধুদের হাসি-মজা একসময় সিরিয়াস আলোচনায় রূপ নিলো। বহুদিন পর হৈ-চৈ করার মতো কোনো বিষয় পেয়ে বয়স, সময় ভুলে হৈ হৈ করে উঠলো আপাত দৃষ্টিতে গম্ভীর হয়ে থাকা উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা। এই হাসি-মজায় একেবারেই যোগ দিলো না রঞ্জন। জয়ীতাও গা করলো না খুব একটা। তবুও কোথাও একটা অচেনা অনুভূতি ঠিক ঠিক বাড়ি বয়ে এলো বুক বেয়ে। রি-ইউনিয়নের পর পুরাতন বন্ধুরা নতুন উদ্যোগে সোশ্যাল মিডিয়ায় গ্রুপ খুললো। সেখানেও আলোচনার প্রধান বিষয় জয়িতা- রঞ্জন এবং তাদের বিয়ে। বন্ধুদের এমন উচ্ছ্বসিত কথাবার্তায় খুব বিপন্নবোধ করলো জয়ীতা। তারা কী এখনও আর টিনেজার আছে? তাছাড়া রঞ্জনও আছে এই গ্রুপে। সমস্ত কথোপকথন সীন করে চলেছে বেশ সময় নিয়ে নিয়ে। উফ! ছেলেটি কী ভাবছে কে জানে? জয়ীতার আকাশসম অস্বস্তির মাঝেই জয়িতা-রঞ্জনকে সরাসরি ম্যানশন করে বসলো শাম্মী। ফাজলামো করে লিখলো,

'এই তোরা দুটিতে মিলে একবার ডেটে যা তো। একান্তে দুটো চুমু টুমু খেয়ে বিয়েটা ফাইনাল করে ফেল।'

শাম্মী তখন টুঙ্গি জেলার এডিশনাল এসপি। জিহ্বায় বাঁধ নেই একবিন্দু। তার এমন খোলাখুলি প্রকাশে অস্বস্তিতে হতভম্ব হয়ে গেল জয়ীতা। রঞ্জনও সাথে সাথেই সীন করেছে কিন্তু কিছু বলছে না। জয়িতা লিখলো,

'অসভ্য মহিলা! তুই যা।'

'তুই এতো লজ্জা পাচ্ছিস কেন, আশ্চর্য! স্কুল-কলেজের বাচ্চারা পার্কে বসে চুমু খেয়ে ধরা খায়। আমাদের লোকেরাই ধরে নিয়ে আসে। তাই বলে একজন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে চুমু খাওয়ার জন্য পুলিশ ধরবে না। অতো সাহস তাদের নেই। তুই নিশ্চিন্তে যেতে পারিস!'

জয়ীতা আর একটা কথাও না বলে স্যোশাল মিডিয়া থেকে বেরিয়ে এলো। এই মেয়েটার সাথে আর জীবনেও কথা বলবে না বলে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। আসার সময় দেখলো, রঞ্জন শাম্মীর ম্যাসেজে 'হা-হা' রিয়েক্ট দিয়েছে। কতবড় ফাজিল ছেলে!


তারও দিন দুই পরের কথা। জয়িতা কলেজে ক্লাস নিচ্ছে; এমন সময় শাম্মির কল এলো। ক্লাস শেষে কল ব্যাক করতেই একে একে যুক্ত হলো রূপা, কলি, মারিয়া। শাম্মী খুব গম্ভীর হয়ে বলল,

'পরশু তুই রঞ্জনের সাথে লাঞ্চে যাচ্ছিস। তোদের লাঞ্চের সব ব্যবস্থা আমাদের। রঞ্জনের পোস্টিং গাজীপুর। তোর পোস্টিং শেরপুর। সুতরাং তোদের দুজনের কথা বিবেচনা করে লাঞ্চের ব্যবস্থা করা হয়েছে ময়মনসিংহে। দুজনকেই আসতে হবে দুই ঘন্টার পথ পেরিয়ে। চুপচাপ চলে আসবি। কোনো কথা না।'

শাম্মী কথা শেষে হতেই ফোন কাটলো; জয়ীতার মতামত দেওয়ার একবিন্দু সুযোগও রাখলো না। কিছুক্ষণ পরই আবার বার্তা এলো,

'রঞ্জনকে এপ্রুচ করার দায়িত্ব ছেলেদের। তুই চাপ না নিয়ে রেডি হ। চাকরি-বাকরি করছিস। এই বছরেই আটাশ বছরের বুড়ি হয়ে যাবি। বিয়ে কবে করবি আর? তোদের শেরপুরের এসপির সাথে কিন্তু আমার গভীর পরিচয়। রাজি না হলে পুলিশের ভ্যানে তুলে আনব বলে রাখলাম।'

জয়ীতার মতামতটা রাজি হওয়া না-হওয়ার মাঝে ঝুলে রইলো। গোটা ব্যাপারটাই খুব বিরক্ত হলেও বুকের কোথাও একটা স্পষ্ট কিশোরী মনের আভাস পেলো। থেকে থেকেই অস্থির লাগছে। উত্তেজনা লাগছে। কী হবে? কী হবে তারপর?
নির্দিষ্ট দিনে কলেজ থেকে ছুটি নিতে হলো জয়ীতার। বন্ধুমহলের একের পর এক ফোন পেতে পেতে অনেকটা বিরক্ত হয়েই তৈরি হতে হলো তাকে। শেরপুর থেকে ময়মনসিংহ দুই ঘন্টার পথ। জয়ীতা ময়মনসিংহ পৌঁছাতেই আচমকা ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। জয়ীতার সাথে সাথেই মনে পড়ল, এখন বর্ষাকাল। আজও বর্ষার সেই ষোড়শতম দিন। জয়ীতা চমকে গেল। এতোদিন বাদেও বাংলা তারিখ খেয়াল রইলো কী করে? জয়ীতা তো কখনও বাংলা দিন-মাস গণণা করে না। সেদিনও করেনি। তবে? আচমকা বৃষ্টিতে একদম নাস্তানাবুদ অবস্থা হলো জয়ীতার। পিচ রঙা নতুন শাড়িটা কাদা-জলে একাকার হলো। চোখের কাজল ল্যাপ্টে গেল। মুখে যে হালকা মেকাপ লাগিয়েছিল তার অবস্থাও হলো রফা-দফা। জয়ীতা একটা রিকশা নিয়ে রেস্টুরেন্টের সামনে আসতেই ঝমঝমে বৃষ্টি বেড়ে আকাশ ভাঙা বর্ষা এলো। ভাড়া মিটিয়ে, শাড়ির কুঁচি সামলে দৌঁড়ে রেস্টুরেন্টে ঢোকার পরপরই জয়ীতার মনে পড়ল, সেই দিনটার কথা। সেই বৃষ্টির কথা। দৌঁড়ে বাস ধরার কথা আর ফ্যাকাশে নীল শার্ট গায়ে বসে থাকা সেই রঞ্জনের কথা। জয়ীতা আবারও চমকালো। কী আশ্চর্য! সেদিন রঞ্জন কী রঙের শার্ট পরেছিল তা তো কক্ষনো খেয়াল করেনি জয়িতা। তবে আজ কী করে মনে পড়ল? বছর আগের স্মৃতিটা হঠাৎ এমন রঙিন কী করে হলো? জয়ীতা নিজের আধভেজা শাড়ির আঁচল গুছিয়ে সামনে চাইতেই রঞ্জনের চোখে চোখ পড়ল। সেদিনের মতোই নীল শার্ট গায়ে পরিচিতের স্মিত হাসি হাসলো রঞ্জন। জয়ীতা আধভেজা আঁচল ঝেড়ে বসতেই কথা বলল রঞ্জন,

'শেরপুর থেকে বাসে এলি?'

জয়িতা সেদিনের মতোই ছোট্ট উত্তর দিলো,

'হুম।'

'গাজীপুর থেকে শেরপুর যেতে কতক্ষণ লাগবে রে? চার-পাঁচ ঘন্টা?'

'অলমোস্ট।'

'প্রতি সপ্তাহের ছুটিতে শেরপুর টু গাজীপুর; গাজীপুর টু শেরপুর আপডাউন করতে একটু সমস্যা হয়ে যাবে, না? আমি কিন্তু প্রতি সপ্তাহে আসতে পারব না। এক সপ্তাহে আমি এলে, পরের সপ্তাহে তোর পালা।'

জয়ীতা এবার অবাক হলো। বিস্মিত চোখে চাইলো। ল্যাপ্টে যাওয়া কাজল আর অল্প ভেজা মুখটিতে তাকে লাগল সদ্য ঝরা বৃষ্টির মতো। রঞ্জন হেসে বলল,

'বিয়েটা করে ফেলি চল। আর কত অপেক্ষা করব? দু'জনেরই বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। বাচ্চা-কাচ্চা মানুষ করতে হবে না? কত কাজ!'

জয়িতা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে হেসে ফেলল। বলল,

'বরকে সপ্তাহে মাত্র একদিন পেলে আমার মন খারাপ হবে।'

বর্ষার তেজ কী খানিক বাড়লো? নাকি ধমকা হাওয়ায় উড়ে গেল মনের অচেনা, গোপন দোর? যে দোর বড়ো অচেনা ছিলো। গোপন ছিলো। দূরের ছিলো। রঞ্জন রুমাল এগিয়ে জয়ীতার চোখের কোণের কাজলটুকু মুছে দিতেই চোখ তুলে চাইল জয়িতা। খুব বর্ষণের দুপুরে চোখের গভীরে চোখ পড়ল। রঞ্জন ফিসফিসিয়ে বলল,

'বেশ! বদলির ব্যবস্থাটা তবে জলদি জলদি করে ফেলতে হবে। কী বলিস?'



***(সমাপ্ত)***

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন