প্রেমাসুখ - পর্ব ৩২ - নবনীতা শেখ - ধারাবাহিক গল্প


কাল গায়ে হলুদ। আলোক সজ্জায় সজ্জিত পুরো বাড়িটা বিয়ে বিয়ে গন্ধে ছেয়ে আছে। খুশিতে জমজমাট পরিবেশ। বড়োদের আনন্দটা চোখে পড়ার মতো। অনেক দিন পর সবাই একসাথে বসেছেন। তাদের আড্ডাস্থল হয়ে আছে বাড়ির উঠোন। মাদুর পেতে বসে আছেন বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষেরা। তাদের প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের খেয়াল রাখছেন সুমিতা বেগম। সমগ্র ছাদটা বাড়ির তরুণ সদস্যদের দখলে। তারা সেখানে আনন্দ-উল্লাস করছে। পুরুষ সদস্যেরা সব বসার ঘর মাতিয়ে রেখেছে। সেখানে আরিফ সাহেব নেই। এত হৈ-হুল্লোড়ে তাঁর বুকে ব্যাথা হচ্ছিল। তাই নিজের রুমে বিশ্রাম নিচ্ছেন।

এত সবার মাঝেও এখানে অনুপস্থিত উপমা, অদিতি, সাঁঝ, আয়াত ও প্রণব সাঁঝের রুমে গৃহবন্দী হয়ে আছে। ব্যস্ততায় এদিকে কারোর তেমন খেয়াল নেই। বিকেলের দিকে বিয়ের কনের সাক্ষাৎ পেতে অনেকেই এসেছিল, কিন্তু সাঁঝ দেখা দেয়নি। বলে দিয়েছে, তার মাথায় ব্যাথা শুরু হয়েছে। মূলত মাথা ব্যথার অজুহাতেই দরজায় খিল লাগিয়েছিল। 

সাঁঝ বিছানার মধ্যেখানে বসে পুরো রুমে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। দরজার কাছে প্রণব দাঁড়িয়ে, প্রণবের থেকে একটু দূরে আয়াত দাঁড়িয়ে। বারান্দার সামনে উপমা ও অদিতি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। 
সাঁঝ চোখ বন্ধ করে ভাবল, এমন পরিস্থিতির জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। কীভাবে কী করবে? হৃদকে জানাবে কী করে এটা? ইতোমধ্যে হৃদ বেশ কয়েকবার কল দিয়েছে। সাঁঝ ধরেনি। বুঝতেই পারছে না কোন মুখে এই কথাটা বলবে! সাঁঝ কল রিসিভ করার সাহস পাচ্ছে না।

আবারও কয়েক মুহূর্তের জন্য সব শান্ত হয়ে গেল। নিস্তব্ধ কক্ষে ফোনের কর্কশ আওয়াজ কর্ণকুহরে ভেসে আসতেই সবাই আওয়াজের উৎসের দিকে তাকাল। নিজের দিকে চার জোড়া চোখ পড়তে দেখেই উপমা ঘাবড়ে গেল। দু'দিন আগে কেনা ফোনটা তার হাতে, একদমে বেজে চলেছে।
উপমা স্ক্রীনে তাকিয়ে কল দেওয়া ব্যক্তির নাম দেখে সবার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে চোখ বুলিয়ে নিল। 

আয়াত ভ্রু উঁচু করল। অদিতি মৃদু আওয়াজে প্রশ্ন তুলল, “হৃদ ভাইয়া?”

উপমা ঠোঁট উল্টিয়ে মাথা উঁচু-নিচু করে বোঝাল, “হ্যাঁ”। কল কেটে গিয়ে পুনরায় বেজে উঠল। সাঁঝের বুকটা বার বার কেঁপে উঠছে। এখনই হয়তো তান্ডব হবে। সে বুঝতে হিমশিম খাচ্ছে, ঠিক করবেটা কী?

প্রণব উপমাকে বলল, “এমন সিচ্যুয়েশনে পিঠ দেখিয়ে ভাগতে নেই। উই হ্যাভ টু ফেইস ইট।”

উপমা রিসিভ করেই বা কী জবাব দেবে? ভয় পাচ্ছে। আয়াত বলল, “স্পিকারে দে।”

সাঁঝের মস্তিষ্ক শূন্য। এখন হয়তো বোমা ফাটবে কিংবা সমগ্র পরিবেশ শান্ত হয়ে যাবে। দুটোই ভয়ানক, বড্ড ভয়ানক। 

কম্পনরত হাত দিয়ে উপমা কল রিসিভ করল। ওপাশ থেকে হৃদ বলল, “কোথায় আছ তোমরা?”

উপমা চুপ করে আছে। উপমার হাত থেকে প্রণব ফোনটা নিয়ে বলল, “হ্যালো, ভাইয়া! আমি প্রণব।”

হৃদ চকিতে বলল, “প্রণব! তুমি! সাঁঝ কোথায়?”

প্রণব সাবলীলভাবে বলল, “আমরা সাঁঝের বাড়িতে এসেছি।”

হৃদ উত্তেজিত হয়ে পড়ল। অস্থির চিত্তে বলল, “সাঁঝ! সাঁঝ ঠিক আছে?”

প্রণব বলল, “ফার্স্ট ক্লাস আছে। ঠিক থাকার উপর মোটামুটি একটা ডিগ্রি পেয়ে গেছে। একটা মহৎ কাজ করে এখন নখ চিবাচ্ছে।”

হৃদ বলল, “কী হয়েছে? খুলে বলো আমায়।”

প্রণব বলল, “বিয়ে করতে বসেছে। পরশু বিয়ে এই গাঁধীর।”

হৃদ কিছুক্ষণ ভেবে একটা শ্বাস ফেলে বলল, “ও কোথায়?”

প্রণব সাঁঝের দিকে তাকাল। সাঁঝ কেমন ছলছল নয়নে তাকিয়ে আছে। সাঁঝের দিকে তাকিয়েই প্রণব বলল, “সামনেই আছে।”

হৃদ নিরস কণ্ঠে বলল, “আচ্ছা, ওকে ফোনটা দাও।”

প্রণব সাঁঝের দিকে ফোনটা দিল। কিছু সময়ের মধ্যে মুখটা কেমন শুকিয়ে গিয়েছে তার। মায়া হলো প্রণবের। ইচ্ছে হচ্ছে, বিয়ের গুষ্টির ষষ্ঠী করে সাঁঝকে নিয়ে ঢাকা চলে যেতে। কিন্তু পারছে না! উপায় নেই যে! 

সাঁঝ ফোন কানে তুলে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “হ্যা... হ্যালো!”

“বিয়ে কবে?”

হৃদের এমন নরম কন্ঠে সাঁঝের ভয় বেড়ে গেল। গলা শুকিয়ে এলো। সাঁঝ কথা বলতে পারছে না। 

সাঁঝকে চুপ থাকতে দেখে হৃদ ধমকিয়ে বলল, “কিছু জিজ্ঞেস করেছি? কী? করিনি?”

“হ... হ্যাঁ।”

“তো বলো।”

“প... পরশু।”

“কার সাথে?”

“প্রহর স্যার।”

“স্যার?”

“হু, আমাদের ভার্সিটির লেকচারার।”

“আজ জানলে?”

“না। বৃহস্পতিবারে জেনেছি।”

সঙ্গে সঙ্গে সাঁঝ ফোনের ওপাশে কিছু একটার বিকট আওয়াজ পেয়ে কেঁপে উঠল। হয়তো হাতের কাছের কোনো কাঁচের কিছু ভেঙেছে। হৃদের ফরসা হাত রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছে। 

সে ব্যাথা চেপে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমাকে জানাওনি কেন?”

“আ... আমি বুঝিনি।”

“কী বোঝোনি? বাচ্চা তুমি?”

হৃদের চিৎকারে সাঁঝ ডুকরে কেঁদে উঠল। হৃদ দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “স্টপ ক্রাইং!”

সাঁঝের কান্না থামছে না। সে যেন মনে করেছে, এভাবে কেঁদে গেলে বকা কম খাবে। হৃদ তার মনের বাসনাকে বুড়িগঙ্গায় ছুঁড়ে আবারও ধমকে উঠল, “আই সেইড, স্টপ ক্রাইং!”

সাঁঝ নিজের কান্না হুট করে থামিয়ে ফেলল। তবুও ফোঁপাচ্ছে। হৃদ জিজ্ঞেস করল, “তুমি বিয়েতে রাজি?”

সাঁঝ ধীর কণ্ঠে বলল, “না।”

“তোমার উপর প্রেশার ক্রিয়েট করছেন তোমার বাবা-মা?”

“না।”

“পারমিশন নিয়েছিলেন তাঁরা?”

“হু।”

“তুমি পারমিশন দিয়েছ?”

সাঁঝ চুপ মেরে গেল। এর উত্তর কী দেবে? হৃদ পুনরায় জিজ্ঞেস করল, “ কী? দিয়েছ?”

“হ...হ্যাঁ।”

“ওহ্! তবে তো হলোই। বিয়ে করে নাও।”

কথাটা বলেই ফোন কেটে দিল হৃদ। সাঁঝের দমবন্ধ হয়ে আসছে। কী করেছে সে এটা? মাথা কাজ করছে না আর। এত বড়ো ভুল কী করে হলো? 

অদিতি সাঁঝকে জিজ্ঞেস করল, “ভাইয়া কী বলল?”

সাঁঝ অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “বলল, বিয়ে করে নিতে।”

আয়াত বলল, “ঠিকই তো বলেছে! বিয়ে করে নে তুই।”

সাঁঝের কিছুই ভালো লাগছে না। প্রণব এগিয়ে এসে বলল, “আঙ্কেল আন্টিকে একবার জানালে ভালো হয় না?”

সাঁঝ যেন আশার আলো দেখল। প্রনবের দিকে তাকিয়ে বলল, “এতে কাজ হবে?”

প্রণব বলল, “তোকে খুব ভালোবাসেন ওঁরা। অবশ্যই তোর ভালোবাসার খেয়ালও রাখবেন।”

সাঁঝ ভরসা পেল। উপমার ফোন তার হাতে দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। 
সবাই এক দৃষ্টিতে সাঁঝের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা শ্বাস ফেলল। যদি পরে জানত! যদি কোনো অনর্থ ঘটে যেত! এভাবেই সাঁঝ যেরকম মেয়ে! অনেক বড়ো কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকত।

উপমা কিছুক্ষণ পর হৃদকে ফোন দিল। হৃদ রিসিভ করতেই উপমা বলল, “ভাইয়া!”

হৃদ মিহি কণ্ঠে বলল, “তোমাকে একটু পরই কল দিতাম। সাঁঝ আশে-পাশে আছে?”

“না, নেই।”

“আচ্ছা। এখন বলো তো, কী হয়েছে।”

উপমা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবটা বলল। হৃদ শুনে বলল, “এই মেয়েটাও না! একটা কাজও জেনে-বুঝে করবে না। পরে নিজেই সাফার করবে।”

_____________________

আরিফ সাহেবের হৃদরোগ ব্যাধিটা সন্ধ্যের দিকে বেড়েছে। তাই তো নিজ কক্ষে গা ছেড়ে দিয়ে একাকী শুয়ে আছেন। মনটা হালকা খারাপ। কাল বাদে পরশু তার কলিজার টুকরোকে অন্যের হাতে তুলে দিতে হবে। সব বাবারই এই হৃদয়বিদারক কাজটা করতে হয়। সমাজের এক অলিখিত নিয়ম এটি।

“বাবা, আসব?”

আওয়াজ পেয়ে আরিফ সাহেব দরজার দিকে তাকালেন। দরজার সামনে সাঁঝকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আরিফ সাহেব মুচকি হেসে বললেন, “হ্যাঁ, মা। এসো।”

সাঁঝ ভেতরে এলো। আরিফ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “কিছু লাগবে?”

সাঁঝ না-বোধক মাথা নাড়ল। আরিফ সাহেব হাসলেন। বললেন, “এসো। বাবা-মেয়ে মিলে গল্প করি।”

সাঁঝ আরিফ সাহেবের পাশে বসল। আরিফ সাহেব সাঁঝের ছোটো বেলার গল্প জুড়ল। বাচ্চাকালে একদম শান্ত-শিষ্ট মেয়ে ছিল সাঁঝ। তখনকার গল্পই বলল। 

আরিফ সাহেবের কথা শেষে সাঁঝ বলল, “বাবা, তোমাকে আমার কিছু বলার আছে।”

“হ্যাঁ, তো বলো।”

সাঁঝ বুক ভরে শ্বাস নিয়ে সাহস সঞ্চয় করে বলল, “আমি বিয়ে করতে চাই না।”

পেছন থেকে খট করে দরজা লাগানোর আওয়াজ পেয়ে সাঁঝ সেদিকে তাকাল। সুমিতা বেগম! মেয়ে ও স্বামীর আদুরে কথপোকথন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে দেখে যাচ্ছিলেন সুমিতা বেগম। মেয়ের মুখের ওমন কথা শুনতেই দরজা লাগিয়ে দেন। বাড়ি ভর্তি মানুষ; যদি কেউ শুনে নেয়!

সুমিতা বেগম সাঁঝকে চোখ রাঙিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী বললে?”

সাঁঝ নিচু মাথায় নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুক কাঁপছে তার। ডাক্তার সাহেবকে হারানোর ভয় তার ভেতরটা চুরমার করে দিচ্ছে। 

সুমিতা বেগম আবার বললেন, “বিয়েটাকে কোনো খেলনা পেয়েছিস? শখ হলে খেলতে যাবি! শখ মিটে গেলে ফেলে দিবি!”

সাঁঝ ফোঁপাচ্ছে। সুমিতা বেগম মেয়ের বাহুতে মেরে বললেন, “কীরে! কথা বলছিস না কেন?”

“মা! মা! আমি অন্য কাউকে পছন্দ করি।”

সুমিতা বেগম অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকিয়ে বললেন, “সেদিন না রাজি ছিলিস! ছ'দিনে কাকে পছন্দ হয়ে গেল?”

“অনেক আগে থেকেই...”
সাঁঝকে কথাটা শেষ করতে দিলেন না সুমিতা বেগম। ঠাস করে সাঁঝের গালে চড় বসিয়ে দিলেন। মেয়েকে কখনো মারেননি। তাই সাঁঝ এটা হজম করতে পারছে না। গালে হাত দিয়ে সুমিতা বেগমের পানে তাকিয়ে রইল। আরিফ সাহেব আঁতকে উঠলেন। মেয়ের এমন কার্যে উনি চূড়ান্ত পর্যায়ের অবাক। বুকের মাঝে তাঁর চিনচিনে ব্যাথা হচ্ছে। ডান হাত দিয়ে বুকের বা-পাশটা ডলে যাচ্ছেন।

সুমিতা বেগম বললেন, “তোর কাছে না আগেই জিজ্ঞেস করা হয়েছিল! তখন কেন না করিসনি?”

সাঁঝ কথা খুঁজে পেল না। সুমিতা বেগম আবারও বলল, “আমাদের মান-সম্মানকে খেলনা পেয়েছিস?”

কিছুক্ষণ থেমে সুমিতা বেগম বললেন, “ভুলে যা সব। প্রহর ভালো ছেলে।”

অতঃপর নিরবতা ছেয়ে রইল বেশ কিছু সময়ের জন্য। সাঁঝের শ্যামলা মুখশ্রীতে রক্তিম আভা ছেয়ে গিয়েছে। কাঁদছে না আর; যেন পাথর বনে গিয়েছে। 
সুমিতা বেগম ও আরিফ সাহেবও ওর দিকে তাকাচ্ছেন না। 

আরিফ সাহেব মেঝের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে সুমিতা বেগমের উদ্দেশ্যে বললেন, “তোমার মেয়েকে বলে দাও, কোনো সিনক্রিয়েট যেন না করে। বাড়ি ভর্তি মানুষ। আমার মান-সম্মান ওর হাতেই।”
.
.
.
চলবে.......................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন