"ওঠ!"
কী শানিত কণ্ঠ! পিউয়ের বুক ছ্যাৎ করে উঠল। আঁচ পেলো ধূসরের ক্ষুব্ধ মেজাজের। মানুষটা প্রচণ্ড রেগে থাকলে আওয়াজ এমন গম্ভীর শোনায়। দুরুদুরু চিত্তে উঠতে চাইল পিউ। কোমরের হাড় ব্যথায় টনটন করল সহসা। ভীষণ বেগে কলমি ডগার মতো লতিয়ে দাঁড়াল মেয়েটা। নিজের প্রতি হতাশায় দ্বিখণ্ডিত বুক। যার ভয়ে সারাদিন ঘরে লুকিয়ে ছিল, খেতে এলো এই এতক্ষণে! শেষমেষ তার খপ্পরেই পড়েছে?
" কটা বাজে?"
প্রশ্নটা ধেয়ে এলো তখনই। নড়েচড়ে তাকাল পিউ। ডিমবাতির সবুজ প্রভায় ধূসরের শ্যামলা চেহারা স্পষ্ট। স্পষ্ট তার কব্জিতে বাঁধা চকচকে ঘড়িটাও। পিউ
মুখ ফস্কে বলে ফেলল,
" আপনার কাছেই তো ঘড়ি আছে! "
" তুই বোধহয় আবার মার খেতে চাইছিস।”
এই এক কথায় চুপসে এলো মেয়েটা।
রুদ্ধ মস্তষ্ক ফিরে গেল অতীতে। দুপুরের সেই দাবাং চড়টার দৃশ্য মনে পড়ল ফের।
এবার বাধ্যেয় ন্যায় জানাল,
“ বাবারোটা!”
" এ বাড়িতে রাতে খাওয়ার সময় দশটা। তাহলে দুই ঘন্টা কোথায় ছিলিস তুই?"
ও মিনমিন করে বলল,
" ঘুমোচ্ছিলাম। "
ধূসরের কণ্ঠ পুরূ,
" একদম মিথ্যে বলবি না! ভেবেছিলি ঘরের দরজা আটকে থাকলেই বেঁচে যাবি? কিছু বলব না?"
পিউ নিম্নোষ্ঠ দাঁতে কামড়াল। কথা খুঁজল মনে মনে।
আচমকা টেনে নেয়া চেয়ারটা এগিয়ে দিলো ধূসর। আদেশ করল থমথমে গলায়,
" বোস।"
শব্দ কম,কণ্ঠ নিরেট।
পিউ দ্বিধায় পড়ল ভীষণ। আবার বসতে গেলে চেয়ার টানবে না তো?
ধূসর ধমকে বলল,
" বোসতে বলেছি না তোকে? বোস!"
ত্রস্ত ধপ করে বসে পড়ল মেয়েটা। ভয়ার্ত,বিভ্রান্ত লোঁচনে চাইল মুখ তুলে। ধূসর আরেকটা চেয়ার এনে সামনে বসল ওর। একদম মুখোমুখি, চোখের কাছে। প্রিয় পুরুষের নৈকট্যে ভয়ডর উবে গেল পিউয়ের। পরিচিত কম্পনে বুকখানা লাফ-ঝাঁপ তুলল। মুগ্ধতার বানে ডুবে মরার মাঝেই ছুটে এলো একটি নরম স্বর। বড়ো মায়া নিয়ে প্রশ্ন করছে,
" তুই কি সত্যিই ওই ছেলেটাকে ভালোবাসিস?"
পিউ সজোরে মাথা নাড়ল। মনে মনে বলল,
“ পাগল হলেন? এই ছোট্টো জীবনে মানুষ কী ওরকম ভুল করে? আপনার মতো একটা জলজ্যান্ত আইটেম রেখে আমি ওমন গোবর-গনেশের প্রেমে পড়ব কোন দুঃখে?'
কিন্তু মুখে আর বলা হলো না। বরাবরের মতো এবারেও মনেই আহুতি দিলো। ধূসর এত কাছে! যেখানে ওকে একটু দেখলেই সপ্তদশীর বুকে তোলপাড় চলে অনুভূতির! সেখানে এখন কেমন লাগছে,কাকে বোঝাবে পিউ?
নার্ভাসনেসে আড়ষ্ট হয়ে জ্বিভে ঠোঁট ভেজাল কিশোরি।
" তোকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি, পিউ!"
অধৈর্য ধূসর।
কোমল কণ্ঠ পালটে গেছে ফের। দড় আওয়াজ পিউয়ের এক সমুদ্র প্রেম উড়িয়ে নিলো।
ফিরে এলো পুরোনো ঐ জেদ। ধূসরকে একটুখানি বাজিয়ে দেখতে,কাঁপা ঠোঁট নাড়ল,
“ হ্যাঁ। বাসি।”
ধূসর ক্ষেপে যায়। দুম করে ঘুষি বসায় চেয়ারে।
ভয়ে ছলকে উঠল পিউ। সন্দিহান চোখমুখ চমকে,থমকে তাকাল। ধূসরের গভীর নেত্র জ্বলছে।
রুষ্ট,রুক্ষ চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল সে। মিনিট কয়েকে পিউয়ের গোল চেহারায় ঘুরে এলো ধ্যান। সুনিপুণ মনোযোগ তাতে। হুট করে হেসে উঠল তারপর।
আলগোছের, একপেশে হাসি। কেমন বিদ্রুপ করে বলল,
" মিথ্যে বলতেও যোগ্যতা লাগে। তোর মতো নির্বোধের তাও নেই।"
পিউ থতমত খেল। প্রখর কৌতূহলে বেঁকে গেল ভ্রুদুটো।
“ কী মিথ্যে বলেছি আমি?"
ধূসর উঠে দাঁড়াল। যাওয়ার জন্যে পা বাড়াল সামনে। একটু থেমে,ঘুরে তাকাল আবার। হুকুম ছুড়ল আঙুল তুলে,
" ভদ্র মেয়ের মতো চুপচাপ খেয়ে ঘুমিয়ে পর। এই কথাটা দ্বিতীয়বার বলতে হলে তোর কপালে দুঃখ আছে, পিউ।"
মানুষটা চলে যায়। কিন্তু পিউ নড়ল না। মুখবিবরে আঁধার মেখে ও ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। ধূসরের এই অযাচিত আচরণে তাজ্জব সে। এমনটা তো আশা করেনি। যা ভেবেছিল তার যে কিছুই হলো না। অন্য কাউকে ভালোবাসে জেনেও ধূসর ভাই কোনও শাস্তি দিলেন না? কিছু বললেন না?
পিউয়ের বুক ভেঙে গেল। মুখজুড়ে মেঘেদের পায়চারি।
কেন কিছু বলল না ধূসর? দুপুরের চড়টাও তবে সামান্য?
হ্যাঁ তাইতো। আজ যদি পিউ বাড়ির কারোর সামনে এই এক কথা বলতো, সেও নিশ্চয়ই এভাবেই শাসন করতো ওকে!
ধূসর কি তবে বড়ো ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন? ওর মনে আলাদা কোনো ফিলিংস নেই?
পিউয়ের ভেতরটা হুহু করে উঠল। ক্লেশে,মর্মে মিটে গেল খিদে। ছলছলে মৃগনয়নে ধূসরের প্রস্থান দেখল সে। যার প্রতি এক তরফা প্রেমে মরছে পিউ।
কেন মরছে?
এই এক তরফা প্রেমে যে ভীষণ জ্বালা! ফাঁদ এটা। মরণ ফাঁদ। বা তার চেয়েও ভয়ানক কিছু। নাহলে পিউয়ের ভেতরটা এমন ছিঁড়ে যাবে কেন? কেন এত কষ্ট হবে? কেন ধূসরের কিছু না বলাতে কান্না এসে থমকে দাঁড়াবে গলার ওপর?
*******
পিউয়ের কানে হেডফোন। ফুল ভলিউমে গান বাজছে সেখানে। সুরেলা পুরুষালি কণ্ঠ বড়ো মায়া নিয়ে গাইছে,
“ বোঝে না সে বোঝে না।
বোঝে না সে বোঝে না।
বোঝে না,বোঝে না।”
পিউয়ের বুক চুরমার করে কান্না পাচ্ছে।
আসলেই ধূসর বোঝে না। কিচ্ছু বোঝে না। এই গান ওর জন্যেই তৈরি হয়েছে। কেন যে ওই পাষণ্ড মানুষের প্রেমে পড়তে গেল!
আচমকা দরজায় টোকা দিলো কেউ। জোরালো আওয়াজে কান থেকে হেডফোন সরাল মেয়েটা। অধৈর্য ব্যক্তিটার বড্ড তাড়া। এত জোরে জোরে কে ধাক্কায়?
পিউ কপাল কোঁচকাল। এত রাতে কে আসবে?
ঝটপট গিয়ে দরজা খুলল সে। ওপাশের মানুষটাকে দেখেই শিরদাঁড়া সোজা হলো পরপর।
ধূসর ভাই! পরনের কালো টিশার্ট,আর চেক চেক ট্রাউজারে যেন পুরো টসটসে স্ট্রবেরি ! তামাটে পুরুষের মনোহর রূপে পিউয়ের দুঃখ শেষ।
মুগ্ধ চোখে আওড়াল,
“ কী সুন্দর আমার ধূসর ভাই!”
গম্ভীর মানব বাক্য ছুড়ল সেসময়,
" সামনে থেকে সর।"
পিউ নড়ে ওঠে। ত্রস্ত সরে দাঁড়ায়। ধূসর ভেতরে ঢুকল। এতক্ষণে ওর হাতের দিকে নজর পড়ল মেয়েটার। একটা সাদা ট্রেতে প্লেট-বাটি সাজিয়ে এনেছে।
পিউ বিস্মিত,স্তম্ভির। ধূসর ভাই ওর জন্যে খাবার এনেছেন?
ধূসর সোজা গিয়ে ট্রে রাখল টেবিলে। বসল বিছানায়। হঠাৎ ঘাড় কাত করে চাইতেই,
পিউয়ের বুকে বাঁজ পড়ল। এইভাবে কেউ তাকায়? খু*ন হবে নির্ঘাত।
ধূসর কোমল কণ্ঠে ডাকল,
" এদিকে আয়!"
বলতে দেরি,পিউয়ের ছুটতে দেরি হয় না। বিধিবাম! বিপত্তি ঘটাল বেসামাল বেগ। ব্যস্ত পা দুটো বিধল পাপোসে। হোচট খেয়ে পিউ পড়তে নেয়।
অমনি উঠে আসে ধূসর। কিন্তু দুরন্ত মেয়ের গতি রোধ করা গেল না। ধরার আগেই পিউ গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল।
আকষ্মিক টাল রাখতে না পেরে,ধূসরকে সহ পড়ে গেল নিচে।
ধূসর উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শুধাল,
" তুই ঠিক আছিস?"
পিউ কিছু বলল না। সে হাঁ করে চেয়ে। ধূসরের চ্যাপ্টা বুকে পড়ে আছে বুঝতেই, জগত পালটে গেছে বিমোহে।
ধূসর ভ্রু গোছাল।
" কী হলো, ওঠ। "
পিউ নিজের মাঝে নেই। খেই হারিয়েছে অনুভূতিতে। জ্বিভ ফস্কে বলল,
“ না উঠলে হয় না?”
" থাপ্পড় খাবি?"
নিষ্ঠুর জবাবে হুশ ফিরল তার। খেয়াল পড়ল কী বলে বসেছে! পিউ লজ্জা পায়।
হাঁসফাঁস করে সরে আসে। ধূসর উঠল,ঠিকঠাক করল টিশার্ট।
সপ্তদশীর তখন কুণ্ঠায় মরমর দশা। যার তোপে মানুষটাতে তাকাতেও কষ্ট।
মেয়েটা মন খিঁচে মাথা নুইয়ে রাখল। ছি,দ্বিকবিদিক ভুলে এটা কী বলে ফেলল! ধূসর ভাই কী ভাবলেন ওকে?
মানুষটা বলল,
" একটু সাবধানে চলতে পারিস না? এক্ষুনি একটা অঘটন ঘটলে কী হতো?"
পিউ ক্লান্ত চোখে চাইল।
" অঘ*টন তো ঘটেই গেছে। এইযে আপনি, আমার মন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন এর থেকে বড় অঘটন আর হয় বলুন তো?”
" হাঁ করে কী দেখছিস?”
পিউয়ের ধ্যান ভাঙল। পিঠ সোজা করে নামিয়ে নিলো চিবুক। ধূসর ফোস করে শ্বাস ফেলল। শুধাল সরাসরি,
"খাসনি কেন?”
পিউ মিইয়ে যায়। এখন কী উত্তর দেবে? আপনার শোকে স্তব্ধ হয়ে গলা দিয়ে খাবার নামেনি, বলবে এটা? নাহ। আরেকটা ছ্যাচড়ামো হবে। আস্তে করে জানাল,
" খেতে ইচ্ছে করেনি।"
ধূসর বিফল শ্বাস ঝাড়ল। লম্বা পায়ে গিয়ে বসল বিছানায়। পাশের জায়গা ছুঁয়ে বলল,
" এখানে বোস।"
পিউ বাধ্য মেয়ে। আস্তেধীরে গিয়ে বসল সেখানে। ধূসরের চোখ ভাতের থালায় । ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভাবছে সে। যেই দৃষ্টি দেখে পিউয়ের বুকখানা প্রত্যাশায় চকচক করে উঠল। এক অলীক স্বপ্ন এসে মাথা তুলল মনে। ভাবল,ধূসর ভাই নিশ্চয়ই খাইয়ে দেবেন। যত্ন করে ভাত মেখে বললেন,
“ নে পিউ,খা।”
হোলো না। এবারেও এমন কিচ্ছু হোলো না। ধূসর নির্দয়ের মতো প্লেট ঠেলে দিলো সামনে। বলল হাস্যহীন,
" খেয়ে নে।"
পিউয়ের কল্পনা শেষ। কাচের মতো ঝরঝর করে ভেঙে পড়ল তা। মুখ কালো করে বলল,
" পরে খাব।"
ধূসর চোখ পাঁকায়,
" এক্ষুনি।"
মেয়েটা হার মানল। তপ্ত দৃষ্টির সামনে চোটপাট দেখানোর সাধ্য তার নেই। ধূসর কোমল হাতটা টেনে নিয়ে পানি ঢালল।
হাত ধুইয়ে বলল,
“ পুরোটা শেষ কর।”
পিউ ঠোঁট উলটে, ভাত মেখে মুখে দেয়। তার মন খারাপ। চেহারায় অনীহা।
যদি খাইয়েই না দেবে,তাহলে ঢং করে খাবার আনার মানে কী ছিল?
খাবার চিবোতে চিবোতে এক বার ধূসরের দিকে চাইল পিউ। নিস্তেজ চাউনী অমনি সচেতন হল।
ধূসর আরেকদিকে চেয়ে। কিন্তু পিউয়ের মনে হলো মানুষটা দেখছিল ওকে। চেয়েছিল,ঠিক যেমন করে পিউ চেয়ে থাকে।
ততক্ষণে পকেট থেকে ফোন বের করেছে ধূসর। পাশ থেকে উঠে গিয়ে অদূরের কেদারায় বসেছে। কিন্তু পিউয়ের চোখ সরল না। একইরকম নিষ্পলক
চেয়ে রইল সে।
সিকদার পরিবারের সবাই সুদর্শন বলতে সাদিফকে বোঝে। অতিরিক্ত ফরসা সে।
কিন্তু পিউ? তার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ, সুশোভিত পুরুষটি হলো ধূসর। মানুষটার গায়ের রং শ্যামলা। অথচ বাকি সব হৃদয় ছিনিয়ে নেয়ার মতো। পিউয়ের কাছে ধূসর মানে অভিভূতি। ধূসর মানে ভালো বাসা।
ধূসর মানে পিউয়ের কাছে আস্ত ডেইরি মিল্ক!
শেষ তিন বছর যাবত এক অদ্ভূত রোগে ভুগছে সে। ধূসর বকলে, ধমকালেও কিচ্ছু এসে যায় না। উলটে ভালো লাগে। ইচ্ছে হয়,ধূসরকে সারাদিন সামনে বসিয়ে রাখতে। সে ধমকাবে,আর পিউ গালে হাত দিয়ে হাঁ করে শুনবে ওসব।
কিন্তু এভাবে চললে তো বেশিদিন বাঁচবে না ও। মানুষটা নিষ্ঠুর! এমন দয়ামায়াহীন লোকের প্রেমের জ্বরে ভুগলে মরণ অবধারিত।
খাওয়া শেষ। প্লেট গুছিয়ে আবার টেবিলে রাখল পিউ। ছোটো করে জানাল,
" শেষ।"
ধূসরের আঙুল ফোনের স্ক্রিনে ব্যস্ত।
চোখ না তুলেই বলল,
" শুধুমাত্র প্রথমবার তোকে মেরেছি বলে খাবার এই অবধি আনলাম। তাই বলে ভাবিস না বলব, মেরে ভুল করেছি। পরেরবার যদি এরকম কিছু শুনি বা দেখি? আমার থেকে খারাপ কিন্তু কেউ হবে না।'
তর্জন-গর্জনে পিউয়ের কিচ্ছু যায় এলো না। বরং তুলতুলে ভালো লাগায় ভরে গেল বুকটা।
একটু যাচাই করতে বলল,
" কেম ধূসর ভাই? আপনি তো আর কাউকে এতটা কড়াকড়ি দেননি। এত গুলো ভাইবোনের মধ্যে কী শুধু আমাকেই খুঁজে পেলেন?"
প্রশ্ন শুনে অপেক্ষা করল সে। চাইল, খুব করে চাইল, ধূসর বলবে,
" হ্যাঁ পেলাম। কারন আমি তোকে ভালোবাসি, আর কাউকে নয়।"
হয়নি। এবারেও তাকে আহত করতে বাঁকা উত্তর এলো,
" হ্যাঁ। তোর মতো তো আর বাকিরা বাঁদড় নয় যে প্রেম পত্র হাতে করে বাড়ি ফিরবে। এতটা পাঁকামো এই বাড়ির কোনও ছেলেমেয়ে করেনি। বয়স সতের অথচ প্রেম ভালোবাসা বোঝে। ইঁচড়েপাকা একটা! "
পিউ ঠোঁট ওল্টাল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল। প্রত্যেকবার ভাবে এক,হয় আরেক। ধূসর ভাই এমন এমন চমকে দেয়া কাজ করেন,যা তার আশা ভরসা ধূলিসাৎ করে দেয়।
ধূসর উঠে এলো।
ড্রয়ার খুলল টেবিলের।
ওষুধের বাক্স হতে একটা ওষুধ নিলো হাতে।
পানির গ্লাস সহ পিউয়ের সামনে দিয়ে বলল,
" রাত অনেক হয়েছে! খেয়ে ঘুমা। সকাল হতে হতে ব্যাথা সেড়ে যাবে।"
চটক কাটার ন্যায় চাইল পিউ। একবার ওষুধ দেখল একবার ওকে। এটা যে পেইন কিলার। এর মানে ধূসর ভাই ঠিক বুঝেছেন ও ব্যথা পেয়েছিল?
পিউয়ের বিস্ময় দেখার দায়িত্ব ধূসর নিলো মা। বেরিয়ে গেল দীর্ঘ পায়ে। সেদিকে চেয়ে হাসল পিউ।
ভীষণ মুক্ত শ্বাস টেনে ভাবল,
“ আমি না বলতেই যদি উনি আমার ব্যাথা বোঝেন,তবে ভালোবাসাটাও তো বোঝার কথা।”
*******
সেই রাতটা পিউয়ের ভালো কাটার কথা ছিল। কিন্তু কাটেনি। ধূসর ভাইয়ের দিয়ে যাওয়া ছোট্টো আশায় ঝলসে গেছে রাতের ঘুম। ছটফট করতে করতে ফজরে চোখ লেগে গেল।
উঠলোও বেলা করে।
তখন প্রায় নয়টা বাজে ঘড়িতে। পিউ তাড়াহুড়ো করে ফ্রেশ হোলো। কলেজ যাওয়া জরুরি। এই বাড়ির নিয়ম, খুব অসুস্থ না হলে ক্লাস মিস দেয়া যায় না।
আর এই নিয়ম তৈরি করেছেন স্বয়ং আমজাদ সিকদার। বাড়ির একমাত্র কর্তা যিনি।
অথচ এই ভদ্রলোকের সাথেই ধূসরের যোজন-যোজন দুরুত্ব। কীসের একটা
অদৃশ্য প্রতিযোগিতা। বাড়ির প্রত্যেকে যেখানে আমজাদের শাসনে তটস্থ থাকে, ধূসর সেখানে গা ভাসানো ছেলে। আমজাদের ধমক,চোখ রাঙানো সবেতেই সে নিরুদ্বেগ,নিষ্পৃহ।
এর অবশ্য কারণও আছে। আমজাদ সিকদারের তুখোড় অপছন্দের আরেক নাম,
“ রাজনীতি”।
পক্ষান্তরে সেই রাজনীতিতেই আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধূসর। ঠিক এজন্যেই ওকে একদিন দেশ ছাড়তে হয়েছিল। কিন্তু না,পথে আনা যায়নি। তবে আশ্চর্য সত্যি হলো,
ধূসরের এই নির্ভীক চিত্তই মন পাখিকে ফুরুৎ করে উড়িয়ে নিয়েছে। যাকে ও ভালোবাসবে,সে যদি বাবার চোখে চোখ রেখে বলতেই না পারল,
“ পিউকে আমার চাই!”
তাহলে সে কেমন পুরুষ শুনি?
পিউ তাড়াহুড়ো করে নিচে এলো।
বাড়ির সবাই তখন নাস্তার টেবিলে। শুধু কর্তারা কেউ নেই। অফিসের উদ্দ্যেশ্যে কাকভোরেই বেরিয়ে পড়েন তারা। শুক্রবার ছাড়া তাদের সাথে পিউ সকালের খাবার কবে খেয়েছে মনে পড়ে না।
ও চেয়ারে বসে আশেপাশে চাইল। ধূসর ভাই কোথায়? প্রশ্নের মাঝেই হাজির হলো সে। নিদ্রিত ভাব স্পষ্ট চেহারায়।
পিউয়ের বুকে দুম করে লাগল তাতে। ইস, কী কিউট লাগছে! ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে একটা চুমু খেয়ে ফেলতে।
" কী রে পিউ! কাল রাতে কী হয়েছিল তোর?"
মেয়েটার ঘোর ভাঙে। চোখ সরিয়ে বলে,
" কই ছোটো মা,কী হবে?”
জবা বললেন,
" কিছু নাহলে খেতে এলি না কেন? কতজন ডাকলাম, উঠলিই না।”
রাদিফ দাঁত বের করে বলল,
" পিউপু মনে হয় ছ্যাকা খেয়েছে।"
পিউ পানির গ্লাসে চুমুক দিয়েছিল সবে। অবোধ বালকের কথায় ছিটকে এলো সেটা। সবার অবাক চোখ তখন রাদিফের ওপর। জবা বেগম ধমকে বললেন,
" চুপ। কোত্থেকে শিখেছিস এসব কথা? "
রাদিফ কাচুমাচু করে বলল,
" টিভিতে দেখেছিলাম,নায়িকারা দুঃখ পেলে ঘর আটকে বসে থাকে।"
সাদিফ রেগে বলল,
“ আজ থেকে তোর টিভি দেখা বন্ধ।"
বেচারা সাফাই দিতে চাইল। কিন্তু পারল না। পথিমধ্যেই জবা বললেন,
" চুপ। আর কোনো কথা না। প্লেটের খাবার তো এক ফোটাও নড়ছে না। চুপচাপ খা।"
দুঃখী দুঃখী চেহারায় খাবার মুখে পুরল রাদিফ। ছেলেটা এখনও বুঝতে পারছে না, এক ঘর মুরুব্বির সামনে সে কী বলে বসেছে!
পিউ আড়চোখে ধূসরকে দেখছিল। কী চুপচাপ খাচ্ছে! সামনের প্লেট-বাটি ছাড়া বাকি কিছুতে মন নেই।
এতক্ষণে মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হলো না? মেজো মা কখন থেকে জিজ্ঞেস করছেন,
" আর একটু ভাজি দেই? একটু জুস দেই?”
শুধু হু-হা করছে। কেন? একটু কথা বললে কী হয়! পিউ নাহয় মুগ্ধ হয়ে শুনতো।
ধূসরের পাশের চেয়ারে টান পড়তেই পিউয়ের ভাবনা কাটল। পুষ্প এসে বসেছে। হাবভাবে ব্যস্ততা। গলা তুলে বলল,
" আম্মু, আমাকে এক কাপ চা দাও।"
মিনা চ্যাঁচালেন অদূর থেকে,
" সময় লাগবে। বোস।"
রুবায়দা বললেন,
" শুধু চা খাবি কেন? নাস্তা করবি না?"
" না মেজো মা ,আমার পেটের অবস্থা ভালো নয়। আপাতত স্যালাইন খেয়ে বেঁচে আছি।"
" সে কী! কেন? কিছু তো বলিসওনি। "
“ আরেহ সামান্য ব্যাপার।”
" তোর পড়াশুনার কী খবর, পুষ্প?"
এই এতক্ষনে কথা বলল ধূসর। পিউয়ের আদল সংকীর্ণ হতে যথেষ্ট যা।
ও এত সময় ধরে বসে আছে এখানে, কই ওকে তো কিছু জিজ্ঞেস করল না। পড়াশুনা তো সেও করে তাই না?
পুষ্প ঘাবড়ে যায়। একটু হেসে বলে,
" এইতো,ভভালো ভাইয়া।"
" তোর ক্লাশ শেষ হয় কখন?"
" একটায়। "
" কাল বাড়ি ফিরলি চারটায়, কোথাও গিয়েছিলি?"
একটা প্রশ্নও ধূসর ওর দিক তাকিয়ে করেনি। অথচ বাকীদের প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি শশব্যস্ত আছড়ে পড়ল পুষ্পতে। ভড়কে গেল মেয়েটা। কী বলবে,কী করবে হযবরল ভাব।
মিনমিনিয়ে বলল,
" রাস্তায় জ্যাম ছিল।"
" রাস্তার জ্যাম নদীর পাড়ে থাকে না। ফুচকা খেলে ভালো জায়গা থেকে খাওয়া উচিত। তাহলে আর দরকার হবেনা স্যালাইনের।'
ধূসর মুখ মুছতে মুছতে উঠে গেল । তার খাওয়া শেষ। তবে সঙ্গে সঙ্গে পুষ্পর পিঠে দুম করে কিল বসালেন মিনা বেগম। ধূসরের কথাগুলো শুনেই রান্নাঘরের কাজ ফেলে ছুটে এসেছেন তিনি।
হঠাৎ হামলায়
ব্যাথায় মুচড়ে উঠল মেয়েটা। ভদ্রমহিলা চটে বললেন,
" এই তোর এক্সট্রা ক্লাস? আজকে আসুক তোর বাবা। ড্যাংড্যাং করে ঘুরে বেড়ানো বার করবে।"
পুষ্প কাঁদোকাঁদো মুখে বসে রইল। মায়ের থেকে রুবায়দা ওকে আড়াল করে বললেন,
" থাক থাক আপা, ছোট মানুষ! "
মেজো মাকে দেখে হাসল পিউ। গালে হাত দিয়ে ভাবল,
' আমার হবু শ্বাশুড়ি মা কিন্তু ফার্স্টক্লাস! বিয়ের পর ধূসর ভাইয়ের সাথে আমার ঝগড়া হলে, আমাদেরও এইভাবে মিটমাট করিয়ে দেবে।”
পুষ্পর ছলছল চোখ দেখে মায়া হয় পিউয়ের। ধূসর ভাই এমন করেন কেন? নিজেতো একটা পান্তাভাত। বাকিরা কী একটুও ঘুরবেও না?
ঠিক এই কারণেই মানুষটাকে সবাই সমঝে চলে। চোখ তো নয়, যেন জ্যান্ত বাজপাখি। কখন, কোনদিকে থাকে কেউ জানে না। এই যে আপু ক্লাস শেষ করে সামান্য একটু ফুচকা খেতে গিয়েছিল, সেটাও চোখে পড়া চাই।
পিউয়ের নাস্তা শেষ। কাধব্যাগটা পিঠে চড়ে দাঁড়াল,অমনি কথা বলল সাদিফ,
" পিউ, দাঁড়া আমিও যাব।"
" আপনার অফিস তো উল্টোদিকে।"
সাদিফ হাত ধুতে ধুতে বলল,
" সমস্যা নেই, ঘুরে যাব আজ। সোজা রাস্তাটায় জ্যাম পরে খুব। তুই চল,তোকে এগিয়ে দেই।"
পিউ খুশি হয়ে গেল। সাদিফের বাইকে যাবে ভেবে। গাড়ির ভেতর ওর এত দমবন্ধ লাগে! বাইকে কী সুন্দর হাওয়া-বাতাস আসে।
পার্কিং লট থেকে সাদিফ বাইক বের করে গেটে আনল। পিউ উঠতে উঠতে বলল,
" জানেন ভাইয়া,আমার না গাড়ির থেকে বাইক বেশি পছন্দ৷ গাড়ির চারপাশ আটকানো। দ্বায় না পড়লে যেতামই না।”
সাদিফ হাসল। বলল,
' অফিসের রাস্তাটা ওদিকে হলে আমি তোকে রোজ পৌঁছে দিতাম।'
পিউ মাথা ঝাঁকায়। আচমকা চোখ পড়ে দোতলায়,ধূসরের ঘরের দিকে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে। চোখ এদিকেই,ওদের ওপর।
সাদিফ বাইক ছুটিয়ে গেট পার হলো। তখনও পিউ চেয়ে রইল সেদিকে। অত দুরুত্বেও যেন ধূসরের নিরেট,কটমটে চিবুক স্পষ্ট বুঝল সে। পিউ আশ্চর্য হয়। প্রশ্ন করে নিজেকে,
“ ধূসর ভাই কী রাগ করলেন?”
.
.
.
চলবে..................................................................