প্রেমিক অপ্রেমিকের গল্প |
বর্ষা পেরিয়ে শরৎ এলো। কালো মেঘ সরে গিয়ে পেঁজা তুলোয় মন ছুঁলো। নরম ডালে দেখা দিলো রাশি রাশি শিউলী ফুলের মালা। ধ্রুবর বন্য গোলাপের ঝাড়টা নুইয়ে পড়লো নিশিতার পুরোনো ফ্ল্যাটের খা-খা বারান্দায়। অথচ নিশিতার মান ভাঙলো না। নানা কূটকৌশল খাটিয়েও নিশিতার সাথে দুই মিনিট কথা বলার সুযোগ পাওয়া গেলো না। নিশিতার নিশ্চুপ ব্রত অস্থির করে তুললো ধ্রুবর মন মেজাজ। বুকের ভেতর থম ধরে থাকা কথাগুলো ফুলেফেঁপে উঠলো। তারা যে কেবল নিশিতার সঙ্গ চায়। চায় তার এক টুকরো সচেতন দৃষ্টিপাত। এইযে ধ্রুব এতো এতো চেষ্টা করছে? নিশিতা কী হঠাৎ হওয়া হাওয়ার মতো একটুখানি ছুটে আসতে পারে না? অথবা শরৎ-এর পেঁজা মেঘের মতো খুব দূরের মানুষ হয়েই শুনে যেতে পারে না ধ্রুবর অজস্র কথামালা? তারপর নাহয় ধ্রুবর শাস্তি হতো। হৃদয় শিলায় লিখে দিতো আজন্ম কথা বন্ধের নির্দেশমালা। তবু, নিশিতা যদি একটু শুনতো ওকে। ওর ভাগের গল্পটা নিশিতা ছাড়া আর বলবেই বা কাকে?
'জলেতে বা আগুনে, বর্ষা বা ফাগুনে;
তোমার নামে যত মেঘেদের গান।
জাগরণে মিছিলে, কোথায় যে কি ছিলে;
আমায় নিখোঁজ ভাবো নিয়ে অভিমান।'
শরতের ধমকা হাওয়ার মতোই টুংটাং গিটার আর এক ঝাপটা সুর এসে ঝাপটে পড়ল ধ্রুবর কানে। আবির গান গাইছে। ছেলেটার গানের গলা চমৎকার। চাইলেই দারুণ কিছু করতে পারতো গান দিয়ে। অথচ সে নির্বিকার। ধ্রুব না-চাইতেও ঘর থেকে বেরিয়ে আবিরের শোবার ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। আবির বারান্দার কাছে পা ছড়িয়ে বসে আছে। তার বাম উরুর উপর এক ঝাঁক কৌতূহল নিয়ে বসে আছে কল্প। ডান উরুতে শোভা পাচ্ছে নান্দনিক গিটার৷ কল্পর বোধহয় গান-টান খুব একটা পছন্দ হচ্ছে না। তার সমুদয় আগ্রহ আবিরের কোলের উপর থাকা ওই যন্ত্রটার উপর। তার বোধহয় যন্ত্রটা ধরে একটু টানাহেঁচড়া করার ইচ্ছে। কল্প তার ইচ্ছের বিশেষ গুরুত্ব দিলো। গম্ভীর মুখে একবার আবির তো একবার গিটারের দিকে চেয়ে দুইহাতে খপ করে খামচে ধরল গিটারের তীক্ষ্ণ তার। আবিরের গিটারের সুর থেমে গেলো। গরম চোখে চেয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলল,
'খরগোশের বাচ্চা! হাত সরা! এক্ষুনি হাত কাটবে। খালি আমাকে বকা খাওয়ানোর ধান্দা? হাত সরা, সরা হাত। তোরে কিন্তু আমি পাঁচ তলা থেকে লাথ্থি মেরে ফেলে দেব কল্প।'
কল্প হাত সরাল না। তারগুলোকে ছোট্ট, নরম হাতে শক্ত করে চেপে ধরে ড্যাবড্যাবে অসহায় চোখে চেয়ে রইলো ভাইয়ের মুখে। আবির মেজাজ খারাপ করে ওর হাত হঠানোর চেষ্টা করলো। বেশি টানাটানি করলেই হাত কাটবে আর ভাইয়া ঠিকঠাক কেবল ওর দোষটাই দেখবে। শেষমেশ অধৈর্য হয়ে চেঁচালো আবির,
'ভাইয়া! ভাইয়া! ভাইয়া কিন্তু বাসায় কল্প। আমি কিন্তু এক্ষুনি ভাইয়াকে ডাকবো। ভাইয়া! এটা আমার গিটার। ছাড় তুই।'
ধ্রুবর কথা শুনে বড়ো অনিচ্ছায় তারগুলো ছেড়ে দিলো কল্প। কচি হাতগুলো নিজের কোলের উপর রেখে লক্ষ্মী বাচ্চাটির মতো বসে রইলো ভাইয়ের উরুর উপর। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে আবারও ছটফট করে উঠলো কল্প। এভাবে বসে থাকতে আরাম লাগছে না। সুতরাং কচি পা'টা ঢুকিয়ে দিলো গিটারের সরু ফোকর বরাবর। এখন আরাম লাগছে। আবির আবার চেঁচালো। কল্পর পা ধরে টানাটানি করতে করতে বলল,
'খরগোশের বাচ্চা! ভাইয়া! ভাইয়য়য়া!'
ধ্রুব দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলো। দুই ভাইয়ের হাড্ডা-হাড্ডি লড়াইয়ের মাঝেই জলদগম্ভীর কন্ঠে ডাকল,
'কল্প!'
সাথে সাথেই নিশ্চুপ হয়ে গেল পরিবেশ। কল্পর পা ঠিক জায়গায় ফিরে এলো মিলি সেকেন্ডের মাঝে। আগের মতোই উদাস মুখে বসে রইলো আবিরের কোলে। ধ্রুব শান্ত চোখে দুই ভাইকে পরখ করলো। ততোধিক শান্ত কন্ঠে বলল,
'পড়াশোনা নেই তোর? সারাদিনে একবারও তো বইয়ের আশেপাশে দেখি না তোকে। ব্যাপার কী? ডি গ্রেড ডাক্তার হওয়ার জন্য মেডিক্যালে ভর্তি হয়েছিস? সারাদিন হৈ-চৈ। বয়স কত তোর?'
আবির ব্যথিত চোখে ভাইয়ের দিকে চাইলো। চোখ ঘুরিয়ে কোলে বসে থাকা কল্পকে চোখ রাঙাল। অভিমানী কন্ঠে বলল,
'তুমি তো শুধু আমার দোষটাই দেখো। কল্পকে কিচ্ছু বলো না। কল্প আমাকে পড়তে দিচ্ছেটা কই? তুমি জানো ও কী করেছে? আমার স্টেথোস্কোপ নিয়ে পানি ভর্তি বালতিতে ভিজিয়ে রেখেছে। বলে, পানিতে অসুখ। এখন আমার আবার স্টেথোস্কোপ কিনতে হবে। তুমি এটাকে এতিমখানায় দিয়ে আসো। ও হওয়ার পর থেকে তুমি শুধু ওকেই দেখো। আমাকে দেখো না। ওর যন্ত্রণায় বাসা ছেড়েই চলে যাব আমি।'
ধ্রুব মুগ্ধ চোখে ছোট ভাইয়ের দিকে চেয়ে রইলো। আবির দিন দিন ঠিক ধ্রুবর মতো দেখতে হচ্ছে। তার মতোই চুলের ছাঁট। গাল ভর্তি পুরুষোচিত দাড়ি। একই রকম চোখ। কেবল চোখের দৃষ্টি আর চিবুকের তিলটা ভিন্ন কোথাও কোনো অমিল নেই। ও হ্যাঁ, আরেকটা অমিল আছে বটে। সে হলো, অভিমান। কথায় কথায় অভিমান করে ফেলার গুণটা আবির পেয়েছে মায়ের থেকে। মায়ের সুপ্ত অভিমান গুণটা আবিরের চরিত্রে হয়েছে প্রকট! ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ধ্রুব কখনো কারো সাথে অভিমান করেনি। বাচ্চা বয়সেও এতো বাচ্চা বাচ্চা স্বভাব তার ছিলো না। অথচ আবিরকে দেখো? এই বয়সে এসেও ভাইকে নিয়ে সে ভয়াবহ রকম অভিমানী। ভাইয়া তাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসবে এটা তার সহ্যেরও অসহ্য। ধ্রুব আবিরের অভিমানী কথার প্রত্যুত্তর করার চেষ্টা করল না। বলল,
'তুমি এখনও ঘুমাওনি কেন কল্প? মায়ের কাছে যাও।'
কল্পর মাঝে কোনো হেলদোল দেখা গেলো না। মায়ের প্রতি তার আসক্তি একেবারে শূন্যের কোঠায়। মায়ের কাছে যাওয়ার কোনো আকাঙ্ক্ষা তার নেই। বড় হতে হতে সে বুঝেছে, মা দূরের মানুষ। মায়ের থেকে বড় ভাইয়া আর আবির মজা। মনে মনে মায়ের জন্য বড়ো দুঃখ হলো ধ্রুবর। আবির বা কল্প কেউই বাবা-মায়ের ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহী নয়। বাবা-মা সবার থাকে, থাকতে হয়, তাদেরও আছে, এতোটুকুই। এর বাইরে কোনো আবেগ নেই। মায়ের আশেপাশে তারা পারতপক্ষে ঘেঁষে না। মায়ের আদরের মূল্যটা তারা শেষপর্যন্ত বুঝতেই পারলো না। ধ্রুব ভাবে, এতে দোষটা কার? মায়ের? নাকি বছরের পর বছর জমিয়ে রাখা মায়ের পাহাড় সমান অভিমানদের? যে অভিমানে তুচ্ছ হয়ে গিয়েছে মায়ের জীবন-সংসার? ধ্রুবর মাঝে মাঝে মনে হয়, ধ্রুব ছাড়া যে মায়ের আরও দুটো সন্তান আছে তা বোধ করি মায়ের খেয়ালই থাকে না। তারা কী করছে, কেন করছে তাতে মায়ের আকাশসম উদাসীনতা। মায়েরা বুঝি এমন হয়? নিজস্ব অভিমানের কাছে মাতৃ সত্তাটাও এতো মিথ্যে হয়ে যায়? কার প্রতি এতো অভিমান মায়ের? বাবার প্রতি? নাকি এই সমাজ বা জীবনের প্রতি? অভিমান যার প্রতিই হোক। ধ্রুব জানে, এই অভিমান উঠানোর দায় কেবল ধ্রুবর। ধ্রুবর ক্লান্ত লাগে। আজ যদি মা মায়ের মতোই হতো? তবে নিশিতার কথাটা বলবো বলবো করেও এতোটা দেরী হয়ে যেতো না। বিনাবাক্যে মায়ের পছন্দের মেয়ের সাথে দেখা করতে যেতে হতো না। নিজের বিয়ের আলাপ থামিয়ে দিতে অপরিচিত এক মেয়ের সাথে আলাপ করার সিদ্ধান্ত নিতে হতো না। আর না, মায়ের কাছে সব ঘেঁটে যাবে বলে; নিশিতাকে বলে ফেলতে হতো ওমন এক অপমানজনক কথা! ধ্রুব কাঁধ ঝাঁকালো। দীর্ঘশ্বাসের সাথে সাথে উড়িয়ে দিলো সব আবেগ। গম্ভীর কন্ঠে বলল,
'তোমাকে মায়ের কাছে যেতে বলেছি কল্প।'
কল্প এবার উরু থেকে নেমে আবিরের কোলে আরাম করে বসলো। কোমল হাতে আবিরের গলা জড়িয়ে ধরে ঠোঁট ফুলাল। গম্ভীর হয়ে বলল,
'আবির ঘুম।'
'আবির ঘুম না। আবির এখন বই পড়বে। আবিরের সাথে ঘুমোনো যাবে না। তুমি মায়ের কাছে যাও।'
কল্প বিনাবাক্য ব্যয়ে আবিরের কোল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। আবিরের কোলের থেকেও লোভাতুর কোলের আশায় দুই হাত বাড়িয়ে দিয়ে বড়ো বড়ো পাপড়িতে ঢাকা চোখদুটো ঝাপটালো বার কয়েক। গোল গোল গালদুটো ফুলিয়ে চোখভর্তি সরলতা নিয়ে বলল,
'মা যাব না। আমি ঘুম।'
ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কল্পকে কোলে তুলে শুধাল,
'মা যাবে না কেন? মা তোমায় আদর দিবে।'
কল্প সে কথার জবাব না দিয়ে তুলতুলে হাতে ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরলো। সতর্ক চোখে একবার আবিরের মুখখানা দেখে নিয়ে আঙ্গুল তুলে গিটার দেখালো। মুখটাকে ভীষণ গম্ভীর করে বলল,
'কপ্প টু টু নিবো। আবির দেয় না৷'
আবির চোখ-মুখ কুঁচকে চাইলো। গজগজ করে বলল,
'আবির দেয় না! দিবেও না আবির। তোর গিটারও লাগবে আবার ভাইয়াও লাগবে? দুনিয়ার সবকিছু তোর? এই তোর বাপ-মা নাই? খবরদার ভাইয়ার কোলে উঠবি না তুই। নাম! নাম বলছি!'
কল্পর ভ্রুতে ভাঁজ পড়ল। বিপদ বুঝতে পেরে দু'হাতে সপাটে জড়িয়ে ধরলো ধ্রুবর গলা। মুখ গুজলো ঘাড়ে। একটু পর পর মুখ তুলে উঁকি দিয়ে দেখতে লাগল আবিরের চেহারা। আবির ফুঁসে উঠে কল্পর হাত টেনে ধরলো। শিশুসুলভ রাগ নিয়ে বলল,
'তুমি ওকে কোলে নিবে না। দাও, ওকে আমি এক্ষুনি মায়ের কাছে রেখে আসবো। ওর কী বাবা-মা নেই? তোমাকেই কেনো কোলে নিতে হবে সারাদিন?'
আবিরের টানাটানি আর কল্পের দম খিঁচে পড়ে থাকার লড়াইয়ে বিরক্ত হয়ে উঠল ধ্রুব। ধমক দিয়ে বলল,
'হচ্ছেটা কী? বয়স কত তোর? একটা বাচ্চার সাথে হিংসে করছিস! ওকে ঘুমোতে দে।'
আবির অভিমানে কালো মুখ নিয়ে চাইলো। মনটা ভালো নেই তার। মেঝেতে পড়ে থাকা গিটারে গোটা দুয়েক লাথি দিয়ে গজগজ করে উঠলো,
'পড়বো না আমি। খাবোও না আজ। সবসময় তুমি ওকে বেশি গুরুত্ব দাও। আমি তো কেউ না।'
গজগজ করতে করতে পড়ার টেবিলের চেয়ারেও একটা লাথি কষলো আবির। ধরাম শব্দ তুলে চেয়ারটা আছড়ে পড়লো মেঝেতে। ধ্রুব একটাও কথা না বলে স্থির দাঁড়িয়ে রইলো। এমন জোয়ানমর্দ ভাইয়ের এহেন ছেলেমানুষীতে কী বলা যেতে পারে ভাষা খুঁজে পেলো না। আবির কিছুক্ষণ বিছানার এককোনায় চুপচাপ বসে থেকে মুখ কাঁচুমাচু করে উঠে দাঁড়াল। ভাইয়ের শীতল দৃষ্টির ভয়ে চুপচাপ চেয়ার তুলে পড়তে বসে গেলো। ধ্রুব এবার নড়ে উঠলো। খুব শান্ত ভঙ্গিতে আবিরের সামনে থেকে তার মোবাইল ফোনটা তুলে নিয়ে শীতল কন্ঠে বলল,
'আগামী এক সপ্তাহ তোর ফোন ইউজ করা বন্ধ। আগে ঠিকঠাক বিহেভ করতে শিখ। তারপর ফোন।'
আবির অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিলো। একটুখানি প্রতিবাদও করলো না। ধ্রুব ফিরে যেতে নিয়েও আবার ঘুরে দাঁড়াল। দীর্ঘ মানসিক টানাপোড়েনে পৃথিবীর কোনো কিছুই আর ভালো লাগছে না তার। নিশিতার বিষণ্ণ মুখ ভালো লাগছে না। ভালো লাগছে না আবিরের মন খারাপও। বয়সে মাত্র চার বছরের বেশ কম হলেও আবিরকে ধ্রুব আগলে রেখেছে অনেকটা সন্তানের মতো করে। আবিরের অভিমানী মুখে যে অবিকল মায়ের মুখের ছাপ। কোথাও না কোথাও মিলে যায় নিশিতার সাথেও। আচ্ছা! পৃথিবীর সব অভিমানের কী একই রকম রূপ? সব অভিমানীদের কী একই রকম দেখতে লাগে? ধ্রুব ইতস্তত করে এগিয়ে গেল। যে কাজটা কখনো করেনি, আজ তাই করলো। ডান হাত বাড়িয়ে আবিরের মাথা ভর্তি চুলগুলো গুছিয়ে দিতে দিতে বলল,
'তুই আর কল্প, তোরা দুজনেই আমার ফার্স্ট প্রায়োরিটি। তুই তো বড়ো হয়ে গেছিস বাচ্চা। কল্প তো ছোট। ও একটু বড়ো হোক ওকে আর আদর করবো না।'
ভাইয়ের থেকে অপ্রত্যাশিত প্রশ্রয় পেয়ে মনটা একটু নরম হলো আবিরের। আড়চোখে ধ্রুবর দিকে চাইলো। ধ্রুবর চোখে তখন ভাসছে ভীষণ বিষণ্ণ এক মুখ। যে মুখটাকে চাঁদের সাথে তুলনা করেছিলো ধ্রুব। মনের ভুলেও বিষণ্ণতার সজ্ঞা বানাতে চায়নি তাকে। অথচ সে হয়ে গেল বিষণ্ণতার সম্রাজ্ঞী। ধ্রুব কয়িৎক্ষণ অন্যমনস্ক থেকে আচমকা বলল,
'তোর ফোনের লকটা খোল তো আবির। লক খুলে আমাকে দে।'
আবির ঝট করে চাইল। ভাইয়ের রুদ্রপ্রতাপ কন্ঠে অন্যরকম একটা ঢেউ খেলে যাওয়ায় রাগ-অভিমান মিইয়ে সন্দেহে চিকচিক করে উঠল দুটো চোখ। ঠোঁটের কোণে সর্বজান্তার হাসি নিয়ে ভ্রু নাচাল। উচ্ছ্বল কন্ঠে বলল,
'ভাবীকে ফোন করবে ভাইয়া? তোমার ফোন বুঝি তুলছে না?'
মনে মনে অস্বস্তির ঢেউয়ে হাবুডুবু খেলেও উপর উপর শক্ত হয়ে রইলো ধ্রুব। ধমক দিয়ে বলল,
'আমি একবারও বলেছি যে তোর ভাবীকে ফোন করব?অন্যকোনো কাজ নেই আমার? যা বলেছি, তা কর।'
ধমকটাকে গায়ে মাখলো না আবির। ফোনের লক খুলে আগ্রহ ভরে চেয়ে রইলো। বলল,
'তোমরা বিয়ে কবে করবে ভাইয়া? আমি ভাবছি, তোমাকে একটা ভয়ঙ্কর প্রেমের বই উপহার দিব। ভাবী তো সাহিত্যের মানুষ। তাকে মানাতে হবে সাহিত্যের ভাষা দিয়ে। তুমি তো সবসময় মুখবন্ধ করে বসে থাকো। দিনরাত প্রেমের...'
ভাইয়ের শীতল চাহনি দেখে বাকি কথাটুকু জিহ্বার ডগাতেই রেখে দিলো আবির। ঠোঁটদুটো ঝট করে বন্ধ করে মৃদু হাসার চেষ্টা করলো। তারপরই মুখ লুকালো বইয়ের পাতায়। ধ্রুব দরজার কাছাকাছি পৌঁছাতেই পেছন থেকে টিপ্পনী কাটলো আবির,
'ওই খরগোশের বাচ্চাকে আমার কাছে দিয়ে যাও। নয়তো দেখা যাবে, তুমি ভাবীকে মাত্রই আই লাভ ইউ বলতে গিয়েছ।'
আর সাথে সাথেই বিচ্ছুটা বলে উঠলো,
'ভাইয়া কপ্প পিপি পেয়েছে।'
ধ্রুব এবার চোখ গরম করে তাকালো। সাথে সাথেই মুখ ফিরিয়ে হেসে ফেললো আবির। ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নিশিতা যে তাকে কী পরিমাণ অস্বস্তির ঢেউয়ে ফেলেছে; আর ধ্রুব কী রকম ভাবে সেখানে হাবুডুবু খাচ্ছে ভেবেই আশ্চর্য হলো। ঘরে ফিরে ঘুমন্ত কল্পর গায়ে কাঁথা টেনে দিয়েই এতোদিনে মুখস্থ হয়ে যাওয়া নিশিতার নাম্বারটার উপর চোখ বুলালো ধ্রুব। ফোন দিবে কী দিবে না? ফোন তুললে কী বলবে? নিশিতা কী ধ্রুবর গলা পেয়েই ফট করে ফোন কেটে দিবে? কারো অনিচ্ছা সত্ত্বেও এমন বারবার ফোন করাটা কী খুব বেশি হ্যাংলামো হয়ে যাচ্ছে? এমন নানা চিন্তার সুতো টানতে টানতে প্রায় ঘন্টাখানেক একইভাবে, পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে বসে রইলো ধ্রুব। অনেকটা সময় সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে শেষমেশ পরিচিত নাম্বারটাই ডায়াল করলো। হৃদয়ের অজস্র শিহরণ, হৃদপিণ্ডের কালবৈশাখী ঝড়কে এক লহমায় থামিয়ে দিয়ে ওপাশ থেকে যান্ত্রিক আওয়াজ ভেসে এলো। সুমিষ্ট কন্ঠে বলে উঠল, 'আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারটি এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।' মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো ধ্রুবর। ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে থম ধরে বসে রইলো। নিজে একজন পুলিশ অফিসার হয়ে রাস্তাঘাটে কোনো মেয়েকে হয়রানি করা নীতির খেলাপ হয়ে যায় বলে এতোদিন সামনাসামনি কোনো চেষ্টাই করেনি ধ্রুব। কিন্তু আজ যেন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। একরোখা ধ্রুবর মনে জেদ চেপে বসলো। দাঁতে দাঁত চেপে চরম এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। অনেক হয়েছে, আর নয়। এবার প্রয়োজনে জোর করেই কথা বলবে ধ্রুব। তারপর যা হওয়ার হোক। ধ্রুব দ্রুত হাতে পরিচিত এক নাম্বারে ডায়াল করলো। গম্ভীর, শক্ত কন্ঠে আদেশ দিলো,
'নিশিতা হক, ঠিকানা আর মোবাইল নাম্বারটা আমি আপনাকে মেইল করছি। তার প্রতিটি গতিবিধি আমাকে জানান। কোথায় যাচ্ছে, কী করছে এবং মোস্ট ইম্পোর্টেন্ট, কালকের শিডিউল কী? বাড়ির বাইরে পা দেওয়ার সাথে সাথে আমার কাছে খবর আসা চাই।'
ওপাশের কণ্ঠস্বর তটস্থ হয়ে বলল,
'এটা কী রিসেন্ট কোনো কেইসের সাথে রিলেটেড স্যার?'
'সেটা আপনাকে ভাবতে হবে না। ইউ জাস্ট ড্যু হোয়াট ইউ আর টোল্ড।'
'ইয়েস স্যার।'
ফোনটা রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ধ্রুব। ব্যালকণির পর্দা উড়িয়ে আসা শরতের হুহু হাওয়াটাও আজ কেমন নির্জীব ঠেকছে। চারপাশে কেমন মন খারাপ মন খারাপ গন্ধ। বুক বেয়ে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। কপালে পড়লো গাঢ় চিন্তার ভাঁজ। জীবনটা আশ্চর্য এক চক্রে ঘুরছে তার। কী জানি, কী আছে পরবর্তী পৃষ্ঠায়!
পরের দিন সকালে আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামলো। শরতের এমন দুর্লভ সকালেই ডিউটি অফিসার জানালেন নিশিতা বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। রিকশা করে ক্যাম্পাসে আসছে। ক্যাম্পাসের সামনে কোনোরূপ সিনক্রিয়েট করা যাবে না বলেই পুলিশ ভ্যান নিয়ে টাউনহলে পুলিশ ফাঁড়ির সামনে অপেক্ষা করতে লাগল ধ্রুব। গাড়ির গরম গদিতে আরাম করে বসে থাকতে থাকতেই উপলব্ধি করলো, তার বুক কাঁপছে। বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ ছাপিয়ে বাজছে হৃদপিণ্ডের কোলাহল। চরম মুহূর্তের অপেক্ষায় কন্ঠনালী শুকিয়ে যাচ্ছে। একই সাথে, বুকের গহীনে, দুধ সাদা এক স্রোত বয়ে চলেছে এঁকেবেঁকে। সে আসছে! দেখা হবে তার সাথে! আহা! কতদিন দেখে না সে সেই রমণীটিকে! স্নিগ্ধ, সরল যার চোখ! ধ্রুব একটি সিগারেট ধরালো। নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চোখ-মুখ আরও গম্ভীর করে বসে রইলো। ধ্রুবর গাম্ভীর্যের আধিক্য দেখে তটস্থ হয়ে উঠলেন সাথে থাকা কনস্টেবল। নিশিতার রিকশাটা মোড় ঘুরে দৃষ্টিগোচর হতেই হাতের ইশারা করল ধ্রুব। জলদগম্ভীর কন্ঠে বলল,
'এই রিকশাটাকে থানায় চালান দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। কীভাবে করবেন সেটা ভাবার জন্য আপনার মাথায় একটা মস্তিষ্ক আছে।'
মাঝ বয়স্ক কনস্টেবল তটস্থ চোখে চাইল। বিনা বাক্য ব্যয়ে গাড়ির হুইল ঘুরিয়ে ঠুকে দিলো জীর্ণশীর্ণ রিকশার গায়ে। রিকশার উপর থেকে ছিটকে পড়তে পড়তে বেঁচে গেল নিশিতা। পুলিশের গাড়ি দেখে মুখে উঠে আসা খারাপ শব্দদুটো গিলে ফেলল ছোকরা দেখতে রিকশাওয়ালা। দৈত্যের মতো দেখতে প্রকান্ড কনস্টেবল বৃষ্টির মাঝেই বেরিয়ে এলেন গাড়ি থেকে। চূড়ান্ত মুখ খারাপ কিছু গালি দিয়ে বললেন,
'শুয়োরের বাচ্চা! চোখে দেখোস না? রং সাইডে রিকশা চালাস। পাখা গজাই গেছে? একটা স্লিপ কেটে দিলেই পাখা মিলাই যাব। পুলিশের গাড়িতে ঠোকর মারিস? বিকেলে থানায় এসে রিকশা নিয়ে যাবি। শালার পু*, গায়ে হাওয়া লাগাইয়া রিকশা চালাস! হাওয়া ছুটে যাব।'
অল্পবয়স্কা রিকশাওয়ালার মুখটা আতঙ্কে ফ্যাকাশে হয়ে গেলো এবার। পুলিশকে কীভাবে সামলাতে হয় সে অভিজ্ঞতা না থাকায় অসহায় চোখে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো। কনস্টেবল আর রিকশাওয়ালার মধ্যকার ঝামেলার মাঝেই নেমে এলো ধ্রুব। গায়ে মোটাসোটা পুলিশি রেইনকোট। রেইনকোটের উপর ঝমঝমিয়ে জল গড়াচ্ছে। একেকটা বৃষ্টির ফোঁটা যেন ভিন্ন ভিন্ন সুরে মাদল বাজাচ্ছে। রিকশায় বসে থাকা আতঙ্কে ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া রমণীটিকে দেখে চোখ শীতল হয়ে এলো ধ্রুবর। পৃথিবীটাকে আচমকা পেঁজা মেঘের মতো নরম, শীতল ঠেকল। বৃষ্টির ছাঁট থেকে বাঁচতে 'তাকে' ঘিরে থাকা নীল রঙা প্লাস্টিকের কাগজটা যেন 'তার' ভয়ার্ত আভাকে আরও হাওয়া দিচ্ছে। বৃষ্টি ভেজা আলতো হাওয়ায় অল্প অল্প কাঁপছে কপালে পড়ে থাকা কেশ রাশি। মোমের মতো ফর্সা গালে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির ছাঁট। ধ্রুবর বুকের ভেতর অদ্ভুত এক কাব্য খেলে গেল এবার। ভেবে রাখা কথা সব গুলিয়ে ফেললো। কন্ঠনালী শুকিয়ে এলো চিন্তায়!
পর্ব ২৭ | পর্ব ২৯ |