শাহবাজের ভিষণ জ্বর। হাসপাতালের বেডের উপর কেমন বেহুঁশের মতো পড়ে আছে সে। হাতে স্যালাইন লাগানো। রিমন পাশেই বসে আছে। বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে ওকে। শাহবাজের মাথার আঘাত এখনো শুকায়নি। এই তো তিনদিন আগে শাহবাজ বাড়িতে ফিরলো। কেমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিলো ওকে। চোখ লাল হয়ে আছে। বিষণ্নতায় মুড়ানো চেহারা। রিমনের সাথে বসে পটল ভাজা, শুটকি ভর্তা দিয়ে ভাত খেলো। কোনো কথা বলেনি। একদম নিরব ছিলো পুরোটা সময়। তারপর উঠে চলে যায় নিজ ঘরে।
রিমন জিজ্ঞেস করলো, "কি হইছে শাহ্?"
চৌকিতে মনম'রা হয়ে শুয়েছিলো শাহবাজ। রিমন বসলো তার পাশে। অনেকক্ষণ জোরাজুরি করার পর আসল খবর জানা যায়। জমি বায়নার কিছু টাকা শাহবাজের কাছে অবশিষ্ট ছিলো। সেই টাকা, তার দামী আইফোন সব নিয়ে গিয়েছে ছিনতাইকারীর দল। একজন মহিলা তার কাছে এসে নাকি একখণ্ড কাগজ দেখিয়ে ঠিকানা জানতে চেয়েছিলো। তারপর নাকে যেন কে পিছন থেকে রুমাল চেপে ধরলো। আর কিছু মনে নেই শাহবাজের। ব্যাপারটা ঘটেছে নরসিংদী স্টেশনে। পানি ছিটিয়ে তাকে জাগিয়ে তুলেছিলো একজন বৃদ্ধা। হতভম্ব হয়ে সে রিমনের বাড়িতে চলে আসে। সেদিন রাতেই হাড় কাঁপিয়ে জ্বর আসে শাহবাজের। পরদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত রিমন আর তার স্ত্রী সুফিয়া জল পট্টি, পানি ঢেলে দেওয়া সহ অনেকভাবেই জ্বর কমানোর চেষ্টা করে। কোনো ভাবেই কমছিলো না। তাই রাতে সদর হাসপাতালে নিয়ে আসে। প্রিয়াঞ্জনা ভাবীর নাম্বার রিমনের জানা নেই। কোথায় থাকে তাও জানেনা। এদিকে তারও তো টানাপোড়েনের সংসার। ঔষধ বাবদ অনেক টাকাই লেগেছে। দেখা যাক আজ জ্ঞান ফিরে কিনা।
ডোরবেল বাজছে। ঘর ঝাড়ু দিচ্ছে সুমনা। প্রীতিকে ডাকলো সে,
"প্রীতি, দরজাটা খুলে দে তো।"
কোনো সাড়া শব্দ নেই। সুমনা নিজেই দরজা খুলে। কালো বোরকা পরনে একজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখ খোলা। সুমনা চিনেনি মেয়েটিকে।
"কে আপনি?"
"আমি স্বর্ণা। প্রীতম স্যার বাসায় আছেন?"
"না। ও তো বাইরে গেছে। আপনি ভিতরে আসুন।"
মেয়েটিকে চেনা চেনা লাগছে সুমনার। কোথাও কি দেখেছে? মেয়েটি ঘরে ঢুকে সোফায় বসলো।
"আপু, একটু পানি খাওয়াবেন? অনেক পিপাসা লেগেছে।"
"আনছি, আপনি বসুন।"
কাউকে তো আর শুধু পানি দেওয়া যায় না। তাই বিস্কুট আর আপেল পিরিচে সাজিয়ে ট্রে করে নিয়ে আসে সুমনা। নিকাব খুলে মেয়েটি পানি পান করে। ফর্সা গাঁয়ের রঙ। বেশ সুন্দর দেখতে।
"আপু, আমি আপনার সাথে কথা বলতে এসেছি। আপনি কি সুমনা? প্রীতম স্যারের ওয়াইফ?"
"জ্বি"
স্বর্ণার পাশেই সোফায় বসে সুমনা। বেশ চিন্তা হচ্ছে তার।
"আপু, আমাকে ভুল বুঝবেন না প্লিজ। প্রীতম স্যারের সন্তান আমার গর্ভে।"
"মানে!"
জোহরা শোবার রুম থেকে ড্রয়িং রুমে আসার পথে কথাটা শুনলেন। তিনি সুমনাকে ধমকে জিজ্ঞেস করলেন,
"এইটা কে সুমনা?"
তারপর স্বর্ণার দিকে ফিরে বললেন,
"এই মাইয়া! এই! কি আবোল তাবোল কথাবার্তা বলো।"
স্বর্ণা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। দৌড়ে এসে পা জড়িয়ে ধরে জোহরার।
"আন্টি, আমাকে সাহায্য করুন আন্টি। আপনি তো প্রীতম স্যারের মা। আপনি স্যারকে একটু বোঝান। আমি তার বিবাহিতা স্ত্রী। আমার গর্ভে আপনাদেরই তো বংশধর।"
এরকম আহাজারি শুনে প্রিয়াঞ্জনা, প্রবীর, প্রীতি আর প্রাপ্তি ড্রয়িং রুমে ছুটে আসে। জোহরা কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। তিনি বেশ থতমত খেয়েছেন। স্বর্ণা তখনো জোহরা বেগম পায়ের কাছে বসে কাঁদছে।
"প্রীতমের বাবা এ মাইয়া কি বলতেছে এগুলা। তুমি প্রীতম রে ফোন দাও।"
সুমনা স্তব্ধ হয়ে বসে আছে সোফায়। প্রিয়াঞ্জনা সুমনার কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে।
"দেখো না প্রিয়া। এই মেয়ে এগুলো কি বলছে! তোমার ভাইয়া তো আমার সাথে এটা করতে পারেনা তাই না বলো?"
কেমন যেন ছোট বাচ্চাদের মতো কথা বলছে সুমনা।
"প্রাপ্তি তোর ভাবিকে নিয়ে ঘরে যা।"
প্রিয়াঞ্জনার সাথে জোহরা কথা বলেন না। তাই প্রাপ্তিকে আদেশ দিলেন। সুমনা জোহরার চোখে চোখে তাকিয়ে বললো,
"আমি সবটা শুনতে চাই মা। ওর স্ত্রী হিসেবে এতটুকু অধিকার তো আমার আছে।"
জোহরা আর কিছু বললেন না। স্বর্ণাকে সোফায় বসতে বললেন। তিনি বসলেন পাশে। স্বর্ণা গলা ছেড়ে কাঁদছে। প্রবীর জিজ্ঞেস করলেন,
"তোমার নাম কি?"
"স্বর্ণা"
মেয়েটা ফোঁপাচ্ছে।
"কান্না করো না মা। আমার ছেলে যদি কোনো দোষ করে থাকে তাহলে তার বিচার আমি করবো। তোমার বাড়ি কোথায়? বাবার নাম কি?"
"আমার বাবার বাড়ি কুমিল্লা। বাবা নেই। তাই নরসিংদীতে ফুফার বাড়িতে থাকি।"
ফর্সা মেয়েটির চোখ-মুখ লাল হয়ে গিয়েছে। জোহরার মায়া হলো। কি সুন্দর মেয়েটি। এমন একটি সুন্দর মেয়েই তো ছেলের জন্য চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সে বিয়ে করলো এক শ্যামলা মেয়েকে। মানতেই হবে মেয়েটি অনেক সুন্দর। বয়সও কম মন হচ্ছে।
"প্রীতমের সাথে তোমার পরিচয় কিভাবে?"
জোহরা প্রবীরকে থামিয়ে বললেন,
"প্রীতমরে ফোন করো। তুমি কি প্রশ্ন করা শুরু করছো!"
প্রবীর ফোন দিয়ে প্রীতম কে আসতে বললেন।
"স্যারের সাথে কলেজেই আমার পরিচয়। তিনি আমাকে বলেছেন সংসার জীবনে তিনি অনেক অসুখী। তার স্ত্রী সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম। আমার মায়া হলো। তার সাথে সম্পর্কে জড়ালাম। তিনি আমাকে লুকিয়ে বিয়ে করেছেন। আমার কাছে কাবিননামাও আছে। আলাদা বাসা ভাড়া করে দিয়েছেন। এরমধ্যে আমি গর্ভবতী হয়ে পড়ি। কিন্তু প্রীতম স্যার গতকাল সারাদিন না আমার ফোন ধরছেন আর না বাসায় গেছেন। তাই আমি এখানে আসতে বাধ্য হই।"
সুমনার চোখের কোণা বেয়ে নিরবে নোনাজল বেয়ে পড়লো। একেবারে নিভৃতে। এই মেয়ের সাথেই তবে সম্পর্কে জড়িয়েছে প্রীতম। এই মেয়ের ছবি দেখেছে সে প্রীতমের মোবাইলে। তাই তো চেনা চেনা লাগছে।
তখনই প্রীতম এসে উপস্থিত হয় ড্রয়িং রুমে। স্বর্ণাকে দেখে অবাক হওয়ার ভান করে বললো,
"তুমি এখানে?"
প্রবীর জিজ্ঞেস করলেন,
"এই মেয়ে কে প্রীতম? এই মেয়ে যা বলছে তা কি ঠিক?"
প্রীতম মাথা নিচু করে বলে,
"বাবা, আসলে...
প্রবীর সোফা থেকে উঠে প্রীতমের গালে একটা চড় বসিয়ে দিলেন। জোহরা তেঁতে উঠলেন।
" প্রীতমের বাবা ছেলের গাঁয়ে হাত তুইলো না। মানছি কাজটা ভালো হয় নাই।"
"তুমি চুপ করো জোহরা।"
জোহরা গলা উঁচিয়ে বললেন,
"খারাপ কি করছে প্রীতম? বাবা ডাক তো সবাই শুনতে চায়। সুমনার তো বাচ্চা হয়না।"
"এটা অন্যায় জোহরা।"
প্রীতম নরম কন্ঠে বললো,
"আমার কি ইচ্ছা হয়না বাবা হতে? আমি কেন বঞ্চিত হবো?"
প্রবীর এবার চিন্তায় পড়লেন। ছেলের দিকটাও তো তার ভাবতে হবে। স্বর্ণা প্রীতমের কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
"আপনি বাসায় যান নাই কেন? ফোনও দেন না। আমি কত ভয় পেয়েছি জানেন?"
"পরীক্ষার চাপ ছিলো কলেজে। তোমাকে না বলে আসছি?"
সুমনার হৃদয়ে কেউ যেন কাঁটা বিঁধিয়ে দিলো। নাকি ভিমরুল কামড়ে ধরলো?
প্রবীর কাশলেন। স্বর্ণা ছেড়ে দিলো প্রীতমকে।
"বাবা, আমি কি স্বর্ণাকে বাসায় দিয়ে আসবো গিয়ে?"
প্রবীর জবাব দিলেন না। জোহরা জবাব দিলেন,
"বিয়ে যখন করে ফেলাইছো এখন আর কি করা যাইবো। তারউপর বাচ্চা পেটে। আমি চাই স্বর্ণা এই বাড়িতেই থাকুক।"
জোহরা সুমনাকে জিজ্ঞেস করলেন,
"সুমনা তোমার কি কিছু বলার আছে? এমন কইরা তো তুমি আর প্রীতমও একদিন আইসা উঠছিলা বাসায়।"
শান্ত, নিস্তেজ কন্ঠে সুমনা বললো,
"না, মা। আমি চাই স্বর্ণা এই বাড়িতেই থাকুক। আমার কোনো অভিযোগ নেই।"
সুমনা ছুটে চলে গেলো প্রিয়াঞ্জনার ঘরে। হতভম্ব প্রিয়াঞ্জনাও তার পিছনে গেলো। স্বর্ণাকে নিয়ে প্রীতম নিজের বেডরুমে গিয়ে দরজা আটকে দেয়। কেমন যেন হঠাৎ একটা ঝড় উঠলো তারপর সব শান্ত। প্রবীরও আর স্ত্রীর উপর কথা বললেন না। এমন জটিল পরিস্থিতিতে আর কিই বা বলবেন। জোহরাকে জিজ্ঞেস করলেন,
"সমাজের মানুষকে কি বলবো?"
"কি আর বলবা। বউয়ের যে বাচ্চা হয়না এটা সবাই জানে। তাই প্রীতমরে চুপেচাপে আরেকটা বিয়ে করাই ফেলছি। আপাতত বাসাতে কোনো মানুষ ঢুকতে দেওয়া যাইবো না। বাচ্চা হোক। পরে বড় করে একটা অনুষ্ঠান করে একবেলা ভালো খাওয়াইবা। দেখবা সমাজ ঠান্ডা। ছেলে-মেয়ে গুলারে মানুষ করতে পারলাম না। এবার আর ধাক্কা খাই নাই। হাসপাতালের কাজও লাগতো না। মাইয়া আগেরটার চাইতে সুন্দর।"
প্রীতম জড়িয়ে ধরে স্বর্ণাকে। গলায় চুমু খায় অনেকক্ষণ। খিলখিল করে হেসে উঠে স্বর্ণা। এই প্ল্যানটা প্রীতমেরই ছিলো। অনেক তো লুকোচুরি খেলেছে। আজ স্বর্ণাকে একদম বাড়িতে তুলে ফেললো। বাবাকে নিয়েই যা ভয় ছিলো তার। কারণ তিনি সুমনাকে বেশ স্নেহ করেন। তবে জোহরা প্রীতমের দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে ভাবছিলেন এটা সে জানে। আগের বার সুমনাকে বিয়ে করায় বেশ কষ্ট পেয়েছিলেন জোহরা। তাই এবারে সরাসরি কিছু বলার সাহস পাচ্ছিলো না প্রীতম। কোনোক্রমেই মাকে বলতে পারছিলোনা। তাই সে আর স্বর্ণা বাচ্চা নিয়ে নেয়। জানে, মা বাচ্চার কথা শুনলে আর কিছু বলবেন না। একটা ছোট বাচ্চা ঘরে হেঁটে বেড়াক, খেলাধুলা করুক তা তিনি মনে প্রাণে চান। প্ল্যান মোতাবেক স্বর্ণা বাসায় এসে উঠে। আর একটা নাটকের সৃষ্টি হয়। এত সহজে যে সুমনা মেনে নিবে তাও ভাবতে পারেনি প্রীতম। যাই হোক সে মানলেই কি আর না মানলেই কি। আসল তো মাকে হাতে রাখা।
শাহবাজ খানিক সুস্থ হয়। বাড়িতে ফিরে আসে বিকেলে। ঘরে আরো কিছু টাকা রেখেছিলো। সেখান থেকে ঔষধ খরচ বাবদ যা লেগেছে তা রিমনকে দিয়ে দেয়। অনেক করেছে ছেলেটা তার জন্য। শাহবাজ তার সিম উঠায় আবার। যা যাওয়ার তাতো চলেই গেছে। এখন দুদিন বাদে জমির দলিল। পাওনাদারদের টাকা দিতে হবে। ফোন করে তারা যদি না পায় সে আরেক বিপদ। তাছাড়া প্রিয়াঞ্জনাকে ফোন দিতে হবে। নিশ্চয়ই অনেক চিন্তা করছে মেয়েটা। কেমন আছে প্রিয়াঞ্জনা?
দলিলটা সারতে পারলেই নিজের কাছে নিয়ে আসবে অর্ধাঙ্গীকে।
কি অদ্ভুত ভালোবাসা! প্রীতমকেও তো সুমনা ভালোবেসেছিলো। বিনিময়ে পেয়েছে একবুক কষ্ট। অথচ অসুস্থ অবস্থায়ও শাহবাজ চৌধুরী ভাবছেন নিজের ভালোবাসার মানুষটা কেমন আছে।
জীবনে একজন সঠিক মানুষ খুব প্রয়োজন। নয়তো জীবনের ক্যালকুলাস বেশ জটিল হয়ে পড়ে।
দেখা যাক শাহবাজ চৌধুরীর জীবন ক্যালকুলাসের সমাধান আদোও হয় কিনা নাকি তা আরো জটিল হয়ে যাবে? ঠিক কোনো কঠিন যোগজীকরণের মতো?
.
.
.
চলবে.............................