সূর্য ওঠে, আলো ফোটে, সকাল হয়। শুরু হয় পিউয়ের ব্যস্ততম জীবন। দশটা থেকে কলেজ,আর চারটা থেকে কোচিং। এরপরে আবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে প্রাইভেট টিউটরের এক গাদা পড়া। সামনে ধেঁয়ে আসছে এইচ- এস-সির তা*ন্ডব। ভালো রেজাল্ট চেয়ে বসে আছে সবাই। প্রত্যেকের এক কথা 'এ -প্লাস চাই পিউ'। কিন্তু এর পেছনের শ্রমটা যে দেয় সেই বোঝে! উচ্চ মাধ্যমিকে এ- প্লাস চাট্টিখানি কথা? তাও আবার বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে? পরীক্ষার কথা ভাবলেই পিউয়ের হাত পা ঠা*ন্ডা হয়ে আসে। তাদের সিকদার বাড়িতে জ্ঞাতিগুষ্টির মধ্যে সবথেকে ভালো রেজাল্ট ধূসরের। এমনকি কোনও ক্লাশে সেকেন্ড অবধি হয়নি সে। সবসময় ফার্স্ট! জেলা পর্যায়েও উঠে গেছিল ধূসরের নাম। সেই ধূসরকে জীবনে পাওয়ার স্বপ্ন দেখলে তার মতো হতে হবে না? রেজাল্ট টা তো একটু ভালো করা দরকার। গোল্ডেন না হোক, এ প্লাসটা অন্তত ঝুলিতে আয়ত্ত করতে হবে। বাকী সব গো*ল্লায় যাক! পরীক্ষার ফল খা*রাপ হলে কোন মুখে ধূসরের পাশে দাঁড়াবে সে? ইটস আ প্রেস্টিজ ইস্যু!
ধ্যানমগ্ন হয়ে আইসক্রিম খাচ্ছে পিউ। ভাবতে ভাবতে আইসস্ক্রিম গলে কব্জি অবধি এলে ঘোর কাটল তার। তাড়াহুড়ো করে মুছতে গিয়ে কিছুটা লেগে গেল ইউনিফর্মের হাতাতে। পিউয়ের মন খারাপ হলো। ঠোঁট ওল্টালো। চকলেট ফ্লেভারের কালো রং সাদার ওপর কী বিশ্রী লাগছে! মা দেখলে রক্ষে থাকবে আজ?
আজ একটু আগে আগেই এলো কলেজে। ক্লাশ শুরু হয়নি এখনও। এইত সবে ন'টা পঞ্চাশ বাজে। এত্ত সকাল,সাথে শীতের সময়,অথচ পিউয়ের অদ্ভূতুরে ইচ্ছে জাগল আইসক্রিম খাওয়ার। লাগুক তাতে ঠান্ডা, হোক সর্দি,বসে যাক গলা। তবুও পিউ খাবে। ইচ্ছেকে দ*মিয়ে রাখতে নেই।
এই আইসক্রিম খাওয়া যদি ধূসর বা সাদিফ দেখতো,দুঃ*খ ছিল কপালে। অবশ্য সাদিফ সুন্দর করে বলতো,সে কখনও পিউয়ের ওপর চোটপাট দেখায়নি। কিন্তু ধূসর? তেড়েমেরে এসে এক ঝটকায় কেড়ে নিত আইসক্রিম। তারপর এই রঙীন মিষ্টি বরফখন্ডটার জায়গা হতো রাস্তায়,কিংবা ডাস্টবিনে।
সঙ্গে বাজখাই ধমক খেয়ে গাল ফোলাতে হতো পিউকে। কী একটা অবস্থা! এরকম ধমক-সমক খেয়েও কী করে ওই মানুষটাকেই ভালোবাসলাম আমি?
পিউ নিজেকেই শুধালো। বরাবরের মত উত্তর এলো,
' অনুভূতি! অনূভূতি!"
পিউ লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল। গলে গলে পরা কোন আইসক্রিমটার প্রতি হঠাৎই কেমন বি*তৃষ্ণা এলো। খেতে ইচ্ছে না করায় পাশের ময়লার বিনে ফেলে দিলো। ভাল্লাগছেনা কিছু। কাল ধূসর তার টিচার পালটে ফেলার ঘোষণা দিয়েছে। বাবার কানে কথাটা এখনও যায়নি। গেলে কী হবে কে জানে! ছেলেটাকে তিনিই ঠিক করেছিলেন। পরিচিত তার, আদব-কায়দা ভালো। বছরের মাথায় ধূসর বদলে ফেলল যে,এটা শুনলে উনি রাগ করবেন না?
এমনিতে পিউয়ের খারাপ লাগছেনা। ধূসর তো তার ম*ন্দ চাইবেনা কোনও দিন। একথা ধূসর নিজে বললেও সে বিশ্বাস করবেনা। ধূসর যদি একটা গণ্ডমূর্খ কে ধরে এনেও বলে " নে আজ থেকে তুই এর কাছে পড়বি" পিউ তাতেও রাজি। শুধু চিন্তা একটাই, বাবার সঙ্গে ধূসর ভাইয়ের ঝা*মেলা না হয়। এদের ঝামেলার পাল্লা যত ভারি হবে,ধূসরকে পাওয়ার পথ সংকীর্ণ হবে তার। ভাবতেই পিউয়ের ছোট্ট হৃদয় কেঁপে ওঠে। কপাল বেঁয়ে ঘাম ছোটে।
পিউ ঢোক গিলে বাম হাত দিয়ে মুছে নেয় সে ঘামের ফোঁটা। ক্লাশের ঘন্টা পরেছে। সে হাঁটা ধরে সেদিকে। একই সময় পাশ দিয়ে রবিনকে ঢুকতে দেখে কপাল কোঁচকাল পিউ। আজ প্রায় এক সপ্তাহ পর কলেজে দেখল ওকে। গর্ত দিয়ে বের হলো কবে? পিউ সঙ্গে সঙ্গে ডেকে উঠল,
" এই রবিন!"
রবিন সাইকেল নিয়ে এসেছিল। ডাক শুনে পেছন ফিরে তাকাল। পিউকে দেখে থামিয়ে দিল গতি। পিউ একটু জলদি হেঁটে এসে দাঁড়াল ওর সামনে।
" কি রে, কবে ফিরলি তুই? "
" পরশু এসেছি। কাল ও তো এসেছিলাম কলেজে। তুই আসিসনি। "
পিউ মাথা দুলিয়ে বলল,
" হ্যাঁ, বাবা ফিরেছেন অনেকদিন পর। তাই আর কেউই...."
" কাল ধূসর ভাই এসেছিলেন কলেজে,জানিস?"
পিউ চকিতে তাকাল। অবাক হয়ে বলল,
" কী? কেন? তোকে কিছু বলেছে?"
রবিন দুপাশে মাথা নেড়ে বলল,
" জানিনা। একাই বাইক নিয়ে এলেন, নামলেন। ওনাকে দেখেই আমার রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেছিল। কোন দিক দিয়ে দৌড়ে, কোনদিকে পালাব বুঝে পেলাম না। আর ঠিক তখনি উনি আমাকেই ডেকে পাঠালেন। "
এটুকু শুনতেই পিউয়ের গলা শুকিয়ে গেল। অধৈর্য হয়ে বলল,
" তারপর, তারপর! "
রবিন চোখ বড় করে বলল,
" তারপর? তারপর আমি গেলাম,সালাম দিলাম। অথচ আমার গলা কাঁপছে। ধরেই নিয়েছিলাম, আজ নাকমুখ ফাটিয়ে ঘরে যাব। ভয়টা আরো তরতরিয়ে বাড়ল যখন ধূসর ভাই আমার কাঁধে হাত রাখলেন। আমি পারলে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। অথচ সেরকম কিছুই হলো না।
উনি বেশ ঠান্ডা কণ্ঠে বললেন,
" এদিক ওদিক মন না দিয়ে ভালো করে পড়াশুনা করো। কেমন? "
আমি ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়লাম। ব্যাস! এটুকু বলেই উনি চলে গেলেন। ভীষণ অবাক হয়েছি জানিস! তবে এখনও বুঝতে পারছি না, ওটা উপদেশ ছিল না কী হুমকি?"
রবিন থামল। চেহারায় ভীতির ছাপ এখনও আধো আধো। গতবছর স্বচক্ষে দেখেছিল ধূসরকে মারপিট করতে। তাও তাদের এলাকার গন্যমান্য এক ব্যক্তির ছেলেকে। সেই থেকেই ধূসরকে দেখলে আত্মা শুকিয়ে যায়। পিউয়ের সাথে শুরু থেকে সম্পর্ক ভালো ছিল। পিউ মিশতো, হাসতো, গল্প করতো। এত কাছাকাছি থেকে রবিনের কিশোর মন পরে গেল প্রেমে। ভেবেছিল পিউও একইরকম পছন্দ করে ওকে। সেই সাহস থেকেই প্রেমপত্র দিয়েছিল সেদিন। অথচ কী হলো? সেই মাশুল হিসেবে পরাণ হাতে নিয়ে ছোটাছুটি করছে। রবিন কষ্ট নিয়ে শ্বাস টানল। পিউ তখন গভীর চিন্তায়। প্রথম দিন ধূসরের হম্বিতম্বির সঙ্গে আজকের এই ঘটনার মিল পেল না। এত সহজে, এত অল্প কথায় ধূসর মিটিয়ে নিলো বিষয়টা?
রবিন বলল,
" আমি একটা প্রতিজ্ঞা করেছি বুঝলি।"
পিউ ধ্যান ভেঙে তাকায়। কালো মুখে ছোট করে শুধায়,
" কী?"
" লাইন মারার আগে চেক করে নেব মেয়ের বড় ভাই টাই আছে না কী! যদি ধূসর ভাইয়ের মত ডেঞ্জারাস বড় ভাই থাকে তবে নেটওয়ার্ক সেখানেই কাট। "
পিউয়ের সবে সবে হওয়া মন খারাপটা এক ধাপ বাড়িয়ে দিল রবিন। ইহজগতে তার সবথেকে বিশ্রী লাগা শব্দটাকে ব্যবহার করে বিগড়ে দিল মেজাজ। নাকচোখ কুঁচকে তাকাল পিউ। ক্ষেপে টেপে একাকার হয়ে বলল,
" খবরদার রবিন! ধূসর ভাইকে আমার ভাই বলবি না একদম, খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু। "
পিউয়ের হঠাৎই চেঁতে যাওয়ায় ভড়কাল রবিন। ভীষণ অবাক হয়ে বলল,
" ওমা কেন? ধূসর ভাই তো তোর ভা...
পরেরটুকু উচ্চারন করার আগেই ওর কাঁধে শক্তপোক্ত চড় বসাল পিউ। ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকাল রবিন। পিউ ফুঁসে উঠে বলল,
" উনি আমার ভাই নন। চাচাতো ভাই আর আপন ভাই এক নয় বুঝেছিস? "
রবিনের হকচকানোর মাত্রা কাটেনি তখনও। ঘাড় ডলতে ডলতে বোঁকার মত মাথা নাড়ল। অর্থাৎ বুঝেছে সে। পিউ বুকের সাথে দুহাত বেঁধে চটপটে কণ্ঠে বলল,
" আপন ভাই মানে আপন ভাই। চাচাতো ভাইয়ের সাথে বিয়ের চান্স থাকে, আপন ভাইয়ের সাথে কী থাকে?"
রবিন দুইগালে দুটো চড় মেরে জ্বিভ কেটে বলল,
" আসতাগফিরুল্লাহ! না না থাকে না।"
পিউ আঙুল উঁচিয়ে বলল,
" তাহলে আর বলবি উনি আমার ভাই?"
রবিন দুপাশে মাথা নাড়তে গিয়েও থমকাল। সতর্ক চোখে চেয়ে বলল,
" এক মিনিট, তুই কি ধূসর ভাইকে বিয়ে করবি পিউ?"
পিউ নেত্র সরু করে বলল,
" কেন? তোর আপত্তি আছে? দাওয়াত পেতে চাস না?"
রবিন দুঃখী দুঃখী মুখ করে বলল
" এটা কি ঠিক করলি? বাবা হতে চেয়েছি বলে মামা বানিয়ে দিবি?"
পিউ নাক ফোলাল।
" আরেকটা থাপ্পড় খাবি ? "
এর মধ্যেই দ্বিতীয় ঘন্টা পরল ক্লাশের। কথা অসম্পূর্ণ রেখেই দুজন ছুট লাগাল সেদিকে।
_______
বিকেলের দিকে বাড়ি ফিরল পিউ। ক্লান্ত সে এক পা এক পা করে সিড়ি বেয়ে উঠল। ঘরে ফিরতে যাবে তখনি কিছু কথায় কদম থামল সেখানেই। পিউ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। মনোযোগ দিল কথার উৎসের দিকে। ধূসরের বাবা মায়ের গলার স্বর আসছে কানে। কন্ঠ চেপে চেপে কথা বলছেন দুজন। পিউয়ের আগ্রহ জাগল। প্রতিবার ধূসরের নাম শুনতে পেয়েই পা বাড়াল সেদিকে। দরজার বাইরে দাঁড়াল এসে। একবার মনে হলো, আড়ি পেতে কথা শোনা ঠিক হবেনা। পরেরবার ধূসরের কথা ভেবে সটান দাঁড়িয়ে রইল। মন,কান দুটোই সজাগ রাখল। দরজা চাপানো। হাল্কা ফাঁকা থেকেই স্পষ্ট কথা শোনা যাচ্ছে। আফতাব সিকদারের কণ্ঠই এলো প্রথমে। তিনি ভীষণ আক্ষেপ নিয়ে বলছেন,
" হবে না, হবে না। তোমার এসব কথার কোনও যুক্তিই নেই। "
রুবায়দা বেগম নিচু কন্ঠে বললেন,
" কেন হবে না? হওয়ালেই হবে। তুমি চেষ্টা তো করে দ্যাখো।"
" কী করে হবে? কোন বাবা মেয়ে দেবে তোমার ছেলেকে? মাথা ঠিক থাকলে বেকার ছেলেকে কেউ মেয়ে দেয় না, বুঝলে! "
" আহ! বেকার কোথায়? রাজনীতি করছে, নিজের খরচা নিজে চালাচ্ছে তাহলে? "
" রাজনীতি? রাজনীতির পাশাপাশি আর কোনও কাজের দরকার নেই? আছে তো না কি! বাড়ি শুদ্ধ সবাই বলে বেড়াচ্ছে,ব্যাবসায় জয়েন হতে, শুনছে? পারিবারিক ব্যাবসা, আমাদের পর আর কে হাল ধরবে এর? সাদিফ নিজের ইচ্ছেমতো প্রফেশন বেছে নিয়েছে। ওর টা তাও মানা যায়, সন্মানের কাজ। কিন্তু তোমার ছেলে? মারপিট করে বেড়ায় রাস্তায়, পথে ঘাটে স্লোগান দেয়, মিছিলে নামে। একটা কথা কানে তোলেনা আমার। সব সময় গা ঝাড়া হাবভাব। আমিতো এখন আর কিছু বলাই ছেড়ে দিয়েছি। শুধু তটস্থ থাকতে হয় এই বুঝি তোমার ছেলে একটা কান্ড ঘটাল, আর ভাইয়েরা সব হামলে পরল আমার ওপর। আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না, আমার মত এরকম মানুষ যার নামে কোনও দিন কেউ বলতে পারে না একটা ঝামেলায় জড়িয়েছি, কারো সাথে ঝগড়ায় নেমেছি, সেই মানুষের ছেলে এতটা বেপরোয়া কি করে হলো? কার ছেলে ও?"
কথায় কথায় কথাটা বললেও মাথায় বাজ পরল রুবায়দা বেগমের। সাংঘাতিক রকম তেঁতে বললেন,
" কী বললে তুমি? তুমি শেষমেষ আমায় নিয়ে সন্দেহ করছ?"
আফতাব সিকদার নির্বোধ বনে তাকালেন। আকাশ থেকে পরে বললেন,
" তা কখন বললাম? পাগল হলে?"
" এইতো একটু আগেই বলেছো। কার ছেলে ও বলোনি? কী বোঝায় এ দিয়ে?"
আফতাব সিকদার মাথায় হাত দিয়ে বললেন,
" ইয়া আল্লাহ! এই মা ছেলের যন্ত্রনায় আমার নির্ঘাত অ্যাটাক ফ্যাটাক হয়ে যাবে।"
রুবায়দা বেগম কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বললেন,
" হ্যাঁ সেতো বলবেই, বিয়ের পর থেকে সেবা শুশ্রূষা করে করে এখন বদনামের ভাগিদার হচ্ছি। সাথে টানছো আমার নিষ্পাপ ছেলেটাকেও।"
পিউ মুখ ভেঙচালো। ধূসরের পাশে নিষ্পাপ শব্দটা শুনে অতিষ্ঠ ভঙিতে দুপাশে মাথা দোলালো। এ ছেলে নিষ্পাপ হলে সে তো দুধের শিশু!
রুবায়দা বেগম ফের বললেন,
" থাক,এখন তোমার সাথে এসব আজেবাজে আলোচনা করার মত সময় নেই আমার। যা বলেছি পারলে কথাটা শোনো, ধূসরের বিয়ে দেয়ার চিন্তা ভাবনা করো। দেখবে, ঘরে বউ এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরবে আমার।"
পিউ আঁ*তকে উঠল কথাটায়৷ ধূসরের বিয়ে দেবে মানে? ঘরে বউ আনবে তারই বা অর্থ কী?
"ধূসর ভাইকে অন্য কোথাও বিয়ে দেবেন চাচা-চাচী? নাআয়ায়ায়ায়া এ হতে পারে না। এ খবর শোনার আগে আমার মরন কেন হলো না?"
দরজার বাইরে দাঁড়িয়েই পিউ মনে মনে আহাজারি শুরু করল। তার ইচ্ছে হলো চাপানো দরজা ঠেলে এক্ষুনি কক্ষে ঢুকে যেতে। মেজো মা কে কঠিন কণ্ঠে হুশিয়ার করতে,
" কোনও বিয়ে টিয়ে হবে না। তোমার ছেলের বউ হব আমি, বুঝেছ? আগে ধূসর ভাই আমার প্রেমে পড়ুক, তারপর এসব ভেবো। এখন রেহাই দাও মেজো মা।"
কিন্তু আফসোস! পারল না পিউ। তবে দুঃখে অধর কেঁপে কেঁপে উঠল। যেন এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে মেয়েটা। উত্তরে আফতাব সিকদার বললেন,
" মাথা খারাপ হয়েছে তোমার? পুষ্পর কথা ভুলে গেছো? বাড়ির বড় মেয়ে ও। ছোট বোনের বিয়ে না দিয়ে ধূসর আগে ভাগে বিয়ে করবে কী করে? আগে তো ওর বিয়ে দিতে হবে না কী!"
কথাটা মাথায় ঢুকল রুবায়দা বেগমের। বোঝার ভঙিতে মাথা নাড়লেন তিনি। বিড়বিড় করে বললেন,
" তাই তো! আমার তো মনেই ছিল না। তাহলে বরং আগে পুষ্পর জন্যে ছেলে দেখব আমরা তারপর ধূসরের বিয়ে। কী বলো? "
ওপাশ থেকে আর উত্তর এলো না। হয়ত আফতাব সিকদার সহমত দিলেন। কিন্তু পিউয়ের কান্না কান্না ভাব উবে গেল তৎক্ষনাৎ। তটস্থ হলো সে। আগে পুষ্পর বিয়ে? আপুর বিয়ের পর ধূসর ভাইয়ের বিয়ে? কী সর্বনাশা কথাবার্তা!
পিউ তড়িঘড়ি করে রুমে ছুটল। কাধ থেকে ব্যাগ নামিয়েই এরপরে ছুট লাগাল মা-বাবার ঘরের দিকে। সব ক্লান্তি, অবসাদ কর্পূরের মত মিলিয়ে গেছে তার। এনার্জি প্যাক যেন গায়ে ঢেলে দিয়েছে কেউ। বৃহস্পতিবার হওয়ায় আজ আমজাদ সিকদার ও আফতাব সিকদার দুজনেই বাড়িতে। হাফ বেলায় অফিস থেকে ফেরেন তারা। পিউ কলেজ ইউনিফর্ম গায়ে পরেই এক দৌড়ে ঢুকে গেল মায়ের ঘরে। পায়ের ধুপধাপ শব্দ পেয়ে চোখ থেকে আড়াআড়ি রাখা হাতটা সরালেন আমজাদ। মেয়েকে দেখে কপাল গুছিয়ে উঠে বসলেন। এটুকুতেই উত্তেজনায় হাপিয়ে গেছে পিউ। আমজাদ সাহেব অবাক হয়ে বললেন
" কী ব্যাপার আম্মা? এই অবস্থা কেন আপনার? "
পিউ কতক্ষন জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলল। পরপর উদ্বেগ নিয়ে বলল,
" আব্বু, আপুর বিয়ে দেবে কবে?"
আচমকা প্রশ্নে কিছুটা হতভম্ব হলেন আমজাদ। ভ্রুঁ গুটিয়ে চেয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। পিউ এগিয়ে এলো। বাবার পাশে বসে বলল,
" আপু তো সবে অনার্সে উঠেছে, ওকে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়া কী উচিত আব্বু?
আমজাদ সাহেব কিছুতেই কিছু বুঝলেন না। অবুঝের মত বললেন,
" পুষ্পর বিয়ে? এসব তোমাকে কে বলল আম্মা?"
পিউ জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাল।
" আমি শুনেছি। মা, মেজো মা এরা সবাই বলাবলি করছিল আপুর জন্যে ছেলে খুঁজবে। তুমি এত জলদি ওর বিয়ে দেবে আব্বু? এটা কি ঠিক হবে? লোকে বলবে তুমি বাল্যবিবাহ দিয়েছো।"
আমজাদ সিকদার রাগী মানুষ। কিন্তু মেয়ের কথায় হেসে ফেললেন। মাথায় হাত বুলিয়ে নরম স্বরে বললেন,
" বোকা মেয়ে! বললেই কি হয় না কী? আগে পুষ্পর পড়াশুনা শেষ হোক, ও কতদূর পড়তে চায় শুনি তারপর ওসব ভাবব। অনেক দেরি এখনও। "
পিউয়ের ভেতরটা গদগদ হয়ে এলো আনন্দে। উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
" সত্যি বলছো? "
আমজাদ সাহেব মৃদূ হেসে বললেন " হ্যাঁ। আর বড়দের এসব বিষয় নিয়ে তুমি অত ভাবতে যেও না। পড়াশুনায় মনোযোগ দাও। ভালো রেজাল্ট করতে হবে না? এখনও ফ্রেশ হওনি দেখছি, যাও হাত মুখ ধুয়ে খেতে যাও আম্মা। "
পিউ মাথা দোলাল। বাবার মুখের কথায় আস্বস্ত সে। তার বাবা এক কথার মানুষ। এখনি পুষ্পকে বিয়ে দেবেন না যখন বলেছেন তখন দেবেন না নিশ্চয়ই। আপুর বিয়ের দেরি আছে মানে, ধূসরের আরো দেরি। ততদিনে সে কি পারবে না, ধূসরকে নিজের প্রেমে ফেলতে? নিশ্চয়ই পারবে। পিউ ভরসা পেল। হাসি হাসি মুখটা ফিরে এলো আবার। ঝটপট ঘর ছাড়ল। আমজাদ সিকদার মেয়ের যাওয়ার দিক চেয়ে রইলেন। একটা পূত্রসন্তানের ভীষণ শখ ছিল তার। পিউয়ের হওয়ার সময় ধরেই নিয়েছিলেন ছেলে হবে এবার। মেয়ে হয়েছে শুনে ক্ষুন্ন হয়েছিলেন খানিক। মন খারাপ করেছিলেন। কিন্তু যেই মুহুর্তে মেয়ের মুখখানি দেখলেন, মনে হলো তার মা স্বয়ং ফিরে এলেন যেন। গোলগাল, ফর্সা, ছোট্ট মুখটা অবিকল তার মায়ের প্রতিচ্ছবি। এরপর আর কোনও মনঃক্ষুন্নতা টিকলো না। মেয়ের রুপে মাকেই জাপ্টে ধরলেন বুকে। তিনি প্রচন্ড মেজাজি মানুষ, পুষ্প জোরে হাঁটলেই যেখানে রাগ দেখান, সেখানে পিউয়ের বেলায় যেন মোমের মত গলে যান। মেয়েটাকে দেখলেই মনে পড়ে মায়ের কথা। তাইতো ইচ্ছেই করে না ওকে বকাঝকা করার। পরপর গুটিবসন্তে মায়ের ছটফটিয়ে মৃত্যুর কথা মনে পড়তেই আমজাদ সাহেবের চোখে জল জমল। কোটর ছড়ানোর আগেই হাতের আঙুল দিয়ে মুছে নিলেন তিনি।
______
পিউয়ের মন একটু আধটু খারাপ। ভাতের থালায় হাত চললেও মুখে যাচ্ছে না। আকাশ-কুসুম ভাবনায় মত্ত সে। অন্য হাত গালে ঠেকিয়ে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে। এই যে একটু আগে বাবার কাছে গিয়ে বোনের বিয়ে আটকাল এটা একটু স্বার্থপরতা হয়ে গেল না? যদি না পেছনে ধূসরের বিয়ের কথা উঠতো তবে কী এত লাফিয়ে-চড়িয়ে যেত বাবার কাছে? উলটে বোনের বিয়ের আনন্দে হৈহৈ করে মেতে উঠত। কসমেটিকস, লেহেঙ্গায় ভরে ফেলতো ঘর। পিউ মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ফেলল।
প্রেমে পড়ে ছ্যাচড়ার সাথে সাথে স্বার্থপর ও হয়ে যাচ্ছে সে। ঠিক তখনি পিঠের ওপর চড় বসালেন মিনা বেগম। ব্যাথার সঙ্গে ভয়ে মুচড়ে উঠল পিউ। বিস্মিত হয়ে মায়ের দিক তাকাল।
" খেতে বসেছিস কখন? তাড়াতাড়ি খা, আজ ধূসরের বন্ধু আসবে না তোকে পড়াতে?"
" আজ কেন মা? একবারে শনিবার থেকে আসতো।"
মিনা বেগম চোখ পাকালেন,
" চুপ কর! ধূসর বলে গেছে, আজ থেকেই পড়াবে।"
পিউ বীতঃস্পৃহায় খাবার মুখে তুলল। কোনও রকমে খেয়েদেয়ে উঠে দাঁড়াতেই রিক্ত এসে আগলে ধরল হাত। মুখে বেজে পরা আধো বুলিতে আবদার করল,
" পিপু, চলো না কেলি? "
পিউ ক্লান্ত কণ্ঠে বলল,
" এখন না সোনা, স্যার গেলে তারপর। তুমি রাদিফের সাথে খেলো এখন।"
রিক্ত দুদিকে দুবার জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল,
" ও কেলবে না। মারে আমাকে।"
" আমি বলে দেব, যেন না মারে। কেমন? "
রিক্তর ছোটখাটো চেহারাটা চকচকে হলো। আনন্দে মস্তক ঝাকিয়ে সেভাবেই চলে গেল। পিউ বেসিনে গিয়ে হাত ধুঁয়ে পা বাড়াল কামড়ায়। বিছানায় শুতেও পারল না এর মধ্যেই মিনা বেগম ডাক ছুড়লেন,
" পিউ তোর টিচার এসছে।"
মারাত্মক রকম বিরক্ত হলো মেয়েটা। মুখ থেকে 'চ' বর্গীয় শব্দ করে উঠে দাঁড়াল। ব্যাগ থেকে বইপত্র বার করল। এলোমেলো চুল আয়নার সামনে গিয়ে ঠিকঠাক করল। গতদিন ফয়সাল দারুন লজ্জ্বা দিয়েছে এ নিয়ে। গায়ে ওড়না পেঁচিয়ে পিউ আস্তেধীরে হাঁটা ধরল স্টাডিরুমের দিকে। ভেতর থেকে আসছে মা আর মেজো মায়ের কন্ঠস্বর। ভীষণ তোষামোদ করে কথা বলছেন তারা। যেন টিচার নয়, পাত্রপক্ষ এসছে। পিউ দরজায় দাঁড়াল। ভদ্রতার খাতিরে ভেতরে ঢোকার জন্যে শিক্ষকের অনুমতি চাইতে হবে তো! কথা বলতে গিয়ে সামনে তাকিয়েই মূর্তির ন্যায় জমে গেল।
সম্মুখে এক সুন্দরী, কম বয়সী মেয়ে দেখে পিউয়ের মাথা ঘুরে উঠল। গোল্লায় গেল ভদ্রতা, অনুমতি। ত্রস্ত পায়ে কক্ষে ঢুকল সে। সরাসরি কোমড়ে হাত দিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল।
" আপনি কে?"
মেয়েটি রুবায়দা বেগমের সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত ছিল। পিউয়ের কথায় তাকাল ওর দিকে। মিষ্টি হেসে বলল,
" আমি মারিয়া। তুমি পিউ?"
" হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কেন এসেছেন?"
মিনা বেগম বললেন,
" ওকি কথা? কেন এসেছে মানে কী, উনিইতো পড়াবেন তোকে।"
পিউ অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে বলল,
" আপনিই কি ধূসর ভাইয়ের বন্ধু? উনিই আপনাকে পাঠিয়েছেন?"
পিউয়ের সিরিয়াস হাবভাব মেয়েটিকে অপ্রস্তুত করল খানিক। বিভ্রান্ত হয়ে আশেপাশের সবাইকে দেখে মাথা নেড়ে বলল " হহ্যাঁ। "
ধূসরের পাঠানো মানুষটা যে মেয়ে, এটা ভাবতেই পিউয়ের মাথায় আকাশ ভেঙে পরল। ব্রহ্মতালু অবধি দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। সে দিন দুনিয়া ভুলে বসল। ধপ করে বসে পরল ফ্লোরে। ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল। হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
" আমি ওনার কাছে পড়ব না। আমি ওনার কাছে পড়ব না।"
____
পিউয়ের বাচ্চামোতে উপস্থিত সবাই হতভম্ব, হতচেতন। বলার জন্যে মুখের কাছে কোনও ভাষাই পেল না। সতের শেষ করে দুদিন বাদেই আঠের তে যে মেয়ে পা দেবে তার এমন ছেলেমানুষী দেখে মিনা বেগমে লজ্জ্বায় মুখ লোকানোর জায়গা পেলেন না। পড়াতে আসা মেয়েটির সামনে মাথা হেট করে দিল নিজেরই পেটের মেয়ে। মারিয়া নিজেও ভীমড়ি খেয়েছে। সে বিভ্রম নিয়ে বার কয়েকবার নিজের চেহারায় হাত বোলালো। মেয়েটা তাকে দেখতেই এমন করল কেন? গোবর লেপ্টানো থাকলেও এরকম করে কেউ? সে কী দেখতে এতটাই বাজে? এদিকে পিউ তখনও মেঝেতে বসে কাঁদছে। কান্নার শব্দ পৌঁছে গেল বাড়ির কানায় কানায়। এমন আর্তনাদ করে কান্না, যেন কী না কী ঘটেছে! আমজাদ সাহেব ঘুমিয়েছিলেন একটু। ঘুমের মধ্যে মেয়ের কান্নার শব্দ পেতেই লাফিয়ে উঠলেন। উৎস ধরে ছুটে এলেন ত্রস্ত। পড়ার ঘরটা নিমিষে ভরে গেল মানুষে। আফতাব সিকদার বই পড়ছিলেন বারান্দায়। সেও হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছেন।
পিউয়ের কান্না থামার নাম নেই। রুবায়দা বেগম গায়ে মাথায় হাত বোলাচ্ছেন। জবা বেগম বিভিন্ন খাবারের প্রস্তাব দিচ্ছেন ' এটা রান্না করে খাওয়াব,ওটা খাওয়াব' তাও মেয়েটা থামলো না। তার হেচকি উঠল এবার। ধূসরের এত সুন্দর মেয়ে বন্ধু আছে, কিছুতেই মানতে পারছে না পিউ। এই জন্যেই ধূসর তার দিকে ফিরেও তাকায় না, এবার বুঝল সে। এই দুঃখে কেঁদে বুক ভাসালেও কম হবে।
এদিকে কেউই বুঝতে পারছে না হঠাৎ মেয়েটার হলো কী। আমজাদ সাহেব এসেই উদ্বীগ্ন গলায় শুধালেন,
" কী হয়েছে? ও কাঁদছে কেন? "
পার্লামেন্টে মিটিং বসেছে। খুব জরুরি আলোচনা হবে সেখানে। অথচ ফোন পেয়েই বাড়ির পথে রওনা হলো ধূসর। পিউয়ের প্রতি রাগে শরীরের রক্ত ফুটছে তার। একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে পুচকিটার। বোঝে কম, চিল্লায় বেশি। রাগের সাথে তাল মিলিয়ে বাইকের স্পিড বাড়াল ধূসর।
বিশ মিনিটের মাথায় বাড়ি পৌঁছাল। বসার ঘরেই বসেছিল মারিয়া। মেয়েটা যে কী পরিমান অস্বস্তিতে পরেছে মিনা বেগম ঢের বুঝলেন। তাইতো ও ঘর থেকে সুমনা বেগমের সাথে পাঠিয়ে দিলেন এখানে। বাটি ভরে খেতে দিলেন দুধে ভেজানো পিঠা। ধূসর লম্বা কদমে বাড়িতে ঢুকল। সুমনা বেগমকে শুধাল,
" পিউ কোথায় ছোট মা?"
ওপর থেকে ধূসরকে দেখেই দৌড়ে পিউয়ের কাছে গেল পুষ্প। তাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে চেয়ার টেবিলে বসাতে পেরেছেন রুবাইদা বেগম। কিন্তু নাকে কান্না কমেনি। পুষ্প বাইরে দাঁড়িয়েই ঘোষণা দিল,
" ধূসর ভাইয়া এসেছেন,এবার মজা বোঝাবেন তোকে।"
ব্যাস! পিউয়ের হেচকি বন্ধ। কান্নাকাটি শেষ। চোখ দুটো মারবেলের মতন করে তাকাল বোনের দিকে। পরপর রুবাইদা বেগমের পানে। রুবাইদা বেগম বলতে নিলেন " কিছু হবে না আমি___
কে শোনে পুরো কথা। পিউ তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। এক ছুট্টে গিয়েই পুষ্পর মুখের ওপর দরজাটা ধড়াম করে লাগিয়ে দিলো। এই মুহুর্তে দরজা আটকানো মানে জীবন বাঁচানো।
.
.
.
চলবে.........................................................................