ডাক্তার রওশন - নাবিলা ইষ্ক - অনু গল্প


নুজহাতের জ্বর। ফার্মেসী থেকে ঔষধ আনা হয়েছে বেশ কয়েকবার। দিন-রাত বিধিমালা মেনে খেয়েছেও। তবে জ্বর নামেনি উল্টো বেড়েছে। সকালে গ্রামের সরকারি হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে বাবার সঙ্গে। ঠোঁট নিল হয়ে আছে জ্বরের তাপমাত্রায়। মুখশ্রী শুঁকিয়ে এইটুকুন হয়ে গিয়েছে। চোখ খুলে রাখা কষ্টকর। বাবার সঙ্গে লেপ্টে হাঁটতে হচ্ছে। একা শরীরের ভাড়টুকু সামলানোর শক্তি নেই। 

হাসপাতালে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো। তারপরই ডাক্তার থেকে ডাক পড়েছে। হেলেদুলে জ্ঞানহীন ভঙ্গিতে ডাক্তারের কামরায় ঢুকেছে নুজহাত। বাবা তাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। ছেড়ে দিলেই পড়ে যাবে যেন! আসলেই নুজহাত পড়ে যাবা বাবা ছাড়লে। সে খুব দুর্বল। বাবার ইশারায় চেয়ার পেতে বসল। তার পাশে বসেছে বাবা। নুজহাত তখনো চোখ জোড়া বুঁজে। বাবা তখন কথাবার্তা বলছেন ডাক্তারের সঙ্গে। কিছুক্ষণ তাদের আলোচনা নুজহাতের জ্ঞানহীন মস্তিষ্ক শুনল। বোঝার সামর্থ্য পেল না। একসময় বাবার ঝাঁকুনি অনুভব করে নয়ন জোড়া মেলে তাকায়। বাবা অতি নরম গলায় বলেন, 'আম্মা! ডাক্তার সাহেব ডাকে। শুনো কী বলে!'

নুজহাত ঝিমুনি দৃষ্টি ঘুরিয়ে তাকায়। ডাক্তারের দৃষ্টির সঙ্গে দৃষ্টি মিলে যায়। তৎক্ষণাৎ তার ঝিমুনি দৃষ্টি সতেজতায় বড়ো হয়। কালো মণি দুটো চকচক করে ওঠে। ভাঙা গলায় কোনোমতে বলে, 
'আ..আপনি?'

রওশন একজন প্রফেশনাল সরকারি ডাক্তার। তার বাচনভঙ্গি, আচার-আচরণ, চাল-চলন মানুষকে তাঁক লাগিয়ে দেবার মতো। স্পষ্টবাদী সে সামনের নারীকে যেমন চেনেই না, তেমন ভঙ্গিতে স্বভাবসুলভ মিষ্টি গম্ভীর মুখশ্রী ধরে রেখে, মোলায়েম গলায় প্রশ্ন করে, 'কেমন বোধ করছেন?'

নুজহাত ভ্যাবলার মতো বলে, 'আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?'

এবারও রওশন তার প্রশ্ন এড়িয়ে নিজের মতো, বিধিমালা, ওষধিপতি এবং জ্বরের কারণ বলতে থাকে। বলার এক ফাঁকে ছোটো টর্চ জ্বালিয়ে নুজহাতের চোখজোড়াও দেখে নেয়। চেক-আপ করে প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দেয় বাবার হাতে। বাবা ওঠে সালাম জানায়। নুজহাতকে ধরে বেড়িয়ে যায় কামরা থেকে। নুজহাত বোকার মতো বাবার ইশারা-ভঙ্গিতে বেড়িয়ে আসে ঠিকই। তবে বেড়িয়ে আর নড়ে না। ঠাঁই দাঁড়িয়ে পড়ে। তাকে সাইড করে আরেকজন পেসেন্ট ইতোমধ্যে ঢুকতে ডাক্তার কামরায়। বাবা চিন্তিত গলা শুধোয়, 
'কী হয়েছে আম্মা? এই ডাক্তার সাহেবরে তুমি চেনো?'

নুজহাত ঘামছে। কাঁপছে ঠোঁট। গলা নামিয়ে বিড়বিড় করে বলে, 'না। একদমই না।'
'তাইলে চলো। পড়ে টড়ে যাইবা নইলে।'
_____

বাড়ি ফিরে নুজহাত ঘাপটি মেরে বসে। আশ্চর্যজনক ভাবে জ্বর নেই আর শরীরে। মাত্র ঘন্টা খানেকের মধ্যে তীব্র জ্বর নেমে যায়। ঔষধপাতিও খেতে হয় না তাকে। এই বিষয় ধরে বাড়ির ছোটো-বড়ো সকলের সেই কী হাসিঠাট্টা! বড়ো ভাবী তো হেসে বলেই দিলো, 'নুজহাতের জ্বর ডাক্তারকে দেখেই গেছে। ঔষধপাতি খেতে হলো না। এরপর থেকে এই ডাক্তারের কাছেই যেতে হইব, বুঝলেন আব্বা?'

হাসল সকলে। এদিকে তরতর করে ঘামছে নুজহাত। রওশন এখানে কী করছে? সে এই গ্রামে কেন? মানুষটা তার গ্রামে কেন? 
____

শহর থেকে নুজহাত ফিরেছে সপ্তাহ খানেক ধরে। হুট করেই ফিরে এসেছে। দীর্ঘদিন ধরে বাবা-মা ভাইয়া সবাই বলেছে, 'ফিরে আয়। ওখানে পড়াশোনা করার প্রয়োজন নেই। এদিকটায় ভর্তি হয়।' 

কারও কথা শোনেনি। যদি তখনই শুনত, তাহলে কী এমন পরিস্থিতি হতো? না সে ওই মানুষটার নিকটে যেত, আর নাইবা আজ তার মন ভাঙত। ফিরেছে অবদি শরীরে তীব্র জ্বর। জ্বরের কারণ ডাক্তার রওশন মোল্লা। আবার তার জ্বর গায়েব হয়ে যাবার কারণ ও ডাক্তার রওশন। তাহলে কী তার ম/রে যাবার কারণ ও এই লোকটাই হবে? নুজহাত দু'হাতে মুখ লুকিয়ে ফুপিয়ে ওঠে। কেন এভাবে শাস্তি দিচ্ছে তাকে? 
চলে এসেছে তো ওই মানুষের চোখের সামনে থেকে। তাহলে কেন? এভাবে তার মন কেন ভাঙছে? ভালোবেসে কী খুব অন্যায় করে ফেলেছে? হ্যাঁ অন্যায় করেছে। তাইতো ফিরে এসেছে নিজ গ্রামে। তাহলে এখানেও কেন তার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করতে চলে এল? 
সারারাত আর ঘুম হলো না নুজহাতের৷ মোবাইল ফোনে দেখতে থাকল তাদের স্মৃতি। দুজনের তোলা কতশত ছবি। এইসব বুঝি ডিলিট দিতে হবে? ভাবতেই তার বুকটা ব্যথায় অচেতন। 
___

শুক্রবার বাড়িতে মেহমান আসে আগামবার্তা বিহীন। 
নুজহাত পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে। বৈঠক খানায় রওশন। রওশনের সঙ্গে তার বাবা-মা, চাচা এবং বড়ো বোন। তাদের ভালোভাবে চেনে নুজহাত। চিনবে না? তাদের বাড়িতেই তো ভাড়া থেকেছিল সে। হতভম্ব নুজহাতের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে, রওশনের মায়ের নরম গলার স্বর, 'আপনার মেয়েকে নিজের মেয়ে করে ঘরে তুলে নিতে এসেছি। পুত্রবধূ হিসেবে আমার তাকেই পছন্দ।'

থমকে গেল নুজহাত। নড়েচড়ে ওঠে শরীর। ভাবী তাকে ধরে রেখেছে। গলার স্বর নামিয়ে প্রশ্ন করে, 'এইডাই তোমার নাগর বুঝি?'

জবাব দেয় না ভাবীর প্রশ্নের। ভাবী নিজের মতো পুনরায় বলে, 'শুনলাম ডাক্তার। তার ওপর কী সুন্দর পোলা! নিশ্চয়ই আগ বাড়াই ধরছ? তুমিতো ভাই জব্বার একজন ধরছ।'

নুজহাত বুকে হাত চেপে নিজের ঘরে দৌড় দেয়৷ সে কী ভাবীকে বলবে, এই মানুষটাকে সে দেখতেই পারতো না? তার থেকে পালিয়ে বেড়াতো? সেটা ত ওই লোক যে নুজহাতকে প্রতিনিয়ত জ্বালিয়ে প্রেমের ফাঁদে পা ফেলতে বাধ্য করেছে। সর্বক্ষণ সর্বত্র তার পিছু ঘুরে বেড়িয়েছে।
____
 
বিয়ের আয়োজন শুরু। নুজহাত হ্যাঁ অথবা না কিছুই বলল না। সন্ধ্যায় কেউ নেই বাড়িতে। শপিং গিয়েছে। শুধুমাত্র তার ভাবী আছে। সে হুট করে রুমে এসে বলে, 'নুজহাত ছাঁদে কাপড় আছে। একটু নিয়ে আয়।'

 নুজহাত আঁধার হাতড়ে ওঠে। ছাঁদে কোনো কাপড় নেই। কপাল কুঁচকে আরেকটু ভেতরে যায়। সেসময় পেছনে এসে ঠেকে অবয়ব৷ ঘাবড়ে যায় মেয়েটা। ছোটো করে চিৎকার করে। তোতলায়, 'কে, কে!

নুজহাতের কোমরে শক্তপোক্ত হাতটা এসে চেপেছে। চেপে রওশন ভারী গলায় বলে, 'নির্বোধ মেয়ে। তুমি আমাকে একমুহূর্ত শান্তি দাও না। তোমার জন্য আমাকে আর কতকিছু করতে হয়, এক আল্লাহ জানেন।'
.
.
.
সমাপ্ত..........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন