রুমের মাঝে পাইচারি করছে হৃদ। একবার এপাশ তো আরেকবার ওপাশে যাচ্ছে। সাঁঝ কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করে রুমে চলে গিয়েছে। কাল সকাল সকাল আফিয়া বেগম ও রায়হান সাহেব চলে আসবেন।
সাঁঝের হঠাৎ করে মনটা খারাপ হয়ে গেল। কেন হৃদ এরকম করছে? একে তো পরিবারের ওমন উদাসীনতা দেখে বাড়ি ছাড়তে হলো, তার উপর আবার হৃদ! কোথায় একটু গল্প-সল্প করবে! তা না! রেগে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে!
আচ্ছা, হৃদ কি গল্প-সল্পই করবে না কি অন্য কিছু! ভাবতেই সাঁঝের গাল দুটো রক্তিম আভায় ছেয়ে গেল।
হৃদ ফোনটা হাতে নিয়ে বারান্দার কাছে চলে এলো। অনেকটা রাত হয়েছে। পরনের শীতের কাপড়টা তাকে উষ্ণতা দিচ্ছে। ঘুমোতে চেয়েছিল। কিন্তু ঘুম পাচ্ছে না। বারান্দায় রাখা বেতের চেয়ারে বসে পড়ল হৃদ। এক হাতের কনুই চেয়ারের হাতলে রেখে, আঙুল দিয়ে কপাল ডলে যাচ্ছে। অন্য হাতে নিউজফিড স্ক্রল করছে। বারে বারে হৃদের চক্ষু সম্মুখে সাঁঝের সেই স্নিগ্ধ মুখশ্রী ভেসে আসছে। কিছুক্ষণ বাদে সাঁঝের ইনবক্সে ঢুকল, পুরোনো কনভারসেশন দেখার জন্য।
সময় কত অদ্ভুত! তাই না? এই তো! ক'দিন আগে যাকে একনজর দেখার জন্য ছুটে চলে গেল তার আঙিনায়; আজ সে তারই পাশের কক্ষে অবস্থান করছে, অথচ দূরত্বের সীমারেখা অনির্দিষ্ট।
হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে হৃদ লাস্ট মেসেজটা দেখল। এটা হৃদ আজ সন্ধ্যেয় করেছিল। বড্ড আবেগী অনুভূতি নিয়ে লিখেছিল, “মানুষ নাকি অভ্যেসের দাস। আর সেই অভ্যেসটা যদি একটা জলজ্যান্ত মানুষ হয়ে থাকে, তবে? এটা ভয়ঙ্কর। অ্যান্ড ট্রাস্ট মি, আমি তোমাতে অভ্যস্ত। কোথায় তুমি? এ্যাই, সন্ধ্যা! এ্যাই, শাস্তি দিচ্ছ? প্লিজ! ফোনটা পিক করো না! আই কান্ট ব্রিথ।”
হৃদ হালকা হাসল। তখনই খেয়াল করল, সাঁঝ কিছু একটা টাইপ করছে। হৃদ গভীর মনোযোগে তাকিয়ে রইল।
সাঁঝ মেসেজ সেন্ড করল, “মি. জামাইজান! লোকে বলে, দূরত্ব ভালোবাসা বাড়ায়। আমার কাছে এটা পৃথিবীর সবচেয়ে ভুল কথাগুলোর মাঝে একটা। কেননা দূরত্ব ভালোবাসার বদলে নিজের সীমানাটা বাড়িয়ে ফেলে। অনেকে তো বিচ্ছেদের দোরগোড়ায়ও চলে যায়। আমি তা চাই না। আমি শুধু আপনাকে চাই। আমি জানি, আপনি আমাকে ভালোবাসেন। আপনি জানেন, আমিও ভালোবাসি। তবে এটা জানেন? আমি আপনাকে একদম পাগলের মতো ভালোবাসি। এক মুহূর্ত দেখতে না পেলে নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগে। মনে হয়, আমার সব ঠিক আছে, তবে আমার বুকের বা-পাশটা শূন্য; হৃৎপিণ্ডটা নেই।
এই যে, মি. জামাইজান! কখনও দূরে যাবেন না। আমার ভীষণ কষ্ট হয়। ভুল করলে বকবেন, প্রচুর বকবেন। ইচ্ছে হলে মারবেন। আমি চুপ থাকব। আপনি আপনার রাগ মিটিয়ে নেবেন। প্লিজ, মুখ ফিরিয়ে নেবেন না। আপনাকে ছাড়া আমার কষ্ট হয়। এই যে! এখন হচ্ছে! আচ্ছা, আপনি কি আমাকে বুঝবেন না? মানলাম একটু ভুল করেছিই, তাই বলে অবহেলা? কতটা যন্ত্রণার এটা, জানেন?”
হৃদের বুকে ব্যথা হলো। কয়েক ঘণ্টা আগেই তো একজনকে কথা দিয়ে এসেছে, সাঁঝকে কষ্ট পেতে দেবে না। এর মাঝেই! নিজের উপর রাগ লাগছে। তবে সাঁঝ অন্যায়ও তো করেছিল!
সাঁঝ আবারও মেসেজ পাঠাল, “কিছু বলুন না!”
হৃদ বড়ো একটা শ্বাস টেনে লিখল, “ইউ হার্ট মি।”
হৃদের রিপ্লাই পেয়ে সাঁঝের বুকের উপর থেকে যেন পাথর সরল। বিনয়ী ভঙ্গিতে মুখে বলল এবং লিখল, “আ'ম স্যরি। আর করব না এমনটা।”
“আর করার সুযোগ দিলে তো!”
“এ্যাই! আপনি আবার হাত-পা বেঁধে ঘরে আটকে রাখার প্ল্যান করছেন না তো?”
“নট অ্যা ব্যাড আইডিয়া। এতক্ষণ ভাবিনি। তবে এখন ঠিকই করব।”
“এ্যাই! না। আমি কিন্তু আপনার নামে শিশু নির্যাতনের কেইস করব, বলে রাখলাম।”
হৃদ ভ্রু কুঁচকে লিখল, “শিশু!”
“হ্যাঁ, এই যে। আমি।”
“তুমি কোন দিক দিয়ে শিশু! ওয়েট অ্যা মিনিট! বাল্যবিবাহ করেছি আমি? এই তোমার বয়স কত?”
“এই মার্চে উনিশ হবে।”
হৃদ হিসেব করল। তার বউটা আসলেই পিচ্চি। তার চেয়ে বছর দশেকের ছোটো। হালকা হাসল। শেষমেষ বাচ্চা বিয়ে করল!
হৃদ তবুও লিখল, “তুমি ১৮+। এখনও শিশু কীভাবে?”
“আরে! আমি প্রায়শই উপমার সাথে একটা পার্কে যাই। আমি একটু বাচ্চা বাচ্চা দেখতে তো। আজ পাঁচ বছর যাবৎ বলি, আমার পনেরো বছর। ষোলো বছরের নিচে আবার টিকিট ফি হাফ। এভাবে আমার হাফ টাকা বেঁচে যায়। তো হলাম না, আমি বাচ্চা?”
মেসেজটা দেখে হৃদের ভ্রু কুঁচকে গেল। পরপর জোরেশোরে হেসে উঠল। এই মেয়েটাও না! হৃদ খানিকক্ষণ পর রিপ্লাই দিল, “আসছি।”
“কোথায়?”
“বাচ্চাটাকে বাচ্চার মা বানাতে।”
সাঁঝ কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইল। ততক্ষণে হৃদ দরজার কাছে চলে এসেছে। রুমের ভেতরে দেখল, সাঁঝ সোফায় বসে আছে। দৃষ্টি তার ফোনের দিকে নিবদ্ধ। এখনও বোঝার চেষ্টায় আছে নাকি? সাঁঝের মুখভঙ্গি দেখে হৃদ ঠোঁট চেপে হাসল।
দরজায় নক করে হৃদ বলল, “তো মিসেস! আর ইউ রেডি?”
সাঁঝ চোখ তুলে তাকাল। কী শীতল দেখাচ্ছে! চোখ দুটো কি কিছু বলতে চাচ্ছে? হঠাৎ হৃদ আবারও তখনকার মতো নিজেকে এলোমেলো অনুভব করল। কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে! সাঁঝের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল। দৃষ্টি মেঝেতে। সাঁঝ হৃদকে দেখল। হঠাৎ তার মনে পড়ল, আজ বাসর!
চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে শুকনো ঢোক গিলল সাঁঝ! মানে আজ থেকে একসাথে থাকতে হবে? হৃদ আশেপাশে থাকলে সাঁঝের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। কেমন সম্মোহনী লাগে সব! উফফ!
সাঁঝ আর অপেক্ষা না করে বারান্দায় ছুটল। সাঁঝের লাজুক মুখখানা হৃদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। দেখেছে সে। মাথা চুলকে হালকা হেসেই বারান্দার উদ্দেশ্যে পা বাড়াল। আজ সাঁঝকে তার চরম স্তরের লজ্জা দিতে ইচ্ছে করছে।
বারান্দার কোণ ঘেঁষে রেলিংয়ে দু'হাত রেখে আকাশপানে তাকিয়ে আছে সাঁঝ। আকাশের চাঁদও মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে। লজ্জাবতী সাঁঝের মতো কি সেও লজ্জায় নিজেকে লুকোচ্ছে?
হৃদের বুকটা ধুকপুক করছে। ইশ! এই মেয়েটা আসলেই তার বউ! হৃদের এখন ইচ্ছে জাগল, সাঁঝের চোখ দেখার। সেই প্রচেষ্টাই করল। কিন্তু সাঁঝের দাঁড়ানোর ধরনের জন্য দেখতে পেল না। হৃদ নিঃশব্দে হাসল।
সে গভীর রাতকে সাক্ষী রেখে সাঁঝকে দেখায় মনোযোগী হলো। রাতেও বুঝি সাঁঝ হয়! হয় তো! এই সাঁঝের আপাদমস্তক লজ্জায় রাঙা।
হৃদ ক'মাস আগে শিউলি গাছের পাশে আরও একটা গাছ লাগিয়েছে। সন্ধ্যামালতী গাছ। এতে হলুদ এবং গোলাপি রঙের ফুল ফোটে। মাঝে মাঝে একটা ফুলে উভয় রঙে দেখা যায়। রুমের আলোয় হৃদ দেখতে পেল, ঠিক এরকম একটা ফুল ফুটেছে।
আলতো হেসে ফুলটা ছিঁড়ে নিয়ে ঠিক সাঁঝের পেছনে দাঁড়াল। একদম নিকটে। সাঁঝের পিঠ গিয়ে ঠেকল হৃদের বুকে। কম্পন সৃষ্টি হলো উভয় মানব-মানবীর অন্তরে। সাঁঝ চোখ বন্ধ করে নিল। হৃদ হাতের ফুলটা সাঁঝের কানের পিঠে গুঁজে দিল।
শীতল এক বাতাস এসে তাদের মন ও কায়ায় শিহরণ জাগিয়ে দিল। হৃদ সাঁঝের কানের নিকট ওষ্ঠ ঘেসে ফিসফিসিয়ে বলল, “সন্ধ্যাবতীর জন্য খুব যত্নে গড়ে তোলা সন্ধ্যামালতী গাছের এই ফুলটা তোমায় ছুঁতে পেরে ধন্য।”
সাঁঝ অতিদ্রুত ঘুরে দাঁড়াল হৃদের মুখোমুখি হয়ে। হৃদ সাঁঝকে দেখে গেল। এই মেয়েটার প্রতি তার কেন এত ভালোবাসা আসে? হৃদ আরও গভীরভাবে লক্ষ করল, সাঁঝের চোখ কুঁচকে বন্ধ করা। পাতলা অধরযুগল কাঁপছে।
হৃদ আরও মোহময় গলায় সম্বোধন করল, “সন্ধ্যা!”
সাঁঝ হৃদ-এর বুকের বা পাশের শার্টের অংশটুকু চেপে ধরল। অনুভব করল, তার ডাক্তারের হৃৎপিণ্ডটা অনেক দ্রুত লাফাচ্ছে। নিজেও ভেতরকার ছটফটানি অনুভব করে আনমনে নিজের নিচের ঠোঁট কামড়ে ভাবল, ‘সত্যিই এই হৃদয়হরণকারী মানুষটা তার এত কাছে!’
সাঁঝের এহেন কর্মকাণ্ডে হৃদের গলা শুকিয়ে গেল। অস্থির ও উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, “শ্যামমোহিনীকে এভাবে দেখে আমার নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। এখন তাকেও বড্ড তীব্রভাবে পাগল করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। হবে কি আমার পাগলামিতে শামিল?”
সাঁঝ লাজুক হাসল।
____________________
দেখতে দেখতে ন'বছর কেটে গেল। সময়ের সাথে সাথে সবকিছুতেই ব্যাপকভাবে পরিবর্তন এসেছে। সাঁঝ দেখল, হৃদ এখনও ঘুমোচ্ছে। মুচকি হেসে হৃদের পাশে বসে তার চুলগুলো এলোমেলো করে দিল। হৃদ ঘুমের ঘোরেই মুচকি হাসল।
সাঁঝ বলল, “সুপ্রভাত, ডাক্তার সাহেব!”
হৃদ ঘুম জড়ানো আওয়াজে বলল, “শুভ সকাল, বউ।”
“ওঠো এখন। সকাল হয়েছে। হসপিটালে যাবে না?”
“ক'টা বাজে?”
“ছ'টা বাজে।”
“উফ! আর পাঁচমিনিট। আচ্ছা, রাত কোথায়?”
সাঁঝ বলল, “ ওর দাদিমার কাছে হয়তো।”
হৃদ ততক্ষণে আবারও ঘুম। সাঁঝ উঠে দাঁড়াতেই কল এলো। উপমা কল দিয়েছে! এত সকালে উপমার কল পেয়ে সাঁঝ অবাক হলো। উপমাদের বাসা ছেড়েছে কয়েক বছর হলো। পুরো পরিবারসহ একসাথে থাকার জন্যই নতুন বাসায় শিফট হয়েছে।
সাঁঝ কল রিসিভ করেই বলল, “এত সকালে?”
“আমি বাবার বাড়ি এসেছি।”
“কী! কেন? কবে?”
উপমা রাগ দেখিয়ে বলল, “সব ভুলে গেছিস?”
সাঁঝের সত্যিই মনে পড়ল না। আমতা আমতা করতে লাগল।
উপমা বলল, “থাক! কষ্ট করে মনে করতে হবে না।”
সাঁঝ দাঁত কেলিয়ে বলল, “তুই আছিস না, মনে করানোর জন্য?”
উপমা হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “অনলাইন হ।”
কথাটা বলেই কল কেটে দিল। সাঁঝ ওয়াইফাই কানেকট করতেই গ্রুপ কল এলো। সাঁঝ রিসিভ ক্রল। স্ক্রিনে অদিতি, উপমা, আয়াত ও প্রণবের চেহারা ভেসে উঠল। সাঁঝের তখন মনে পড়ল, আজ ওদের রি-ইউনিয়ন। বিকেলের দিকে বটতলায় দেখা করবে।
অদিতির সাথে শুভর বিয়ে হয়েছে বছর আটেক আগে। একটা পাঁচ বছরের মেয়ে আছে, নাম শুভ্রা। উপমা ও অর্ণবের এক ছেলে ও এক মেয়ে হয়েছে। আট বছরের ছেলেটার নাম আনজুম আর তিনবছরের মেয়েটার নাম অর্ণা। এদিকে আয়াতের বিয়েটা তাদের মাস্টার মশাই, প্রহরের সাথেই হয়েছিল। এই নিয়েও আছে এক সুবিশাল কাহিনি, আয়াতের পাগলামি। আয়াত তো পুরোদমে অশান্তিতে ফেলে দিয়েছিল প্রহরকে। শেষমেশ প্রহর হার মানল। আপন করে নিল আয়াতকে।
তারা সবাই কলে সংসারিক আলাপচারিতা করছে। উপমা সাঁঝকে জিজ্ঞেস করল, “রাত কী করছে রে?”
“মায়ের রুমে আছে। আর বলিস না! দিনদিন ভীষণ দুষ্ট হচ্ছে। বাবার আহ্লাদে মাথায় চড়ে বসেছে। আমি বারবার হৃদকে বলি, একটু শাসন করো মেয়েকে। অথচ সে আমার কথা এক কান দিয়ে শোনে আরেক কান দিয়ে বের করে দেয়। আসলে শুনবে কী করে? মেয়েতো একদম বাপের মতোই বজ্জাত হয়েছে।”
ঘুমন্ত হৃদ সাঁঝের কথা শুনে বলল, “আমার মেয়েকে কিছু বলবে না একদম।”
সবাই হাসতে থাকল। আয়াত খেয়াল করল, প্রণব কোনো কথ বলছে না। জিজ্ঞেস করল, “কীরে, প্রণু! চুপ কেন?”
“তোগো বিয়াইত্যাগো মধ্যে নিজেরে পশমছাড়া বিলাইয়ের মতো লাগতাছে।”
আয়াত ভ্রু-কুঁচকে বলল, “বিয়ে করে নে তুই।”
প্রণব অসহায় চোখে বলল, “কোনো মাইয়া আমারে পছন্দ করে না।”
আয়াত বিস্মিত কণ্ঠে বলল, “মিথ্যা বলবি না। তুই ‘হ্যাঁ’ বললেই মেয়েদের লাইন লেগে যাবে।”
প্রণব মেকি রাগ দেখিয়ে বলল, “এখনও একটা গার্লফ্রেন্ড জুটায়া দিতে পারো নাই, সেই তুমি কচুর বন্ধু আমার। আবার বড়ো বড়ো কথা কস! যা! দূরে যা।”
আয়াত থমথমে চেহারায় তাকিয়ে রইল। প্রণবের নির্লিপ্ত দৃষ্টি আয়াতে লিপ্ত। কেন যেন বুকে যন্ত্রণা শুরু হলো তার। এই মেয়েটা যদি তাকে বুঝত! ভাগ্যকে তাচ্ছিল্য করে প্রণব হাসল। ইচ্ছে হলো বলতে, ‘তুই কেন আমাকে বুঝলি না?’ কিন্তু বলতে পারল না। কোনো একটা বাহানা দিয়ে কল কেটে দিল। এক পুরুষের বুকে দুই নারী জায়গা পাবে না। প্রণব সেই জায়গা অন্য কাউকেই দেবে না। তার চেয়ে যেভাবে আছে, বেশ আছে।
_________________
রাতের রান্না করার উদ্দেশ্যে সন্ধ্যার দিকে সাঁঝ রান্নাঘরে ঢুকল। সেখানে ইতোমধ্যে পূর্বিকা রান্না শুরু করে দিয়েছে। সাঁঝ বলল, “এই শরীর নিয়ে এখানে কী?”
পূর্বিকা সাত মাসের ফোলা পেটে হাত রেখে বলল, “ভালো লাগছিল না, আপু।”
সাঁঝ পূর্বিকার সাথে কথা না বলে সোজা আফিয়া আহমেদের রুমে চলে গেল। সেখানে আফিয়া আহমেদ ও রায়হান আহদেম রাতের সাথে খেলছেন।
সাঁঝ কপাট রাগ দেখিয়ে বলল, “মা! তুমি পূর্বকে রান্না ঘরে এলাউ করলে কী করে?”
আফিয়া আহমেদ চশমা ঠিক করতে করতে বললেন, “সে কী! ও ওখানে গেল কেন?”
“মা! তোমার মেয়েকে বলে দাও। আর যদি ওকে এই অবস্থায় কাজ করতে দেখি, তবে বেঁধে রেখে দেব।”
পূর্বিকা প্রশান্তির হাসি হাসল। এমন জা পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে সাঁঝ ছুঁটল দরজার দিকে। উদয় ও হৃদ দাঁড়িয়ে। ওঁরা ভেতরে ঢুকতেই সাঁঝ উদয়কে বলল, “তোমার বউ কিন্তু আমার একটা কথাও শোনে না। বারবার বলি, একজায়গায় শান্তিতে বসতে। সে শোনেই না। তার নাকি কাজ ছাড়া ভালো লাগে না। বকে দিয়ো পূর্বকে।”
উদয় থমথমে গলায় বলল, “বেঁধে রেখে দাও, ভাবি।”
সাঁঝ পেছনে দাঁড়ানো পূর্বিকার উদ্দেশ্যে বলল, “পার্মিশন পেয়েছি কিন্তু!”
বাবাকে আসতে দেখে তিন বছরের রাত দৌড়ে চলে এলো হৃদ-এর কাছে। হৃদ মুচকি হেসে রাতের হাতে চকলেটস দিয়ে বলল, “দিন কেমন কাটল, মামনি?”
রাত খিলখিল করে হেসে বলল, “কুউউব বালো, বাবাই।”
________________
পরিশিষ্ট:
বয়স বাড়ছে। সেই সাথে ভালোবাসাও। সময়ের তালে শুদ্ধ ভালোবাসার শুদ্ধতা ক্রমেই বৃদ্ধি পায়। যদি প্রেয়সীর কোঁচকানো চামড়ার হাত ধরে বার্ধক্যের পৃথিবী দেখার ইচ্ছে নাই জাগে, তবে তুমি কোনো জাতেরই প্রেমিকপুরুষ নও। এই ইচ্ছেগুলো জাগে সত্যিকার অর্থের প্রেমিকদের অন্তরে।
সন্ধ্যার দিকে ছাদে বসে রয়েছে সাঁঝ ও হৃদ। এটা মে মাস। সাঁঝের কিছু মনে পড়তেই বলল, “ডাক্তার সাহেব!”
হৃদ বলল, “হুঁ, বলো।”
“আজ ক'তারিখ?”
“২১শে মে। কেন?”
“যদি বলি ভালোবাসি?”
হৃদ বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল। এতগুলো বছরে এটা বলেনি। সাঁঝ হৃদ-এর হাত ঘড়িতে সময় দেখল। খানিকটা কাছ ঘেঁসে হৃদের কাঁধে মাথা রেখে কাউন্ট ডাউন শুরু করল। হৃদ বুঝল না। কাউন্টডাউন শেষ হতেই সাঁঝ বলল, “হ্যাপি টেন্থ ভার্চ্যুয়াল ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি, জামাইজান।”
হৃদ-এর মনে পড়ল। সাঁঝ আবারও বলল, “ঠিক এই সময়টাতেই আমি অসুখে জর্জরিত হয়েছিলাম।”
হৃদ বলল, “ভালোবাসি তোমায়, সন্ধ্যাবতী।”
সাঁঝ হৃদ-এর বাহু জড়িয়ে ধরে বলল, “আমিও তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি। আমার ব্যক্তিগত ডাক্তারকে ভালোবাসি। আমার অসুখকে ভালোবাসি।”
বেশ কিছুটা সুখের সময় অতিবাহিত হওয়ার পর সাঁঝ ডাকল, “ডাক্তার সাহেব!”
হৃদ সাড়া দিল, “হুঁ!”
সাঁঝ প্রশ্ন করল, “প্রেম কী?”
হৃদ মুচকি হেসে সাঁঝের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে উত্তর দিল, “প্রেম হচ্ছে অসুখ।”
.
.
.
সমাপ্ত....................................