প্রেমিক অপ্রেমিকের গল্প |
ধ্রুব সর্বদায় আত্ম-জেদি মানুষ। গায়েগতরে ঠান্ডা এক জেদ তার জন্মগত স্বভাব। ছেলেবেলা থেকেই নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে শিখে ফেলার জন্যই নাকি কে জানে? নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে এক পা নড়তেও সে রাজি নয়। পৃথিবী এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে গেলেও নয়। কিন্তু এবার সে রাজি হলো। তরুর অনুরোধের জন্য যতটা নয়, বুকের ভেতর অবাধ্য এক ইচ্ছের টালমাটালই তাকে রাজি হতে বাধ্য করল। টাউনহলের দশ তলা এপার্টমেন্টটা নিষিদ্ধ এক চাহিদায় চুম্বকের মতো টানতে লাগল। অস্বস্তি, রাগ, জেদ, অহং, নিষেধাজ্ঞা সবকিছুকে বর্ষার জলে ভাসিয়ে দিয়ে টলমলে মনটাকে কোথাও একটা খুব প্রশ্রয় দিয়ে বসল। যে প্রশ্রয়টা ধ্রুব দিয়েছিল আরও মাস দেড়েক আগে।
সমস্ত সকালটা অসহ্য গরমে পুড়িয়ে ক্লান্ত মধ্যাহ্নে আকাশ ভেঙে আষাঢ় নামলো। ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ আর কোথা থেকে উড়ে আসা ভেজা বেলীর সুবাস মেখে অন্যমনস্ক হয়ে বাইরের দিকে চেয়ে রইল ধ্রুব। অফিস ঘরের জানালাটা ঠাঁ করে খোলা। ঝুমঝুম বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে মোটা থানের পর্দাটা।
'স্যার, আসবো?'
দরজায় মৃদু কড়াঘাতে সচেতন হয়ে বসল ধ্রুব। চোখ তুলে চেয়ে নীরব সম্মতি দিল। মধ্য বয়স্ক কনস্টেবল বিনম্র পায়ে ভেতরে এসে দাঁড়াল। শুধাল,
'ইয়েস, স্যার?'
'আপনাকে একটা কাজ করতে হবে। পার্সোনাল কাজ।'
'কী করতে হবে স্যার?'
'মার্কেট থেকে একটা শার্ট আর একটা প্যান্ট কিনে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। পছন্দ বা রঙ নির্বাচন নিয়ে কোনো ঝামেলা নেই। সাইজটা কাগজে লেখা আছে।'
'ওকে স্যার।'
ধ্রুব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। মনের ভেতর দ্বিধাদ্বন্দের পাহাড়টা এখনও ঠিক কাটছে না। নিশুর প্রতি রাগটা তার থিতিয়ে গেলেও অস্বস্তিটা আছে। নিশুর ওই চাহনির সামনে দাঁড়াতেই বিশ্রী এক অস্বস্তিতে ছেঁয়ে যায় মন। এই অস্বস্তি ধ্রুবর ব্যক্তিত্বের ব্যতিক্রম। এই অস্বস্তি নিয়ে ধ্রুবর শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে আনমনা বসেছিল ধ্রুব। কনস্টেবলের ডাকে ঘোর কাটল,
'স্যার আমি কী আসব?'
ধ্রুবর চটক কাটল। বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে কী মনে করে বলল,
'হ্যাঁ আসুন। আর একটা ব্যাপার। আমি এখন বেরিয়ে যাচ্ছি। শার্ট-প্যান্ট কিনে সোজা আমার বাসায় পৌঁছে দিবেন। পারবেন না?'
মধ্যবয়স্ক কনস্টেবল হন্তদন্ত হয়ে বলল,
'শিওর স্যার।'
ধ্রুব চোখের ইশারায় তাকে যাওয়ার অনুমতি দিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো। নিজেকে হঠাৎ খুব হ্যাংলা লাগছে তার। ব্যক্তিত্বের সাথে ভয়াবহ রকম সংঘাত চলছে। নিজের চোখেই কেমন ছোট হয়ে যাচ্ছে। রাগটা যে কেবল নিশুর সম্পদ, ধ্রুবর নয়, তা তো নয়?তবুও সকল দায় কেন কেবল তারই গলগ্রহ? না-চাইতেও তার জন্যই এতো তাড়া? অন্যমনস্ক মনটাকে স্থির করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ধ্রুব। বাসায় ফিরতে হবে। তরু বারবার করে বলে দিয়েছে, 'ধ্রুব যেন কিছুতেই পুলিশ ইউনিফর্মে দাওয়াত খেতে না যায়। তাহলে কেইস খেয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভবনা আছে।' ধ্রুব মনে মনে খুব বিরক্ত হলো। সেই বিরক্তির সাথেই খুব আলগোছে বয়ে গেল সফেদ রঙা সুখানুভূতির নদী। চাপা, টলমলে এক আনন্দ।
ধ্রুব যখন বাসায় ফিরল তখন শহরজুড়ে আষাঢ়িয়া বর্ষা। বাড়ির সামনের রাস্তাটা প্রায় ডুবন্ত। সেই সাথে ডুবন্ত ধ্রুবর শোবার ঘর। বারান্দার দরজাটা ঠাঁ করে খোলা। জলে জলে ভেসে যাচ্ছে রঙিন মোজাইকে ঢাকা শৌখিন মেঝে। ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ধীর পায়ে বারান্দার দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। যা ভেবেছিল তাই। বারান্দায় পুরোদস্তুর ভেজা গায়ে শুয়ে আছে কল্প। ছোট্ট, কচি পা'দুটো রেলিঙ ভেদ করে ছড়িয়ে দিয়েছে বাইরে। উল্টো হয়ে শুয়েছে বলে পা'দুটো মুক্ত করতে তাকে বেশ কসরত করতে হচ্ছে। কিন্তু পারছে না। ধ্রুবর বুনো গোলাপের পাশে আবিরের সদ্য লাগানো বেলী গাছটারও ফানাফানা অবস্থা। সব পাতা ছিঁড়ে ন্যাড়া করে ফেলা হয়েছে ইতোমধ্যে। না-চাইতেও বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ধ্রুবর। পাঁচ তলার বারান্দায় তার পুতুলের মতো ছোট্ট ভাইকে অর্ধ-ঝুলন্ত অবস্থায় দেখে ইস্পাত কঠিন হৃদয়টাও কেঁপে উঠল মৃদু৷ দুশ্চিন্তা হলো। যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেতো? রেলিঙ বেয়ে উঠতে গিয়ে নিচে পড়ে যেতো? মায়ের উচিত এই বাঁদরটাকে কলেজ নিয়ে যাওয়া। নয়তো অতিশীঘ্রই নতুন এক কাজের লোক রাখা। যদিও কাজের লোকের চোখ ফাঁকি দিতে দুই সেকেন্ডও সময় লাগে না কল্পর। হাড়ে হাড়ে বাঁদর৷ ধ্রুব বুঝে পায় না, এই দুটো গর্ভে থাকা অবস্থায় কী এমন খেয়েছে মা, যাতে এতো দুষ্ট হতে হলো এদের? দুটো সেকেন্ড স্বস্তি নেই। শান্তি নেই। ধ্রুবকে দরজায় দাঁড়াতে দেখেই মুখ তুলে চাইল কল্প। বড় বড় চোখদুটো গোল গোল করে, পাতলা ঠোঁটদুটো ফুলিয়ে বলল,
'আমি.. আমাল পা নাই।'
রাগ করতে গিয়েও হৃদয় গলে গেল ধ্রুবর। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
'গুড। এখন উঠে এসো।'
কল্প উঠে বসলো। কয়েক সেকেন্ড পা গুটিয়ে বসে থেকে ধীরে ধীরে ভাইয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ছোট্ট ছোট্ট হাত দুটো দিয়ে আচমকা ধ্রুবর গলা জড়িয়ে ধরে মাথা এলিয়ে দিলো কাঁধে। আধো আধো অভিযোগ করে বলল,
'আমি জ্বয়।'
ধ্রুবর বুকটা কেঁপে উঠল। আসলেই জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে কল্পর গা। কতক্ষণ ধরে বৃষ্টিতে ভিজছে কে জানে? কল্পকে বুকে জড়িয়ে ভেতরে এসেই গমগমে কন্ঠে আবিরকে ডাকল ধ্রুব। আবিরের সাড়া পাওয়া গেল না। সুরাইয়া এসে জানাল, আবির কলেজ থেকে ফিরেই ঘুমোচ্ছে। সুরাইয়াকে মেঝে পরিষ্কার করতে বলে আবারও আবিরের ডাক পড়ল। কিছুক্ষণের মাঝেই ঘুমো ঘুমো চোখে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো আবির। ধ্রুবর শীতল চাহনি দেখেই আঁতকে উঠল। অসহায় কন্ঠে বলল,
'আমি আবার কী করলাম? ঘন্টাখানেক আগেই ক্যাম্পাস থেকে এসেছি। আজকে সারাদিনে কিচ্ছু করিনি, সত্যি।'
কল্প তখনও জোঁকের মতো ঝেঁকে রেখেছে ধ্রুবর গলা। মুখ গুঁজে রেখেছে কাঁধে। যেন ধ্রুবর শরীরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। টেনেও আলাদা করা যাচ্ছে না। অথচ তার জামা পাল্টানো প্রয়োজন। রাগে দপদপ করে উঠল ধ্রুবর কপালের শিরা। তথাপি কী শান্ত তার মুখাবয়ব! শীতল কন্ঠে বলল,
'কল্পকে একা রেখে কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমোস কী করে তুই? তাও এই বৃষ্টির দিনে? আগামী দুইদিন তোর জন্য ঘুম নিষেধ। সুরাইয়া? মনজু চাচাকে ডেকে বলো আবিরের বিছানা বালিশ তুলে দুই দিনের জন্য স্টোর রুমে রেখে দিতে।'
ধ্রুবর শান্ত নির্দেশ যেন বেদবাক্য। সুরাইয়া খুশি মনে মনজু চাচাকে ডাকতে গেল। আবির বিমর্ষ চোখে চেয়ে বলল,
'আমি ওকে নিয়েই ঘুমিয়েছিলাম। কাঁথার নিচে একদম চেপে ধরে শুয়েছিলাম। সত্যি। কসম। বাঁদরটা কখন ফুড়ুৎ করে বেরিয়ে গিয়েছে, আমি কী করে বলব? তুমি সবসময় শুধু আমায় বকো। ওকে কিছু বলো না। আমি বুঝি তোমার ভাই না? এই তুই নাম ভাইয়ার কোল থেকে!'
আবিরের গলায় আদ্র অভিমান। শ্যামলা মুখটি অভিমানে কালো। ধ্রুব আবিরের শিশুসুলভ অভিমানকে খুব একটা পাত্তা দিলো না। কল্পের জ্বরটা হুহু করে বাড়ছে। এদিকে পকেটে থাকা মুঠো ফোনটাও বেজে চলেছে নিরন্তর। বার বার কেটেও কূল পাওয়া যাচ্ছে না। বাসায় এসেছে থেকে তরু তাকে ফোন দিয়ে ফেলেছে গুণে গুণে বত্রিশ বার। ধ্রুবকে কল্পর গায়ে হাত বুলাতে দেখেই এগিয়ে এলো আবির। কল্পকে টেনে নিজের কোলে নেওয়ার চেষ্টা করে বলল,
'এই তুই ভাইয়ার কোল থেকে নাম। তোর পার্সোনাল ভাই নাকি যে কোলে উঠে বসে থাকবি? তোকে বাবা-মা যে কী মনে করে পৃথিবীতে এনেছে, তাই তো ভেবে পাই না৷ বিচ্ছু একটা, নাম!'
আবিরের টানাটানিতে আরও শক্ত করে ধ্রুবর গলা জড়িয়ে ধরল কল্প। এখন তাকে কিছুতেই ধ্রুবর কোল থেকে নামানো যাবে না। পৃথিবীর সবথেকে লালায়িত বস্তু দিয়ে দিলেও না। ধ্রুব অবাক চোখে তার জোয়ানমর্দ ভাইয়ের এমন শিশুসুলভ ছেলেমানুষী দেখল। বিরক্ত হয়ে ধমক দিল,
'তুই কী বাচ্চা? চার বছরের বাচ্চার সাথে হিংসা করছিস। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে ওর। গরম জামা-কাপড় নিয়ে আয়।'
আবির ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। ধ্রুব অধৈর্য হয়ে বলল,
'কী হলো?'
'আমি ওকে মোটেও হিংসা করছি না। ওর জন্য বাবা-মা আছে না? তুমি ওকে এতো আদর করবে না।'
ধ্রুব হতাশ হলো। হতভম্ব হলো। আবিরের অভিমানে ফুলে ফেঁপে থাকা মুখের দিকে কয়েক পলক চেয়ে থেকে উত্তর করার মতো ভাষা খুঁজে পেলো না। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বলল,
'আচ্ছা বাবা, আমি ওকে আদর করছি না। এখন যা?'
আবির এবার গটগট করে বেরিয়ে গেল। ঘন্টাখানেকের মাঝে দুই ভাইয়ের অদম্য পরিশ্রমে কল্পর জামা পাল্টে, ঔষধ খাওয়ানো হলো। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো অন্য জায়গায়। কল্প কিছুতেই ধ্রুবকে ছাড়বে না। অসুস্থ হলেই ছেলেটা জেদি হয়ে যায়। ঘুমের মাঝেও ধ্রুবর সাথে মিশে থাকে। নড়তে চড়তে দেয় না। এদিকে তরুর ফোনের জ্বালাতনেও থাকা যাচ্ছে না। ফোনে কথা বলার সময় বার দুই হাস্যরত তরুণীর কন্ঠ কানে এসেছে। কন্ঠটা শুনেই চমকে উঠেছে ধ্রুব৷ আশ্চর্য হয়েছে। বুকের ভেতর ঢলঢলে নরম এক স্রোত বয়ে গিয়েছে। মনটা খুব প্রশ্রয় পেয়েছে আজকাল। খুবই দুর্লভ এই হাসিটা দেখতে ইচ্ছে করছে। ধ্রুব বহু কষ্টেসৃষ্টে কল্পকে ভুলিয়ে পোশাক পাল্টে সাদা শার্ট জড়াল গায়ে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলো ঠিক করতেই পেছন থেকে প্রশ্ন ছুঁড়লো আবির,
'ভাবীর কাছে যাচ্ছ?'
ধ্রুব যেন হোঁচট খেলো। আবিরের কথার ধরনে ছোট ভাইয়ের কাছে খুব লজ্জায় পড়ে গেল। গলা খাঁকারি দিয়ে চোখ রাঙাল। কিন্তু চোখ রাঙানোটা ঠিকঠাক হলো না। অবাক হয়ে খেয়াল করল, ভেতর ভেতর ভীষণ অস্বস্তিতে কাদা হয়ে যাচ্ছে মন। লজ্জা লাগছে।
'ভাবীর কাছে যাচ্ছি মানে কী? এটা কেমন অসভ্য প্রশ্ন? তরুর সাথে দরকার আছে, তাই যাচ্ছি। নিশিতাকে ভাবী ডাকতে নিষেধ করেছি না?'
'তাহলে কী ডাকবো? যদিও ভাবী এখন শুধু ভাবী নেই। ভাগ্নী হয়ে গিয়েছে। ভাবী যখন মামণি। মামণি ডাকবো?'
কথাটা বলেই হেসে উঠল আবির। ধ্রুব উত্তর দিলো না। আবিরটা দিন দিন চূড়ান্ত বদমাইশ হচ্ছে। ধ্রুবর সূক্ষ্ম ধারণা, আবির তার দুর্বলতাটা ধরে ফেলেছে। আর ধরে ফেলেছে বলেই রাত-দিন ক্ষেপানোর চেষ্টা করছে৷ আবির আবদার করল,
'আমিও যাই?'
শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে ভ্রু কুঁচকাল ধ্রুব,
'তুই গিয়ে কী করবি?'
'ভাবীর সাথে দেখা হবে। আই মিসড্ হার।'
সন্দিহান চোখে চাইল ধ্রুব,
'বাহ! ভাইয়ের থেকে ভাবীর প্রতিই দরদ বেশি দেখছি।'
'ন্যাহ! আমি ভাবীকে ভালোবাসি কারণ ভাবী তোমায় ভালোবাসে। তোমার একজন খুব ভালোবাসার মানুষ দরকার। অবশ্যই মেয়ে মানুষ।'
কথাটা বলে নিজেই হেসে ফেলল আবির। ধ্রুব শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে থেমে গেল। বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডটা থমকে গেল একটিবারের জন্য। তারপর চিনচিনে ব্যথা করে গেল অনেকটা সময়। বাসন্তী বাতাস ঝাপটা দিলো ঘরের দাওয়ায়। নিশিতা তাকে ভালোবাসে, কথাটা খুব মধুর শুনাল। কিন্তু এখনও কী বাসে? মুহূর্তেই ঝুপ করে বাস্তবতায় ফিরে এলো ধ্রুব। মনে পড়ে গেল অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের গল্প। আবির রয়ে সয়ে বাকিটা শেষ করল,
'আর ভাবী হলো তোমার সেই "খুব ভালোবাসার মানুষ"। সে তোমাকে খুব ভালোবাসে।'
ধ্রুব পাত্তা না দিয়ে বলল,
'ফালতু কথা। তুই কী করে জানলি?'
'জানা যায়। প্রথম যেদিন ভাবীর সাথে দেখা হয়েছিল। সেদিনই মনে হয়েছিল কিছু কাহিনি আছে।'
ধ্রুব আগ্রহ দেখাল না। আবির নিজে থেকেই বলল,
'ভাবীর সাথে আমার দেখা হয়েছিল আচমকা। গাঙিনাপাড় গিয়েছি। গরমে জীবন শেষ। মেজাজ তিরিক্ষি। এমন সময় পেছন থেকে কেউ একজন চেঁচামেচি জুড়ে দিল, ওই যে মিস্টার চেইক চেইক। মিস্টার চেইক চেইক। আমি আশেপাশে চেয়ে দেখলাম, কারো গায়েই চেইক শার্ট নেই। আমার গায়েও ছিলো না অবশ্য। তবে কেন জানি মনে হলো, মেয়েটা আমাকেই ডাকছে। আমি সাড়া দিতেই মুখের উপর অপমান করে দিলো।'
ধ্রুব এবার চাইল,
'নিশিতা ছিল?'
'না। ভাবী তো লক্ষ্মী মেয়ে। অপমান করেছিল, তার পাশের জন্য। ওই ঝগড়াঝাঁটি মেয়েটা। আমার এতো মেজাজ খারাপ হলো। তারপরই পাশে ভাবীকে দেখলাম। সে অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে। চোখের পলক পড়ছে না। ব্যাপারটা আমি তখন ঠিক ক্যাচ করতে পারিনি। একটা অপরিচিত মেয়ে কেন আমার দিকে ওভাবে চেয়ে থাকবে? পরে একদিন জানলাম, এইটা আমার ভাবী। তখন বুঝলাম কাহিনি। সে নিশ্চয় আমাকে তুমি ভেবেছিল।'
ধ্রুব কিছুটা চমকাল। আয়নার ভেতর দিয়েই বিছানায় বসে থাকা ভাবলেশহীন আবিরের দিকে চাইল। অবাক হয়ে দেখল, সত্যিই তাই। আবিরকে ঠিক তার মতোই দেখাচ্ছে। বছর দুই-তিন আগেও তাদের দুই ভাইয়ের মাঝে বিস্তর পার্থক্য ছিল। আবিরের গায়ের রঙ আরেকটু চাপা আর স্বাস্থ্যও ছিল কম। কিশোর কিশোর ছাপ ছিলো মুখে। চেহারার আদলটা ধ্রুবর মতো হলোও ঠিক ধ্রুব বলে ভুল হয়নি। কিন্তু এখন আবিরের স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে। শরীরে পূর্ণাঙ্গ পুরুষ পুরুষ ভাব এসেছে। গায়ের রঙটাও উজ্জ্বল হয়েছে। চালচলনেও বড় ভাইকে অনুকরণের ছাপ। তবে কী নিশিতা ধ্রুবকে নয় আবিরকে পছন্দ করেছিল? ধ্রুব বিভ্রান্ত হয়ে গেল। কিন্তু নিশিতাকে দেখে কখনো তো আবিরের প্রতি আকৃষ্ট বলে মনে হয়নি!
মাথার ভেতর অপ্রতিভ এক চিন্তা নিয়েই নিশিতাদের এপার্টমেন্টে পৌঁছাল ধ্রুব। বৃষ্টি তখনও থামেনি। কাঁধের দিকের শার্টটা ভিজে গিয়েছে। ভিজে গিয়েছে চুল। ধ্রুব ডানহাতে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে কলিং বেল চাপল। প্রায় সাথে সাথেই খুলে গেল দরজা। ধ্রুব না তাকিয়েই বুঝল একটি অতৃপ্ত দৃষ্টি, মন্দ-ভালোর মিশ্রণ নিয়ে তার দিকে চেয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলো। হারিয়ে গেল পর্দার আড়ালে।
'আরে, ধ্রুবমামা! আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন?'
ধ্রুব চোখ তুলে তাকাল, প্রিয়তা। এই মেয়েটির সাথে এর আগে কখনো কথা বলেনি ধ্রুব। প্রয়োজন পড়েনি। তবে বুঝেছে, মেয়েটা যথেষ্ট ঠোঁট কাটা। মূর্তমান ঝামেলা। ধ্রুব গম্ভীর হয়ে রইলো। মেঘমন্দ্র কন্ঠে বলল,
'ওয়া আলাইকুম আসসালাম আন্টি। তরু বাসায় আছে?'
প্রিয়তা হতভম্ব হয়ে গেল। চোখ বড় বড় করে চেয়ে ধ্রুবর মনোভাব বুঝার চেষ্টা করল। মুখ কালো করে বলল,
'আপনি আমাকে আন্টি ডাকছেন কেন? আমাকে আন্টিদের মতো দেখায়?'
ধ্রুব উত্তর দিলো না। আশেপাশে চেয়ে বলল,
'তরুর ঘরটা কোনদিকে?'
প্রিয়তা হতাশ, ভঙ্গুর মুখ নিয়ে শুধাল,
'আপনি কী নিশুকেও আন্টি ডাকবেন নাকি ভাইয়া?'
ধ্রুব প্রিয়তার পেছনে ভেসিনের আয়নায় ভেসে উঠা, উল্টো পাশের রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা রূপসীর ওড়নার মোলায়েম আঁচলের দিকে চেয়ে রইল। বুক ভারি শ্বাস নিয়ে বলল,
'সে আমায় মামা বলে সম্বোধন করলে, নিশ্চয় ডাকব।'
প্রিয়তার দেখিয়ে দেওয়া ঘরটিতে ঢুকতে ঢুকতেই প্রিয়তার ধূপধাপ পায়ের শব্দ আর ফিসফিস কন্ঠ কানে এলো ধ্রুবর। আদতে ফিসফিস হলেও ধ্রুবর স্বাভাবিক কন্ঠস্বরের থেকেও জোরে শুনাল সেই শব্দ। প্রিয়তা খুব আক্ষেপ নিয়ে বলল, ' এই মাল তো ভীষণ চালু নিশু। আমাকে কেমন মুখের উপর আন্টি ডেকে দিলো? কই মামা ডেকেছি বলে একটু মন খারাপ করবে, তা না। এমন হ্যান্ডসাম, হট ছেলেরা আন্টি ডাকলে কী বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে, বল? ইশ!' তার পরপরই খোলামেলা ধরনের খুব অসভ্য একটা কথা বলে ফেলল। প্রিয়তার কথার ধরনে মনে মনেই হোঁচট খেলো ধ্রুব। নিজেকে নিয়ে এমন মন্তব্যে কানদুটো ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। বয়সে এতো বড় একটি ছেলেকে এক লহমায় মাল বানিয়ে ফেলল? ধ্রুব তরুর ঘরে ঢুকেই বলল,
'তোর ভাগ্নীরা দুনিয়ার বেয়াদব। এদের উপর নজর দিতে হবে না। এরাই আমার বন্ধুদের গিলে খেয়ে ফেলবে।'
পর্ব ২৫ | পর্ব ২৭ |