আজ অফ ডে। বাড়ির মেইডও ছুটিতে আছে দু'দিন ধরে। হুট করেই বলা-কওয়া ছাড়া উদয় হৃদের ফ্ল্যাটে চলে এলো। হৃদ এতে মোটেও অবাক হলো না। ডিএমসিতে উদয়ের পড়ার এবং হৃদের পড়ানোর সুবাদে প্রতিদিনই দেখা হয়। উদয় মেডিকেলের হলেই থাকে। এজন্য মাঝে মাঝেই ভাইয়ের সাথে দেখা করতে চলে আসে। তবে থাকে না, হৃদ থাকতেও বলে না।
উদয় ভিন্নধর্মী মানুষ। সে পড়ালেখার পাশাপাশি জীবনটা সমানতালে উপভোগ করে যাচ্ছে। যেটা এখানে, ভাইয়ের সাথে থাকলে পারত না। তার উপর তার ভাই হচ্ছে রোবট। উপভোগ এর ‘উ’-ও জানে না।
সোফায় বসে বসে ইভের সাথে খেলছে উদয়। কিছুক্ষণ আগেই দুই ভাই মিলে সকালের নাশতা সেরেছে।
পাশ থেকে বাজখাঁই আওয়াজে হৃদের ফোন বেজে ওঠায় উদয় বিরক্ত হলো। ভেবেছে হয়তো মেডিকেল থেকে কল এসেছে এবং এই ছুটির দিনেও হৃদকে যেতে হবে। তবে ইমার্জেন্সি হলে তো যেতেই হবে।
ফোন হাতে নিয়ে হৃদকে ডাকল, “ভাইয়া...”
হৃদ সাড়া দিল না। উদয় ফোনটা নিয়ে হৃদের রুমে চলে গেল। ওয়াশরুম থেকে আওয়াজ আসছে বিধায় উদয় বুঝে গেল তার ভাই শাওয়ার নিচ্ছে। এদিকে বার বার ফোন বেজেই চলেছে। নম্বর সেভ করা ‘সন্ধ্যা’ দিয়ে। উদয় বুঝল, এটা কে। সে অনেকটাই জানে।
রিসিভ করা উচিত হবে না ভেবেও রিসিভ করল। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মেয়েলী কন্ঠে ভেসে এলো, “আই মিস ইউ সো মাচ!”
উদয় কেশে উঠল। তার ভাই এই পর্যায়ের আমিষ কবে হলো? ভেবে পেল না। পাশ থেকে পানির গ্লাসটা এক চুমুকে শেষ করে বলল, “আসসালামু ওয়ালাইকুম, ভাবি।”
ওপাশে সাঁঝ জিভে কামড় দিল। জোরপূর্বক হেসে সালামের জবাব দিয়ে বলল, “স্যরি, আপনার ভাই বলেননি আমাকে যে আপনি এসেছেন।”
“ভাইয়াও জানত না। কিছুক্ষণ আগেই এসেছি।”
“ও আচ্ছা! কেমন আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ। তুমি?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।”
“আমি তো শুরুতেই বুঝে গেছিলাম তোমাদের কাহিনি।”
“আপনার ভাই বলেছিলেন নিশ্চয়ই?”
“একদম না। তোমাদের দেখলেই বোঝা যেত।”
“কীভাবে?”
“অনেক ভাবেই। সেসব পরে বলব। আগে এটা বলো তো! এই নিরামিষকে আমিষ বানালে কী করে?”
উদয়ের কথা শুনে সাঁঝ উচ্চশব্দে হেসে উঠল। হাসি থামাতেই পারছে না। কোনো মতে কমিয়ে বলল, “আপনার ভাই, আর নিরামিষ!”
আবারও হেসে দিল। উদয় হাসির কারণ বুঝল না। বলল, “হ্যাঁ তো! কীভাবে বানালে, বলো।”
“আমি কিছু বানাইনি। আপনার ভাই তো মিচকে শয়তান। সামনে ঝগড়া করতেন, আর লুকিয়ে লুকিয়ে পটানোর চেষ্টা করতেন। ভাবা যায়! কী চালু!”
“তারপর?”
“বাবারে! কী গালিটাই না দিতাম! এও বলেছি, তার বিয়ে হবে না। হলেও বউ টিকবে না।”
“ইন্টারেস্টিং ব্যাপার স্যাপার তো!”
“কীসের ইন্টারেস্টিং কাহিনি হচ্ছে?”
পেছন থেকে হৃদ একথা বলে উঠল। উদয় নিজের হাতের ফোনটা হৃদকে দিয়েই বলল, “ভাবি কল দিয়েছে, কথা বল।”
উদয় সাথে সাথে প্রস্থান ঘটাল। হৃদ ফোন কানে তুলতেই সাঁঝ বলল, “মিস করছি ভীষণ!”
হৃদ আলতো হাসল। কয়েকটা দিন কেটে গেছে। সাঁঝ এখন ভীষণ স্বাভাবিক হৃদের সাথে। গভীর রাত পর্যন্ত কথা হয়। সাঁঝ এখনও সাহস করে তার প্রথম রিলেশনের ব্যাপারে কিছু বলতে পারেনি। তার ভয় হয়, যদি হৃদের ভালোবাসা কমে যায়।
হৃদ মুচকি মুচকি হেসে বলল, “দেখা করবে?”
“ঘুরতে যাব।”
“কোথায়?”
“আপনার মনের আঙ্গিনায়।”
“দারুণ কথা শিখেছ।”
“হু, আপনিই তো শেখালেন। ভালোবাসা শেখালেন আমায়।”
হৃদ আবারও হাসল। কখনও ভাবেনি সাঁঝও তাকে এত ভালোবাসবে। এখন এই মেয়েটাকে তার চাই-ই চাই। ভালো থাকার জন্য হলেও চায়।
______________
দুদিন পার হলো। ক্যাম্পাসে এসেই উপমা ও সাঁঝ নিজ নিজ ক্লাসরুমে চলে গেল। ডিপার্টমেন্ট ভিন্ন দুজনেরই।
সাঁঝ ভার্সিটির প্রথম দিনই দুইটা ফ্রেন্ড বানিয়ে নিয়েছিল। আয়াত ও প্রণব। আয়াত মেয়েটা ভীষণ চঞ্চল। কথার ছলে জানতে পেরেছিল, সে চট্টগ্রামের বাসিন্দা। এদিকে প্রণবও উচ্ছল প্রকৃতির একজন ছেলে।
ক্লাসরুমে ঢুকতেই আয়াত এগিয়ে এসে বলল, “দেরি করলি কেন?”
সাঁঝ ভ্রু কুঁচকে বলল, “কোথায় দেরি করলাম? এখনও তো ক্লাস শুরুই হয়নি।”
“শুরু হতে আর বাকি কই? ভেবেছিলাম ক্যাম্পাস ঘুরব!”
“ঘুরবি না কী করবি, কাকে খুঁজবি, জানা আছে। এরপর তো ব্রেক আছে, তখন যাব। আচ্ছা, প্রণব কই?”
“আসেনি আজ।”
“আসবে না?”
“না। কল দিয়েছিলাম। বলল, ওর ফুপি অসুস্থ। তাকে দেখতে যাবে। এজন্য আসতে পারবে না।”
“ওহ্ আচ্ছা।”
ভারি মিশুক মেয়েটা। দুজনে একে অপরের সাথে এমন ভাবে মিশে গেছে, যেন তারা অনেক বছর ধরে একে অপরকে চেনে। এর মধ্যে সাঁঝ জেনেছে, আয়াত ভার্সিটির কোনো এক স্টুডেন্টের উপর ক্রাশ খেয়ে বসে আছে, কিন্তু নামটা জানে না। এও জানে না, সে কোন ডিপার্টমেন্টের, কোন ইয়ারের।
ক্লাস শেষে সাঁঝ ও আয়াত গিয়ে ক্যাফেটেরিয়ায় বসল। এক ঘণ্টার ব্রেক আছে। সকালে উঠতে দেরি করায়, খেয়ে আসেনি। খাবার অর্ডার দিয়ে গিয়ে শেষের দিকের একটা টেবিলে বসল তারা দু'জন। কিছুক্ষণ বাদে খাবার আসল। খেতে খেতে মনে পড়ল হৃদের কথা। আর কিছু না ভেবে কল দিল। পাশে আয়াত বসে খাচ্ছে আর নিউজফিড স্ক্রল করছে।
হৃদ কল রিসিভ করতেই সাঁঝ বলল, “কী করছেন?”
“এইতো, চেম্বারে বসে আছি।”
“এতক্ষণ কী করলেন?”
“ক্লাস করিয়ে এলাম।”
“ওহ্! শুনুন, মেয়েদের থেকে দূরে দূরে থাকবেন। মেডিকেলের মেয়েগুলো খুবই ধুরন্ধর হয়, তাদের দিকে তাকাবেন না। আর নার্সদের বলবেন, যেন আপনার থেকে কয়েক ফিট দূরে থাকে। বেশি কথা বলবেন না তাদের সাথে।”
“আচ্ছা।”
“১৬-৩০ বছরের কোনো মেয়ে পেশেন্ট দেখবেন না।”
হৃদ হেসে হেসে বলল, “তারা অসুস্থ থাকলেও না?”
“অন্য ডাক্তারের কাছে পাঠাবেন। তবুও আপনি দেখবেন না।”
“অন্য ডাক্তার ব্যস্ত থাকলে?”
“আপনি কি দেখতেই চান তাদের?”
হৃদ হাসতে থাকল। সাঁঝ রাগী কন্ঠে বলল, “সাবধান করে দিচ্ছি। একদম না।”
“আচ্ছা, মহারাণী। যা হুকুম করবেন।”
“গুড বয়।”
খাবার চিবাতে চিবাতে কথা বলছে সাঁঝ। হৃদ জিজ্ঞেস করল, “খেয়ে এসেছ?”
“হ্যাঁ।”
“রুটি?”
“হ্যাঁ।”
“মিথ্যে বলছ?”
“হ্যাঁ। এই না!”
“দ্যাখো সাঁঝ, তোমাকে বারবার বলেছি, সকালে না খেয়ে বেরোবে না; তাও শোনো না কেন?”
“আসলে, উঠতে দেরি হয়েছিল?”
“কেন? রাতে কী করেছ? চুরি করতে গিয়েছিলে?”
সাঁঝ মিহি কন্ঠে বলল, “তা যাইনি, তবে দোষ আপনার।”
“আমি কী করেছি?”
“একটা অবধি জাগিয়ে রেখেছেন।”
হৃদ বুঝতে পারল। হালকা কেশে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “এইটাই লাস্ট। কাল থেকে ভোরে উঠে নামাজ পড়বে। রাতে কথা বলতে হবে না।”
সাঁঝ চুপ থেকে বলল, “উঠব, কিন্তু কথাও বলব।”
“এই না বললে, কথা বলার জন্য সকালে উঠতে পারো না।”
“আর বলব না।”
হৃদের সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বলল। আয়াতকে এসব প্রথম দিনই বলেছে সাঁঝ। এজন্য কিছু বলল না। চুপচাপ নিজ ভঙ্গিতে খেয়ে যাচ্ছে আর ফেসবুকিং করছে।
বেশ কিছুটা সময় বাদে হৃদ বলল, “একটা সার্জারি করতে হবে এখন। পরে কথা বলব। আল্লাহ হাফেজ।”
“আল্লাহ হাফেজ।”
“শোনো, শ্যামমোহিনী!”
“হু, বলুন।”
“এই শ্যামাকে ভালোবাসি।”
সঙ্গে সঙ্গে কল কেটে দিল। সাঁঝ তুমুল বেগে কেশে উঠল। খাবার গিয়ে শ্বাসনালীতে আটকেছে। পানিও আনেনি। ইতোমধ্যে চোখ থেকে পানি বেরোচ্ছে। আয়াত জলদি উঠে গেল পানি আনতে। ততক্ষণে পাশ থেকে একজন পানির বোতল এগিয়ে দিল। সাঁঝ বোতলটা নিয়ে গটগট করে পুরোটা শেষ করল। কাশি থেমেছে। তবে এখনও চোখে জল। বুকে হাত রেখে বড়ো বড়ো কয়েকটা শ্বাস টেনে পানিদাতার উদ্দেশ্যে বলল, “থ্যাংকস।”
ভদ্রলোক মুচকি হেসে বলল, “ঠিক আছেন এখন?”
এতক্ষণে পাশের লোকটার দিকে তাকাল। হোয়াইট শার্ট পরা একটা যুবক, গালে খোঁচা খোঁচা চাপ দাঁড়ি, চোখে চশমা, হাতে কালো ঘড়ি; সব মিলিয়ে নজরকাড়া। প্রথম দেখায় যে-কোনো মেয়ে তাকে সুদর্শন পুরুষের কাতারে ফেলবে।
সাঁঝ দৃষ্টি সরিয়ে নিতেই সে বলল, “আমি তাহসান প্রহর।”
.
.
.
চলবে......................................