সাঁঝ এখন খানিকটা স্বাভাবিক হয়েছে। প্রহর আরও কিছু বলতে চেয়েছিল। কিন্তু তার আগেই একটা কল আসে। সে সাঁঝের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে প্রস্থান ঘটাল। ঘটনার আকস্মিকতায় সাঁঝ হতভম্বের ন্যায় তাকিয়ে রইল। ভাবতে লাগল, এই লোকটাকে কি সাঁঝ চেনে, না কি না!
নাহ্! মনে করতে পারল না।
আয়াত পানি নিয়ে এসে পাশে বসে পুরো দৃশ্য দেখে গেল। প্রহর যেতেই বলে উঠল, “সাঁঝ! এ্যাই সাঁঝ!”
সাঁঝ ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে ছোট্ট করে প্রশ্ন করল, “হু?”
“আমার ক্রাশটাকে পেয়ে গেছি, জানু।”
“কোথায়? কখন?”
“আরে! এই যে! মাত্রই যে তোকে পানি দিল। সাঁঝ রে! নাম আর ভয়েসের উপরও ফিদা হয়ে গেলাম রে।”
সাঁঝ বুঝল আয়াতের কথা। প্রহরের মতো সুদর্শন ছেলে প্রথম সাক্ষাতে যে কোনো মেয়ের মন কেড়ে নিতে পারে। কাজেই আয়াতের সাথেও তাই হয়েছে। তবে সাঁঝ প্রহরকে পছন্দ করল না, পছন্দ হচ্ছে না; চাচ্ছেও না। একটা শ্বাস ফেলে পুনরায় খানিকটা পানি খেয়ে নিল।
কিছু একটা মনে আসতেই সাঁঝ ভ্রু কুঁচকে বলল, “তুই না বললি, কোনো এক স্টুডেন্টের উপর ক্রাশ খেয়েছিস?”
“হ্যাঁ, তো?”
“এটাকে দেখে তোর কোন দিক দিয়ে স্টুডেন্ট মনে হয়?”
“কেন? মনে না হওয়ার কী আছে?”
“কিছু না। আমিই ভুলে গিয়েছিলাম, আমার বিপরীতে যে বসে আছে, সে একটা গাঁধী।”
________________
ক্লাস শেষে সাঁঝ লাইব্রেরীর উদ্দেশ্যে গেল। কিছু বই নিতে হবে। কিছুক্ষণ আগে উপমার কাছে জেনেছে, প্রহর তাদের ডিপার্টমেন্টের লেকচারার। এটা আয়াত শোনার পর তার মুখটা ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল। ভার্সিটির প্রথম দিন এসেই একজন লেকচারারের উপর ক্রাশ খাওয়ার অপরাধে তার শাস্তি হওয়া আবশ্যক। শাস্তি হিসেবে কী দেওয়া যায়? আপাতত সাঁঝের কিছু মনে পড়ছে না। চুপচাপ লাইব্রেরীতে প্রবেশ করল। একটা বই নিয়ে বসতেই মনে হলো পাশে কেউ একজন বসেছে।
সাঁঝ সেদিকে তাকিয়ে দেখল, প্রহর! খানিকটা অবাক হলো। সে এখানে কী করছে? সাঁঝ যেহেতু জেনেছে, সে একজন লেকচারার; সেহেতু তাকে কোনো ভাবেই অসম্মান করা যাবে না।
হুট করেই প্রহর সাঁঝের দিকে তাকাল। এতে সাঁঝ ভড়কে গেল। সেই সাথে বেশ অপ্রস্তুত বোধ করল। মেকি হেসে প্রহরকে বলল, “আসসালামু আলাইকুম, স্যার।”
প্রহর হালকা হেসে বলল, “ওয়া আলাইকুমুস সালাম, সাঁঝ।”
প্রহর জানত না সাঁঝ এখানে। তার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো, ‘এখানে কী করছ?’ কিন্তু জিজ্ঞেস করল না। প্রশ্নটা করা নেহাতই বোকামি হতো। লাইব্রেরীতে বসে, বই হাতে নিশ্চয়ই কেউ মশা মারে না! তাই প্রশ্নটা চেপে গেল।
প্রহর কথা খুঁজে পাচ্ছে না। সে বেশ অন্তর্মুখী স্বভাবের। এখন কিছু বলতে হবে। তার ভেতরের সত্তা তাকে কিছু বলার জন্য চাপ দিচ্ছে।
অনেক খুঁজে উপদেশ দিল, “খাওয়ার সময় কথা বলবে না, কেমন?”
সাঁঝ মিহি হেসে বলল, “জি, স্যার।”
আর কোনো কথা হলো না। সাঁঝও জলদি প্রস্থান ঘটাল। অপরিচিত কোনো ছেলের এমন পরিচিত ভাব তার ভালো লাগছে না। এই মুহূর্তে হৃদকে লাগবে তার। লাইব্রেরী থেকে বের হতেই তার মনে হলো, প্রহর তাকে তার নামেই সম্বোধন করেছে। সে কী করে তার নাম জানল?
________________
ভার্সিটি থেকে বাড়ি না ফিরে সাঁঝ সোজা হৃদের চেম্বারে চলে গেল। উপমার আরও একটা ক্লাস আছে। ক্লাস শেষ হলে, একসাথেই বাড়ি ফিরবে। তাই সাঁঝ একাই এলো। সাঁঝের হঠাৎ আগমনে হৃদ বেশ অবাক হয়েছে, সঙ্গে ভীষণ খুশিও।
চমকিত ভঙ্গিতে শুধাল, “তুমি? এখানে? হঠাৎ?”
সাঁঝ হালকা হেসে বলল, “কেন? আসতে পারি না?”
“অবশ্যই পারো।”
“তবে?”
“কিছু না। বসো।”
এরপর হৃদ ভেবেছে, বেশ কিছুটা সময় সাঁঝকে দেবে। কিন্তু একটা কাজ পড়ে যাওয়ায় হৃদকে যেতে হলো। সাঁঝকে বলে গেল, “জাস্ট কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো। আসছি আমি।”
সেই যে গেল, আর আসার নাম নেই। সাঁঝ পুরো চেম্বারের প্রতিটি কোনা দেখতে লাগল। বেশ পরিপাটি ও গোছানো; যেমনটা হৃদ নিজেই। হালকা হাসল সাঁঝ। কিছুক্ষণ পর গিয়ে হৃদের চেয়ারে বসে ফোন চাপতে লাগল। নিজের না, হৃদের ফোন। লোক স্ক্রীনে ইভের ছবি দেওয়া। সাঁঝ পাসওয়ার্ড টাইপ করল। সেদিন হৃদ বলেছিল, তার ফোনের পাসওয়ার্ড হচ্ছে, ‘evening_star’। সাঁঝ টাইপ করতেই ফোন আনলক হয়ে গেল। এখন স্ক্রীনে নিজের ছবি দেখতে পাচ্ছে। সাঁঝ অবাক হলো। ছবিটা তার। এখানে সে একটা ওড়না পেঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশ পানে তার মুগ্ধ দৃষ্টি। সমগ্র মুখশ্রীতে বিন্দু বিন্দু পানির ছিটে। বাড়ির পেছনের দিকে। হ্যাঁ, সেদিনই তুলেছিল হৃদ। সাঁঝ ভেবে পেল না, কখন তুলল। যখন সাঁঝ তাকে উদ্দেশ্য করে কথা বলছিল, তখন? না কি এর পরে কিংবা আগে?
হঠাৎ দরজায় করাঘাত হলো। সাঁঝ এখন গভীর ভাবনায় তলিয়ে আছে বলে সেটা খেয়াল করেনি। ওপাশের ব্যক্তি আর অপেক্ষা না করেই ভেতরে প্রবেশ করল। হৃদের চেয়ারে সাঁঝকে বসে থাকতে দেখে সে চমকিত হলো। বুঝতে না পেরে কিছুটা এগিয়ে সাঁঝের সামনে দাঁড়াল। হতবিহ্বল চাহনি তার।
সাঁঝ এতক্ষণে কারো উপস্থিতির আভাস পেয়ে সেদিকে তাকাল। সামনে সজ্জিত রূপে শর্মীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাঁঝ বিমূঢ় বনে গেল। মুহূর্তেই তা ছাপিয়ে বিরক্তি তুঙ্গে উঠে গেল। মেয়েটা কি হৃদের পিছু পিছু এখানেও চলে এলো!
সাঁঝের রাগ লাগছে। প্রচণ্ড রাগ লাগছে। মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
শর্মী এবার জিজ্ঞেস করে বসল, “কী ব্যাপার, সাঁঝ? এখানে কী করছ?”
চোখ বন্ধ করে বড়ো বড়ো দুটো শ্বাস টেনে বিরক্তিপূর্ণ হেসে সাঁঝ বলল, “মুভি দেখতে এসেছি, আপু।”
শর্মী ভ্রু কুঁচকে বলল, “মুভি! হসপিটালে?”
“সেটাই তো! হসপিটালে নিশ্চয়ই কেউ মুভি দেখতে আসে না। তাই নয় কি?”
“তো? কী করতে এসেছ? হৃদের চেম্বারে কী?”
সাঁঝের রাগ এবার গিয়ে আকাশ ছুঁল। তেজি কন্ঠে বলল, “পাহারা দিতে এসেছি, আপু।”
“কাকে?”
“ডাক্তার সাহেব… আই মিন হৃদকে।”
“মানে?”
“মানে আমার বরটা ভীষণ মিষ্টি, বুঝলেন? প্রচুর মাছি উড়ছে চারপাশে। মাঝে মাঝে তো মাছিগুলোও মুখে আটাময়দা মেখে আসে। তাই খেয়াল রাখতে এসেছি, যাতে মাছি না বসে।”
“তোমার এসব কথা বুঝতে পারছি না। বাই দ্যা ওয়ে! তোমার বর কে? তোমার তো বিয়ে হয়নি।”
“কী যে বলেন না, আপু! বিয়ের কথা নিশ্চয়ই ঢাক পিটিয়ে জানাব না। আর আপনি এখন যার চেম্বারে এসেছেন, উনি আমার সুইট জামাইজান।”
শর্মী হতভম্বের ন্যায় তাকিয়ে রইল। সাঁঝ আরও বলল, “এই যে! এটা দেখুন।”
হৃদের ফোনের ওয়ালে নিজের ছবিটা দেখিয়ে বলল, “সেদিন হৃদের সাথে বৃষ্টিবিলাস করছিলাম। ওহ্ হ্যাঁ, আমি আবার বৃষ্টিবিলাসী, বুঝলেন? আর হৃদ এই ছবিটা তুলেছেন। লুকিয়ে চুরিয়ে ছবি তোলার অভ্যেস তাঁর এ জীবনে গেল না। এরপর আবার ওয়ালেও দিয়ে রেখেছেন। কী যে পাগল! দেখুন!”
শর্মীর এবার রাগ হচ্ছে। গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “হৃদ বিয়ে করতে পারে না। মিথ্যে বলো না তুমি।”
সাঁঝ দাঁত কেলিয়ে বলল, “এমা, আপু! মিথ্যে বলতে যাব কেন?”
“জানি না। তবে তুমি মিথ্যে বলছ।”
“একদম না। ২১শে মে, ২০২২ ইং তারিখ; রোজ: শনিবার; সন্ধ্যে ৭:৪৮ ঘটিকায় আমি ওঁকে স্বামী হিসেবে কবুল করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই।”
শর্মী অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল। সাঁঝ হেসে হেসে বলল, “এখন বলুন তো! আমার বরের কাছে কী প্রয়োজন?”
“তেমন কিছু না। তোমার বরকে বলো না আমি এসেছিলাম।”
সাঁঝ মুচকি হাসল। শর্মী প্রশ্ন করল, “একসাথে থাক না কেন তোমরা?”
“আর বলবেন না! হৃদও না! একদম পাগল একটা! ওঁর ধারণা, একসাথে থাকলে আমার পড়াশোনায় ইফেক্ট পড়বে। তাই আলাদা রেখেছেন।”
শর্মী আর কিছু বলল না। খুব শীঘ্রই প্রস্থান ঘটাল। শাড়িকে বিরক্তিকর পোশাকের কাতারে ফেলা শর্মী আজ পাতলা জর্জেটের শাড়ি পরে এসেছিল, সাথে মুখে ভারী মেকআপের আস্তরণ। শর্মী ভেবেছিল, স্ট্রং মেয়েকে পাত্তা না দিলেও, কোমলমতি মেয়ে হিসেবে শর্মী নিশ্চয়ই পাত্তা পাবে। কিন্তু তার সে গুড়ে বালি। এত সাজা! সব জলে গেল। প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে অপমানিত হয়ে শর্মী হসপিটাল ত্যাগ করল।
শর্মীর যেতেই সাঁঝ চোয়াল শক্ত করে ফেলল। অসহনীয় রাগ লাগছে। ছোটো বেলায় যখন সাঁঝের রাগ হতো, তখন সে একটা খাতা ও কলম নিয়ে আঁকিবুঁকি শুরু করত। বড়ো হওয়ার পর সে আঁকিবুঁকি জায়গায়, যে কারণে বিরক্ত, সে কারণটা পুরো পেইজে লিখত। এক পেইজেই সাধারণত তার রাগ কমে যেত। না কমলে আরেকটা পেইজ। এর বেশি লাগত না। আজ সাঁঝের রাগ কমানোর জন্য এছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
সাঁঝ টেবিল থেকে একটা কলম ও একটা প্যাড নিয়ে লেখা শুরু করল। ছোটো ছোটো হাতের লেখা তার। পুরো পেইজে সে একটা বাক্যই লিখেছে। ১৩৬ বারের মাথায় তার রাগ নেমে গেল। ডানপাশে হালকা ফাঁকা জায়গা আছে। পাশ থেকে একটা লাল কলম নিয়ে সেখানে লিখল, “ভালোবাসি, ডাক্তার সাহেব।”
কিছুক্ষণবাদে হৃদ এলো। সাঁঝ নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে আছে। কেন যেন তার মাত্রই নামা রাগটা হৃদকে দেখে হুড়হুড় করে বেড়ে যাচ্ছে। ঠান্ডা আবহাওয়ায়ও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। নাকের ডগা লালচে হয়ে আছে। ইতোমধ্যে সাঁঝের চোখও লাল বর্ণ ধারণ করেছে। ব্যাপারটা হৃদের কাছে ভীষণ অস্বাভাবিক ঠেকল।
হৃদ এগিয়ে এসে সাঁঝকে বলল, “কী ব্যাপার? রাগ করেছ কোন করণে?”
সাঁঝ চোখ তুলে হৃদের দিকে তাকাল। সাঁঝের রক্তলাল চোখ দেখে হৃদের হৃৎপিণ্ড কেঁপে উঠল। জিজ্ঞেস করল, “শরীর খারাপ করছে তোমার? সাঁঝ? ঠিক আছো?”
সাঁঝ উঠে গিয়ে হৃদের মুখোমুখি দাঁড়াল। দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করল, “শর্মীর সাথে কী সম্পর্ক আপনার?”
হৃদ কিছুই বুঝতে পারছে না। তবুও সত্যিটা বলল, “আমাকে পছন্দ করে। ইমপ্রেস করতে চায়। আর বরাবরই রিজেক্ট হয়।”
“এই সিলেক্ট-রিজেক্ট খেলা কার কার সাথে খেলছেন আপনি?”
“মানে?”
সাঁঝের রাগ আরও বেড়ে গেল। জোরালো কন্ঠে বলল, “মানে? হ্যাঁ? মানে? আপনাকে আমি মানে বোঝাচ্ছি। ঐ শর্মী আপনার চেম্বারে কী করে? কেন আসে? প্রস্টিটিউটদের মতো পাতলা শাড়ি পরে শরীর দেখাতে কেন আসে?”
“সাঁঝ! শান্ত হও। পানি খাও। সাঁঝ!”
“আরে রাখুন আপনার পানি। ও এখানে কেন এলো, সেটা বলুন।”
“আমি সত্যিই জানি না।”
সাঁঝ আরও খানিকটা এগিয়ে এসে হৃদের বুকের বা পাশের শার্ট মুচড়ে ধরল। মাঝে হয়তো দু'ইঞ্চি মতো ফাঁকা আছে। একে অপরের শ্বাস গুনতে পারছে।
সাঁঝ অধৈর্য কন্ঠে খুবই ধীরে ধীরে ফিসফিসিয়ে বলল, “আমার সহ্যসীমা খুবই স্বল্প পরিসরের। এখন নিজেকে সামলে নিলাম। কিন্তু এরপর আর পারব না। এরপরেও যদি আমার জিনিসে কারো নজর দেখেছি, তবে আমার জিনিসটাকেই শেষ করে দেব। বুঝলেন? খুন করে ফেলব আপনাকে।”
সাঁঝ শার্ট ছেড়ে দিল। তার চোখ ছলছল করছে। হৃদ তো বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিস্মিত দৃষ্টিতে সাঁঝকে দেখে যাচ্ছে। এত তেজ! এর আগে দেখেনি। হ্যাঁ, এর আগে একবার শর্মীর জন্য হৃদের সাথে পাগলামি করেছিল সাঁঝ। তবে এতটা না! এত ভয়ঙ্কর ছিল না তা।
চেয়ারে বসে পানি খেল হৃদ। বোতল রাখতেই টেবিলের উপর দৃষ্টি গেল। একটা পেইজের পুরোটায় ছোট ছোট করে কিছু লেখা। নিচে লেখা, “ভালোবাসি, ডাক্তার সাহেব।”
আর পুরোটাতেই একটা বাক্য লেখা, “আপনি শুধুই আমার।”
হৃদ অদ্ভুত ভাবে হাসল। সে না চাইতেও এত ভালোবাসা পেল কী করে?
.
.
.
চলবে..................................