প্রিয়াঞ্জনা - পর্ব ০৮ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প


বিকেল হয়ে আসছে। আকাশটাও মেঘলা। অনেকক্ষণ চা-বাগানে সময় কাটিয়ে কিছুক্ষণ পূর্বেই হোটেলে ফিরে এসেছে দুজনে। রাতে বেশ বৃষ্টি হলো। সেই সাথে বিকট বজ্রপাত। বারান্দা দিয়ে আলো ছিটকে আসে। তার কিছুক্ষণ পর উচ্চস্বরে শব্দ হয়। প্রিয়াঞ্জনা রাতের বজ্রপাত ভয় পায়। বেশ ভয় পায়। দিনে তেমন ভয় হয় না। তবে রাতে বজ্রপাত হলে ওর জ্বর চলে আসে। এর পিছনে একটা গল্প রয়েছে।

ছোটবেলায় গ্রীষ্মের ছুটি হলেই মা নিয়ে যেতেন নানাবাড়ি। নানা, নানু আর মামা খুব আদর করতো প্রিয়াঞ্জনাকে। গাছের বড় আমটা, বড় পেয়ারাটা প্রিয়াঞ্জনাকেই খাওয়াতেন নানি। তখন প্রিয়াঞ্জনার বয়স সবে আট। অন্য সময়ের গ্রীষ্মের ছুটি আনন্দের হলেও সেবারের ছুটিটা ছিলো বিভীষিকা। নানা কৃষক হওয়ার সুবাদে চাষাবাদের জন্য যেতেন চকে। নরসিংদীতে জমি ফলানোর সুবিশাল জায়গার সমষ্টিকে সবাই চক বলে। সেই দিনটা আজো স্পষ্ট মনে আছে প্রিয়াঞ্জনার। যত বজ্রপাতের শব্দ শুনে স্মৃতিটা আরো প্রখর হয়ে উঠে। দৃশ্যগুলো হয়ে উঠে প্রাণময়, স্পষ্ট। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল সেই সকাল থেকে। নানি মানা করা সত্যেও নানা চকে গেলেন। বোরো ধান কাঁটার মৌসুম। নানার ধান কাঁটার নেশা প্রবল। বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে ধানক্ষেত। সেদিন সকালে নানি চটা পিঠা করেছিলেন। বানানো খুব সহজ। একটা পাত্রে পরিমাণমতো আটা নিয়ে তাতে কাঁচা মরিচ, পিঁয়াজ কুঁচি দিতে হবে। তারপর তাতে লবণ আর পানি মিশিয়ে বেশি পাতলা নয় আবার বেশি ঘন নয় এমন একটি মিশ্রণ তৈরি করতে হবে। গরম তাওয়াতে গোল করে ছড়িয়ে দিতে হবে। প্রিয়াঞ্জনা সেদিন রান্নাঘরে নানির পাশে দাঁড়িয়ে বেশ মনোযোগ দিয়ে পিঠা বানানো দেখছিলো। রোয়াকে পেতে রাখা পাটিতে বসে নানার সাথে গতরাতের গরুর গোশত আর চটা পিঠা খেয়েছিলো। বাইরে তখন গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। নানি বললেন,
"আজকা যাওন লাগতো না জোহরার বাপ। কালকা কাইটেন ধান।"
"ঘোর বন্যার সময় ধান কাঁটছি বানু। তোর মন নাই? গলা পর্যন্ত বন্যার পানি সেই সময় ধান কাইটা আনছি। আর অহন তো খালি ডলকই। এই ডলকে আমার কিছু হইতো না। তুই চিন্তা করিস না। তোর পোলায় আসলে কইস বাপেরে যেন সাহায্য করতে যায়।"

নানির কথাকে তোয়াক্কা না করেই নানা ধানক্ষেতে চলে গেলেন। নানির বাড়িতে অনেক কাজ। গরু সামলানো, রান্না-বান্না, হাঁস মুরগী দেখা, ধান সিদ্ধ করার জোগাড় করা। জোহরাও সাহায্য করছিলেন মাকে। ছোট জমি। তাই নানা একা হাতেই ধান কাঁটবেন। ছোট প্রিয়াঞ্জনা ঘুরে বেড়ায় উঠানে। ডাংগুলি খেলে, লুকোচুরি খেলে। দুপুরে আকাশ তখন কিছু পরিষ্কার। জোহরা প্রিয়াঞ্জনাকে ডেকে এক থালা ভাত, গরুর গোশত, পিঁয়াজ, কাঁচা মরিচ দিয়ে গামছা দিয়ে ঢেকে বললেন যেন প্রিয়াঞ্জনা খাবারের থালা চকে নানার কাছে দিয়ে আসে। প্রিয়াঞ্জনার ভালোই লাগে। ধানক্ষেতের পাশে বসে খেতে। সে জানে নানা খাবার খাওয়ার সময় তাকেও খাইয়ে দিবেন। আকাশে তখন অল্প বজ্রপাত হচ্ছে। তেমন বৃষ্টি হচ্ছেনা। মৃদু হাওয়া। প্রিয়াঞ্জনা খুশি মনে ছুটলো নানাকে খাবার দিতে। তারপর.... 

তারপরের দৃশ্যের কথা কল্পনা করলেই অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে প্রিয়াঞ্জনার। দূর থেকে প্রিয়াঞ্জনার চোখে তীব্র একটুকরো আলো লাগলো। সাথে সাথে বিকট শব্দ। কানে তব্দা লেগে যাওয়ার মতো। প্রিয়াঞ্জনা কতক্ষণ হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে ছিলো খেয়াল নেই। দূর থেকে যখন ধানক্ষেতের কাছে গেলো দেখলো নানার পুড়ে যাওয়া দেহখানি পড়ে আছে৷ ভাতের থালা ফেলে দিয়ে চিৎকার করে বাড়ির দিকে ছুটেছিলো প্রিয়াঞ্জনা। মাকে চিৎকার করে বলেছিলো, "মা, নানা নাই।" তারপরের স্মৃতি আবছা। নানার লা শ বেশ কয়েকবার চুরি করতে চেয়েছিলো অনেকে। বজ্রপাতে পোড়া লা শ নাকি কত কাজে লাগে। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে কবর সিমেন্ট দিয়ে বাঁধাই করতে হয়েছে। আজো প্রিয়াঞ্জনা বজ্রপাত ভয় পায়। বজ্রপাত হলেই মনে ভীতি সৃষ্টি হয় তার। চোখে ভেসে উঠে নানার পোড়া লা শ। বিশেষ করে রাতের বেলা। 

প্রিয়াঞ্জনাকে জড়িয়ে ধরে আছে শাহবাজ। বাইরে বজ্রপাত কমেছে কিছুটা। প্রিয়াঞ্জনা থরথর করে কাঁপছে। বিড়বিড় করে কিসব যেন বলছে। শাহবাজ বেশ ভালো করেই প্রিয়াঞ্জনার এই বিষয়টা জানে। গত চারবছরে বেশ কয়েকবার এমন হয়েছে। রাতে জ্বর আসবে। কোনো ঔষধ দেওয়ার প্রয়োজন হয়না। সকালে এমনিতেই সেরে যায়। কিন্তু সে রাতটা ভয়াবহ কাটে শাহবাজের। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে বারবার। একদম শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখে নিজের অর্ধাঙ্গীকে সবসময়।

দূরে মসজিদে আজান দিচ্ছে। শাহবাজ আজান শুনে উঠে পড়ে। হাত ছুঁয়ায় প্রিয়াঞ্জনার কপালে। জ্বর নেই। কমফোর্টার দিয়ে শরীর ঢেকে দেয়। তারপর ফজরের সালাত আদায় করে। আজ তার বিছানাকান্দি যাওয়ার পরিকল্পনা ছিলো। প্রিয়াঞ্জনা ঘুমিয়ে আছে নিশ্চিন্তে। শাহবাজ প্রিয়াঞ্জনার পাশে বসে। কি পবিত্র! কি নিষ্পাপ তার অর্ধাঙ্গিনী। কিভাবে সবকিছু সামাল দিবে সেই পরিকল্পনাও করে কিছুটা। যে জমিটার বায়না করেছে সেটাই শেষ জমি। বাকি অন্য যত সম্পত্তি ছিলো সবই বিক্রি করে দিয়েছে শাহবাজ। এখনও পাঁচ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। জমি বিক্রি করলে আড়াই কোটি পাবে। বাকি আড়াই কোটি! কি করবে শাহবাজ! ব্যাংকের টাকা নিয়ে যে কেলেঙ্কারি ঘটেছে কোনো ব্যাংক তো তাকে লোনও দিবেনা। সম্পত্তি যা ছিলো সবই বিক্রি করে দিয়েছে। মাথা চেপে ধরে বসে থাকে অনেকক্ষণ। যে অপরাধ সে করেনি তার শাস্তি পাচ্ছে সে। গতবার টাকা পরিশোধ করার সময় এক প্রকার মা রা মা রি বেঁধে গিয়েছিলো। শাহবাজের কেবল প্রশ্ন একটাই। কেন টাকা দেওয়ার আগে তাকে একবারও জিজ্ঞেস করা হলোনা? 
ব্যবসায়ী সাইফুল। কাঠ ব্যবসা করেন। সেই সাথে সুদের ব্যবসা করেন। স ন্ত্রা স সাইফুল নামে সবাই চিনে। তার কাছ থেকেও সুদে টাকা ধার নিয়েছিলো শাহবাজের চাচারা। লেনাদেনার যে কাগজ তৈরি করা হয়েছে তাতে আবার শাহবাজের সিগনেচারও আছে। সাইফুলের উত্তর, 
"আফনের চাচারা কইছে আফনে ব্যস্ত মানুষ। আমি কাগজে সাইন চাইছি। তা পাইছি। আমার কি ঠেহা লাগছে আফনের লগে গিয়া মা রা দিয়া জিজ্ঞাইতাম ভাইজান সাইন আসল না নহল? এত ভং চং বুঝিনা পয়সা নিছেন। পয়সা দিবেন।"

শাহবাজ বলেছিলো সুদের টাকা যেন না নেয়। তাও মানেনি। তারপর কথা কাটাকাটি। সেখান থেকে 
মা রা মা রি। সব টাকাই পরিশোধ করতে হয়েছে শাহবাজকে। পাওনাদারদের কাছ থেকে সময় চেয়েছিলো শাহবাজ। দুদিন বাদে জমির টাকা পাবে। কিন্তু তারপর? আবারও নিজের অর্ধাঙ্গীর পানে তাকায় শাহবাজ। ভিতরটা কেঁপে উঠে হু হু করে। একটু কান্না করতে পারলে ভালো হতো। তখনই ফোন বেজে উঠে শাহবাজের। ফোন বন্ধ করে রেখেছিলো। রাতে জমির ব্যাপারে কথা বলতে মোবাইল অন করেছিলো। অফ করার কথা আর খেয়াল নেই। আননোন নাম্বার। ফোন ধরতেই মেয়ে কন্ঠে একজন বললো,
"হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম।"
"ওয়ালাইকুম আসসালাম। কে?"
"ভাইয়া, আমি সুমনা। প্রিয়ার ভাবী।"
"হ্যাঁ, সুমনা। বলো।"
"ভাইয়া, আপনি প্লিজ প্রিয়াকে নিয়ে বাসায় আসেন। মা স্ট্রোক করছেন।"
"কি!"
"জ্বি, ভাইয়া। তাড়াতাড়ি আসেন।"

বলেই ফোন কেটে দেয় সুমনা। তার গালে চড়ের চিহ্ন। প্রীতম মে রে ছে। জোহরা পাশেই বসে ছিলেন। প্রীতমও উপস্থিত এখানে। সুমনা প্রীতমের দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে বলে,
"খুশি এবার?"
"তুমি বেশ বাড়ছো সুমনা।"

জোহরা প্রীতমকে থামিয়ে বলেন,
"সুমনা ঘরে যাও।"

সুমনা দ্রুত ঘরে চলে আসে। এত করেও কারো মন পায়না সে। ছোটবেলা কেটেছে কষ্টে। সৎমায়ের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলো জীবন। নিজের পরিশ্রমে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায়। সেখানে পরিচয় প্রীতমের সাথে। পালিয়ে বিয়ে করেছিলো দুজনে। এই বাড়িতে আসার পর থেকে রান্না থেকে কাপড় ধুয়া। সবই করে সুমনা। তাও শ্বশুর-শাশুড়ীর মন পায়না। বাচ্চাটা ছয় মাসের হয়ে মা রা যাওয়ার পর থেকে প্রীতমও কেমন হয়ে গেছে। আগের মতো ভালোবাসেনা। আদর করেনা। বেশ কয়েকদিন আগে মেসেঞ্জারে কিছু ছবি এসেছিলো। প্রীতম নিজের কলেজের এক শিক্ষার্থীর সাথে অন্তরঙ্গ হয়েছে। তাও সুমনা টু শব্দটি করেনি। তার ব্যর্থতা সে প্রীতম কে বাবা ডাক শুনাতে পারেনি। প্রাপ্তির মুখে শুনেছে সুমনা প্রিয়াঞ্জনার ব্যাপারে সব জানে। অমনি ঘর থেকে টেনে হিঁচড়ে ড্রয়িং রুমে নিয়ে সবার সামনে পরপর দুইটা চড় লাগিয়েছে সুমনার গালে। এই প্রীতমের ভালোবাসা! শাহবাজ ভাইকেও তো দেখেছে সুমনা। ছোট বাচ্চাদের মতো আগলে রাখে প্রিয়াঞ্জনাকে। সুমনার ভাগ্যই খারাপ। জীবনটা বোধহয় কষ্টে কষ্টেই যাবে। 

_______________

শাহবাজ আলতো করে ডেকে তুলে প্রিয়াঞ্জনাকে। প্রিয়াঞ্জনা মায়ের অসুস্থতার খবর শুনে ভয় পেয়ে যায়। ছটফট শুরু করে। শাহবাজ নরসিংদীর উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। প্রিয়াঞ্জনা সারাটা পথ কেঁদেছে। 
.
.
.
চলবে.............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন