প্রেমিক অপ্রেমিকের গল্প - পর্ব ২৪ - নৌশিন আহমেদ রোদেলা - ধারাবাহিক গল্প

পড়ুন নৌশিন আহমেদ রোদেলা'র লেখা একটি সুন্দর ভালোবাসার গল্প প্রেমিক অপ্রেমিকের গল্প
প্রেমিক অপ্রেমিকের গল্প
প্রেমিক অপ্রেমিকের গল্প

ধ্রুব দেখল, ধ্রুবর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা খুব বিষণ্ণ মেয়েটি তার মামার কথার প্রত্যুত্তরে টু শব্দটি পর্যন্ত করল না। ধ্রুব যেন মনে মনে স্বস্তি পেল। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচল। পরমুহূর্তেই এসিড ঝলসানো চামড়ার মতোই ঝলসে গেল হৃদয়। আগের সেই লাবণ্য খুইয়ে শীর্ণ হয়ে যাওয়া মেয়েটি ধ্রুবর দিকে ফিরেও চাইল না। চোখে-মুখে নিদারুণ ঘৃণা নিয়ে তরুকে বলল,

'আমরা ভেতরে ঢুকি ছোট মামা? বাবা চা খেয়ে গাড়ি দেখতে গিয়েছেন। বাবা আসতে আসতে জিনিসপত্র বাঁধাবাঁধি হয়ে গেলে সুবিধা হয় না?'

নিশুর খুব সচেতনভাবে ধ্রুবকে এড়িয়ে যাওয়ার কৌশলটা ঠিক ধরতে পারল না তরু। আশ্চর্য হয়ে বলল,

'সে হবে। আগে ধ্রুবর সাথে পরিচিত হ। ধ্রুবদের বাসার পরিবেশ তো দূর্দান্ত। এই বাসাটা ছাড়ার জন্য এমন মটকা মারলি কেন?'

নিশু উত্তর দিল না। তার বিরক্তিতে রি রি করা মেজাজটা খুব বুঝল ধ্রুব। হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে, নিশুকে এই বিরক্তি থেকে বাঁচাতেই বলল,

'মাত্র অফিস থেকে ফিরলাম, ফ্রেশ হবো। তোরাও আয় বাসায়। সব গল্প কী রাস্তায় দাঁড়িয়ে করবি নাকি?'

ধ্রুবর কথায় কাজ হলো। তরু সম্মত হয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো। শুধুমাত্র সম্মত হতে পারল না ধ্রুবর মন। জানা সত্যের মুখোমুখি হয়েও থিতিয়ে গেল হৃদয়। সেদিন পার্কে ওমন একটা ঘটনা ঘটার মিনি সেকেন্ড পরই ধ্রুব বুঝতে পেরেছিল নিশু আর তার মাঝে তৈরি হয়ে গিয়েছে চীনের মহাপ্রাচীরের থেকেও বিশাল এক সীমান্ত। যোজন যোজন মন ব্যথার গল্প। এই ব্যথা কখনো কমবে না। এই দূরত্ব কখনো কাটবে না। নিশুর ঘৃণা কখনও ফুরাবে না। ধ্রুব ভেবেছিল, এই ঘৃণা সহ্য করার ক্ষমতা তার আছে। চোখের আড়াল হলেই কর্পূরের মতো উড়ে যাবে মন কেমনের গল্প। একটা বাচ্চা মেয়ের ঘৃণার দৃষ্টি কতটুকুই বা প্রভাব ফেলবে তার মনে? কতটুকুই বা কাতর করবে? তাই তো সেদিন সিনথিয়াকে ফিরতি পথ দেখিয়ে নিশুর পেছন ছুটতে গিয়েও থমকে গিয়েছিল সে। উলোটপালোট মস্তিষ্ক নিয়ে ভেবেছিল, এই বুঝি তাদের ভবিতব্য। নিশুকে যদি সত্যিই কাছে টানতে না পারে তাহলে কী লাভ হবে আবারও তার পিছু ছুটে? বারবার ওই একই ভুলেরই বা কী প্রয়োজন? কিন্তু এখন বুঝতে পারছে, খুব ভুল ভেবেছিল ধ্রুব। এই বাচ্চা মেয়েটির ঘৃণার দৃষ্টি যে কত কঠিন। সেই ঘৃণাটুকুকে বুক পেতে নেওয়া যে কত শক্ত তা এই মাত্র বুঝতে পারছে সে। নিশুর ভীষণ মায়াবী চোখদুটোতে আত্ম-অহংকার আর আত্মমর্যাদার চাপা আঙ্গার যেন ছাই করে দিচ্ছিল ধ্রুবর বুক।

'ময়মনসিংহে পা দিয়েই শুনলাম প্রেমিকার হাতে ভয়াবহ থাপ্পড় খেয়ে চাপার দাঁত নড়ে গিয়েছে তোর? হা কর তো দেখি। ক'টা দাঁত নড়ল?'

ধ্রুব আনমনা ভাবনায় সিঁড়ির দিকে চোখ রেখে হাঁটছিল। তরুর প্রশ্নে চমকে মাথা তুলে চাইল। আবির চমকাল তার থেকেও বেশি। চোখ বড় বড় করে নিষ্পাপ বিস্ময় নিয়ে বলল,

'কিহ! ভাবী তোমায় থাপ্পড় মেরেছে ভাইয়া? সত্যি?'

ধ্রুব খুব বিরক্ত হলো। ছোট ভাইয়ের সামনে কোনো মেয়ের হাতে চড় থাপ্পড় খাওয়ার আলোচনা খুবই বিব্রতকর। তরু কী নির্জনে গিয়ে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করতে পারল না? স্কাউন্ড্রেল। জন্মগত মাথামোটা! মনে মনে ফুঁসে উঠে গম্ভীর হয়ে রইলো ধ্রুব। বিমর্ষ মুখটিতে কুঁচকে এলো ভ্রু। কপালে ফুটলো বিরক্তির চিন্হ। ধ্রুবর বিরক্তিতে বিস্ফোরণ ঘটাতেই যেন চেঁচিয়ে উঠল প্রিয়তা। আশ্চর্য হয়ে বলল,

'আল্লাহ! সত্যি? ভাইয়া! থুক্কু মামু? আপনাকে নি...'

এটুকু বলেই থমকে গেল প্রিয়তা। কয়েক সেকেন্ড ভেবে আবিরকে টেনে সরিয়ে নিজে এক ধাপ এগিয়ে দাঁড়াল। ফিসফিসিয়ে বলল,

'আপনাকে আপনার কোন প্রেমিকা থাপ্পড় মেরেছে ভাইয়া? প্রাইভেট প্রেমিকা? নাকি পাবলিক প্রেমিকা?'

ধ্রুব হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল। ভেতর ভেতর বিরক্তিতে ফেটে গেলেও চোয়াল শক্ত করে চুপ করে রইল। ধ্রুবর ঠান্ডা চেহারা দেখেই আর ঘাটানোর সাহস করল না প্রিয়তা। উৎসাহী মুখটা চুপসে গেল আতঙ্কে। আবির অবাক হয়ে বলল,

'প্রেমিকা আবার প্রাইভেট পাবলিক হয় কী করে?'

প্রিয়তা যেন ভীষণ বিরক্ত হলো। আবির কিচ্ছু জানে না, গণ্ডমূর্খ এমন একটা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

'হয়। ওসব আপনি বুঝবেন না। আমি বুঝাতে চাইছি কোন প্রেমিকার কথা বলা হচ্ছে?যে প্রেমিকার কথা আমরা জানি সেটা? নাকি যে প্রেমিকার কথা একমাত্র উনি জানেন সেটা?'

প্রিয়তার উলোটপালোট যুক্তিতে বিভ্রান্ত চোখে চাইল আবির। তার ভাইয়াকে কেউ থাপ্পড় মেরেছে তাই-ই তো সে বিশ্বাস করতে পারছে না। তার মাঝে আবার প্রাইভেট, পাবলিক প্রেমিকা! কী আশ্চর্য! আবিরের এমন নির্বোধ দৃষ্টি দেখে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল প্রিয়তার। ধৈর্যহারা হয়ে বলল,

'আরে! আপনি এতো টিউবলাইট কেন বলুন তো? আমি জানতে চাইছি যাকে তিনি চেপে ধরে চুমু খেয়েছিলেন সে'ই থাপ্পড় মেরেছে কি-না? একটু চালাকি করে জিজ্ঞেস করেছি। যাতে অন্যকেউ বুঝতে না পারে। ফট করে নামটা তো বলে ফেলতে পারি না। তাই না?'

প্রিয়তার কথা কানে যেতেই যেন আকস্মিক বজ্রপাত ঘটে গেল ধ্রুবর মাথায়। তরু বিস্ময় সামলে কৌতুক করে বলল,

'বাহ! তুই প্রেমিকাকে চুমু খেলেও দেখি ব্রেকিং নিউজ হয়ে যায়। সবাই জানে দেখছি। আমিই শুধু জানতাম না।'

আবির অত্যধিক মর্মাহত হয়ে বলল,

'কষ্ট পাবেন না তরু ভাই। আপনি একা নন, আমিও জানতাম না।'

ধ্রুবর স্তব্ধ, বাক্যহারা দৃষ্টিটা নিরুপায় হয়ে গেল এবার। মুখ কালো করে অসহায় চোখে নিশুর দিকে তাকাল। এইজন্যই বলে মেয়েদের পেট পাতলা। এই চুমু খাওয়ার ব্যাপারটাও তার বলে দিতে হলো? বেয়াদব মেয়েছেলে। কোনো প্রাইভেসি সেন্স নেই? এই মেয়ে বিয়ের রাতের পরেরদিন কতকিছু ফাঁস করে দিতে পারে ভেবেই আতঙ্ক হলো ধ্রুবর। বেচারা স্বামীর জন্য মায়া হলো। নিশু সেসব নিয়ে মাথা ঘামাল না। পুরো আলোচনাটা যেন শুনতেই পায়নি এমন গম্ভীর মুখ নিয়ে তরতর করে উপরে উঠে গেল। তার পিছু পিছু দৌঁড়ে গেল জ্বলজন্ত মাথাব্যথা প্রিয়তা। ধ্রুব হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে সামনে তাকাতেই আবির মুখ কালো করে চাইল। বলল,

'ভাইয়া তুমি....'

জীবনের প্রথম ছোট ভাইয়ের সামনে অস্বস্তিতে দম আটকে এলো ধ্রুবর। অপ্রস্তুত হলো। চোখ-মুখ শক্ত রাখার চেষ্টা করে বলল,

'হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তোর পড়াশোনা নেই? আজ থেকে তোর হাতখরচ বন্ধ।'

ভাইয়ের আকস্মিক রূঢ়তায় হতবাক হয়ে গেল আবির। কী আশ্চর্য! সে আবার কী দোষ করল? নিজে চুমু খেয়ে তাকে জরিমানা ধরার মানে কী? হতাশায় কালো মুখটা এবার কালবৈশাখীর মতো অন্ধকার হয়ে গেল তার। অনাকাঙ্ক্ষিত শাস্তি এড়াতে চট করে ভাইয়ের কঠিন দৃষ্টির সামনে থেকে সরে গেল। সবাই চলে যেতেই হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল ধ্রুব। তরুর দিকে ক্রুব্ধ চোখে চেয়ে বলল,

'শালা! হারামখোর! যেখানে সেখানে মুখ খুলে দিস। পেটে কথা থাকে না?'

পকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে হাসল তরু। ঠোঁটের কোণে সিগারেট রেখে ফস করে দেশলাই জ্বালালো। বলল,

'তুমি নৌকা চালাতে পারো আর আমি বলতে পারব না? মেয়েটার নাম কী?'

ধ্রুব উত্তর দিল না। কিছুটা নরম হলো তার পেশী। বাকি সিঁড়িগুলো নীরবে পেরুলো। পাঁচ তলা ডেঙিয়ে ছাদের ফটকের কাছে এসে বলল,

'তোর যে এতো বড় একটা ভাগ্নী আছে বলিসনি তো?'

তরু কৌতুক করে বলল,

'দোলা আপার যে এমন দামড়া দামড়া ছেলে আছে বলিসনি তো?'

তরুর ধারণাকে সত্য প্রমাণ করে দিয়ে চোখের পলকে মাথা গরম হয়ে গেল ধ্রুবর। গম্ভীর ক্রুব্ধ কন্ঠে বলল,

'মাকে নিয়ে বাজে কথা বলবি না তরু। খবরদার!'

তরু অবাক হয়ে বলল,

'বাজে কথা বললাম কোথায়? আপা ডাকা বুঝি বাজে কথা? তোর মা আর আমার বয়সের ডিফারেন্স মাত্র দশ বছর। মেট্রিকটা একটু মন দিয়ে দিলে। আই.এ তে ফেইল না মারলে। আর দুই তিনটি বছর আগে জন্মালেই কাহিনি ঘুরে যেতে পারতো। মাত্র দশ বছরের বড় মহিলাকে আপা ডাকা যাবে না? খালাম্মা ডাকতে হবে? অসম্ভব!'

ধ্রুব কয়েক সেকেন্ড শক্ত চোখে চেয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ধ্রুবরা যখন কলেজে ভর্তি হয় তখন তরু উদাসী চোখের ইয়ার ড্রপ করা ছাত্র। মেট্রিকে তিনবার আর কলেজের গন্ডি পেরুতে গিয়ে একবার উষ্ঠা খাওয়া দূর্দান্ত তার্কিক। বিতর্কের মঞ্চ কাঁপিয়ে ফেলা এই অসম্ভব বুদ্ধিমত্তার ছেলেটিকে কলেজে ভর্তি হয়েই ভীষণ ভালো লেগে গেল ধ্রুবর। ধ্রুবর মা তখন সেই কলেজেরই অধ্যাপিকা। ইংরেজি পড়াতেন। ধ্রুব অবাক হয়ে দেখতো, তারই কিছু বন্ধু মায়ের ক্লাসের জন্য কেমন চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করতো। ঝড়-বৃষ্টি-তুফান হয়ে গেলেও ম্যামের ক্লাস মিস দেওয়া চলবে না। তাদের মাঝে তরুও ছিলো একজন গুণমুগ্ধ ছাত্র। ধ্রুব খুবই চুপচাপ ছেলে। তরুর সাথে কোনোরূপ যোগসূত্র তখনও তৈরি হয়নি। এরইমধ্যে একদিন তরু কোথা থেকে ছুটে এসে ধপ করে বসে পড়ল তার পাশে। অবাক হয়ে বলল,

'এ্যাঁই! তুই দোলা আপার ছেলে? কী আশ্চর্য! দোলা আপার বিয়ে হয়ে গেছে?'

এমন অদ্ভুত প্রশ্নের উত্তর খুঁজে না পেয়ে বরাবরের মতোই গম্ভীর হয়ে রইলো ধ্রুব। তারপর থেকে কীভাবে কীভাবে এই সুতার্কিক ছেলেটির সাথেই বন্ধুত্ব হয়ে গেল ধ্রুবর। তরু খুবই আত্মমগ্ন ছেলে। খারাপ-ভালো, সিনিয়র-জুনিয়র সবার সাথেই তার অন্তঃপ্রাণ সম্পর্ক। গম রঙা, ঝাঁকড়া চুলের শিশু শিশু চেহারার জন্য বয়সের ব্যবধান সত্ত্বেও সকলের বন্ধুমহলেই কেমন ঠিকঠাক মানিয়ে যেতো। ধ্রুবরা যে সালে কলেজ পাশ করল। সেবারই পাশ দিয়ে বেরুলো তরু। গম্ভীর গম্ভীর কন্ঠে বলল,

'পাশ করার ইচ্ছে ছিলো না, বুঝলি? কিন্তু নিরুপায়। কলেজের গন্ডি আর ভালো লাগছে না। সব মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। এবার ভার্সিটিতে গিয়ে দেখি কাহিনিটা কী!'

ভার্সিটিতে এসে অবশ্য তরু আটকায়নি। তরতর করে পাশ করে বেরিয়ে গিয়েছে। তবে ভার্সিটি পেরুনোর পর থেকেই তার সাথে যোগাযোগ রাখাটা খুব শক্ত হয়েছে। মাসের পর মাস গুম হয়ে বসে থাকে। খোঁজ খবর পাওয়া যায় না। তারপর হুট করেই কোথা থেকে উদয় হয়। গম্ভীর হয়ে বলে, 'মামা? একটা সিগারেট দে। সিগারেট খাই। তা আমার প্রিয়তমা কেমন আছে?' তরু তাকে রাগানোর চেষ্টা করছে বুঝতে পেরেও খুব রাগ হয় ধ্রুবর। সিগারেটের বদলে চোখ-মুখ লাল করে তাকায়। তরুর সাথে ধ্রুবর এবারের দেখাটা প্রায় দেড় বছর পর। প্রথম এক বছর ধ্রুব চাকরির ট্রেনিংয়ে শহরের বাইরে ছিলো। বাকি কয়েক মাসে তরুরই খোঁজ খবর পাওয়া গেল না। আর যখন পাওয়া গেল তখন মূর্তমান অগ্নিগোলা নিয়ে দেখা করতে চলে এলো। ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কল্পর যা বয়স। তাতে করে সে-ও ভবিষ্যতে ধ্রুব বা আবিরের মেয়ের প্রেমিকের বন্ধু না হয়ে যায় তাতেও বেশ আতঙ্ক হলো। ভবিষ্যৎ কন্যার ভবিষ্যৎ প্রেমিকের জন্য পাতলা এক মায়াও হলো।
ঘন্টা তিনেকের মাঝে বাঁধাছাঁদা শেষ করে বাসার যাবতীয় আসবাব গাড়িতে তুলে নিল নিশুরা। তরুর বন্ধু হওয়ার সুবাদে ধ্রুবকেও সাহায্য করতে হলো। সেই ঘটনার পর নিশুর সামনে যেতে পাহাড় সমান অস্বস্তি হলেও অদৃশ্য কোনো মায়ার টানে আনমনা দৃষ্টি ঘুরে ঘুরে অসংখ্যবার তার দিকেই স্থির হলো। নিশু পারতপক্ষে ধ্রুবর সামনে এলো না। ধ্রুবর দিকে চাইল না। একটি কথাও বলল না। এতোকিছুর পরও নিশু তার সাথে হেসে-খেলে কথা বলবে এমন আশাও অবশ্য ধ্রুব রাখে না। তথাপি তার শুষ্ক মুখ। শীর্ণ গাল। বিষণ্ণ চোখ ধ্রুবর দৃষ্টি এড়াল না। মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে নিশুর আশ্চর্য পরিবর্তনে বুকের ভেতরটা কেমন কেঁপে উঠল ধ্রুবর। অবাক হয়ে খেয়াল করল, যে রূপ লাবণ্য দেখে প্রথম নিশুর প্রেমে পড়েছিল সেই রূপ লাবণ্যের ছিটেফোঁটা আর অবশিষ্ট নেই। কোমল গোলাপি গালদুটো এখন পাণ্ডুর,ফ্যাকাশে। বড় বড় ভয়ার্ত চোখজোড়ার নিচে যেন কেউ যত্ন করে এঁকে দিয়েছে স্থায়ী কালিমার দাগ। ঠোঁটদুটো শুষ্ক। হাসি নেই একবিন্দু। যেন ভয়াবহ এক কালবৈশাখী আচমকা লন্ডবন্ড করে দিয়েছে এই শীর্ণদেহী প্রাণ। অথচ এই পাণ্ডুর, ফ্যাকাশে মুখটির মাঝেই বিস্তর মায়া। এই মায়া বুঝি কেবল ধ্রুবর জন্য? এই মায়ার বলেই বুঝি এই শীর্ণ মুখটির দিকেই চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে নিরন্তর? বুকে ব্যথা হয়। তুষের আগুনের মতো ধিকিধিকি যন্ত্রণা হয়। প্রশ্ন জাগে, প্রেয়সীর এহেন পরিণতির জন্য বুঝি সেই দায়ী? একা এবং একমাত্র সে'ই?
নিজের অস্তিত্বের শেষ পাটটুকুও চুকিয়ে নিয়ে, চারতলার ফ্ল্যাটটাকে বিরান করে দিয়ে যখন নিশু গাড়িতে উঠল তখন ঘড়িতে আটটা বাজে। ধ্রুবর বুকের ভেতরটাও ঘড়ির কাটার মতোই টিকটিক করে বাজতে লাগল। স্মিতহাস্যে তরু আর নিশুর বাবাকে বিদায় দিলেও অদ্ভুত এক কষ্টে দমবন্ধ হয়ে এলো। গাড়িটা যখন মূল ফটক পেরিয়ে গলির মোড়ে হারিয়ে গেল ঠিক তেখনই অঙ্গচ্ছেদ হওয়ার মতো বেদনা হলো ধ্রুবর। অন্ধকার রাতে সড়ক বাতির মিঠে আলোয় মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থেকে এই প্রথমবারের মতো উপলব্ধ হলো, নিশু নেই। এই বাড়িতে, ওই চারতলার ঘরটিতে, দু'তলার সিঁড়ির গোড়ায়, ছাদের রেলিঙের পাশে, কোথাও নিশু নেই। আসবে না কখনো। বুকের ভেতর থেকে ছিটকে আসা দীর্ঘশ্বাসকে পুঁজি করেই ঘরে ফিরে গেল ধ্রুব। চোখেমুখে লেপ্টে রইল মামলায় সর্বস্ব হারানো স্থায়ী দুঃখের ছাপ।

পর্ব ২৩ পর্ব ২৫

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন