অনন্যার মুখ জুড়ে অসহায়ত্ব। ব্লাউজ বুকে চেপে বিছানায় শক্তপোক্ত হয়ে বসে। নয়ন ভর্তি অশ্রু। লালিত গাল জোড়া। মেহেন্দি অনুষ্টান শুরু হবে প্রায়! আর ব্লাউজ শরীরে আঁটছে না! কষ্টে-দুঃখে অনন্যার কান্না পাচ্ছে। খালাতো বোনের বিয়ে নিয়ে কতশত জল্পনাকল্পনা, আনন্দ, স্বপ্ন মূহুর্তে ভেঙেচুরে ছারখার।
দরজায় করাঘাত হচ্ছে। ভেসে আসছে নারী কন্ঠ, 'এইরে অনু! কী করছিস এতক্ষণ যাবত? শাড়ি কি পরবি না?'
অনন্যা অভিমানী গলায় জবাবে বলে, 'পরব না। শাড়ি আমি পড়ছি না।'
'এই? কী বলছিস কী? শাড়ি পড়বি বলে কতো খুশি ছিলি। কি হয়েছে মনা আমার? দরজা খোল। ছোটো মাকে বল।'
অনন্যা দরজা খুলে না। বরং নীরবে কেঁদে ফেলে। বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ে। একটুই তো মোটা সে। অনেক তো নয়! বাবা তো প্রত্যেকদিন বলে, 'অনন্যা আমার সুন্দরতম প্রিন্সেস। আমার অনন্যাকে এভাবেই সুন্দর লাগে। শুঁকিয়ে গেলে এই সৌন্দর্য থাকবে না।' অথচ বাবার কথা শুধু বাবার। অন্যদের চিন্তাভাবনা একদমই তার বাবার মতো নয়। মোটেও নয়। সবাই কথায় কথায় ফার্মের মুরগী বলে কটাক্ষ করে। মুটকি বলে অপমান করে। আর আজ ত তার 'ব্লাউজের সাইজ' নিয়ে অপমানিত করল।
অনন্যার ব্লাউজ সাইজ বাড়ির বাকি মেয়েদের থেকে আলাদা। চাচাতো খালাতো বোনেরা স্লিম কি-না! অনন্যাই বাবার মতো মোটাসোটা। এই নিয়ে অনন্যার মাথা ব্যথা নেই। মাথা ব্যথা বাকিদের। খালাতো বোনদের চাচাতো বোনগুলো অনন্যাকে দেখলেই, কপাল কুঁচকে বসে। অগোচরে লুকিয়ে বাজে কথা বলে। আর এবার ত অনন্যার ব্লাউজ সাইজ পরিবর্তন করে ফেলেছে। ইচ্ছে করে এমন করেছে তার সঙ্গে। নিচু দেখতে চায় কি-না!
_______
প্রিয়া অনন্যার প্রিয় খালাতো বোন। সবথেকে পছন্দের মানুষ। সেই মানুষের আজ মেহেন্দি। কীভাবে না যায় অনন্যা? কান্নাকাটি বন্ধ করে উঠে বসে৷ চিকন ব্লাউজ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে বিছানায় রেখে দেয়। পাশেই সবুজ রঙের জর্জেট শাড়ি। আজকের অনুষ্ঠানের থিম হচ্ছে সবুজ রঙ। স্মার্ট ফোনটা ড্রেসিংটেবিল থেকে উঠিয়ে হাতে নেয়৷ সে কল করে তার বাবাকে।
বাবা ফিরোজ আলম তখন নিউজপেপার পড়ছিলেন মনোযোগ দিয়ে। তার ফোনটা সচরাচর সঙ্গেই থাকে। ব্যবসার খাতিরে ফোনকল আসতেই থাকে। সেই সূত্রে সে হারিয়ে গেলে ব্যাপার না, তবে সেলফোন হারানো যাবে না। পাশেই থাকতে হয়। রিং হতেই নিউজপেপার সরিয়ে ফোনের স্ক্রিনে তাকালেন। স্ক্রিনে তার আর তার মেয়ের একটি ছবি ভেসে উঠল। অনন্যা আর ফিরোজ আলম হাসছেন। মোটাসোটা দুজন হুবহু একইরকম দেখতে। চেহারার মিল অবিশ্বাস্য ধাঁচের। ফিরোজ আলম চশমা খুলে, ফোনটা তুলে নেন। কল রিসিভ করে কানে ধরেন। নরম গলায় বলেন, 'মামণি! বিয়েবাড়িতে আনন্দ করছ ত?'
অনন্যা মুখ গোমড়া করে বলে, 'হু। কিন্তু পাপা আমার ব্লাউজ লাগবে।'
'তোমার খালাকে বারংবার বলে দিলাম, যা যা লাগবে নিয়ে দিতে। এতো ইম্পর্ট্যান্ট জিনিস মিস দিলেন। কেন?'
'দিয়েছিলেন ব্লাউজ। সাইজে হচ্ছে না।'
কথাটা বলতে নিতেই অনন্যার গলা ভেঙে আসলো। রেগে গেলেন ফিরোজ আলম। গলা উঁচিয়ে বললেন, 'সাইজে হবে কীভাবে? ওটার সাইজ কি ঠিকাছে? একদম না। ওসব সাইজ পড়ে চিক্না, শরীরে মাংস নেই যাদের তারা। আমি এক্ষুনি পারফেক্ট ব্লাউজ পাঠাচ্ছি শাহরিয়ারকে দিয়ে। ওকে? মন খারাপ করে না।'
অনন্যা ফোন রেখে বসে থাকে। আধঘন্টার মধ্যেই ডাক পড়ে তার। ব্লাউজ চলে এসেছে। অনন্যা দরজা খুলে দেয়। রুবিনা বেগম দাঁড়িয়ে। হাতে ব্লাউজ। সেটা নিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকলেন। দরজা লাগিয়ে অনন্যার কাঁধ ধরলেন, 'আমাকে বলবি না? আমি তক্ষুনি কাউকে পাঠিয়ে একটা আনাতাম কিনে।'
অনন্যা কিছু বলে না, তবে হাসে টোল দেখিয়ে। রুবিনাও হাসে। অনন্যার গালে হাত বুলিয়ে দেয়। নিজ হাতে সুন্দর ভাবে শাড়ি পরিধান করায়। বড়ো চুলগুলো-তে স্টাইলিশ বিনুনি গেঁথে দেয়। সামনে কিছু লম্বা চুল বের করে রাখে। অনন্যা সাজতে বসে ড্রেসিং-টেবিলের সামনে। রুবিনা বেড়িয়ে যায়। সেজেগুজে বাগানে আসতে-আসতে সন্ধ্যা সাতটা। গান বাজছে স্লো বিটে। স্টেজে আরও কিছু ফুল লাগানো হচ্ছে। রাস্তা বানানো হচ্ছে ফুল দিয়ে। ফুলের রাস্তা দিয়ে এন্ট্রি করবে, হবু-বঁধু। কুঁচি ধরে অনন্যা স্টেজের দিক যেতে থাকে। ওখানে তার খালাতো ভাই-বোনেরা। আঁখি তাকে দেখতেই প্রশংসা করে, 'মাশাআল্লাহ। আমাদের অনন্যাকে হুরপরী লাগছে।'
অনন্যার মন খারাপ চট করে চলে যায়। সে প্রশংসা শুনতে খুব পছন্দ করে। কেউ একটু ভালো কথা বলে দিলে, নিমিষেই মন খারাপ উবে যায়। ভুলে যায় মন খারাপের কারণ। দিব্বি লেগে পড়ে অনুষ্ঠান উপভোগ করতে।
____
একপর্যায়ে অনন্যা পশ্চিম দিকে আসে, একটা ফুল তুলতে। বাড়ির পেছন দিকটায়। ফুলটা কানে গুঁজবে। তাজা ফুলের সৌন্দর্য কানে শোভা পাবে দারুণ ভাবে। সেই সুবাধে সেখানে পৌঁছাতেই তাজ্জব বনে যায়। মেঘালয় দাঁড়িয়ে। বিশ্রী গন্ধযুক্ত কিছু একটা খাচ্ছে। তার সামনে একটা মেয়ে শাড়ির আঁচল ফেলে দাঁড়িয়ে। মেয়েটাকে চিনতে কষ্ট হয়না অনন্যার। রিধিকা! রিধিকাই তো তার ব্লাউজের সাইজ নিয়ে কাহিনী ঘটিয়েছে। অনন্যা হাসফাস করে ওঠে। চোখ নামায়। পাশেই ফুলের সাড়ি। এতদূর এসে চলে যাবে না নিয়ে? অনন্যা আরেকবার মাথা তুলে তাকায়। মেঘালয় তাকিয়ে এদিকেই। তবে রিধিকা তাকে দেখেনি। অনন্যা দ্রুত পায়ে কিছুটা এগিয়ে, ঝুঁকে একটি ফুল নিয়ে দৌড় লাগায়। স্বাস্থ্যসম্মত মেয়েটা একটু দৌড়ে হয়রান হয়ে পড়ে। বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলে। বকাঝকা করে রিধিকাকে। নষ্ট মেয়ে! আত্মসম্মান বলতে কিচ্ছু নেই। মেঘালয় পাত্তা দেয়না তবুও পেছনে ঘুরে বেড়ায়। এবার তো শেষ সীমানায় চলে গিয়েছে।
মেঘালয়কে অনন্যা চিনত না। চিনেছে গতকাল। ডাইনিংয়ে খেতে বসে। মেঘালয় তার বড়ো খালুর মালিকের ছেলে। বড়সড় কোম্পানির উত্তরাধিকার সে। ভালো সম্পর্কের টান ধরেই জোরপূর্বক বিয়ের কিছুদিন আগেই, দাওয়াত করে নিয়ে এসেছে। বেশ খাতিরযত্ন করা হচ্ছে তার। যেন কোনো দেশের রাজপুত্র এসছে। দেখতেও রাজপুত্রের মতো। লম্বাচওড়া, স্লিম। টানটান মুখশ্রীর অধিকারী। চোখে বিঁধে তার সুদর্শনতা। কাল থেকেই রিধিকা পিছনে পড়ে। শুধু অবশ্য রিধিকা নয়। আরও অনেকেই। অনন্যা ঠিকঠাক দেখছে ওদের পাগলামি।
দু-হাত জুড়ে মেহেন্দি দিতে বসে অনন্যা পড়ল বিপাকে। বের করে রাখা চুলগুলো
বিরক্ত করছে। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে আশেপাশে তাকায়। দেখতে পায় অদূরে মেঘালয় দাঁড়িয়ে ছেলেপুলেদের গ্রুপে। সেখানে অনন্যার খালাতো ভাইয়েরাও উপস্থিত। কিছু একটা নিয়ে হাসাহাসি করছে। মেঘালয়ের দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলে যায় তৎক্ষণাৎ। অনন্যা দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। মেহেদী আর্টিস্টকে বলে, 'আপু। চুলগুলো একটু কানে গুঁজে দেবেন প্লিজ?'
মেহেদী আর্টিস্ট রাজি হয়। আনন্দিত ভঙ্গিতে গুঁজে দেয় অনন্যার চুল। হাফ ছেড়ে বাঁচে মেয়েটা। মহানন্দে পড়তে থাকে মেহেদী। দু-হাতে মেহেদী পড়ে উঠে দাঁড়ায়। কনুই ধরে আঙুল পর্যন্ত, ফর্সা হাতে সবুজ রঙের মেহেন্দি দেখতে আকর্ষণীয় লাগছে। অনন্যা নিজেই বারবার দেখে মুগ্ধ হচ্ছে। সে ছবি তুলতে চাচ্ছে। দু-হাত মুখের সামনে ধরে কিছু ক্যান্ডিড ছবি তুলবে। বাবাকে দেখাতে হবে না? অনন্যা সামনে এগুতে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। ফটোগ্রাফার ওদিকেই তো মেঘালয় ওরা দাঁড়িয়ে। লোকটাকে দেখলেই অস্বস্তি হচ্ছে অনন্যার। একটু আগে সে রিধিকাকে দেখেছে। কাঁদছিল মেয়েটা। গাল লাল। চড় খেয়েছে মনে হয়। ঠিকই আছে। দুষ্টু মেয়েটার উচিৎ শিক্ষা হলো।
অনেকেই ছবি তুলছে। অনন্যা যেতেই খালাতো ভাই রাসেল বলে, 'এই অনু ছবি তুলে নে। দাঁড়া এক্ষুনি দাঁড়া।'
মাথা দুলায় অনন্যা। মুখে বলে, 'আমি বাগানে তুলব। এইযে এদিকে। ফুলের কাছটায়। ভাইয়া আপনি তুলে দিন না।'
রাসেল ক্যামেরা নেয় ফটোগ্রাফার থেকে। সে এগুতে নিলে মেঘালয় তার হাত থেকে ক্যামেরা নেয়। হেসে বলে, 'তুমি না ব্যস্ত? আমি তুলে দেই?'
রাসেল অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। তাকায় অনন্যার দিক। অনন্যা জড়সড় হয়ে গিয়েছে। মেয়েটা ক্যামেরা শায়। একটু মোটাসোটা দেখে খুবই লজ্জা পায়, অন্যদের হাত থেকে ছবি তুলতে। আবার সে মেঘালয়কে না ও করতে পারছে না। বাবার আদেশ এই মানুষের জন্য কোনো না নেই। তার প্রত্যেক জবানে জবাব আসবে হ্যাঁ। উপায় না পেয়ে হেসে মাথা দোলায়। উঁচু গলায় বলে, 'অনু এইযে মেঘালয়। খুব ভালো ছবি তুলে। ছবি তুলে নে তার থেকে কেমন?'
অনন্যা না করতে চাইছে। সে তুলবে না। কিন্তু পারছে না। লোকটা চলে এসেছে। এখন মুখের ওপর না করাটা কী ভালো দেখাবে? নিশ্চয়ই অপমান বোধ করবে? বাধ্যতামূলক মেয়েটা এগোয় ছবি তুলতে। ঘাসের সঙ্গে শাড়ি মিলিয়ে যাচ্ছে। হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে। কুঁচি যে ধরবে উপায় নেই। তার পেছনেই মেঘালয়। হুট করে সামনে এসে দাঁড়ায়। ঝুঁকে অনন্যার কুঁচি ধরে শাড়ি কিছুটা ওপরে তুলে। থমকে যায় অনন্যা। বড়ো বড়ো চোখে তাকায়। অবিশ্বাস্যতা লেপ্টে মুখশ্রী জুড়ে। মেঘালয় পুরুষালি ভারী গলায় বলে, 'হাঁটা বন্ধ করলেন যে?'
অনন্যা আতঙ্ক নিয়ে সামনে পা বাড়ায় রোবটের ন্যায়। ফুলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তার সামনে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ায় মেঘালয়। ক্যামেরা চোখের সামনে ধরে নাড়াচাড়া করে। অনন্যা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে। মেঘালয় চোখ থেকে ক্যামেরা সরিয়ে শুধায়, 'পোস নিবেন না বুঝি? অবশ্য…. আপনার পোস না নিলেও হয়। যেভাবেই ক্যামেরা তাঁক করিনা কেন, শুধু সৌন্দর্যই ভেসে ওঠে।'
বাকরুদ্ধ হয়ে গেল অনন্যা। আরেকদফায় কিংকর্তব্যবিমুঢ় মেয়েটা! গোলগাল স্বাস্থ্যসম্মত মুখশ্রী করুণ। লোকটা কী তিরস্কার করছে তার? নাকি সত্যি প্রশংসা? এই প্রথম.. প্রসংশা শুনে ভালো লাগার পরিবর্তে, অনন্যার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এসেছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা। মেঘালয় ইতোমধ্যে ছবি তুলতে শুরু করেছে। লজ্জিত অনন্যা দু'হাতের উল্টোপিঠ মুখের সামনে ধরে, মুখশ্রী আড়াল করে। সেভাবেই ছবি তোলে মেঘালয়। হাত নামাতেই আরও কিছু ছবি তুলে। একপর্যায়ে লাজুক অনন্যা বলে,'আর তুলব না। ধন্যবাদ।'
মেঘালয় হাসে, 'ইটস মাই প্লেজার! অ্যাই আপনি চলে যাচ্ছেন নাকি? ছবি দেখবেন না?'
অনন্যা না চাইতেও মাথা দোলায়। এগিয়ে আসে মেঘালয়। কড়া পারফিউমের ঘ্রাণ ঘিরে ধরে অনন্যাকে। লম্বাটে দেহ তার ওপর। হালকা ঝুঁকে ক্যামেরা ধরে তার চোখের সামনে। অন্যপাশে তাকিয়ে রয়েছে সে। মেহেদী ভর্তি হাত দুটো সামনে। তার পেছনে ফুল। আঁধারে নিমজ্জিত সাদাটে আলোয় ছবিটি ধবধবে ফর্সা উঠেছে। মোটাসোটা তাকে খারাপ লাগছে না। ছবি দেখে ভালো লাগল অনন্যার। মনোযোগ সহ দ্বিতীয় ছবিটিও দেখল। তৃতীয় ছবিটি দেখতেই মুখশ্রী থমথমে। পাতলা জর্জেট শাড়ি খানা বাতাসে দুলেছে। পেটের দিক থেকে সরে গিয়ে, পেট দৃশ্যমান। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে অনন্যা। ধীর গলায় বলতে নেয়, 'ছবিটা ডি…'
মেঘালয় পূর্বেই বলে, 'ছবিগুলো সুন্দর হয়েছে। অবশ্য রূপবতীদের ছবি সর্বদাই সুন্দর হয়।'
অনন্যা ছোট করে পুনরায় ধন্যবাদ বলে কেটে পড়ে। ঢুকে পড়ে বাড়ির ভেতর। কাজকর্মতে ব্যস্ত সবাই তখন। খিদে পেয়েছে তার। কিছু খাওয়ার জন্য ডাইনিংয়ে আসে। রুবিনা দাঁড়িয়ে সেখানে। অনন্যাকে দেখতেই বলে, 'খিদে পেয়েছে না? অল্প একটু খেয়ে নে আগেই। বোস, আমি আসছি।'
মাথা দোলায়। বসে সোফায়। রুবিনা প্লেটে বিরিয়ানি নিয়ে হাজির। নিজ হাতে খাইয়ে দেয়। খেয়েদেয়ে সেখানেই বসে থাকে অনন্যা। মেঘালয় নামের লোকটা তখন মস্তিষ্ক জুড়ে তার।
______
চলবে~
অনন্যার আছে মেঘালয় - ২
_______
হলুদে অনন্যা হলুদ লেহেঙ্গা পড়ে । কোনোভাবেই শাড়ি পড়বে না জানাল! শাড়ি পড়ে ভীষণ বিপাকে পড়েছিল গতকাল। আর পড়বে না। কখনোই না। মেক-আপ আর্টিস্ট এসেছে বাড়িতে। অনন্যা সেজেগুজে তৈরি। এরমধ্যে খালা বলে গেলেন, 'রাসেলকে বলে আয় আমি ডাকছি।'
'জি। যাচ্ছি।'
অনন্যা হলরুম ধরে যাচ্ছে। রাসেলের রুম পেছনেরটা। সে নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করে বিধায় তার রুম শেষপ্রান্তে। চারটা রুম ডিঙিয়ে কাঙ্ক্ষিত দরজার সামনে দাঁড়ায়। ছোটো করে করাঘাত করে। ধীর গলায় ডাকে, 'রাসেল ভাইয়া। আপনায় ডাকছে খালামণি।'
জবাবের আশায় থাকে না। চলে যেতে নেয়। পূর্বেই দরজা খুলে যায়। ভেতরে মেঘালয় দাঁড়িয়ে। উদোম শরীরে। গোসল সেড়েছে কেবল! হতবাক অনন্যা চোখ পিটপিট করে নজর ফেরায়। মেঘালয় হাসে। দৃষ্টিতে তার মুগ্ধতা লেপ্টে। গাল ভরে হেসে বলে, 'রুমটা আমি নিয়েছি। আমারটা রাসেলকে দিয়েছি।'
এখন রুম কেন হঠাৎ পরিবর্তন করেছে তা বুঝতে বাকি নেই অনন্যার। নিশ্চয়ই মেয়েরা ডিস্টার্ব করে বিধায়। বোঝার ন্যায় মাথা দোলায়। তাড়াহুড়ো পায়ে চলে যেতে চায়। মেঘালয় ডাকে, 'শুনুন।'
ফিরে তাকায় অনন্যা। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলে, 'জি?'
'সুন্দর লাগছে।'
অনন্যা ফিসফিস করে 'ধন্যবাদ' জানিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। ওখানে দাঁড়ানো সম্ভব হচ্ছিল না। লোকটা কী অনন্যাকে টার্গেট করছে কোনো কারণে? তাকে কী কোনো ফাঁদে ফেলতে চাচ্ছে?
হলুদ প্রোগ্রাম জুড়ে সর্বতোভাবে অপ্রস্তুত, জড়সড় হয়ে ছিল অনন্যা। মেঘালয় তার আশেপাশেই পুরোটা সময় জুড়ে। তাকিয়ে থাকে অদ্ভুত ভাবে। কী দেখে এতো? আর এতো কেন ছবি তুলে? অনন্যা কী বলেছে ছবি তুলতে?
এই মানুষটার জন্য অনন্যা একদমই উপভোগ করতে পারেনি অনুষ্ঠান। সর্বক্ষণ নুইয়ে ছিল।
______
বিছানায় এপাশ-ওপাশ করেও ঘুম আসছে না অনন্যার। মাথা জুড়ে মেঘালয়। একদম মস্তিষ্কে ঢুকে বসে। ওদিকে খালাতো বোনেরা ঘুমিয়ে পড়েছে দিব্বি। নাক টানছে ক্ষনে ক্ষনে। ওই মানুষটা কি জাদু করল? অনন্যা কেন ভুলতে পারছে না? ইচ্ছে করছে এক্ষুনি বাড়ি ফিরে যেতে। আর এভাবেও কাল তার পরিবার আসবে। মাত্র কিছু ঘন্টা। পরিবার এলে তো মেঘালয় আর তার পিছু পিছু ঘুরতে পারবে না। এরপর দাওয়াত খেয়ে সে ফ্যামিলির সাথে চলে যাবে। ব্যস!
সকালে অনন্যার ফ্যামিলি হাজির। বাবা-মা আর বড়ো ভাই। অনন্যা চারদিন পর পরিবারের মুখ দেখল। এতটা সময় পরিবার ছাড়া সে সচরাচর থাকে না। বড়ো ভাই অরণ্য অনন্যার ফুলো মুখশ্রী ধরে বলে, 'আমাদের পাণ্ডা বাসায় নেই, বাসায় আলোও নেই। বাসায় মজাও নেই। এভাবে এতদিন ধরে আর দাওয়াত খাওয়া যাবে না। ওকে?'
অনন্যা হেসে মাথা দোলায়। বিয়েতে বড়ো ভাইয়ের পাঞ্জাবির কালার ম্যাচ করে সে কামিজ পরে সাদা রঙের। এবং লেপ্টে থাকে তার বাবার সঙ্গে। যেখানে যাচ্ছে সেও পিছু পিছু যাচ্ছে। আজ আর আশেপাশে মেঘালয়কে দেখা গেল না। ফিরোজ সাহেব মেয়েকে বললেন, 'মামণি তোমার মাম্মামকে ডেকে নিয়ে এসো।'
'আচ্ছা।'
অনন্যা বাড়ির ভেতরে ঢুকে। বোনেরা-ভাইয়েরা ছুটাছুটি করছে। খালারা ব্যস্ত অত্যন্ত। কেউ বসে নেই। অনন্যা রুবিনা বেগমকে জিজ্ঞেস করল মায়ের কথা। তিনি বললেন ওপরে দেখেছে যেতে।
সে ওপরে ওঠে। হলরুমে দেখা মিলল শুভ্রতার। এই মেয়েটা ভীষণ ভালো। টুকটাক কথা বলে পুনরায় মাকে খোঁজার কাজে লেগে পড়ল।
স্টোর রুম পেরোতে নিতেই অদ্ভুত এক কাণ্ড ঘটল তার সঙ্গে। হুট করে স্টোর রুমের দরজা খুলল। হাতে পরপর টান অনুভব করে। কেউ তাকে টেনেহিঁচড়ে দ্রুত স্টোর রুমে নিয়ে গেল। আঁধার চারিপাশে। বড়সড় চোখে তাকানো অস্পষ্ট ভাবে মেঘালয়কে দেখতে পেল। পাঞ্জাবি-কোটি পরে একদম ফিটফাট। ঘাবড়ানো অনন্যার পিঠ ঠেকল দরজায়। তার ওপর হামলে পড়ে মেঘালয়। সুঠাম হাত দুটো দরজার দুপাশে। অনন্যা নড়েচড়ে বলে, 'কী হয়েছে? সরুন। কি দরকার!'
মেঘালয় সাবলীল গলায় জবাব দেয়, 'আপনায়। আমাকে এভয়ড করছেন। কারণ?'
অনন্যার দম বন্ধ হয়ে আসছে। সে বেরুতে চাচ্ছে এক্ষুনি। কিন্তু বেরোতে দেয় না মেঘালয়। চোখ রাঙিয়ে তাকায়, 'কথাবার্তা শেষ করি। তারপর যাবেন।'
অনন্যা বাধ্যগত মেয়ের মতো চুপসে যায়। ভয়ার্ত গলায় বলে, 'করছি না এভয়ড। সত্যি!'
'ওই ছেলেটা কে! আপনার সঙ্গে ছিল যে!'
অনন্যা অবাক গলায় প্রশ্ন করে, 'কোন ছেলেটা?' তারপর কিছুটা আন্দাজ করতে বলে, 'ও.. ওটা আমার ভাই, অরণ্য।'
মেঘালয় শান্ত হয়। এগোয় কিছুটা। আঁধারে দৃষ্টিপাত করে অনন্যার মুখশ্রীর পানে। পকেট থেকে ফোন বের করে। পাওয়ার বাটন চাপতেই স্ক্রিন জ্বলে ওঠে। স্ক্রিন মেলে ধরে অনন্যার চোখের সামনে। হতবিহ্বল হয় অনন্যা। ওয়ালপেপারে সে। তার ওই পেট দেখানো ছবিটা। লজ্জায় বাকরুদ্ধ সে বলে, 'এটা কেমন বিহেভিয়ার! আপনি… '
মেঘালয় বলে, 'আপনার নাম্বার বলুন।'
'বলব না।'
'কেন?'
'দেখুন এভাবে জ্বালালে আমি চেঁচাব।'
ধীর গলায় হাসে মেঘালয়। প্রশ্ন করে, 'আপনায় জ্বালাচ্ছি? আচ্ছা মানলাম জ্বালাচ্ছি। জ্বালাতে বাধ্য হচ্ছি। কে বলেছে আমার মন চুরি করতে? আমিতো বলিনি। এখন দায়ভার কার?'
ঢোক গিলে অনন্যা। বুকটা কেঁপে ওঠে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে নেই। কী এক অবিশ্বাস্য কাঁপুনি সর্বাঙ্গে বইতে শুরু করল! মেঘালয় পুনরায় বলে, 'নাম্বার বলুন। নাহলে যেতে দিব না।'
খুব সময় নিয়ে নাম্বার বলে অনন্যা। তারপর আশাহত সুরে বলে, 'এখন যেতে দিন।'
'ইচ্ছে করছে না।'
'এটা তো কথা ছিল না!'
দরজা থেকে হাত সরিয়ে এক আঙুলের সাহায্যের অনন্যার চোখের সামনে থাকা চুল আলগোছে কানের পেছনে গুঁজে দেয়। কেঁপে ওঠে অনন্যা। কঠিন ভাবে লেপ্টে যায় দরজার সঙ্গে। মেঘালয় মুখটা কাছাকাছি নিয়ে বলে, 'আপনি বুঝতে পারছেন তো কি করেছেন আমার সঙ্গে? এক প্রেমরোগে ফেললেন। উম…প্রেমে পড়েছি আপনার। ভালো লাগে আপনাকে। ডেট করতে চাচ্ছি। আপনার আমায় পছন্দ তো?'
চোখ বুঁজে নেয় মেয়েটা। কাতর গলায় বলে, 'প্লিজ যেতে দিন।'
মেঘালয় হাসে। সরে দাঁড়ায়। ছুটে বেরিয়ে যায় অনন্যা। এক দৌড়ে নিচে। সে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
_______
বিয়ের পর মেঘালয়কে আর দেখা গেল না। পরিবারের সঙ্গে বাড়ি ফিরে এলো অনন্যা। মস্তিষ্ক জুড়ে মেঘালয় নামের মানুষটা ঘাপটি মেরে বসে। রাত-দিন অন্যমনস্ক হয়ে রয় সে। ঘুম নেই দু-চোখের পাতায়। তিনদিনের দিন ভার্সিটি যায়। সে এবার থার্ড ইয়ার। সামনেই ফাইনাল। ক্লাস শেষে বেরিয়েছে মাত্র। সাথে তার বান্ধবী রিয়া।
এসময় সামনে চোখ যায় অনন্যার। হতবাক হয়
সামনে দাঁড়ানো মেঘালয়কে দেখে। লম্বাচওড়া মেঘালয় খুব সাধাসিধে ভাবে এসেছে। জিন্সপ্যান্ট আর শার্ট পরে। চোখে সানগ্লাস। তবে সাধাসিধে দেখতে তাকে লাগছে না। সে অনন্যার সামনে এসে দাঁড়ায়। রিয়া অবাক চোখে চেয়ে শুধায়, 'ইনি কে অনন্যা?'
মেঘালয় হাসে। বলে, 'বয়ফ্রেন্ড। আম হার বয়ফ্রেন্ড। নাইস টু মিট ইউ।'
____
ঠিক এভাবেই অনন্যার কপালে এক সুদর্শন বয়ফ্রেন্ড জুটে যায়। অদ্ভুত ভাবে প্রণয় হয় দুজনের। গভীর প্রেমে ডুবতে থাকে দিন বা দিন।
এই গাঢ় প্রেমে পড়ে প্রায়সময় কেঁদেছে অনন্যা। টুকটাক কথা কাটাকাটি হলেই কেঁদে ভাসায়।
রাতে কল করল মেঘালয়। টুকটাক কথা হতেই, অনন্যা প্রশ্ন করে, 'আপনার আমায় কেন পছন্দ? আমিতো মোটা।'
'শরীরে গোস্তো না থাকলে ধরে মজা নেই।'
ব্যস আর কোনো কথাই বলতে পারল না মেয়েটা। এভাবে কী চুপ করানো খুব বেশি দরকার? সেদিন অনন্যা ডায়রি লেখে। ওপরে বড়ো বড়ো অক্ষরে লিখে 'অনন্যার আছে মেঘালয়।'
.
.
.
সমাপ্ত.........................