এক সমুদ্র প্রেম - পর্ব ০৩ - নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি - ধারাবাহিক গল্প


সারাটা কলেজ রবিনকে তন্নতন্ন করে খুঁজেছে পিউ। ক্লাসে আসেনি, ফোনও তুলছে না। সেই যে কাল পালাতে বলল, আর কথা হয়নি তারপর। পিউ দুশ্চিন্তায় অস্থির । ধূসর ভাই ওকে পেলেন কী না! 
পেলেও কী কী বললেন, এসব জানার জন্যে ছটফট করছে ভেতরটা। রবিনের সাথে দেখা না হলে,পিউ যে মিথ্যে বলছিল কীভাবে বুঝল মানুষটা? 

কলেজের টিফিন প্রিয়ড মাত্র শুরু হোলো। অমনি করিডোরে ছুটে এলো পিউ। 
রবিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তামিম। ও নিশ্চয়ই খোঁজ জানবে? পিউ একদম গিয়ে সামনে দাঁড়াল ওর। ব্যস্ত গলায় বলল, 
“ তোর ফোনটা দে তো।” 
হঠাৎ কাণ্ডে ছেলেটা ভ্যাবাচ্যাকা খেল। চাইল সন্দেহী চোখে। 
“ কেন?” 
“ রবিনকে ফোন করব,দে।” 
তামিম মিটিমিটি হেসে বলল,
“ হঠাৎ ওর খোঁজ করছিস? ব্যাপার কী হুঁ?” 

পিউ তপ্ত চোখে চাইল। অমনি মিইয়ে গেল ছেলেটা। 
“ দিচ্ছি।” 
ফোনটা হাতে পেয়েই, পিউ সরে এলো। দুবার রিং বেজে,রিসিভ করল রবিন। হ্যালো বলার আগেই,মেয়েটা প্রশ্ন ছুড়ল উদ্বেগে,
" কোথায় তুই?" 
তামিমের জায়গায় মেয়ের গলা? রবিন থমকাল। ফোনের স্ক্রিন দেখে নিলো আরেকবার। 
“ কে?” 

" আমি কে জেনে লাভ নেই। আগে বল তুই কোথায়? লুকোতে বলেছি বলে কী সত্যিই ইঁদুরের গর্তে গিয়ে ঢুকেছিস?" 

" ও পিউ! 
লুকোবো না কী করব? তোর ধূসর ভাইকে বিশ্বাস আছে! গতবার আমাদেরই এলাকার এক ছেলেকে মেরে আধমরা করে দিয়ে গেছিল। ওই লোকের হাতে পরার ইচ্ছে আমার নেই। আমি যদি বুঝতাম,তুই ওনাকে গিয়ে নালিশ করে দিবি বিশ্বাস কর কোনোদিন তোকে চিঠি দেয়ার ভুল করতাম না। এখন তার খেসারত হিসেবে আমাকে জান হাতে নিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে।" 

পিউ ঠোঁট চেপে হাসল। গত পনের দিন ধরে যে ছেলে তুই থেকে নেমে তুমি তুমি করছিল, আজ এক ধাক্কায় কী বদল তার! জিজ্ঞেস করল গম্ভীর স্বরে,
“ কোথায় এখন?" 
" বগুড়া এসেছি,নানা বাড়িতে।" 

ও শব্দ করে হেসে ফেলল। 
“ এই সাহস নিয়ে তুই এসেছিলি আমার সাথে প্রেম করতে? ভীতুর ডিম। থাক ওখানেই থাক। রাখছি!” 

 লাইন কেটে পিউ ফিরে এলো। তামিম সরু চোখে চেয়ে। ফোনটা বাড়িয়ে দিতেই বলল,
" তোদের মধ্যে কী চলছে বলতো?" 
পিউয়ের কণ্ঠে অনীহা,
" তোর এই বন্ধু কী কিছু চলাচলের যোগ্য? আমাকে সন্দেহ করলে ড্যাশিং কারো সাথে করবি। উম, লাইক ধূসর ভাই। বুঝেছিস?' 

ঝুঁটি করা চুলগুলো দুলিয়ে চলে গেল মেয়েটা। কিন্তু আহাম্মক বনে রইল তামিম। কী আশ্চর্য! এখানে ধূসর ভাইয়ের কথা এলো কেন? 

টিফিনের পর আরো দুটো ক্লাস হয়। প্রথম ক্লাস নেন কবিতা আনাম। হোয়াইট বোর্ডে গ্রামার টুকছেন তিনি। সহজ বিশ্লেষণে বুঝিয়ে দিচ্ছেন সবাইকে। তবে পিউয়ের মনোযোগ ওদিকে নেই। তার মস্তিষ্ক রুদ্ধ ধূসরের প্রতি। নিউরনে ছুটছে তার নাম। 
মানুষটার হাসি,কথা বলা,তাকানোর ধরণ,রাগে ফুলে ওঠা সেই সরু নাক আর কুঁচকে ফেলা ঘন ভ্রু? সবেতে পিউয়ের নিদ্রা নেই,স্বস্তি শেষ।
ধ্যান-জ্ঞান হারানোর এই টালমাটাল তাণ্ডবে
বোর্ডে লেখা একটা লাইনও মেয়েটা খাতায় তোলেনি। উলটে আনমনে সফেদ পাতা ভরিয়ে ফেলল
“ ধূসর ভাই” লিখে। 

বছর তিনেক আগের সেই দিন, পিউয়ের
আজও পরিষ্কার মনে আছে। ধূসরের সঙ্গে তার প্রথম দেখা হওয়া। 
 একবার দেখেই যার প্রেমে পড়া ওর। বয়ঃসন্ধিকালীন কোমল সময়ের সে এক অন্যরকম,আলাদা অনুভূতি। 

 সেদিন,দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধূসরকে দেখল পিউ। কী
চমৎকার, পরিপাটি একটা মানুষ! আর পিউ,ও যে একটু ভালো করে চুলও বাধেনি। এমন মানুষের সামনে এভাবে যাওয়া যায়? 
মেয়েটা এক ছুট্টে ফিরে এলো ঘরে। তাড়াহুড়ো করে জামা পাল্টাল। কয়েদ চুল খুলে ছড়াল পিঠে। কপালে টিপ,হাত ভরতি চুড়ি আর ঠোঁটে ঠাসা লিপস্টিক মেখে ফের ছুটল বসার ঘরে। 

ধূসর তো অনেক লম্বা! পিউকে নিশ্চয়ই ওনার পাশে ব্যাকটেরিয়ার মতো লাগবে! মেয়েটা পুষ্পর ঘরে গিয়ে এক জোড়া হিল পরে এলো। এসব উঁচু জুতো ওর কাছে নেই। ক্যারি করা বেশ ঝামেলার কী না! পিউ পারে না ওসব। 

ঘরজুড়ে তখন আত্মীয়দের মেলা বসেছে। সবাই এসেছেন ধূসরকে দেখতে। শ্যামলা মানুষটাকে ঘিরে বসেছে তারা। 
দেশের বাইরে কেমন কাটল,শুকিয়ে গেল কেন,খাওয়া দাওয়া করে না? কতরকম প্রশ্ন তাদের। এর মাঝেই ডাকলেন জবা,
" কী রে, পিউ! 
তুই কোথায় ছিলি? আয় এদিকে। ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছে তোর?” 

ধূসর তক্ষুনি ঘাড় বাঁকাল। ক্ষুরধার চাউনীজোড়া সরাসরি ঠিকড়ে পড়ল পিউয়ের দিকে। সহসা তুষারের ন্যায় শক্ত হলো কিশোরি। শরীরের নড়ন বন্ধ তার। শুকনো ভেজা গলা।
চোখ তো নয়,যেন ধারালো এক তির ছুড়ল ধূসর। যা সদর্পে এসে পিউয়ের বুক ভেদ করে গেল। এফোড়-ওফোড় করল হৃদপিণ্ডের অলিন্দগুলো। 

মিনা বললেন, 
“ দাঁড়িয়ে আছিস কেন? সেজো মা ডাকল না? আয়।” 

পিউ নড়ল না। চাইছে,পারছে না। পা-দুটো আটকে বসেছে মেঝেতে। হবে না? ধূসর ভাই যে এখনো তাকিয়ে আছেন। অমন শান্ত-গভীর দৃষ্টি পেরিয়ে নড়ার সাধ্য আছে কারো? কী এত দেখছেন উনি?
 ও টেনেহিঁচড়ে পা বাড়াল।
উদাসীনতা,আবার হিল পরার অভ্যেস নেই। তারওপর পুষ্পর জুতো জোড়া ঢিল হয়েছে পায়ে।
এক পা এগোতেই,গোড়ালিটা নড়বড়ে হয়ে জুতো কাত হলো। আর ব্যস! ধপাস করে পড়ে গেল পিউ। ঘরভরতি মানুষ ভ্যাবাচ্যাকা খায়। চেয়ে থাকা হাঁ করে। সেকেন্ড কয়েকে আবার স্বশব্দে হেসে ওঠে সবাই। 
পিউ লজ্জায় শেষ! ধূসরের সামনে ইজ্জত্বের এই দফারফায় আর বসে থাকতে পারল না। চোখমুখ খিচে জুতো হাতে তুলে ছুটল পালাতে। 

অতীত ভেবে মুচকি হাসল মেয়েটা। ভাগ্যের কী বিরোধিতা! যার কাছে নিজেকে সুন্দর দেখানোর প্রয়াসে পিউ 
এত কিছু করেছিল,আছাড় খেলো তার সামনেই? ইস! 

“ কী ব্যাপার,হাসছো কেন তুমি?” 
হঠাৎ প্রশ্নে পিউ নড়ে উঠল। চাইল মুখ তুলে। কবিতা আনাম ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছেন। শুধু কি তাই? গোটা ক্লাস পিউকেই দেখছে। মেয়েটা থতমত খেলো। 
হুস ফিরল সে কোথায়! 
ছাত্রীর অন্যমনস্কতায় চটে গেলেন কবিতা। 
দু পা ফেলে বেঞ্চের কাছে এসে দাঁড়ালেন। আদেশ ছুড়লেন হাস্যহীন,
" স্ট্যান্ড আপ! "
পিউয়ের আদল সংকীর্ণ। কাচুমাচু করতে করতে দাঁড়াল উঠে। 
" আমি ক্লাস করাচ্ছি আর তুমি হাসছো? হাসার কিছু ঘটেছে এখানে?"
পিউ দুপাশে মাথা নাড়ল। 
" তাহলে হাসছিলে কেন? " 
" সরি ম্যাম।” 
তার সরিটা ভদ্রমহিলা শুনলেন না। পূর্বেই চোখ পড়ল পিউয়ের খাতার দিকে। হিজিবিজি করে ‘ধূসর ভাই’লেখা দেখেই রুষ্ট চোখে চাইলেন তিনি। 
পিউয়ের গলা শুকিয়ে গেল। ঢোক গিলল ক-বার। 
কবিতা রেগে বললেন,
" আউট! এক্ষুনি ক্লাসের বাইরে গিয়ে কান ধরে দাঁড়াও, যাও। " 

পিউ ঠোঁট ওল্টাল। কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ চলে এলো বাইরে। 
কবিতা আনাম হুকুম করলেন ভেতর থেকে,
" কান ধরো!” 

পিউ তাই করল। দু কান ধরে দাঁড়াল নিশ্চুপ। বাউন্ডারির মতো কলেজের সমস্ত ক্লাস থেকেই, করিডোরের জায়গাটা দেখা যায়। এই মুহুর্তে পিউকেও সবাই দেখছে নিশ্চয়ই। দেখুক,তাতে কী! 
 ভালোবাসার জন্যে মানুষ কত কী করে! আর ও একটু কান ধরতে পারবে না? 

পিউয়ের শাস্তির আধঘন্টা কেটেছে। রীতিমতো পায়ে ব্যথা করছে এখন। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায়? উফ,কোমরটাও ধরে এলো। ও অসহায় চোখে কবিতার দিকে চেয়ে রইল। যদি একটু মায়া করেন তিনি! কিন্তু ভদ্রমহিলা এদিকে দেখলেনও না। 

পিউ বিফল শ্বাস ফেলল। এক জীবনে এই ধূসর ভাইয়ের জন্য আর কী কী করতে ওর? জীবনে কান ধরেনি। আজ তাও ধরতে হচ্ছে। 
ঠিক সেইসময় বাইকের হর্নের শব্দ শোনা গেল। গেটের ওপাশ থেকে হুড়মুড়িয়ে আসছে। পিউ কৌতূহলে ফিরে চায়। 
ধূসরকে দেখেই চমকায় এক চোট। একী! 
উনি এখানে কী করছেন? 
আর এটা! এটা কার বাইক? 
পিউ ভেবে সময় নষ্ট করল না। ও যে এই মুহুর্তে কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে,মনে পড়তেই ত্রস্ত ঘুরে গেল এপাশে। 
এই প্রথম ধূসরের হাজির হওয়া পিউয়ের ভালো লাগেনি। একটুও না।  
এই কানে ধরা অবস্থায় ওকে দেখলে তো ইজ্জ্বত যা ছিল তাও শেষ! ধূসরের সাথে আরও একজন আছে। বাইক সেই চালাচ্ছিল। অধ্যক্ষের রুমের সামনে থামল দুজন। কোনোদিক না চেয়ে,সোজা ঢুকে গেল ভেতরে। 
অমনি স্বস্তির শ্বাস ফেলল পিউ। যাক! ওকে দেখেনি। ধূসর ভাই বের হতে হতেই যদি ম্যাম ডেকে নেন,তাহলে আর কোনো চিন্তা নেই। বিধিবাম! এমন কিছু হলো না। 
দশ মিনিটের মাথায় বাইরে এলো ধূসর। সাথে অধ্যক্ষও আছেন। 
পিউ শক্ত হয়ে দাঁড়াল। চিবুক ঢুকিয়ে রাখল গলায়। মনপ্রাণ উজাড় করে চাইল,
ধূসর যেন এদিকে না আসে। হয়নি। ফলেনি ওসব। উলটে 
ক'জোড়া পা এসে থামল কাছে। পিউয়ের মুখটা চুপসে গেল। দেখাল ঠিক হাওয়া ছেড়ে দেওয়া বেলুনের ন্যায়। চোরা চোখে একটু মুখ তুলল সে। অধ্যক্ষ অবাক হয়ে বললেন,
“ পিউ,কী ব্যাপার? এভাবে কান ধরে আছো কেন?” 
মেয়েটার নজর তখন ধূসরের ওপর। মানুষটার শ্যামলা কপালে ভাঁজ পড়েছে। রেখার খাঁজে চকচক করছে ঘামের ফোঁটা। 
অধ্যক্ষকে দেখে বেরিয়ে এলেন কবিতা। জিজ্ঞেস করলেন নরম সুরে,
“ কিছু হয়েছে, স্যার?” 

“ মেয়েটা এভাবে দাঁড়িয়ে কেন, ম্যাম? কোনও সমস্যা?” 

" পিউ দিন দিন পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়ছে, স্যার। আমি বোর্ডে যা লিখেছি কিচ্ছু নোট করেনি। উলটে হাবিজাবি লিখে খাতা ভরিয়ে ফেলেছে।” 
কবিতার কথায় বিরক্তি। 
কিন্তু পিউয়ের বুক ধ্বক করে উঠল। সর্বনাশ! এখন যদি ম্যাম বলে দেন,ও ধূসরের নাম লিখেছিল খাতায়! কী হবে? 
পিউ ঢোক গিলল। চেয়ে রইল অবলার মতো। নীরব গলায় চ্যাঁচাল,
“ না ম্যাম, প্লিজ বলবেন না। দরকার পড়লে সারাজীবন আপনার বাসায় গিয়ে থালাবাসন মেজে দিয়ে আসব। তাও বলবেন না,প্লিজ!” 

ওর ধ্যান ছুটল অধ্যক্ষের আওয়াজে। কণ্ঠে আক্ষেপ তার। 
" তোমার থেকে কিন্তু এসব আশা করা যায় না, পিউ। তোমার মত ব্রাইট স্টুডেন্ট যদি এরকম করে ব্যাপারটা কিন্তু সত্যিই হতাশার।” 

মেয়েটা মিনমিন করল,
" সরি স্যার। আর হবে না।” 
ভদ্রলোক থামলেন না। পরপরই পিউয়ের সেই অপছন্দের বাক্যখানা আওড়ালেন,
" তুমি হলে ধূসরের বোন। ধূসরের রেজাল্ট কিন্তু সব সময় ব্রিলিয়ান্ট ছিল। তোমারও উচিত ওকে অনুসরণ করা।” 

শান্ত পিউয়ের মেজাজ চটে। মাথা নুইয়ে ভ্রু কুঁচকায়। কটমটিয়ে ভাবে,
 “ আমি ধূসর ভাইয়ের বোন নই, বুঝেছেন আপনি?” 
ভদ্রলোক আরো জ্ঞান দিলেন। কতশত উপদেশ। সিকদার বাড়ির ছেলেমেয়েদের এটা কমন কলেজ। বাড়ির কাছে,আবার মানের দিকে ভালো। ধূসর থেকে সাদিফ সবাই এখান থেকেই পাশ করে বেরিয়েছে।  

এক চোট বক্তব্য শেষ করে দম নিলেন ভদ্রলোক। পিউ আনত হয়ে দাঁড়িয়ে। এইবার মুখ খুলল ধূসর। বরাবরের মতো গম্ভীর তার গলার স্বর,
" আমার মনে হয় আপনাদের আরেকটু স্ট্রিক্ট হওয়া প্রয়োজন। ক্লাসে মনোযোগ না দিলে শুধু কান ধরানো নয়, দরকার পড়লে হাফ চেয়ার বানিয়ে রাখবেন।” 

পিউ হাঁ করে চাইল। শত্রুতো তার ঘরেই। কী নির্মল লোক রে বাবা! কোথায় ওকে এভাবে দেখে দুঃখে দুভাগ হবে,তা না। 
ধূসর বলল,
" আমি এখন আসছি, স্যার। আপনি কিন্তু আসবেন!" 
ভদ্রলোক গদগদ হয়ে বললেন,
" আরে নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই! তুমি নিজে এলে নিমন্ত্রণ জানাতে আমি আসব না?" 
" থ্যাংক ইউ।" 

ধূসর চলে গেল। যেতে যেতে একবারও পিছু ঘুরল না। সপ্তদশীর চাতক চাউনী ফের আহত হলো। কষ্টে ভাসতে গিয়েও সোজা হলো,সামনে কবিতা দাঁড়িয়ে বলে। ভদ্রমহিলা গমগমে কণ্ঠে বললেন,
“ যাও। আর যেন এরকম না দেখি।” 
ঝটপট ঘাড় নাড়ল পিউ। বোঝাল,
আর এমন হবে না। ক্লাসে ঢুকল হাসিহাসি মুখে। এই যে এতক্ষণ কান ধরে পুরো কলেজের মাঝে দাঁড়িয়েছিল,সেসবের চিহ্ন মাত্র নেই। 
তার হাস্যোজ্জ্বল মুখটা দেখে কপাল গোছায় তানহা। 
অবাক হয়ে ফিসফিস করে,
“ তুই হাসছিস কেন? এভাবে কান ধরে দাঁড়িয়ে ছিলি, লজ্জা করছে না?" 

পিউ পালটা অবাক হোলো 
" নিজের কানইতো ধরেছি,লজ্জা করবে কেন?" 

কলেজ,কোচিং সব সেড়ে পিউয়ের বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে যায়। তারওপর শীতকাল, বেলা ছোট। 
সাদিফ আসে ওর পরপরই। আজকেও একই সময় এলো। কাধ থেকে লম্বা ব্যাগটা নামিয়ে রেখেই ধপ করে বসল সোফায়। পিউ সেটার অন্য মাথায় বসে। মেয়েটার এদিকে মন নেই। মনোযোগী চোখদুটো টেলিভিশন আটকে। 
 তক্ষুনি মাথায় টোকা দিলো সাদিফ। হুকুম করল খসখসে গলায়,
" সারাক্ষন টিভি। এক গ্লাস পানি নিয়ে আয় যা।" 
পিউ বিরক্ত চোখে চাইল। না করবে ভাবলেও,সাদিফের ক্লান্ত মুখটায় নিভে গেল তা।  
“ যাচ্ছি” বলেই ছুটল খাবার ঘরে। 

পিউ ফিরে এলো মিনিট কয়েকে। গ্লাস বাড়িয়ে দিতেই আলোর মতো হাসল সাদিফ। প্রচণ্ড ফরসা ছেলের হাসিটা চোখ ধাধিয়ে দেয়ার মতো। কিন্তু পিউয়ের তো ধ্যান এসবে নয়। সে উৎসুক চিত্তে টিভির স্ক্রিন দেখছে। কেজিএফ চলছে। হিরোটা এত ড্যাশিং। একেবারে ধূসর ভাইয়ের মতো সারাক্ষণ কপাল কুঁচকে রাখে। হাসেও না।
সাদিফ আড়চোখে পিউকে দেখল এক পল। 
হাসল সে। জিজ্ঞেস করল 
“ টিভি দেখতে অনেক ভালো লাগে, তাই না?” 
পিউয়ের চিত্ত প্রফুল্ল,
“ খুউব।
আপনার কি আর কিছু লাগবে?” 
মাথা নাড়ল সাদিফ। পিউ জায়গায় এসে বসল আবার। 
সাদিফের পানি আনার কাজ তার নতুন নয়। অফিস থেকে ফিরেই সব সময় বলবে, 
“ পানি দে। “ 
তাতে আশেপাশে লোক থাকুক, না থাকুক। এমনকি পিউ ঘরে থাকলেও ডেকে নামাবে। 
মেয়েটা মাঝেমধ্যে বিরক্ত হয়। বিড়বিড় করে বকাঝকা করে। 
কিন্তু মুখের ওপর না বলে না। শত হোক,বড়ো ভাই তো। 
তবে এই ভদ্রতার মাঝেও পিউয়ের অন্যরকম আক্ষেপ মিশে থাকে। সাদিফের মতো ধূসর কেন ওকে দিয়ে কাজ করায় না? কেন বলে না,পিউ আমাকে পানি এনে দে? তাহলে তো জান-প্রাণ খুইয়ে হলেও,পানির গ্লাস মাথায় নিয়ে বসে থাকতো পিউ। 

সাদিফ পেশায় একজন চার্টারড একাউন্টেন্ট। একটা ভালো কোম্পানিতে সদ্য চাকরি পেয়েছে। একেবারে সোজা ম্যানেজার পোস্ট। 
এই গুণেই ছেলেটা পরিবারের নয়নমণি এখন। অবশ্য ছোটো থেকেই সাদিফ ভীষণ বাধ্য,ভদ্র ছেলে। বড়োদের সাথে ঠোঁট মিলিয়ে তর্কে নামার রেকর্ডটা ওর থলিতে নেই। প্রথম প্রথম বাপ-চাচারা ব্যবসার জন্যে চাপ দিলেও, তার স্বীয় চেষ্টার এই উন্নতিতে আর মতবিরোধ করেননি। আর যাই করুক,ধূসরের মত তো আর বখে যায়নি! 

সাদিফের চেয়ে ধূসর বয়সে বড়ো। সম্পর্কে ভালোবাসারও কোনো খামতি নেই। বাড়িময় মানুষের দুই ভাইকে নিয়ে দুরকম নাচানাচি তাদের মধ্যে কোনো প্রভাবই ফেলে না। 
মানুষ হিসেবে দুজন ভিন্ন মেরুর। 
সাদিফ শান্ত,ধীরস্থির, হাসিখুশি। ধূসর ঠিক বিপরীত তার। বাউন্ডুলে,সাহসী বেপরোয়া, প্রচণ্ড অশান্ত ছেলে। সেজন্যেইতো কর্তাদের যত চিন্তা। বিশেষ করে,আমজাদ সিকদারের। 
ধূসর পরিবারের বড়ো ছেলে। জ্ঞাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট সে। যার মাথার প্রত্যেক কোষে ব্যবসা সামলানোর বুদ্ধি আছে। এমন এক রত্নের বিপথে যাওয়া,ভদ্রলোক কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না। 

হাজার বার বারণ করলেও ধূসর মাথা দোলায়,স্বায় দেয় ক্ষণিকের। কিন্তু আদৌতেও রাজনীতি ছাড়ার নাম নেয় না। তাকে যে আর ফেরানো সম্ভব না,এতদিনে বুঝে গেছেন আমজাদ।

সাদিফকে নিয়ে বাপ-চাচাদের যেমন গদগদ ভাব? ধূসরকে নিয়ে একই অবস্থা এ বাড়ির গৃহীনিদের। মিনা বেগম তো অন্ধ তার প্রতি। 
বাইরের লোক, বাড়ির লোক মাঝেমধ্যে ভুলে বসে, ছেলেটা আসলে কার? রুবায়দা, মিনার? ধূসর নিজেও মিনার ন্যাওটা। খাবার চাওয়া থেকে শুরু করে যে কোনও কিছু মাকে কম,বড় মাকে হাঁক ছোড়ে বেশি। 
বাড়ির প্রতিটা মানুষকেই সে ভালোবাসে। বাসেনা শুধু পিউকে।
পক্ষান্তরে মেয়েটা তার এক ফোঁটা ভালোবাসা পাওয়ার জন্যে প্রচণ্ড মরিয়া!

সাদিফ পানি খেয়ে গ্লাসটা পিউয়ের হাতে দিলো। মেয়েটা আরেকদফা বিরক্ত হলো তাতে। টেবিলেই তো রাখা যায় এটা! ওর হাতে দেয়ার কী দরকার? 
এই বীতস্পৃহা পিউ এবার ঠেসে রাখতে পারল না। বলল ফটাফট, 
" আপনার খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করা দরকার সাদিফ ভাই।" 
ছেলেটা ভ্রু কোঁছায়,
“ কেন?” 
" এই যে আপনাকে পানি দিতে গিয়ে আমি সিনেমার কতকিছু মিস করি। একটা ভাবি থাকলে এটা আর হবে না।" 

সাদিফের ঠোঁট দুটো বেঁকে গেল। লম্বা-দীর্ঘ রেখার মতোন হাসল সে। কিচ্ছু বলল না। কালো ব্যাগটা হাতে তুলে উঠে দাঁড়াল ফিরতে। 
এক পা বাড়িয়েও ফেরত এলো আবার। 
পিউ একইরকম বসে। ও
কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
" এই রহস্য একদিন বুঝবি, পিউ। আরেকটু বড় হ, তারপর বলব।" 

চলে গেল সে। পিউ কৌতুহল নিয়ে চেয়ে থাকে। আঠেরতে পা দেবে সামনে ,আর কত বড় হবে ও?

******

ধূসরকে সকালে নাস্তার টেবিল ছাড়া পাওয়া যায় না। সবার সাথে ও খুব কম খেতে বসে। দুপুরে বাড়ির লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। রাতে ফেরে খাওয়া দাওয়ার পর। অবশ্য এই রুটিন বিগত কয়েকদিনের। তাদের দলের মেয়র নির্বাচন সামনে। সে নিয়েই ধূসরের নিরন্তর খাটাখাটি, ছোটাছুটি। 
আজ শুক্রবার। একমাত্র সাদিফ ছাড়া বাকি সকলের ছুটির দিন। ধূসর এইদিনেও বাড়ি থাকে না । এর কারণ,বাপ-চাচাদের সামনে না পড়ার চেষ্টা। পরলেই তাদের এক প্রশ্ন, 
'ব্যবসায় জয়েন করবে কবে? আর কত রাজনীতি করবে,এবার ওসব ছাড়ো। '

বাক্যগুলো সবথেকে বেশি বলেন আমজাদ সিকদার। রাজনীতির সঙ্গে তার যোজন-যোজন দুরুত্ব। সেখানে বাড়ির বড় ছেলে এই নিয়ে পড়ে থাকুক,কোনোমতেই চান না তিনি। কিন্তু ধূসর প্রতিবার প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যায়। না সঠিক সুরাহা দেয়,না যায় তর্কে। এসব বাড়ির বহু পুরনো কাসুন্দি। যার নাড়াচাড়ায় প্রতিটি সদস্য এখন বিরক্ত,হতাশ। আর তাই ধূসর খেতে বসে কর্তারা বাড়ি ছাড়লে, বা বন্ধের দিন সবার খেয়ে ওঠার পর। না মুখোমুখি হবে ওনাদের,আর না ওনাদের প্রশ্নের। 
 
******

 পিউ হুটোপুটি করে এসে নাস্তার টেবিলে বসল। বড় যত্ন আর আশা নিয়ে পাশের চেয়ারটা খালি রাখল প্রিয় মানুষটার জন্যে। ধূসর ভাই আসবেন,বসবেন এখানে। রাদিফ আপ্রাণ চেষ্টা করল ওখানে বসতে। পিউ কিছুতেই দিলো না। না মানে না। মিনা ধমকালেন। পুষ্প চোখ পাকাল। 
কিন্তু পিউ অটল তার সিদ্ধান্তে। ধূসরের পাশে বসে থাকার অল্প সময়ের একটু অনুভূতিও তার কাছে বিরাট কিছু। এই অনুভূতি কী কাউকে বলে বোঝানো যায়? 

কিন্তু প্রতিবারের মত আজকেও আহত হলো মেয়েটা। কথাবার্তা ছাড়াই, সাদিফ দুম করে বসে পড়েছে সেখানে। পিউ চেয়েও নিষেধ করতে পারেনি। কিন্তু মনে মনে ভীষণ ক্ষেপল ওর ওপর। এই মানুষটা কে নিয়ে আর পারা যায় না! এত্তগুলো চেয়ার ফাঁকা, এখানেই বসতে হলো? পিউ কপালে ভাঁজ সমেত চুপ করে রইল। বিষয়টা চোখে পড়ল পুষ্পর। বলল,
 " তুই কি এতক্ষন সাদিফ ভাইয়ার জন্যে চেয়ার ধরে রেখেছিস?" 
 
পিউ না বলতে গিয়েও, খেয়াল করল সাদিফ ওর দিকে চেয়ে। মুখের ওপর না শুনে যদি কষ্ট পান! তাই দুপাশে নাড়াতে চাওয়া মাথাটা সবেগে ওপর-নিচে দোলাল। বোঝাল " হ্যাঁ। " 
সাদিফ মুচকি হেসে চায়ের কাপে চুমুক দেয়। অথচ পিউয়ের থমথমে মুখটা দেখতেই পেলো না। 
মিনা বেগম পরোটা শেঁকে প্লেট ভরে নিয়ে এলেন। সুমনা তার থেকে একটা নিয়ে ছোট ছোট টুকরো করে ছিড়লেন। পাশেই চেয়ারে দুপা উঠিয়ে বসে রিক্ত। পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য সে। বয়স মাত্র ছয় হলেও পাঁকামোতে এগিয়ে।

জবা বেগম মিনাকে বললেন,
" আপা, তুমি এখন বসো। আমি বাকিটা সামলাই।" 

তিনি ঘাড় নাড়লেও, বসলেন না। একইরকম কাজে ব্যস্ত তখনও। বাড়ির বড় বউ হওয়ায়, কাঁধে দায়িত্বের চওড়া চাপ । এমন নয় যে কেউ চাপিয়ে দিয়েছে। মিনা বেগম যা করেন স্বেচ্ছায়,সংসারের প্রতি ভালোবাসা থেকে। কাজ ব্যাতীত দুদণ্ড বসতে পারেন না। তিনি
 পুরো টেবিলে একবার চোখ বুলিয়ে বললেন,
" এ কী! ধূসর এখনও আসেনি?" 
রান্নাঘর থেকে রুবায়দা উত্তর দিলেন,
" রাত করে ফিরেছে, আপা। ঘুমোচ্ছে মনে হয়।" 

মিনা, পুষ্পকে বললেন,
" এই যা তো, ওকে তোল গিয়ে। কত বেলা হলো, খাবেনা ছেলেটা?"

পিউ চকিতে চাইল। ফটাফট বলল,
" আপু থাক,আমি যাচ্ছি।" 

কারো কোনও উত্তরের আগেই ছুট লাগাল সে। দুরন্ত কদম দেখে সুমনা সাবধান করলেন,
" আস্তে আস্তে,পরে যাবি।" 

কে শোনে কার কথা! পিউ এক দৌড়ে ধূসরের ঘরে ঢুকল। উত্তেজিত হস্তখানার ধাক্কায়, চাপানো দোর বারি খেল দেয়ালে এসে। এত জোরে শব্দ হলো! পিউয়ের ঘাবড়ে যায়। ভয়ে ভয়ে তাকায় বিছানার দিকে। না, ধূসরের ঘুম ভাঙেনি। পিউ স্বস্তি পেলো। শ্বাস ফেলল মুখ ফুলিয়ে!  

ধূসর উপুড় হয়ে ঘুমোচ্ছে। নিঃশ্বাসের শব্দ জোড়ালো। কোমড় অবধি টানা কম্বলে, উদাম তার শ্যামলা পিঠ। পিউ আস্তেধীরে এগোয়। কাছাকাছি যায়। 
বিছানা ঘেঁষে, ফ্লোরে হাঁটুভেঙে বসে। তারপর গালে হাত দিয়ে চেয়ে থাকে ধূসরের শক্তপোক্ত চিবুকের দিকে। ইশ! কী দারুণ দেখতে উনি! আচ্ছা,
কেন সাদিফ ভাইকে সুন্দর বলে সবাই? তারা কী ওর চোখ দিয়ে কখনও ধূসর ভাইকে দেখেনি? এই যে মানুষটা ঘুমিয়ে আছে, এতেও যেন সৌন্দর্য কমেনি। কমেনি তার নিপুণতা। মনে হচ্ছে সম্মুখে পৃথিবীর সবথেকে শোভিত পুরুষটা শুয়ে। পিউ সন্তর্পণে হাত এগোলো। এলোমেলো করে দিলো ধূসরের মাথার চুল। মিহি কন্ঠে মিষ্টি করে ডাকল,
" শুনছেন? উঠুন। সকাল হয়েছে তো! 
ধূসর নড়ে উঠল,চোখ মেলল না। উপুড় থেকে সোজা হয়ে শুলো আবার। তন্দ্রাচ্ছন্ন শব্দে আওড়াল একটু,
" উম,পরে…”

পিউ মুচকি হাসল। অভিনিবিষ্টের ন্যায় চেয়ে থেকে বলল,
" আচ্ছা ধূসর ভাই, সারাজীবন আপনাকে এভাবে ঘুম থেকে তোলার দায়িত্বটা আমাকে দিতে পারেন না? আমি আমার এই নরম হাত দিয়ে প্রতি ভোরে আপনার জন্যে চা বানাব। তারপর রুমে এসে আলতো করে ছুঁয়ে দেব আপনাকে। পৃথিবীতে যতরকম মধু পাওয়া যায় সব আমার কণ্ঠে মিশিয়ে ডাকব,
" ওগো শুনছো, তোমার চা এনেছি। উঠবেনা? 

ঘুমে জুবুথুবু ধূসরের জবাব এলো না। এত গভীর ঘুম দেখে পিউয়ের মাথায় দুষ্টুমি ভর করে। ঠোঁট টিপে আরেকটু এগিয়ে বসল সে। তর্জনী তুলে ধূসরের কপালে ছোঁয়াল । নাক ছুঁয়ে ছুঁয়ে টেনে নামানোর মধ্যেই আচমকা আঙুলটা খপ করে চেপে ধরল ও। পিউ আঁতকে ওঠে। চমকে যায়। ধূসর চোখ মেলেছে। দুর্বোধ্য চাউনী এদিকেই। পিউ ঢোক গিলল। বিড়বিড় করল,
“ পিউ রে! এবার তুই গেলি!' 
.
.
.
চলবে.....................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp