প্রিয়াঞ্জনা - পর্ব ১১ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প


"আপা, আজকে নাকি ফাহিম ভাইয়া আসবে।"
"তো এখন আমি কি করবো?"
"তুই কি করবি আমি কি জানি। মা বলছে তোকে জানাইতে। তাই জানিয়ে দিলাম।"
"তুই আমার চোখের সামনে থেকে চলে যেতে পারবি প্রাপ্তি? আমার তোকে ভিষণ বিরক্ত লাগছে।"

প্রাপ্তি কপাল কুঁচকে তাকালো। প্রিয়াঞ্জনা বারান্দার গ্রিল ধরে বাইরে তাকিয়ে আছে। গোধূলিলগ্ন। দূরের শ্যাওলাঘন পুকুরের পানিতে হলদে আলো পড়ছে। চিকচিক করছে পুকুরের জল। দুয়েকটা পাখি ফিরে যাচ্ছে নীড়ে। আজকের বিকেলটা বেশ বিষণ্ণ। মন খারাপ করা বিকেল। গত বেশ কয়েকদিন যাবত শাহ্ এর কোনো খোঁজ নেই। কোথায় আছে? কেমন আছে শাহ্? দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রিয়াঞ্জনা। 
"একটা কলও তো করতে পারতেন শাহ্!"

বিড়বিড় করে প্রিয়াঞ্জনা। প্রাপ্তি তখনও দাঁড়িয়ে আছে পাশে। 
"আপা, কি বিড়বিড় করছিস?"

অতিরিক্ত আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে প্রাপ্তি। প্রিয়াঞ্জনা বিরক্ত হয়। কিঞ্চিৎ রাগও হয় তার। সে প্রাপ্তির কথার জবাব না দিয়েই রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়। এককাপ কফি তার ভিষণ প্রয়োজন। সুমনা রান্নাঘরে বিকেলের নাস্তা বানাচ্ছে। প্রিয়াঞ্জনা রান্নাঘরে ঢুকে তার সাথে কোনো কথা বলেনি। সুমনা গত কয়েকদিনে বেশ কয়েকবার কথা বলতে চেয়েছে। প্রিয়াঞ্জনা এড়িয়ে গেছে। ভাবীর প্রতি তার অনেক অভিমান। কফির জারটি কোনো ক্রমেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। কি আশ্চর্য! 
"মাইক্রোওয়েভের পাশের ক্যাবিনেটে দেখো। নতুন কফির জারটা ঐখানেই রাখা।"

প্রিয়াঞ্জনা সেখানেই খুঁজে পেলো। সুমনা আবার বললো,
"দেও, আমি করে দিচ্ছি। ক্যাপাচিনো, আমেরিক্যানো যা বলবে তাই করে দিবো।"

প্রিয়াঞ্জনা গরম পানি বসিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে বললো,
"দরকার নেই।"

সুমনার খুব মন খারাপ হলো। 
"তুমি কি আমার সাথে রাগ করেছো প্রিয়া?"
"না"
"তাহলে কথা বলোনা কেন?"
"এমনি"

সুমনা কেঁদে দেয়। নিঃশব্দে তার চোখদুটো অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। কোনো ফোঁপানোর শব্দও হচ্ছেনা। প্রিয়াঞ্জনা বেশ বিব্রতবোধ করে।
"এই ভাবী তুমি কাঁদছো কেন?"
"বিশ্বাস করো প্রিয়া, আমি কিছু বলতে চাইনি। তোমার ভাইয়া সেদিন আমার গাঁয়ে হাত তুলে। এমন পরিস্থিতি ছিলো আমি সব বলতে বাধ্য হই।"

প্রিয়াঞ্জনা সুমনার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলে,
"যা হওয়ার তাতো হয়েই গেছে ভাবী। থাক আর কান্না করো না।"

সুমনার কান্না থামে। 
"প্রিয়া, তুমি আবার পালিয়ে যাও। আমি কথা দিচ্ছি এবার আমাকে মে রে ফেললেও আমি কিছু বলবো না। তোমার মা এবং ভাই তোমার জীবনকে তছনছ করে দিবে। বাবাও তোমার ভালো হবে ভেবে ঐ তালেই নাচছেন। উকিলের সাথে কথা বলতে শুনেছি। ডিভোর্স পেপার তৈরি করে ফেলেছে। যেকোনো সময় তোমার সিগনেচার চাইতে পারে।"
"আমি কি করবো কিছু বুঝতে পারছিনা ভাবী। শাহ্ এর কোনো খোঁজ আমার কাছে নেই। সে কেমন আছে? কোথায় আছে আমি কিছু জানিনা।"

ফুটন্ত পানি ছলকে উঠে। প্রিয়াঞ্জনা গ্যাসের চুলা কমিয়ে তাতে কফি দেয় দুই চামচ। কোনো চিনি দিবেনা। এমন ভাবে কফি পান করে তার শাহ্। প্রিয়াঞ্জনা তো দুধকফি কিংবা দুধ চা ছাড়া পান করতেই পারতো না। বসুন্ধরার ফ্ল্যাটে গত চার বছরে কত অভ্যাস পরিবর্তন হয়েছে তার। শাহ্ এর সবকিছুকে সে আপন করে নিয়েছে। শাহ্ এর বুকে মাথা না রেখে সে ঘুমাতে পারতোনা। তার মাঝে এত এত অভ্যাস গড়ে তুলেছে মানুষটা। সেই মানুষটাকে সে ডিভোর্স দিবে? প্রিয়াঞ্জনা আবার বিড়বিড় করে,
"আমি ম রে যাবো শাহ্। তবুও আপনাকে ছাড়া থাকা আমার সম্ভব নয়।"

প্রাপ্তি এবং প্রীতি এবারে এসএসসি পরীক্ষার্থী। দুজনেই বেশ ভালো শিক্ষার্থী। সন্ধ্যায় তাদের ইংরেজি পড়াতে আসেন মইনুল ইসলাম নামের একজন শিক্ষক। প্রিয়াঞ্জনার মেইন ডোরের কাছে আসা নিষেধ। জোহরা সবসময় তাকে চোখে চোখে রাখেন। প্রীতম, প্রবীর বাসায় নেই। দরজায় কলিং বেল বেজে উঠে। সুমনা নিজেই দরজা খুলে দেয়। তাড়াহুড়োয় মাথার কাপড় পড়ে যায় তার। ডান গালে স্পষ্ট চড়ের চিহ্ন। একটু আগেই প্রীতম 
মে রেছে তাকে। কারণ সে তার মানিব্যাগ খুঁজে পাচ্ছিলো না। সুমনাকে ডাক দিয়েছিলো। কিন্তু চুলার খাবার নামিয়ে আসতে দেরি হয়। ঘরে প্রবেশের সাথে সাথে তার গালে চড় বসিয়ে দেয় প্রীতম। মইনুল সাহেব একনজর তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নেন। সুমনা তড়িঘড়ি করে মাথায় কাপড় দেয়। 
"প্রাপ্তি, প্রীতি ঘরে আছে। আপনি যান স্যার।"

বলেই দ্রুত রান্নাঘরের দিকে ছুটে সুমনা। মইনুল এক দৃষ্টিতে সেদিক পানে তাকিয়ে থাকে। শ্যামবর্ণ মেয়েটা। জলপাই রঙের সুতি থ্রী-পিস, নাকে বড় একখানা ডায়মন্ডের নাকফুল, এলোমেলো চুলে খোঁপা করা। চেহারায় মায়া মায়া ভাব। দেখলে খুব শান্তি লাগে। আচ্ছা, এই মেয়েটির জীবনে কি খুব কষ্ট? কেমন যেন বিষণ্ণতার চাদরে ঘেরা তার মুখাবয়ব। নিজের এমন ভাবনাকে তিরস্কার দিলো মইনুল। একজন বিবাহিত নারীর প্রতি এমন অনুভূতির জন্য নিজের প্রতি ঘৃণা জাগ্রত হয় তার। তাড়াতাড়ি পা বাড়ায় প্রাপ্তি-প্রীতির ঘরের দিকে। তার অনুভূতিগুলো আজকাল বেশ অবাধ্য হয়ে যাচ্ছে। কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। 

ফাহিম আর তার মা এলেন রাত আটটায়। ফাহিম দুহাত ভরে এনেছে। মিষ্টি, দই, চার প্রকার ফল, কেক। 
"এতকিছু আনতে গেলে কেন আব্বা?"

জোহরা হাসিমুখে জিজ্ঞেস করেন। ফাহিমকে তিনি ছোটবেলা থেকেই অনেক স্নেহ করেন।
"অনেকদিন পর তোমাদের বাসায় এসেছি ছোট আম্মু। এটুকু তো আনতেই পারি। আমি তোমার ছেলে না বলো?"

"ছেলেই তো আব্বা। আমার বড় ছেলে।"

জোহরা বেগম খোশমেজাজে ফাহিমের মায়ের সাথে গল্পে মেতে উঠেন। ফাহিম কিছুক্ষণ পরপর প্রিয়াঞ্জনার ঘরের দিকে তাকাচ্ছে। জোহরা তা লক্ষ্য করে বললেন,
"যাও প্রিয়ার সাথে কথা বলে এসো।"
"না, মানে..
"যাও। আমি আর তোমার মা অনেক গোপন কথা বলবো।"

ফাহিমের মাও সায় দিলেন। ফাহিম দরজায় নক না করেই প্রিয়াঞ্জনার ঘরে ঢুকে গেলো। প্রিয়াঞ্জনা খাটে বসে বই পড়ছিলো। 
"কেমন আছো প্রিয়া?"

পুরুষ কন্ঠ পেয়ে তৎক্ষনাৎ মাথায় উড়না টেনে দেয় প্রিয়াঞ্জনা। 
"কোনো মেয়ের ঘরে প্রবেশ করলে, নক করে প্রবেশ করতে হয়। আপনার কি ন্যূনতম এই কমনসেন্সটাও নেই?"

ফাহিম খাটের অপর প্রান্তে বসে বললো,
"না, নেই। কয়েকদিন পর তো আমাদের বিয়েই হচ্ছে।"

"বিশ্বাস করেন আমার স্বামী যদি এই মুহূর্তে উপস্থিত থাকতো তাহলে আপনার গালটা ফাটিয়ে দিতো।"

ফাহিম হাসলো। সুদর্শন হিসেবে সকল মেয়ের কাছেই এই হাসিটা ভালো লাগার কথা। তবে প্রিয়াঞ্জনার মনে হচ্ছে মানুষের হাসি এত কুৎসিতও হতে পারে? 
"এখনো তেজ কমে নাই? ছোটবেলার কথা মনে নাই প্রিয়া?"

ছোটবেলায় ফাহিমের কাছ থেকে অল্পের জন্য নিজের ইজ্জত নিয়ে ফিরেছিলো প্রিয়াঞ্জনা। এরপর আর কখনো তাদের বাড়ি যায়নি। ফাহিমও চলে গিয়েছিলো বিদেশ। প্রিয়াঞ্জনার মা এটা জানেন। তারপরেও তিনি বারবার ফাহিমের সাথে তাকে জুড়ে দিতে চান।

"আমি কাপুরুষের স্ত্রী না। আমার স্বামী শাহবাজ চৌধুরী একজন সিংহ পুরুষ। আমি তার অর্ধাঙ্গিনী। আপনার মতো কাপুরুষদের এখন আমি আর ভয় পাই না।"
"তাই নাকি? তা শুনলাম তোমার সিংহ পুরুষ নাকি বাটপার?"
"মুখ সামলে কথা বলুন।"
"তেজ তাহলে এখনো কমে নাই? তোমার স্বামী তোমার তেজ ভাঙতে পারে নাই। আমার সাথে কেবল একরাত থাকবা। পরদিন সকাল থেকে তুমি একেবারে সোজা হয়ে যাবা।"

প্রিয়াঞ্জনা বারান্দায় ঢুকে দরজা আটকে দেয়। ফাহিম হাসতে হাসতে বাইরে বেরিয়ে যায়। আর কিছুদিন। মেয়েটা এত সুন্দর! একে তো ফাহিমের অবশ্যই চাই। 

বারান্দায় নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে প্রিয়াঞ্জনা। মাকে সে ভালোবেসেছে নিজের চাইতে বেশি। সেই ছোট থেকে কলেজে উঠার আগ পর্যন্ত যা বলেছেন জোহরা তাই সে করেছে। খুন্তি, ঝাড়ু কতকিছু দিয়ে আঘাত করেছেন জোহরা। কোনো সময় একটা কথার প্রতিবাদ করেনি। আজ সবটা জেনেও তার মা এমনটা করছেন! ছোটবেলা থেকেই অন্য কেউ কিছু করলে সে শাস্তি পড়তো প্রিয়াঞ্জনার ঘাড়ে। একবার পাশের বাড়ির ছোট একটা বাচ্চা তাকে 
মে রে ছিলো। ও কিছু করেনি। তবুও বাচ্চাটার মা রাতে এসে বললেন আপনার মেয়ে প্রিয়া আমার মেয়েকে মে রে ছে। সত্য মিথ্যা যাচাই না করেই হাতের খুন্তি দিয়ে প্রচুর মে রে ছিলেন প্রিয়াঞ্জনাকে। এক পর্যায়ে প্রিয়াঞ্জনা নিজেকে বাঁচাতে খাটের তলে ঢুকে যায়। আজ শাহবাজ চৌধুরীকে শিক্ষা দিতে গিয়ে তিনি নিজের সন্তানের সাথে অবিচার করছেন। 
"তুমি আমাকে কখনোই বুঝলেনা মা। কখনোই বুঝলেনা।"

বাইরে ঘোর অন্ধকার। পূর্ণিমার চাঁদ কি উঠবেনা?
.
.
.
চলবে...............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন