জেদ জিনিসটা বড়ই অদ্ভুত। কারো কারো ক্ষতি করে। কারো কারো উপকার করে। অনেকের মাঝে জেদ কিংবা ইগো থাকে মাত্রাতিরিক্ত। জোহরা বেগম তেমনই একজন। এক কথার মানুষ। তিনি একবার যা বলেন তাই করেন। নিজের মনমতো মর্জি মতো চলেন। অনেকটাই নিজের বাবার স্বভাব পেয়েছেন। কখনো নিজের মাকে কথার খেলাপ করতে কিংবা একবার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার বিপরীতে কিছু করতে দেখেনি প্রিয়াঞ্জনা। তার চাচিরা আড়ালে তার মাকে বলতো পাথর হৃদয়ের মানুষ। দুটি ঘটনা স্পষ্ট মনে আছে প্রিয়াঞ্জনার।
তখন সে ক্লাস ফাইভে পড়ে। ছোট থেকেই পুতুলের মতো দেখতে ও। গোলাপি দুটো গাল। বড় বড় চুল। শারীরিক গঠন, উচ্চতাও অন্যদের তুলনায় ভালো। মা সবসময় দুটো বেণী করে দিতেন। যে প্রাইমারি স্কুলে সে পড়তো সেখানকারই শিক্ষিকা ছিলেন জোহরা। অসম্ভব সুন্দরী হওয়ায় ছোট থেকেই রাস্তা ঘাটে ছেলেরা বিরক্ত করতো প্রিয়াঞ্জনাকে। বাবা তখন বিদেশ। ভাই ঢাকায় পড়াশোনা করে। মা-মেয়ে থাকতো একসাথে দাদাবাড়িতে। কখনো সেই বখাটেদের বিরুদ্ধে কিছু বলেনি প্রিয়াঞ্জনা। মাকেও বিষয়টা বুঝতে দেয়নি। প্রিয়াঞ্জনার চাচী বিষয়টা জানতেন। উনি দেখেছিলেন বিষয়টা স্বচক্ষে। কি নিয়ে একবার কথা কাটাকাটি হলো জোহরা বেগমের সাথে। ঝগড়ার মাঝেই তিনি প্রিয়াঞ্জনার কথা তুললেন। সুন্দরী মেয়ে নিয়ে ব্যবসা করেন জোহরা। মা-মেয়ে খারাপ। আরো কত কথা। জোহরা উঠুনে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যান প্রিয়াঞ্জনাকে। কোমড় সমান চুলগুলো গজগজ করে কেটে দেন কেঁচি দিয়ে। ন্যাড়া করে দেন প্রিয়াঞ্জনাকে। ওর অপরাধ কেন অন্যের মুখে বখাটেদের কথা শুনতে হলো তাকে। কেন সে বলেনি। অনেকে থামাতে আসতে চেয়েছিলো তবে জোহরা বেগমের রাগী চেহারাই যথেষ্ট ছিলো। কেউ সাহস করে থামায়নি। প্রিয়াঞ্জনা এই ন্যাড়া মাথায় স্কুলে যেত। মাথায় হিজাব দেওয়াও নিষেধ ছিলো কয়েকদিনের জন্য। জোহরা বেগমের কথা হলো, "এখন মানুষ দেখুক আমি আমার সুন্দরী মেয়ে নিয়ে ব্যবসা করছি কিনা।"
আরেকবার প্রিয়াঞ্জনা কত করে বললো সবাই পিকনিকে যাচ্ছে হাইস্কুল থেকে। তাকেও যেন যেতে দেন জোহরা। কিন্তু জোহরা যেতে দেননি। কারণ পরীক্ষায় সেবার ৩য় হয়েছিলো প্রিয়াঞ্জনা। তিনদিন না খেয়ে ছিলো। তাও জোহরার সিদ্ধান্ত বদলাতে পারেনি। পিকনিকে যেতে দিবেন না বলেছেন। মানে এখানেই কথা শেষ। এরপর তুমি ম রে যাও। তাও সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হবেনা।
সুমনার ঘরে বসে এসব ভাবছিলো প্রিয়াঞ্জনা। সুমনা চাবি আনতে গিয়েছে। বাইরে বৃষ্টি কমেছে কিছুটা। তবে আকাশ হয়ে আছে আঁধার কালো। শীত শীত আবহাওয়া বিরাজমান। রাতে বোধহয় বেশ বৃষ্টি হবে। সুমনা চাবি এনে দেয় প্রিয়াঞ্জনার হাতে। প্রিয়াঞ্জনার চোখে কৃতজ্ঞতা। সুমনা শান্ত কন্ঠে বলে,
"মা বলেছেন ভাত আর ডিম ভাজি করে দিতে।"
"কেন ভাবী? তিন পদ তরকারি ছেড়ে আমি কেন ডিম ভাজি করে দিবো?"
সুমনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
"অনার্স পাশ করেছো প্রিয়া। একটু ম্যাচিউর হও। মা যে শাহবাজ ভাইয়ার আনাগোনা পছন্দ করেনা এটা আমরা সবাই জানি। তাছাড়া তোমার বাবা-ভাইও কিন্তু উনাকে এখন ভালো চোখে দেখেনা।"
"মানিব্যাগটা যখন ভারী ছিলো তখন সবাই ভালো চোখেই দেখতো। এখন মানিব্যাগ ফাঁকা তো তাই আর ভালো চোখে দেখেনা।"
"পুরুষের সম্মান অনেকটা মানিব্যাগেই আটকা প্রিয়া। এই কথাটা শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই নিষ্ঠুর বাস্তবতা। আর বিয়েটা কিন্তু হয়েছিলো মায়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে। তিনি হয়তো মুখে মেনে নিয়েছেন। মন থেকে এখনো মানতে পারেন নি। তুমি তাদের মেয়ে। থাকতে এসেছো থাকতে পারো। তবে শাহবাজ ভাই...
সুমনা থামে। একজন স্ত্রীর কাছে স্বামীর মন্দ দিকটা তুলে ধরতে মন সায় দেয়না তার। প্রিয়াঞ্জনা নিঃশব্দে রান্নাঘরে চলে আসে। তার শাহ্ কে তো সে চিনে। এত কর্মঠ, নিষ্ঠাবান মানুষটা কখনো কারো প্রতি অন্যায় করবে বলে মনে হয়না তার। ডিম ভাজতে ভাজতে চোখ দিয়ে না চাইতেও অশ্রু গড়ায় অসহায় এক অর্ধাঙ্গীর। মা এক তুচ্ছ ঘটনার কারণে শাহবাজ কে মন থেকে মেনে নেননি। সেই ঘটনার পিছনে শাহবাজের কোনো দোষ নেই। একপ্রকার মায়ের, পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়েই বিয়ে করেছে প্রিয়াঞ্জনা। মাঝখানে অবশ্য সবাই তাদের মেনে নিয়েছিলো। শাহবাজ যখন দু'হাত ভরে আনতো। বাজারের সেরা মিষ্টিটা, সেরা ফলটা যখন আনতো তখন সবাই ভালো ব্যবহারই করতো। আর আজ!
শাহবাজ শুয়ে আছে প্রিয়াঞ্জনার খাটে। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে হাজারো চিন্তা। নিজের দুই চাচা এবং চাচাতো তিন ভাইকে অনেক বিশ্বাস করতো শাহবাজ। বাবা-মায়ের আদর কখনো তেমনভাবে পায়নি সে। তার বয়স যখন সাত তখন বাবা-মা আলাদা হয়ে যায়। তার বাবা ছিলেন শেখের চড়ের প্রসিদ্ধ এক কাপড় ব্যবসায়ী। তখন ব্যবসায় মন্দা চলছিলো। ভালোবেসে বিয়ে করলেও স্বামীর দুঃসময়ে পাশে থাকেন নি শাহবাজের মা। তার বাবারই এক বন্ধুর সাথে পালিয়ে যান। বাবা সাময়িক কষ্ট পেয়েছিলেন। তবে নতুন বিয়ে, সংসার আবার ব্যবসায়ে ভালো পরিস্থিতিতে তিনি প্রথম স্ত্রীকে প্রায় ভুলেই যান।
বাবাও ভালো ছিলেন নিজের সংসার নিয়ে আর মাও ভালো ছিলেন। মাঝখানে জীবন থেমে যায় এক শিশুর। দুরন্ত ছেলেটা চুপচাপ হয়ে যায়। সৎ মা তেমন হেয়ও করতেন না আবার তেমন আদরও করতেন না। নিজের ছেলেকে নিয়েই থাকতেন। বাবা শাহাদাত চৌধুরী ছিলেন ব্যস্ত মানুষ। ছেলেকে দেখার সময় কোথায় তার! একা একা নিভৃতে কখন যেন বড় হয়ে যায় শাহবাজ। হাইস্কুল শেষ করেই বাড়ি থেকে দূরে সরিয়ে নেয় নিজেকে। ঢাকা নটরডেম কলেজে চান্স পায়। নিজেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার কারণও ছিলো অবশ্য। কারণ বাবা বিবাহিত এক নারীকে ঘরে তুলেছিলেন। স্ত্রী থাকার পরেও এরকম কাজ সত্যি মানা যায় না। নিজের চোখের সামনে দুই সৎ মায়ের ঝগড়া বিবাদ বেশ লজ্জায় ফেলতো তাকে। অনেকটা বাধ্য হয়েই নিজেকে দূরে সরিয়ে নেয় শাহবাজ। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞানে পড়ার সুযোগ করে দিলেন আল্লাহ তায়ালা। ভেবেছিলো একটা চাকরি করে জীবন পাড় করে দিবে। কখনো আর ফিরে যাবেনা সে বাসায়। শাহাদাত চরিত্রের দিক দিয়ে খারাপ হলেও নিজের সন্তানদের ঠিকই ভালোবাসতেন। বিশেষ করে শাহবাজকে। তাইতো শাহবাজের নামে বাবুর হাটে একটি দোকানসহ বেশ কিছু সম্পত্তি লিখে দিয়ে গিয়েছেন। মৃত্যুর আগে কসম দিয়েছিলেন শাহবাজ যেন ব্যবসা আঁকড়ে থাকে। বাবার কথা ফেলে দেয়নি শাহবাজ। একটি দোকান থেকে দুটো দোকান। একটি কাপড়ের ফ্যাক্টরি করেছিলো নিজ প্রচেষ্টা ও শ্রম দিয়ে। তবে আপনজনদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে আজ পথের কাঙাল সে। নিজের বউকে পর্যন্ত রাখতে হচ্ছে বাবার বাসায়। বিপদে মানুষ বেশ ভালো করেই চিনছে শাহবাজ।
"শুনছেন? উঠুন।"
শাহবাজ ঘুমায় নি। হাত কপালের উপর রেখে চোখ বুজে শুয়ে ছিলো। ভাবছিলো নিজের বত্রিশ বছর জীবনে ঘটে যাওয়া খন্ড খন্ড ঘটনাগুলো।
"এই যে শাহ্। উঠুন না।"
শাহবাজ চোখ মেলে চায়। প্রায় চার বছরের সংসার তাদের। বেশ সুখেই তো ছিলো তারা। এই পুতুলের মতো মেয়েটা সারাদিন ফ্ল্যাটে ঘুরঘুর করতো। এখন ভাগ্য তাদের আলাদা করে দিচ্ছে। আর কে আছেই বা শাহবাজের! এই ফুলের মতন বউটাও যদি চলে যায়? শাহবাজ তো একেবারে ম রে যাবে!
শাহবাজ কে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে দেখে প্রিয়াঞ্জনা আবার প্রশ্ন করে,
"কি হলো শাহ্? চোখ লাল কেন আপনার? জ্বর আসবে মনে হয়।"
শাহবাজ অন্যদিকে চায়। অর্ধাঙ্গীর সামনে কান্না করে তাকে কষ্ট দিতে চাচ্ছেনা সে। তাহলে মেয়েটা ভেঙে পড়বে।
"ভাত, ডিম ভাজি আর শুকনো মরিচ ভাজা এনেছি। খেয়ে নিন।"
প্রিয়াঞ্জনার হাতে ভাতের প্ল্যাট। ভাতের কথা শুনেই ক্ষুধাটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। হাত ধুয়ে ভাত খেতে বসে শাহ্। বেশ খিদে পেয়েছে তার। সকালে শুধু এককাপ রঙ চা পান করেছিলো। সারাদিন ঘুরে বেড়িয়েছে যাযাবরের মতো। জমি বিক্রির চেষ্টা করছে। দেখা যাক কি হয়। গাপুসগুপুস করে খাচ্ছে শাহবাজ। প্রিয়াঞ্জনা এক নজরে চেয়ে আছে তার পুরুষের পানে। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, সুঠাম দেহ, মানানসই উচ্চতা, খাড়া নাক। একজন আদর্শ পুরুষ যেমন হয়। তার শাহ্ ঠিক তেমনই। খাওয়া থামায় শাহবাজ। এক লোকমা ভাত মুখের সামনে ধরে প্রিয়াঞ্জনার। প্রিয়াঞ্জনা খেয়ে নেয়। দুপুরে মায়ের সাথে রাগ করে খায়নি। মানুষটা ঠিক বুঝতে পেরেছে হয়তো সে যে খায়নি। এমন সময় তার ঘরের দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হয়। দরজা আটকে এসেছিলো প্রিয়াঞ্জনা। অজানা আশঙ্কায় ভিতর কেঁপে উঠে তার।
.
.
.
চলবে...............................