এক সমুদ্র প্রেম - পর্ব ০১ - নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি - ধারাবাহিক গল্প


"ভালোবাসি" শব্দটা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে পিউয়ের বাম গালে শক্তপোক্ত এক চড় বসাল ধূসর। মেয়েটার গাল সহ মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। ধূসরের রক্তাভ চোখ এদিকেই চেয়ে । ক্রোধে ফুঁসছে চোখা নাক। এই সতের বছরের জীবনে কোনোদিন মার না খাওয়া পিউ, আজ যেন বাকরুদ্ধ,স্তব্ধ। মুখায়বে অবিশ্বাস নিয়ে মেয়েটা হাঁ করে রইল। মস্তিষ্কের কানায় কানায় প্রশ্ন,
" ধূসর ভাই আমায় মারলেন?"
 রুদ্রমূর্তি ধারনকারী ধূসরকে দেখে পিউয়ের অন্তরাত্মা শুকিয়ে যাওয়ার যোগাড়। সে মানুষটা সবেগে কনুই চেপে ধরল ওর। সবটুকু তেজ কণ্ঠে ঢেলে বলল,
" খুব সাহস বেড়েছে তোর তাই না?  
এতটা নির্লজ্জ্ব হয়েছিস যে,আমার সামনে দাঁড়িয়ে এসব বলতেও জিভে আটকালো না?” 

ধমকে পিউয়ের ছোট্ট দেহ কম্পিত। থরথর করে হাত-পা কাঁপে। অথচ তাও,
ভীষণ সাহস যুগিয়ে বলল,
“ আমি কী করব? আপনিই তো সত্যিটা শুনতে চাইলেন। "
ধূসরের হাতের বাঁধন দৃঢ় হলো আরো। বড় শক্ত করে ধরেছে । পিউ ব্যাথায় মুচড়ে উঠলেও ছাড়ল না,তোয়াক্কা দেখাল না। উলটে রাগে আগুন হয়ে বলল,
" তোর জিভ টেনে ছিড়ে ফেলব, পিউ। তুই আমায় চিনিস না। ভবিষ্যতে তোর মুখ থেকে এসব যেন না শুনি।" 

পিউ দমে গেল না। দমে যাবে বলে কী এতটা ঝুঁকি নিয়েছে? হেরে যাওয়ার পাত্রী সে নয়। ভয় পেলেও বলল,
" কেন বলব না আমি? আমি কি কাউকে ভালোবাসতে পারি না? কাউকে ভালো লাগতে পারে না আমার? আপনিই বা কেন এমন করছেন! আপনি বুঝি কাউকে ভালোবাসেন না?" 
ধূসরের অভিব্যক্তি থমকায়। শিথিল হয় মোটা ভ্রু। স্পষ্ট বোঝা গেল তার বদলে যাওয়া চিবুক। কিছুক্ষন অমত্ত চেয়ে রইল সে। পরপরই দাঁত খিঁচে বলল,
" এক থাপ্পড়ে তোর সব দাঁত ফেলে দেব বেয়াদব! তোর বয়স কত? ভালোবাসার কী বুঝিস তুই? পড়াশুনার নাম করে কলেজে গিয়ে এসব করছিস ? 
ওকে ফাইন! তোকে তো আমি পরে দেখছি। আগে দেখে আসি, তোকে প্রেমপত্র দেয়া সেই দুঃসাহসী আশিককে।"
পিউয়ের চোয়াল ঝুলে পড়ল। ধূসর হাতখানা ছাড়ল না,যেন ছুড়ল সজোরে। রুষ্ট,ক্ষুব্ধ চাউনী নিক্ষেপ করে গটগটিয়ে ঘর ছাড়ল তারপর।  
প্রস্থান দেখে আতঙ্কে ঘাম ছুটে গেল পিউয়ের। ধূসর ভাই ভয়ানক মারকুটে লোক। ওনার বিশ্বাস নেই। রাগের মাথায় কী না কী করবেন! 

সে তড়িঘড়ি করে ফোন তুলল। কন্টাক্ট লিস্ট খুঁজতে গিয়েও হাতের প্রতিটি আঙুল কাঁপছে। চটপট ডায়াল করল রবিনের নম্বরে। ছেলেটা ধরল না। কোথায় মরে গেছে কে জানে! এই মুহুর্তে ফোন না ধরলে ধূসর ভাই সত্যিই ওকে কবর দিয়ে দেবেন। টানা কয়েকবার রিং হওয়ার পর রিসিভ হলো ফোন। রবিনের কণ্ঠে অবিশ্বাস,
" পিউ! তুমি আমায় ফোন করেছো?" 

পিউয়ের যতটা না ভয় লাগছিল,ততোধিক মেজাজ খারাপ হলো এই তুমি ডাক শুনে। রাগ চেপে বলল,
" কোথায় আছিস তুই?" 
" কেন,দেখা করবে না কী?" 
পিউ কষে ধমক দিলো, 
" চুপ কর। এই মুহুর্তে যেখানে আছিস পালা। কোথাও গিয়ে লুকিয়ে পর। একটা কাজ কর,সেলুনে গিয়ে বসে থাক ওটা সেইফ জায়গা।" 
রবিন বোঝেনি। জিজ্ঞেস করল, 
" কেন? লুকোতে যাব কেন?" 

পিউ হাহুতাশ করে বলল,
" না লুকোলে তোর কপালে ভীষণ দুঃখ আছে, রবিন। ধুসর ভাই তেড়ে যাচ্ছেন তোর কাছে। " 
রবিন বসেছিল। তড়াক করে দাঁড়িয়ে বলল, 
" ককেন? আমিতো কিছু করিনি। সেদিনের পর থেকে তোমাকে তেমন বিরক্তও করিনি পিউ। তুমি কি ওনার কাছে আমার নামে নালিশ করেছো?"
" নালিশ করিনি। তবে ওনার হাতে তোর লেখা চিঠি আছে। এবার তুই ঠিক কর,পালাবি না ওখানেই বসে থাকবি! আমার সাবধান করার করলাম। জান বাঁচানো ফরজ,এই কথা মাথায় রেখে কোনও গর্তে গিয়ে লুকিয়ে থাক। রাখছি।" 

 রবিন ঢোক গিলল। আতঙ্কিত হয়ে চারপাশ দেখল একবার। কপালের দরদর করা ঘামটা মুছেই চট করে ছুটল কোথাও। 

পিউ লাইন কাটল ফোনের। মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ফেলল জোরে। গালের হাড়গোড় টনটন করছে। কী মারটাই না মেরেছে পাষাণ লোক! কোমল দুটো আঙুল কপোলে বোলায় সে। ঠিক যেখানটায় স্পর্শ বসেছে ধূসরের। চিনচিনে ব্যথা ছাপিয়ে,আচমকা হেসে ফেলল কিশোরি। 
সত্যি বলতে ধূসর ভাইয়ের এই থাপ্পড় খেয়েও ওর খারাপ লাগেনি, আর না কষ্ট পেয়েছে। সে যে তৈরিই ছিল। আন্দাজ করেছিল, মানুষটার সামনে অন্যকাউকে ভালোবাসি বলতে দেরি হলেও গর্দান ছেদ হতে দেরি নেই। 
কিন্তু, এছাড়া যে উপায়ও ছিল না। ধূসর ভাইয়ের মুখ থেকে একটা সত্যি কথা শোনার আশায় আজ তিনটে বছর ওর এভাবেই কাটছে । কী-ই না করেছে পিউ! কত চেষ্টা, কত পন্থা অবলম্বন করেছে। কিন্তু না,কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পায়নি। পিউ আজও বিভ্রমে ভোগে,
" ধূসর ভাই আমায় ভালোবাসেন? না কি বাসেন না? " 
উত্তরগুলো ওরই মতো বিভ্রান্ত। একবার বলে হ্যাঁ, পরেরবার না। তবে মানুষটা ভালো না বাসলেও, পিউয়ের অনুভূতির কমতি নেই। ওরা বিশালাকার! সমুদ্রের মতো গভীর,পাহাড়ের মতো উঁচু।
ধূসর এমন এক পুরুষ,যে সামনে এলেই সপ্তদশীর হৃদয় কাঁপে। কেমন অস্থির লাগে সবকিছু । পরিচ্ছন্ন আঁখিতে নামে প্রেমের বারিধারা। মনে হয় সে নেই,হাওয়ায় ভাসছে। 
মাঝেমধ্যে তো লজ্জা বিসর্জন দিয়ে ক্যাবলা বনে চেয়ে থাকে পিউ। এই সর্বনাশের শুরু আজ নয়, হয়েছিল সেদিন, যেদিন প্রথম দেখেছিল সিকদার ধূসর মাহতাব নামক ঐ পাষণ্ড মানুষটিকে। 

সম্পর্কে ধূসর-পিউয়ের চাচাতো ভাই। এ বাড়ির মেজো কর্তা আফতাব সিকদারের একমাত্র সন্তান সে। অথচ ভাই-বোনের মধ্যে ধূসরই সবার বড়। একান্নবর্তী পরিবার ওদের। চার কর্তার আন্ডাবাচ্চা ধরলে সে এক মস্ত বড় তালিকা। 
ভাইদের মধ্যে সবার বড় হলেন আমজাদ সিকদার। স্বভাবে ধূসরের আরেকজন মানুষ । বিষয়টা একটু ওলট-পালট। হিসেব মতো বড় ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা বড় হলেও এক্ষেত্রে পিছিয়ে ভদ্রলোক। ওনার আগেই মেজো ভাই আফতাব বিয়ে করে ঘরে বউ তুলেছিলেন। 

এরকমই আরেকটি গোলমেলে বিষয় হলো আজমল সিকদারের বেলাতেও। তার ছেলে সাদিফ, সেও পিউয়ের চেয়ে বড়ো। সম্পর্কে সব কিছু ঠিকঠাক হলেও এই বয়সটাই অতিমাত্রায় কম্পলিকেটেড।

পিউয়ের বয়স যখন আটের কোঠায়? ধূসরকে নিউইয়র্ক পাঠানো হয়। এর পেছনেও রয়েছে এক মস্ত বড়ো অতীত। কারণ,বিদেশ থেকে পড়াশুনা তাদের জ্ঞাতিগোষ্ঠীতে ধূসরের বেলায় প্রথমবার। এক প্রকার তার বাউন্ডুলে স্বভাবে বাধ্য হয়েই বাপ-চাচা ঠেলেঠুলে বাড়ি ছাড়িয়েছিলেন। 
পাক্কা সাত বছর ভিনদেশে কাটিয়ে দেশে ফিরেছে ধূসর। যেদিন সে এলো? কী উৎসবটাই না লেগেছিল বাড়িতে! আত্মীয় -স্বজনের উপচে পড়া ভিড়ে পা রাখার জায়গা নেই। সকলের উৎকণ্ঠিত অপেক্ষার ইতি টেনে চৌকাঠে কদম রাখল ধূসর। বড়ো বড়ো মানুষের মধ্যে, কোনওরকম খরগোশের মতো মাথা বের করে উঁকি দিল এক পনের বছরের কিশোরি। দেখতে চাইল মা -চাচীদের দিনরাত নাম জপা সেই মানুষটিকে। ঠিক যেই মাত্র দেখেছে, তার সবটা চুরি হলো। 
বিনাদ্বিধায় নাম লেখাল এই প্রণয় নামক সমূহ বিনাশের খাতায়। থুবড়ে পড়ল ঐ দীর্ঘদেহী,শ্যামলা পুরুষের প্রেমে। 

পিউ ঠোঁট ফাঁকা করে চেয়েছিল কতক্ষণ। পরতে পরতে মনোযোগ ঢেলে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছিল ধূসরকে। চোখ জুড়ে তখন বিমোহের বৃষ্টি। এত সুদর্শন, এত সুপুরুষ ওর চাচাতো ভাই? 
ভাবতেই নাক সিটকাল মেয়েটা। মনে মনে চরম প্রতিবাদ জানাল এই আমূল সত্যির। 
ধূসরের পাশে ' ভাই' শব্দটা বেমানান, কুৎসিত। কেন ধূসর ওর ভাই হবে? 
সেজন্যেই তো পিউ ওনাকে ধূসর ভাই ডাকে। ঠিক প্রতিবেশীর মতো। পিউয়ের বিশ্বাস,সম্বোধনের দিক থেকে ধূসরকে যত দূরে ঠেলবে, মনের দিক থেকে তত কাছে আসবে মানুষটা। 

কিন্তু ধূসর! একটা ফালতু লোক। একটা গর্দভ, হাদারাম! গত তিনটা বছর ধরে পিউ চোখের সামনে ঘুরঘুর করছে। প্রতি মুহুর্তে দুহাত ভর্তি প্রেম ঢেলে দিচ্ছে, অথচ ওই মানুষটার চোখেই পড়ে না? 
উনি দুনিয়ার সব বোঝে,বোঝে না শুধু ওকে। এজন্যেই ছেলেদের বেশি সুন্দর হতে নেই। তাহলেই অহংকার বেড়ে যায়। এই যেমন ধূসরের আকাশচুম্বী ভাব। যে মিষ্টি দেখতে পিউকে ড্রেনের ময়লা পানি ভাবে। যা দেখলেই মানুষ নাকমুখ গোটাবে। যাকে ধমকানো যাবে,রাগানো যাবে,আজকের পর মারাও যাবে, কিন্তু ভালোবাসা যাবে না। 
কখনও ভালো করে , একটু স্পষ্ট চোখে তাকায়নি অবধি। সে সাজল,না সাজল,কী জামা পরল, কেমন করে চুল বাঁধল আজ অবধি লক্ষ্য করেছে কী না সন্দেহ।  
পিউ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কাঁদোকাঁদো চেহারায় ঘরের বাইরে এলো তারপর। 
চিন্তায় এখনো আধমরা দশা! রবিনটাকে পেলে ধূসর ভাই কী যে করবেন! তার পরীক্ষা আর যাচাইয়ের যন্ত্রনায় ছেলেটা শুধু শুধু ফেসেছে। 

পিউ মনমরা হয়ে হাঁটছিল। আচমকা সামনে পড়লেন মিনা বেগম। বেখেয়ালে ওকে একবার দেখে আবার সতর্ক চোখে চাইলেন তিনি। 
" কী রে,গালটা ওমন লাল হয়ে আছে কেন?"
পিউ আমতা-আমতা করল,
" কই,না তো।" 

মিনা এগোতে নিতেই, ত্রস্ত এক পা পেছনে সরল পিউ। বলল,
" মশা কামড়েছে আম্মু,সত্যি বলছি।" 
" মশা কামড়ালে এমন দেখাবে কেন?'' 

পিউ গাল চেপে মাথা নোয়াল। কী করে বলবে এখন, আমাকে তোমাদের আদরের ধূসর আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে চড় মেরেছে। এই কথা কী বলা যায় কখনও? দোষতো ওরই ছিল। কেন যে পাঁকামো করতে গিয়েছিল তখন! 

পিউ মনে মনে বিরক্ত হলো নিজের ওপর। রবিন আর সে একই ক্লাসে পড়ে। বেশ কয়েকদিন যাবত ওর পেছনে ছুঁকছুঁক করছিল ছেলেটা। পিউ বুঝলেও, কিছু বলেনি। কারণ রবিন সীমায় ছিল,বাড়াবাড়ি করেনি। আর না প্রস্তাব দিয়েছে প্রেমের। কিন্তু আজকেই যেন সেই সীমা অতিক্রমের ভয়ানক ইচ্ছে জাগল ওর। কলেজ ছুটির পরপরই হঠাৎ ছুটে এসে হাতের মধ্যে একটা চিঠি গুঁজে দিলো। পিউ কিছু বোঝার আগেই দৌড়ে পালাল আবার। 

পিউ ও চিঠি খুলেও দেখেনি। ভীষণ রেগে রাস্তায় ফেলে দিয়েছে। 
 কিন্তু সেই কথা চাপা রইল না। বাতাসের গতিতে,এক অলৌকিক শক্তি দ্বারা ধূসর ভাইয়ের কানে ঠিক পৌঁছে দিয়েছে কেউ। 
পিউ ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখল,ধূসর কামরায় দাঁড়িয়ে । একেবারে সটান একটা দীর্ঘ দেহ। ও অবাক হোলো। ধূসর এই রুমে সহজে পা ফেলে না। 
হাঁ করার আগেই, উল্টোপাশের কটমটে প্রশ্ন তেড়ে এলো,
" ছেলেটা কে?" 

পিউ সত্যিটা বলতে গিয়েও ঠোঁট টিপে নেয়। মাথায় বসে দুষ্টুমি। ও উপন্যাসে পড়েছিল, কিছু সিনেমাতেও দেখেছিল নায়ক জেলাসির তোড়ে ভালোবাসার কথা বলে দেয়। সেজন্যে ইচ্ছে করে বলেছিল,
 ' রবিনকে আমি ভালোবাসি।’

 কিন্তু এর শেষটায় কী হলো? ধূসরের মুখ থেকে কিছুতো বের হলোই না, উলটে প্রকাণ্ড থাপ্পড় খেয়ে মাথা চক্কর কাটল ওর। গালে ব্যথাও লাগল ওর।
 পিউ দীর্ঘ ব্যথিত এক নিঃশ্বাস টানল বুকে। 
মিনা তখনো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে। বললেন,
" কী ব্যাপার? কথা বলছিস না কেন? কী হয়েছে, কেউ মেরেছে? '

মেয়েটার সম্বিৎ ফিরল। কথা ঘোরাতে বলল,
" কে মারবে? কী যে বলো না! তুমি কী কাজে যাচ্ছিলে যাও না। আমার অনেক তাড়া,দাঁড়ানোর সময় নেই।" 

তারপর পালিয়ে গেল সে। মিনা কতবার ডাকলেন,শুনলোই না। 
করিডোরের এখানটায় এসে কতক্ষণ পায়চারি করল পিউ। ধূসর এই মুহুর্তে কোথায় আছে জানতে পারলেও হতো। কিন্তু এখন ফোন করলেও উনি ধরবেন না। অবশ্য ওই ফোনটুকু করার সাহসও ওর আছে না কি! 

হঠাৎ মাথায় এলো সাদিফের কথা। ও ফোন করতে না পারলে কী হবে? সাদিফ ভাই তো পারবেন। পিউ চকচকে চেহারায় হাঁটা ধরল অমনি। সাদিফের ঘরের সামনে থেমে, উঁকি দিলো ভেতরে। আস্তে আস্তে ডাকল,
" ভাইয়া! ও ভাইয়া!" 

না,সাড়া নেই। আজ রবিবার,সাদিফের অফিসের ছুটির দিন। ঘরে নেই যখন,ছাদে হয়ত। পিউ ঘুরতে গেল, সহসা একটা প্রসস্থ বুক ঠুকে গেল নাকটা। 
মেয়েটা ভড়কায়। হকচকিয়ে পড়তে নেয় ফ্লোরে। ত্রস্ত ডান হাতটা টেনে ধরল সাদিফ। টালমাটাল পিউকে সোজা দাঁড় করিয়ে বলে,
" তুই কি সত্যিই এত পুষ্টিহীনতায় ভুগছিস, পিউ? সামান্য একটা ধাক্কা খেয়ে কেউ এভাবে পরে যায়?" 
পিউ নাক ডলছে। এত লেগেছে এখানে! ওভাবেই চোখ তুলে চাইল। চশমা পরা,
গোলাকার চেহারার ছেলেটাকে সরু চোখে দেখল এক পল। 
" আমি কি জানতাম আপনি আসবেন? উফ,ওটা শরীর না লোহা!”

সাদিফ কপাল কুঁচকে বলল,
" আমি তো তোর মতো তুলো খাই না, যে ফুঁ দিলে উড়ে যাব। যাক গে,ঘরে উঁকি মারছিলি কেন? " 

“ উঁকি মারব কেন? খুঁজছিলাম আপনাকে। একটা হেল্প চাই আমার।” 

" কী হেল্প?"
" ধূসর ভাইকে একটা ফোন করবেন?" 
'' করলে?'' 
'' শুনতাম উনি কোথায়,বাড়ি কখন আসবেন!'' 

" তোর ফোন থেকে কর।" 
পিউ মিনমিন করে বলল, 
“ ব্যালেন্স নেই। আর আমি কি আমার জন্যে বলছি? আম্মু বলেছেন করতে।'' 

সাদিফ ঘরের ভেতর ঢুকল। পিউ উদ্বেগী পায়ে পেছনে আসে। ও দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে বলল,
" কিন্তু এখন তো ভাইয়াকে ফোন করা যাবে না। সামনে দলের নির্বাচন, ব্যস্ত থাকতে পারে।'' 

পিউ অনুরোধ করল। 
" একটা কল দিয়েই দেখুন না, প্লিজ!" 

 ফিরে চাইল সাদিফ। দৃষ্টি এসে সোজাসুজি বর্তাল কিশোরির ফরসা মুখের ওপর। পিউ করুণ চোখে চেয়ে। ও মৃদূ হেসে বলল,
" আচ্ছা দিচ্ছি।" 

পিউ ঝলমলিয়ে উঠল। দাঁত কপাটি বের করে বলল
" আপনি খুব ভালো! " 

সাদিফ কিছু বলল না। হাসিটা বাড়ল একটু। ফোন তুলে কল দিলো ধূসরকে। কয়েকবার রিং হতেই কেটে দিলো সে। 
" বললাম না,ব্যস্ত ।" 

পিউয়ের অবস্থা দুঃসহ। দুশ্চিন্তায় মাথাটা কিলবিল করে ওঠে। 
রবিনটাকে কী খুঁজে পেলেন উনি? ছেলেটা শুধু শুধু কেলানি খাবে। সে না হয় ধূসর ভাই ফেরার আগে আগে, দরজার খিল দিয়ে বসে থাকবে। নাহলে, ভান করবে অসুস্থ। কিন্তু রবিন! ওর কী হবে? মেয়েটার কালো চেহারা কিছুক্ষণ নরম চোখে দেখল সাদিফ। জিজ্ঞেস করল, 
" কিছু হয়েছে? "
তাকাল পিউ। মাথা নাড়ল দুপাশে। ফোস করে শ্বাস ফেলে বলল,
" ঘরে যাই।" 

******

ঘরে এসেও পিউয়ের স্বস্তি ফিরল না। এপাশ-ওপাশ পায়চারি শুরু করল। 
কী হবে এখন? কী করবে সে? না,কোনো বুদ্ধিই আসছে না। 
মেয়েটা হতাশ ভঙিতে দুহাত মেলে শুয়ে পড়ল বিছানায়। না,জীবনে এত অশান্তি আর নেওয়া যায় না । 

পিউ চোখ বুজল বিধ্বস্তের ন্যায়। আশ্চর্য! এখানেও ধূসর ভাইয়ের তামাটে চেহারা। লোকটা ফর্সা নন,কিন্তু দেখতে মারাত্মক। সব থেকে মারাত্মক ওনার হাঁটা-চলা। 
ওনার পার্সোনালিটিতে পিউ শতবার ঘায়েল হয়। মরে যায় অ্যাটিটিউডে। 
ওনার কথা বলার ভঙ্গিমায় মুগ্ধতায় বুক কাঁপে তার। এজন্যেই তো সেদিন এক দেখায় প্রেমে পড়ল পিউ। 
ও চ সূচক শব্দ করে মুখ গুঁজল বালিশে। 
তাতেই চার ঘন্টা শেষ।  
যখন চোখ খুলল,বাইরেটা অন্ধকারে ডুবে। পিউ হাই তুলে উঠে বসল। ঘড়িতে বারোটা বাজে প্রায়। 
সহসা চোখ কপালে তুলল সে।  
'এইরে,এতক্ষন ঘুমিয়েছি?' 
ত্রস্ত বিছানা ছাড়ল মেয়েটা।
ধূসর বাড়ি ফেরে এগারটার দিকে। ইদানিং ব্যস্ততায় আরো দেরি হয়। আজকেও হয়ত অমন দেরি হবে। 
পিউয়ের এত খিদে পেয়েছে! মানুষটা ফেরার আগে ঝটপট কিছু খেয়ে আসা যাক। একবার রুমের দোর আটকে বসলে ধূসর ভাই তো আর ডাকতে আসবেন না। 
তারপর মোটামুটি সপ্তাহখানেক ওনার সামনেও পড়বে না পিউ। ব্যস,তাহলেই ঝামেলা শেষ। 

পিউ আস্তে করে দরজা খুলল। সারা বাড়ির মধ্যে বসার ঘরের ডিমবাতিটা জ্বলছে।  
 ও চোরের মতো পা টিপেটিপে নিচে নেমে এলো। খাবার টেবিলের ওপর পাশাপাশি দুটো থালায় ভাত বেড়ে রাখা। 
এর একটা ধূসরের। 
তার মানে উনি এখনো আসেননি। যাক, সুবিধেই হলো!  
একটু আরাম করে বসে খাওয়া যাবে এখন। 
পিউ চটপট বেসিন থেকে হাত ধুয়ে এলো। 
টেবিলের বুক থেকে চেয়ার টানল বসবে বলে, আচমকা সেটা টেনে নিলো কেউ একজন। ব্যস,শক্ত মেঝেতে ধপাস করে পড়ে গেল মেয়েটা। টাইলসের প্রহারে সরু কোমর ধরে গেল ব্যথায়। চমকে, থমকে মুখ তুলল পিউ। তামাটে মানুষটা বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে এসে। পিউ ঢোক গিলল। বিড়বিড় করল মনে মনে, 
“ পিউরে! যেখানে বাঘের ভয়, তোর সন্ধ্যে সেখানেই হয়।”
.
.
.
চলবে.......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp