প্রেমাসুখ - পর্ব ২৪ - নবনীতা শেখ - ধারাবাহিক গল্প


সাঁঝ অনিমেষ তাকিয়ে আছে হৃদের দিকে। কান দুটো লাল হয়ে যাচ্ছে। সে হিসেব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে। কথা গোছাতে পারছে না। মুখ ফুটে কী বলবে সেটা জানে না। কাঁপছে এখনও। 

হৃদ মুচকে হেসে সাঁঝের মুখোমুখি দাঁড়াল। সাঁঝ হৃদের দিকে অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকিয়ে, কম্পনরত অধরযুগল নেড়ে বলল, “অ... অসুখ!”

হৃদ হালকা হেসে শুধাল, “বিশ্বাস হয় না?”

সাঁঝ ডুকরে কেঁদে উঠল। হৃদ এই কান্নার দরুন নিজের বুকের মাঝে চিনচিনে এক ব্যথার আভাস পেল। সাঁঝ দু'হাতে মুখ ছাপিয়ে কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে একসময় সামনের লম্বাটে পুরুষটার বুকে কপাল ঠেকাল। হৃদ মিহি হেসে সাঁঝের অগোছালো চুলে নিজের হাত ডুবাল। 

সাঁঝ কান্নাভেজা গলায় জিজ্ঞেস করল, “আপনি তো অন্য কাউকে ভালোবাসেন! কিন্তু, অসুখ তো আমায় ভালোবাসতো।”

হৃদ থেমে গেল, সাথে সাঁঝের এলোমেলো চুলে বুলানো হাতটাও। সাঁঝ মাথা তুলল। হৃদের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখল, সেই চোখে বিস্ময়। সাঁঝ বুঝল না, নিষ্পলক তাকিয়ে রইল।

হৃদ অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন করল, “কী?”

সাঁঝ সেদিনকার সবটা খুলে বলল। হৃদ বোকার মতো কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। তার মুখের ভাব পরিবর্তন হলো অনেকটা সময় বাদে। অস্থির চিত্তে এদিক-ওদিক চোখ বুলিয়ে নিল। নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। চিৎকারে করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, ‘এই মেয়ে! এই! বোঝো না কেন আমাকে? এত বোকা কেউ হয়?’

তবে একথা সাবলীল ভাবে বলার মতো ধৈর্য নেই। কিছুটা জোরালো গলায় বলল, “কান্না থামাও, একদম কাঁদবে না।”

সাঁঝ কান্না থামাল। নাক টানছে তবুও। আবারও কেঁদে দিল। ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলল, “থামছে না তো, কী করব?”

 সাঁঝের এহেন অবস্থা দেখে হৃদ হালকা কণ্ঠে বলল, “শুনেছি মেয়েদের কাছে স্পেশাল পাওয়ার থাকে। দূর থেকে কোন ছেলে তাকে দেখে কী অনুভব করছে, সব বুঝে যায়। কিন্তু সন্ধ্যাবতী এত বোকা হলো কী করে? সে তারই অসুখকে চিনতে পারেনি!”

এরপর সেদিনকার সব ঘটনার সত্যিটা খুলে বলল। সাঁঝ হতভম্বের ন্যায় তাকিয়ে রইল। কী ভুলটাই না করেছে সে! দেরি হচ্ছে বিধায় হৃদ আর কিছু না বলেই প্রস্থান করল।
সাঁঝ কিছুই বলতে পারল না। ফোন অন করে হৃদকে একটা মেসেজ পাঠাল, “ডাক্তার সাহেব! আপনার-আমার প্রেমটা বড্ড অদ্ভুত হবে। আপনার মেডিকেল লাইফ আর আমার টক্সিক লাভ লাইফ, দুয়েতেই মেডিসিনের স্মেল। এত অসুখের বাহার কেন?”

 সাঁঝ একটা লম্বা শাওয়ার নিল। হঠাৎ সে অনুভব করল, তার বুকে আনন্দের ঢেউ বইছে। সে তো এটাই চেয়েছিল। তার ঠোঁটে হুটহাট হাসির রেখার দেখা দিচ্ছে। নিজেকে সবচেয়ে সুখী লাগছে। তখনই তার মনে হল, সে কাঁদতে কাঁদতে কী করেছিল! তার ডাক্তার সাহেবের বুকে মাথা রেখেছিল! সে এও বুঝল, যাকে এত ভালোবেসেছে, সে নিজে তাকে তার চেয়েও বেশি ভালোবাসে। সাঁঝের অদ্ভুত রকমের সুখ লাগছে। 

শাওয়ার নিয়ে বের হতেই উপমাকে তৈরি হতে দেখল। উপমা গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “তোর শাড়ি থেকে শুরু করে সব ধরনের অর্নামেন্টস বেডের উপর রেখেছি। টাইম দিলাম ২০মিনিট। রেডি হ।”

সাঁঝ কপাল কুঁচকে বলল, “রেডি কেন হব?”

“তোকে বিয়ে দেব। বাইরে তোর জামাই কাজি নিয়ে ওয়েট করছে।”

এতে যেন সাঁঝের কুঁচকানো কপাল আরও কুঁচকে গেল। বড্ড সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে উপমার দিকে তাকিয়ে আছে। উপমা একটা শ্বাস ফেলে সাঁঝকে মনে করিয়ে দিল, “গাঁধী ননদিনী, আজ নবীন বরণ।”

সাঁঝ সত্যি ভুলে গিয়েছিল। সামনের দু'পাটি দাঁত কেলিয়ে বলল, “রেডি হচ্ছি।”

_________________

দুপুরের দিকে কলেজ থেকে ফিরেছে অদিতি। বড্ড চিন্তিত সে। কিছুদিন আগে রাস্তায় সুমিতা বেগমের সাথে দেখা হওয়ায় সে উপমা আর অর্ণবের কাবিন সম্পর্কিত সব জেনেছে। ভালোবাসার মানুষটার ভাগ দেওয়া যায়? যায় না বোধ হয়। 
দুপুরে আর খাবার খেল না সে। রুমা বেগম ডেকেও কুল পেল না। পাবে কী করে? তার মেয়েটা শুরু থেকেই ভীষণ জেদি।

অদিতি নিজের রুমে শুয়ে শুয়ে ভাবছে সেই দিনটা। উপমা আর অর্ণব রিকশায় করে ঘুরছে। উপমার মাথা অর্ণবের কাঁধে। দূর থেকে সেসব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল অদিতি। ভাবনা শেষ হচ্ছে না। বেস্ট ফ্রেন্ডের জন্য তো অদিতির খুশি হওয়ার কথা। হতে পারছে না কেন? মনে হচ্ছে, কেউ তার কলিজা ছিঁড়ে নিয়ে গেল। হঠাৎ অদিতির শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেল। বুকে হাত চেপে ঘনঘন কয়েকটা শ্বাস নিল।চোখ দুটো বুজে এলো। সেই বন্ধ চোখের ভাঁজে অদিতি শুভর অসহায়ত্ব দেখতে পেল। সেও নিশ্চয় এরকমই যন্ত্রণা ভোগ করছে!

বিকেলের দিকে অদিতিকে রুম থেকে বেরোতে দেখে রুমা বেগম এগিয়ে এলো। মেয়ের চোখের ডার্ক সার্কেল তার দুশ্চিন্তা শতগুণে বাড়িয়ে দিল। এভাবেই মায়ের মন বড়োই নাজুক, তার উপর মেয়ের এমন দিন দিন অবনতি তার বুকটা কাঁপিয়ে তুলল। মেয়ে খারাপ পথে যায়নি তো!

জলদি গিয়ে অদিতির সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, “খাবি না? আয়। ভাত বাড়ছি।”

অদিতি বড্ড গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “খাব না।”

“কেন? দ্যাখ, তোর পছন্দের সব খাবার রেঁধেছি।”

“ফিরে এসে খাব।”

“কোথায় যাচ্ছিস?”

“একটা কাজে।”

“কী কাজ?”

অদিতি মিহি হেসে ফেলল। মাকে এত দুশ্চিন্তায় ফেলা তার মোটেও উচিত হয়নি, সে বুঝল। হুট করেই এক অদ্ভুত কাজ করল। রুমা বেগমকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, “সুখ খুঁজতে যাচ্ছি। নিজের কষ্টের চেয়েও তোমার চোখের পানি আমাকে বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছে।”

এরপর তাকে ছেড়ে সোজা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। রুমা বেগম শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছল। অনেক সাধনার পর সন্তান সুখ পেয়েছিল। সেই সন্তানের কষ্ট কী করে সহ্য করবে?

অদিতি বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা রিকশা নিয়ে সোজা পাশের এলাকার একটা বাড়িতে চলে এলো। বাইরে থেকে ভীষণ সাজানো গোছানো পরিপাটি এই বাড়িটা। আজই প্রথম এসেছে আর মনেও ধরেছে তার। ঠিকানা পেতে অবশ্য বেগ পোহাতে হয়েছে অনেক।

পরপর দুটো বিশালাকার শ্বাস টেনে কলিং বেলে চাপ দিল। অকারণেই ঘামছে, নার্ভাস হচ্ছে। খানিকক্ষণ বাদে দরজা খুলল একজন মাঝ বয়সী ভদ্র মহিলা। 

অদিতিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কপাল কুঁচকে ফেলল। সে চিনতে পারছে না। অনেক ভেবেও শাহানা বেগম অদিতিকে চিনল না। তাই জিজ্ঞেস করল, “তুমি?”

অদিতি মুচকি হেসে বলল, “আসসালামু ওয়ালাইকুম, মা।”

শাহানা বেগম বেশ বিস্মিত হলো। এভাবে চেনা নেই, জানা নেই, একটা সুন্দরী যুবতী এসে তাকে মা সম্বোধন করছে! ব্যাপারটা বেশ ঘোলা। সে সালামের জবাব দিয়ে বলল, “তোমাকে চিনতে পারলাম না।”

অদিতি এতে আরও খুশি হয়ে মুখশ্রীতে লজ্জার ছাপ এনে বলল, “আমাকে চিনবেন না, মা।”

“আবার ‘মা’ বলছ! চিনতে পারছি না তো। আর আমি যতদূর জানি, আমার একটাই ছেলে।”

“আপনার ছেলেই তো বলল, আপনাকে যেন মা ডাকি।”

শাহানা বেগম অদিতিকে আর কিছু না বলে ভেতরের রুমের দিকে তাকিয়ে ডাকল, “বাবু! বাবু!”

অদিতিও শাহানা বেগমের সাথে সাথে ভেতরে ঢুকল। ভেতরের রুম থেকে খালি গায়ে একটা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরে ভেজা চুলগুলো হাত দিয়ে ঝেড়ে বাইরে এলো শুভ। শুভকে এই অবস্থায় দেখে অদিতি চোখ কুঁচকে ফেলল। মনে মনে বলল, “এভাবে কেউ আসে?”

_____________

ফিরতে ফিরতে হয়ে গেল সন্ধ্যে। এই সময়টা সাঁঝের কাছে ভীষণ স্পেশাল। সে জন্মেছিলও এই সময়ে। জন্মলগ্নের সাথে মিল রেখেই তার নামকরণ করা হয় ‘সাঁঝ’।
একটা মানুষের নামের সাথে ভাগ্যের এত মিল হয়! সাঁঝ এই সন্ধ্যেতে যেভাবে অনেক কিছু হারিয়েছে, ঠিক এই সন্ধ্যেতেই তার চেয়েও ভালো কিছু পেয়েছে। 
মনটা ভীষণ উশখুশ করছে তার। তার ডাক্তার সাহেবও তাকে ভালোবাসে! তাহলে কেন এতদিন বলেনি? মনে ভালোবাসার বীজের বেড়ে ওঠার সাথে সাথে অভিমানের পাল্লাও বেড়েছে। সে কেন এত কষ্ট পেয়েছে! তার ডাক্তার সাহেব তো পারত, তাকে এই চিন্তা থেকে মুক্তি দিতে। দিল না কেন? 

বাসায় ফিরেই সাঁঝ ছাদে চলে এলো। উপমা আটকাল না। অর্ণবকে কল লাগল। অর্ণব রিসিভ করেই বলল, “ফিরেছেন তবে!”

উপমা মিহি হেসে বলল, “হু। তুমি অপেক্ষা করেছ। তাই না?”

“একদম না। আরেকটা বউয়ের সাথে প্রেমালাপ করলাম।”

“দ্যাখো! ভালো হবে না কিন্তু।”

অর্ণব হাসল। তাদের কথার পরিধিও বাড়ল। এদিকে সাঁঝ ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। আজ তার সব কিছুই ভালো লাগছে। এই অভিমানটাও ভালো লাগছে। কোত্থেকে যেন একটা ঠান্ডা হাওয়া সাঁঝের সর্বাঙ্গকে শিহরিত করে তুলছে। হালকা হালকা কেঁপে উঠল। ঠোঁটের হাসির রেখা বাড়ল, অনেকটা বাড়ল। সে জানে, তার ডাক্তার সাহেব আসবে। এসে তার মান ভাঙ্গাবে।

সাঁঝের বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। কিছুক্ষণ বাদেই পেছন থেকে পুরুষালি কণ্ঠ বলে উঠল, “সন্ধ্যাবতী!”

সাঁঝ আবারও কেঁপে উঠল। এত মোহনীয় কোনো আওয়াজ হয় বুঝি! সাঁঝ মাথা নিচু করে হাসল। পেছন থেকে আবারও সে বলল, “আমার কী ভাগ্য! এই নন্দিনী আমার।”
.
.
.
চলবে....................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন