শাহজাহান তন্ময় - পর্ব ১৫ - নাবিলা ইষ্ক - ধারাবাহিক গল্প


অরুর চোখমুখে লালাচে আভা। শ্বাসপ্রশ্বাস এবং বুকের ওঠানামার গতি অস্বাভাবিক। কাছাকাছি এসেই ঠোঁটের হাসির রেখা দীর্ঘ হয় ওর। চাঁদের মতো জ্বলজ্বল করছে চোখজোড়া। এই চোখে চেয়ে তন্ময়ের বুকের চাপা যন্ত্রণাটুকু, নিদারুণ সুখময় অনুভূতিতে রুপান্তরিত হলো। অশান্ত, অস্থির তোলপাড় চলিত বক্ষে ঝিরিঝিরি শান্তির বর্ষন নামল যেন। পৃথিবীর শুদ্ধতম প্রাণস্পন্দন হাসির রেখা ধরে রাখা ঠোঁট জোড়ার দিকে তাকিয়ে বলল,  

‘বোকার মতো এতো হাসার কি হলো!’

ওড়নার কোণ মোড়াতে থাকা অরু লাজুক হাসে। আঁকাবাঁকা ভঙ্গিতে তাকিয়ে , ফকফকে পরিস্কার দাঁত দেখিয়ে বলে, 

‘আমি অনেক খুশী।’

তন্ময় দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে। অস্পষ্ট স্বরে শুধায়, 
‘কেন?’

অরু হেলেদুলে পা-জড়া নাড়াচড়া করে। নুপুর জোড়া প্রতিধ্বনি তুলে ঝনঝন শব্দে। হেসে হেসে বোকার মতো বলে, 

'এম্নেই।'

পাশ দিয়ে রিক্সা যাচ্ছে। হুটহাট গাড়ি দেখা দিচ্ছে। তন্ময় অরুর মাথায় ডান হাত চেপে সাইডে নিয়ে আসে। সে নিজে দেয়ালের মতো ওর সামনে দাঁড়ায়। প্যান্টের পেছন পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করতে করতে প্রশ্ন করে,

'পড়াশোনা ঠিকভাবে হচ্ছে?'
'না।'
'কেন না?'

অরু চুপ মেরে আছে। তন্ময় দোকানের টাকা মিটিয়ে ফিরে তাকায়। ধমকের সুরে বলে, 
'না কেন?'

অরুকে মিনমিন গলায় বলতে শোনা যায়, 

'আমায় পড়াবেন না!'

তন্ময়ের মুখমণ্ডলের পরিবর্তন হলো না। গলার স্বর ও রুক্ষ রয়ে গেল। অথচ ভেতরে প্রশান্তি। সে তো এটাই চাচ্ছিল। অরু আসুক প্রতিদিন। চোখের সামনে থাকুক। সারাদিন পর একটিবার দেখতে পারলে ক্লান্তির নিস্তার ঘটবে, ভালো ঘুম হবে। খুব সাবলীল গলায় হুকুম করে, 

'চলে আসবি কাল সন্ধ্যা ছ'টায়। আমি চাচ্চুকে বলে রাখব।'

অরু লাফিয়ে উঠলো। খুশিতে চকচক করছে সম্পূর্ণ ও নিজে। তড়িঘড়ি গলায় বলল, 

'আচ্ছা। আমি তার আগেই চলে আসব। খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করব। একদম ফাঁকিবাজি করব না। একটুও জ্বালাব না।'

তন্ময় অদেখা হাসে। আনমনে আওড়ায়, 'যতখুশি জ্বালা, যতখুশি ফাঁকিবাজি কর। আমি আছি তো সহ্য করার জন্য, তোকে আগলে রাখার জন্য।'

অরু ছটফট করছে। আড়ে আড়ে তাকাচ্ছে। সবসময় এভাবে তাকায়। এইযে, এভাবে যে তাকায় ও কী বোঝে তন্ময় সব দেখে, আগাগোড়া জানে? এমন হাবভাবে কতটা অশান্ত করে তাকে বোঝে? অশান্ত, অবিন্যস্ত ও যে সর্বনাশের পুনরাবৃত্তি। এতক্ষণ শুধু একপলক দেখতে চেয়েছিল! অথচ এখন.. এখন তো ইচ্ছেগুলো ক্রমশ বেড়ে চলেছে। 

রাত হচ্ছে। অরুর ফিরে যাওয়া দরকার। কিন্তু তন্ময় বলতেই পারছে না, চলে যেতে। এই রাস্তার আলোয়, চাঁদের রূপে সবকিছু যেন এক মোহ। এই মোহ থেকে দূরে যেতেই ইচ্ছে হয় না। কিন্তু সবসময় ইচ্ছেরা পূর্নতা পায় না। তন্ময় হাত ঘড়িটা দেখে বলে, 

'খাওয়া দাওয়া করছিস না কেন? কি সমস্যা? আমি যেন আর না শুনি এসব। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করবি। এখন যা বাসায়।'

অরু ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। তন্ময় তাড়া দিল না। তাকিয়ে থাকল। একসময় নিজেই পা ঘুরিয়ে হাঁটা ধরল মেয়েটা। যাওয়ার পথে কয়েকবার ফিরে তাকাল। দরজার ভেতরে ঢুকতেই দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে তন্ময়। মাথার ওপরে তখন চাঁদটা জ্বলজ্বল করছে। 
________

তন্ময়ের ডিপার্ট্মেন্টের মেয়েগুলো উগ্র স্বভাবের। সারাদিন গসিপ করে বেড়ায়। আচার-আচরণেও সভ্যতা নেই। তন্ময়কে সবখানে ফলো করে। ইরাবতী নামের মেয়েটা তো সেদিন ইনিয়েবিনিয়ে প্রপোজ ও করে বসল। ফেইসবুকে রিকোয়েস্ট দেওয়া, নাম্বারে কল দিয়ে বিরক্ত করা তো আছেই! প্রত্যেকদিন লাঞ্চ টাইমে টিফিনবাক্স নিয়ে সামনে আসবে। আজও তাই! তন্ময় ফাইলস গোছগাছ করছিল। ওসময় ইরাবতী আসে। হাতে নিত্যদিনের মতো টিফিনবাক্স। পাত্তা না পেয়ে একটু কেশে নিজের আসার বার্তা বোঝায়। মিষ্টি গলায় শুধায়, 

'ডিরেক্টর! লাঞ্চ টাইম এখন। ক্যান্টিন যাবেন না?'
'না। একটু বেরোব।'
'কারো সাথে দেখা করতে?'
'জি।'
'কে জানতে পারি?'

তন্ময়ের ফাইলস গোছানো শেষ। সেলফোন বেজে ওঠে সেসময়। কল রিসিভ করে যেতে যেতে বলে যায়, 

'বোন।'

অফিস বিল্ডিংয়ের পাশেই একটা কফি-শপ। সেখানেই এসেছে শাবিহা। থমথমে মুখে বসে। তন্ময় দরজা ঠেলে প্রবেশ করেই, বোনের শক্তপোক্ত মুখখানা দেখে নিল। তার আর মায়ের ওপর শাবিহা ভীষণ রেগে। রেগেমেগে কথাবার্তা বন্ধ রেখেছিল। কল দিলেও ধরছিল না। অবশ্য ওর রাগার উপযুক্ত কারণ আছে। তন্ময় গিয়ে পাশের চেয়ারে বসে। শাবিহার নাক ফুসছে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে। এই কেঁদে ফেলবে ফেলবে ভাব। তন্ময় হতাশ মুখে হাত বাড়ায়। তৎক্ষণাৎ ঝাপিয়ে পড়ে ভাইয়ের বুকে। মাথা রেখে, শাবিহার সে কী কান্না! কান্নার তোড়ে মেয়েটা শ্বাস নিতে পারছে না। মুখমণ্ডল চোখের জলে ভিজে একাকার। এতো কাঁদার কি হলো? কখন থেকে একনাগাড়ে কেঁদে যাচ্ছে। তন্ময় মাথায় হাত রাখে। চুলের ওপর হাত বুলিয়ে দিয়ে নরম গলায় বলে, 

'হয়েছে তো। আর কাঁদে না। দেখি…মুখ তো লাল করে ফেলছিস। পানি খা… ধর!'

তন্ময় পানির বোতলের ঢাকনা খুলে শাবিহার হাতে ধরিয়ে দেয়। দু চুমুক পানি খেয়ে বোতল টেবিলে রাখে শাবিহা। বড়ো বড়ো নিশ্বাস নিচ্ছে আর ফেলছে। তন্ময় দুটো কফির অর্ডার করে। তার জন্য সাধারণ কফি আর শাবিহার জন্য কোল্ড ওয়ান। শাবিহা নিজেকে শান্ত করে। টিস্যু দিয়ে চোখমুখ মুছে নেয়। নাক টেনে ভাইয়ের দিক তাকায়। অভিমানী গলায় বলে, 

'আমিতো তোমার কেউ না। মায়ের ও কেউ না। আমি কারো কেউ না।'

তন্ময় হাসে। শাবিহার লাল নাকে টোকা মেরে বলে, 

'রাগলে তোকে মায়ের মতো দেখায়।'
'আর হাসলে তোমায় বাবার মতো দেখায়।'

বলেই ফিক করে হাসে শাবিহা। হাসতে হাসতে দুলে পড়ে ভাইয়ের ওপর। নিজের ফোন বের করে। একটি ছবি দেখিয়ে বলে, 'দেখ দেখ। এই ছবিটায় তোমার আর বাবার মুখমণ্ডল একদম এক লাগছে।'

ছবিটি তাদের বাগানের। তন্ময় আর মোস্তফা সাহেব পাশাপাশি চেয়ারে বসে। পেছনে হরেকরকম ফুলের সমাহার। নীলসাগরের আসমান মাথার ওপর। চারিপাশে সবুজ গাছপালা। হাতে দুজনের চায়ের কাপ। দুজনের দৃষ্টিই অদূরে। ছবিটি সাইডে থেকে তোলা। তুলেছে শাবিহা। আদুরে চোখে তন্ময় ছবিটি দেখল। অন্যমনস্ক গলায় প্রশ্ন করে, 

'বাবা কেমন আছে?'
'ভালো না। মনমরা হয়ে থাকে। খুব কষ্ট পাচ্ছেন। আমি জানি তুমি আর মাও পাচ্ছ। আর আমাকে তোমরা সবাই মিলে কষ্ট দিচ্ছ। আমার এসব ভালো লাগছে না ভাই। সব ঠিক করে দাও না।'

এরমধ্যে কফি চলে এসেছে। কফি খেতে-খেতে দু ভাইবোনের মধ্যে অনেককিছু নিয়েই কথাবার্তা হলো৷ আলাপ-আলোচনার শেষ নেই। শাবিহা সবকিছু নিয়ে একের পর এক টপিক তুলছে। কথার ফুলঝুরি নিয়ে বসেছে। 
____

সামনেই পবিত্র ঈদুল ফিতর। রমজান মাসের শুরু হবে কাল বাদে পরশু থেকেই। জবেদা বেগমের মন খারাপ। ভীষণ ভাবে খারাপ। বাড়ি ছেড়ে এই প্রথম ঈদ তার আর তন্ময়ের। কেঁদেকেটে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছেন। রাতভর তন্ময় মায়ের পাশেই থাকল। বারবার করে বলল, 

'আমি দিয়ে আসি। বাসায় ফিরে যাও৷ তুমি ছাড়া ঈদের মজা আছে?'

জবেদা বেগমের কান্নাকাটি সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল। তিনি কড়াকড়ি গলায় বললেন,

'আমি গেলে তোর কী হবে? আমার ছেলেকে আমি একা ফেলে যাব? অসম্ভব!'
'অসুস্থ হয়ে পড়বে মা।'
'হব না। আচ্ছা শোন না, বাবা! ভাবছিলাম ইফতারি তো আমি নিজের হাতে প্রত্যেকবার করি। ওরাও আমার হাতের খাবারেই অভ্যস্ত। তাই ভাবছিলাম রমজানের ইফতারি এখান থেকে বানিয়ে পাঠালে কেমন হয়?'
'ভালো হয়। লিস্ট করে দাও, বাজার করে নিয়ে আসি।'
'হ্যাঁ, ভালো বলেছিস। এখনই করে রাখব। আর শোন.. আমি চাচ্ছিলাম শাবিহা, অরু, দীপ্ত আকাশ ওরা সবাই একদিন না-হয় এখানেই ইফতারি করুক। এখন প্রথম রোজায় আনা তো ঠিক হবে না ওদের। প্রথম রোজার ইফতারি এখানে করলে, ওই বাড়িটা খালিখালি লাগবে। বরংচ দ্বিতীয় রোজায় ওরা এখানে ইফতারি করবে, তোর চাচ্চুকে বলে রাখিস। প্রথম রোজায় বরং তোর বন্ধুদের দাওয়াত কর। ছেলেমেয়ে গুলো এতো আদুরের। ওরা বাসায় আসলেই বাড়িঘর জ্বলজ্বল করে।'

তন্ময় মাথা দোলায়। বন্ধুবান্ধবদের আগের থেকেই জানিয়ে রাখে। তারাও রাজি। জবান দিয়েছে সন্ধ্যার আগেই হাজির হবে। 

পরদিন বিকেলের ঘটনা। তন্ময় অফিস ছেড়ে দ্রুত ফেরে বাজার করবে বলে! বাড়ির কাছাকাছি আসতেই দেখে ছোটোখাটো একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে। ট্রাকে ভর্তি সরঞ্জাম। রান্নাবান্নার কী নেই সেখানে? চাল-ডাল-তেল-আটা থেকে ধরে সবকিছু। সেগুলো ওঠানো হচ্ছে পাঁচতলায়। জবেদা বেগমকে দেখা গেল বেকুব বনে দাঁড়িয়ে থাকতে। তন্ময়কে দেখেই তিনি ছুটে আসলেন। তন্ময়কে আর জিজ্ঞেস করতে হলো না, কী হচ্ছে। সে নিজেই বুঝে নিয়েছে। তার বাপ-চাচাদের ছাড়া আর কার কাজ এগুলো? এরমধ্যেই কল এলো আনোয়ার সাহেবের। তিনি প্রাণ খুলে হাসছেন, 

'হ্যাঁ, শোনো আব্বু! সবকিছু পাঠিয়ে দিয়েছি। সাহায্যের জন্য রূপালী আপাকেও পাঠাব। ভাবীর রান্নাবান্না ছাড়া কী রমজান মাস উপভোগ করতে পারব? আর ভাই বা কীভাবে রোজা রাখবে ভাবীর হাতের খাবার ছাড়া?'

এই সূত্রপাত ধরে রাতেই রূপালী আন্টি হাজির। কোমরে ওড়না বেঁধে তিনি সঙ্গে সঙ্গে কাজে নেমে পড়েছেন। একদিক দিয়ে ভালোই হলো। একাএকা 
 জবেদা বেগমের পক্ষে এতো কাজ করা অসম্ভব ছিল।
________

প্রথম রোজার দিন অফিস ছুটি। রাতে সেহরি খেয়ে নামান পড়ে শুয়েছিল তন্ময়। তাই বেলা করে এখনো শুয়ে। আধোঘুমে সে সজাগ আবার ঘুমের ঘোরে। এরমধ্যে আবছা মেয়েলী চিকন গলার স্বর শুনতে পেলো। অরু এসেছে। নুপুরের শব্দও তো কানে এসে ঠেকছে। কখন এলো? মাত্রই বুঝি। ভাবনার মধ্যেই দরজা ঠেলে কারো প্রবেশের শব্দ! শব্দহীন ভঙ্গিতে হাঁটছে। তন্ময়ের ঘুম পুরোপুরি কেঁটে গেল। তবে উঠল না। ঠাঁই সেভাবেই শুয়ে রইল যেন গভীর ঘুমে। চোখের পাপড়ি অবধি নড়ছে না। অনুভব করল অরু বিছানার কোণে এসে বসেছে। খুব ধীরেসুস্থে যেমন ভীষণ ভয়ে আছে। মাথাটা ঘুমন্ত তন্ময়ের দিকেই ঝুঁকানো। বিড়বিড়িয়ে কীসব বলছে! এরমধ্যে তন্ময় একটি বাক্য শুনে নিল, 'ঘুমন্ত তন্ময় ভাই বেশি সুন্দর নাকি সজাগ তন্ময় ভাই?'

এই বাক্যের মাথামুণ্ডু তন্ময় বুঝল না। তার বোঝার আগেই অরুর হাত এলো তার গালে। নরম হাতের স্পর্শ তার দাঁড়ির ওপর পড়ল। এবং পরপরই চলে গেল। ছুঁয়েই মেয়েটা হন্তদন্ত ভঙ্গিতে ছুটে পালিয়েছে। পালানোর পূর্বে দুয়ারে হোঁচট ও খেয়েছে।

অনেকক্ষণ পর তন্ময় চোখ মেলে তাকায়। গাল ছুঁয়ে গাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দরজার দিক। বুকটা ধড়ফড় করছে। অরু তাকে যেভাবে জ্বালায়, সেভাবে অরুকে জ্বালালে কেমন হয়? 
.
.
.
চলবে..............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন