প্রিয়াঞ্জনা - পর্ব ১৬ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প


বদরুজ্জামান সাহেবের বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে শাহবাজদের রাত প্রায় আটটা বেজে গিয়েছে। পুরানো আমলের দু’তালা বাড়ি। অন্ধকারে কিছু বোঝা দায়। বাড়ির সামনে ছোট একটি উঠান রয়েছে। উঠানে জ্বলছে একশো ওয়াটের একটি হলদে বাতি। বাড়ির কিনারায় দেয়াল ঘেঁষে বেশ কিছু সুপারি গাছ লাগানো। নিচতলায় বদরুজ্জামান ভূঁইয়া সাহেব পরিবার সমেত থাকেন। শরীর বেশ খারাপ লাগছিলো প্রিয়াঞ্জনার। শাহবাজ, প্রিয়াঞ্জনা এখন ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে আছে। ড্রয়িং রুমটা বেশ গোছানো। মধ্যবিত্ত পরিবারের ড্রয়িং রুম যেমন হয়। চা-বিস্কুট নাস্তা দিয়েছেন নাজমা চাচি। তিনি বদরুজ্জামান সাহেবের স্ত্রী। বেশ অমায়িক তার ব্যবহার। বদরুজ্জামান সাহেব বললেন, 
"নাজমা ছোটখাটো আয়োজন করেছে। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিন। তারপর উপরতলার ঘরে নিয়ে যাচ্ছি নাহয়।"
"আপনারা শুধু শুধু এসব ঝামেলা করতে গেলেন চাচা।"

নাজমা ড্রয়িং রুমে এসে বলেন,
"মোটেও ঝামেলা না বাবা। তোমার সম্পূর্ণ কথা আমি শুনেছি। সত্যিই কষ্টদায়ক। তাছাড়া তোমার বাবা বিথীর আব্বুর জন্য যা করেছে সেই তুলনায় তো আমরা কিছুই করতে পারিনি।"

অতঃপর প্রিয়াঞ্জনাকে দেখে বললেন, 
"তোমার কি খারাপ লাগছে?"
"না, ঐ একটু মাথা ব্যথা।"
"খাবার খেয়ে ঔষধ খেয়ে নিয়ো। চলো খেয়ে নিবে।"

বদরুজ্জামান সাহেবের তিন মেয়ে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ছোট দুই মেয়ে নিয়ে তারা থাকেন। মেঝো মেয়ে অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ছে আর ছোটজন ইন্টারে। তারা অবশ্য সামনে আসেনি। শাহবাজ, প্রিয়াঞ্জনা ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নেয়। বদরুজ্জামান সাহেব তাদের উপরে নিয়ে আসেন। চিলেকোঠাই বলা যায়। তবে আকারে বড়। সিঁড়ি দিয়ে উঠে পাশেই ঘর। ঘরের সামনে বিশাল ছাদ। ঘরটিতে বাথরুম, রান্নাঘর আছে। 
"আমরা যার কাছ থেকে বাড়ি কিনেছি তিনি বেশ শখ করেই এই ঘরটা বানিয়েছিলেন। কিন্তু বেশিদিন থেকে যেতে পারেন নি। ক্যান্সার হয়েছিল ভদ্রলোকের। আমরা উঠার পর ভাড়া দিয়েছিলাম। গত তিনমাস যাবত খালি পড়েছিলো। সবকিছু পরিষ্কার করিয়ে রেখেছি।"

বদরুজ্জামান সাহেব বলে চললেন একমনে। প্রিয়াঞ্জনার খারাপ লাগলেও ঘরটা দেখে মন ভালো হয়ে গেলো। তার আর শাহ্ এর ঘর। নতুন করে তারা সাজাবে সংসার। 
"শাহবাজ, আপনারা থাকতে পারবেন তো?"

শাহবাজ বদরুজ্জামান সাহেবের দু'হাত নেয় নিজ হাতে। নরম কন্ঠে বলে,
"আপনি আমাদের জন্য যা করেছেন চাচা। তাতে আমরা কৃতজ্ঞ।"

বদরুজ্জামান সাহেব খুশি হলেন। চলে গেলেন তিনি। বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলো শাহবাজ, প্রিয়াঞ্জনা। ঘরটির সামনে ছোট বারান্দা রয়েছে। এককোণায় রাখা দুটো বেতের সোফা। ঘরের দরজার পাশটায় বড় করে লেখা 'চন্দ্রবিলাস'। কাঠের দরজা খুলেই শাহবাজ কোলে তুলে নেয় প্রিয়াঞ্জনাকে। নতুন করে প্রিয়াঞ্জনা প্রবেশ করে প্রিয়তমের কোলে চড়ে। লাইট জ্বালানো ছিলো আগে থেকেই। একটি পুরনো আলমারি, খাট আর ছোট একটি পড়ার টেবিল। খাটে বালিশ, তোশক সবই আছে। শাহবাজ প্রিয়াঞ্জনাকে নিয়ে খাটে বসে। প্রিয়াঞ্জনা চোখ বুজে আছে। শাহবাজ কপাল ঠেকায় প্রিয়াঞ্জনার কপালে। ভেজা কন্ঠে বলে উঠে,
"আবার আমাদের পথচলা শুরু হবে প্রিয়াঞ্জনা। দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের ছোট পৃথিবী আবার রঙিন হয়ে উঠবে। প্লিজ পাশে থেকো।"

বলেই প্রিয়াঞ্জনার চোখে, মুখে, ঠোঁটে অজস্র নরম স্পর্শে ভরিয়ে তুলে। প্রিয়াঞ্জনা লাজুক কন্ঠে বলে,
"থাকবো শাহ্। সব সময় থাকবো।" শাহবাজ প্রিয়াঞ্জনার মাথা টিপে দেয়। আরাম অনুভব করে প্রিয়াঞ্জনা। গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। 

আজ বোধহয় অমাবস্যা। নিশীথের নিস্তব্ধতা চিড়ে ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। 

কারো নিশীথ হয় প্রণয়ের, গভীর ভালোবাসার। আর কারো নিশীথ বয়ে আনে অনাবিল দুঃখ, য ন্ত্র ণা। আপাতত প্রিয়াঞ্জনার ঘরেই ঠাঁই হয়েছে সুমনার। প্রিয়াঞ্জনা আর প্রীতমের ঘর প্রায় পাশাপাশি। সুমনার কানে স্পষ্ট স্বর্ণার খিলখিল হাসির শব্দ ভেসে আসছে। প্রীতম হয়তো কোনোকিছু নিয়ে দুষ্টুমি করছে স্বর্ণার সাথে। বুকের মাঝে অসহনীয় ব্যথা অনুভব করে সুমনা। চোখের সামনে ভেসে উঠে প্রীতমের সাথে তার কাটানো মুহূর্তগুলো। মানুষ কি করে এত বদলাতে পারে? কি করে! উত্তর খুঁজে পায় না সুমনা। এখন আর প্রিয় মানুষটার জন্য মনে ভালোবাসা নেই। আছে এক বুক ঘৃ ণা। চোখ মুছে একখানা সিদ্ধান্ত নেয় সুমনা। খুবই কঠিন সিদ্ধান্ত। 

সকাল আটটা বাজেই ফাহিম বাসায় এসে হাজির। রাগে গাঁ জ্বলছে তার। এতকিছুর পরও সে প্রিয়াঞ্জনাকে পাবেনা! ফাহিম আজ একাই এসেছে। প্রীতম কলেজে যাবে ক্লাস নিতে। ডাইনিং টেবিলে বসে খাচ্ছিলো। খাবার এগিয়ে দিচ্ছে স্বর্ণা। ফাহিমকেও খাবার খাওয়ার আহ্বান জানালো। কিন্তু ফাহিম যায়নি। বসে আছে সোফায়। জোহরা পাশের ফ্ল্যাটে গিয়েছেন। প্রীতি,প্রাপ্তি স্কুলে যাবে। ফাহিমের সামনে দিয়েই গেলো। কুশল বিনিময়ও করলো ফাহিমের সাথে। প্রীতির চাইতে প্রাপ্তি বেশি সুন্দর। মুখে প্রিয়াঞ্জনার একটা ছাপ আছে। হঠাৎ নিজের সিদ্ধান্তের পরিবর্তন করে ফাহিম। আমেরিকায় সে একজন ফরেন মেয়ে বিয়ে করেছে। এই ব্যাপারটা এখনো কেউ জানেনা। তবে বাঙালি পুরুষ। বাঙালি মেয়েদের প্রতি অন্য রকম টান। আর ছোটবেলা থেকেই প্রিয়াঞ্জনার আকর্ষণীয় শরীর বেশ টানতো তাকে। তাই প্রিয়াঞ্জনার বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো সে। কিন্তু প্রাপ্তিকে দেখে তার মাথায় ভাবনা জাগে। এত সুন্দর অবিবাহিত মেয়ে তার চোখের সামনে থাকতে সে কেন ঐ মেয়ের পিছনে ঘুরবে! প্রীতম যে মাত্রার লোভী তাকে রাজি করানো সেকেন্ডের ব্যাপার। হুট করেই মন ভালো হয়ে যায় ফাহিমের। প্রীতম তার পাশে এসে বসে। 
"কি ব্যাপার প্রীতম? তুমি না বলেছিলে প্রিয়ার ডিভোর্সের ব্যবস্থা করবে? এখন শুনি প্রিয়া নাকি পালিয়েছে?"
"আপনি কি করে জানলেন ফাহিম ভাই?"
"গতকাল রাতে মাকে ফোন করে জানিয়েছে ছোট আম্মু।"
"হ্যাঁ, আসলে কি বলবো ভাই। প্রিয়ার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। নয়তো এত ভালো সুযোগ থাকতে কেউ বা'ট'পা'রের সাথে পালায়? আপনে বলেন? ঐ শাহবাজ নিজেই টাকা মা র ছে। নয়তো নিজে টাকা ফেরত দিতেছে কেন!"
"শাহবাজ কি করলো না করলো সেটা আমার দেখার ব্যাপার না প্রীতম। কথা আমার তোমার সাথে হইছে। ঐ লোকের সাথে না।"
"কি করবো আপনিই বলেন?"
"তোমার বোন প্রাপ্তিকে আমি বিয়ে করতে চাই।"

প্রীতম থতমত খেয়ে গেলো কথাটা শুনে। প্রাপ্তি তো এখনও অনেক ছোট।
.
.
.
চলবে.......................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন