কোনো এক কারণে নাদিয়ার সাথে এখনো প্রিয়াঞ্জনার দেখা হয়নি। কেন হয়নি তাও এক বিস্ময়ের ব্যাপার। নাদিয়ার দেখা হলো আবার শাহবাজের সাথে। শাহবাজ সবকিছুই এনেছে তবে সয়াবিন তেল আনতে ভুলে গিয়েছে। তাই মাগরিবের নামাজের কিছুক্ষণ আগে, প্রিয়াঞ্জনা তাকে আবার বাজারে পাঠিয়েছে তেল আনার জন্য। তখনই নীল পাঞ্জাবি পরনে আবার সেই সুপুরুষের সন্ধান পায় নাদিয়া। সকালে বান্ধবীর বোনের বিয়েতে গিয়েছিলো। ফিরেছে এখন। শাহবাজ গেট খুলেই দেখে নাদিয়া দাঁড়িয়ে। উঠান পেড়িয়ে স্টিলের মেইনগেট। নাদিয়া টোকা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলো। চঞ্চল নাদিয়ার মুখে এমনিতে খই ফুটে। কিন্তু সকালে এই লোকের সন্ধান পাওয়ার পর থেকেই তার ভিতরে কেমন কেমন যেন করছে। বিয়েতে গেলো। সারাটা সময় কেটেছে অস্থিরতায়। ঘুরেফিরে মাথায়, মনে সকালবেলার সেই যুবক! এখন এই গোধূলিলগ্নে নীল পাঞ্জাবি পরনে সুপুরুষটাকে দেখে নাদিয়ার হৃদপিণ্ড ভয়ানক গতিতে লাফাচ্ছে। ভয়ানক মানে ভয়ানক! শাহবাজ স্বাভাবিক স্বরেই জিজ্ঞেস করলো,
"ভিতরে আসবে খুকি?"
আর হৃদপিণ্ড লাফানো! খুকি শব্দটা শুনে রাগ উঠে গেলো নাদিয়ার। হিসহিসিয়ে বললো,
"খুকি নয় নাদিয়া। আমার নাম নাদিয়া।"
শাহবাজের খেয়াল ছিলোনা নামটা। তাই খুকি বলেই সম্বোধন করেছে। বাচ্চা একটা মেয়ে।
"সরি, সরি। আমার আসলে মনে ছিলো না।"
নাদিয়ার মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। ওর নামটাই যে লোকের মনে নেই সেই লোককে নিয়ে সে সারাদিন ভেবেছে! কান্না পেয়ে গেলো তার। কি অদ্ভুত!
শাহবাজ গেইট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে বললো,
"গেট লাগিয়ে দিয়ো না। আমি এখনই চলে আসবো।"
"জ্বি"
শাহবাজ চলে গেলো। মন খারাপ করে বাসায় প্রবেশ করে নাদিয়া। নাজমা উঠানে চেয়ারে বসে পাশের বাড়ির ভাবীর সাথে গল্প করছিলেন। নাদিয়াকে দেখে ডাক দিলেন। সে কিছু না বলেই ঘরে চলে গেলো। নাজমা চিন্তায় পড়লেন। তার যা রণচণ্ডী মেয়ে! না জানি আবার কি ঝামেলা পাকিয়ে এসেছে। তিনি আর বিষয়টা ঘাঁটালেন না। গল্পেই মেতে উঠলেন। এই মেয়ে এমনই। যদিও তিনি ছোট মেয়েটাকে বড়ই আদর করেন।
শাহবাজ তেল নিয়ে ফিরলো কিছুক্ষণ পরই। প্রিয়াঞ্জনা টুকটাক সব গুছিয়ে নিয়েছে। আজ রাতের মেনু আলুভাজি, ডাল আর ভাত। তবে এই আলুভাজি কিছুটা ভিন্ন ধরনের। সচরাচর আমাদের দেশে ভাতের সাথে এমন করে আলুভাজি খাওয়া হয় না। এর প্রচলন রয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। প্রিয়াঞ্জনা তখন হাইস্কুলে পড়ে তাদের বাড়ির পাশের দালানে এক ভারতীয় পরিবার উঠেছিলো। সুভদ্রা মাসি বড়ই স্নেহ করতেন তাকে। এটা সেটা করে খাওয়াতেন। ভদ্র মহিলার কোনো মেয়ে ছিলোনা। দুটো ছেলে। যাই হোক তার কাছ থেকেই শিখেছে প্রিয়াঞ্জনা। প্রথমে আলু মিহি করে কেটে নিতে হবে। তারপর তা ভালো করে পানি দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। এতটা পরিষ্কার যেন পানির মধ্যে আলু কাটাগুলো রাখলে স্বচ্ছভাবে দেখা যায়। ভালোকরে পানি ঝড়িয়ে একটা প্লেটে মিহি করে কাটা আলুগুলো ছড়িয়ে রাখতে হবে। যেন পানি অবশিষ্ট না থাকে। তারপর অল্প লবণ মিশাতে হবে। কিছুক্ষণ পর ডুবো তেলে ভেজে নিতে হবে। মচমচে হয়। গরম ভাতের সাথে বেশ ভালোলাগে খেতে। শাহবাজও এটাসেটা কেটে দিচ্ছে। এই কাজ শাহবাজ সবসময়ই করে। যখনই সুযোগ পায় প্রিয়াঞ্জনাকে সাহায্য করে। তা হোক রান্না-বান্না আর হোক ঘরের কাজ। আমি পুরুষ! আমি কেন এসব করবো! এমন মনোভাব কোনোকালেই শাহবাজের ছিলোনা। এই যেমন এখন লোকটা বেশ মনোযোগী হয়ে শসা কাটছে। মনে হচ্ছে এই কাজটি করাই তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। দুষ্টুমি চেপে বসে প্রিয়াঞ্জনার মাথায়। গ্যাসের চুলা অফ করে শাহবাজের সামনে গিয়ে বসে। শাহবাজ মুখ তুলে তাকিয়ে চোখে ইশারা করে, 'কি?'
প্রিয়াঞ্জনা মাথা নাড়ায়। যার অর্থ 'কিছু না তো!' তারপর হাত বাড়িয়ে এলোমেলো করে দেয় শাহবাজের চুল। শাহবাজও কম কিসে! দপ করে ধরে ফেলে প্রিয়াঞ্জনার হাত। একটানে নিয়ে আসে কোলে। ঠোঁট ছুঁয়ায় ঘাড়ে। কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
"খুব দুষ্টু হয়েছো প্রিয়াঞ্জনা!"
এখনও লজ্জা! এত বছর সংসার করার পরও প্রিয়াঞ্জনা তার শাহ্কে লজ্জা পায়। এই যেমন এখন লাজুকলতার মুখে কোনো কথা নেই। শাহ্ হাসে। টাকা পয়সা চাইনা তার। কেবল একটি সুখের সংসার হলেই চলবে। এই মানুষটা থাকলেই চলবে।
চারপাশে মাগরিবের আজান দিচ্ছে। পাখিরা ফিরছে নীড়ে। হলদে বর্ণ সুবিশাল আকাশ। মেঘেদের আনাগোনা তেমন চোখে পড়ছেনা। জুঁইফুল গাছের নিচে ইটের তৈরি বেঞ্চের মতো আছে। সেখানে সুমনা বসে আছে। এটি বাড়ির পিছন দিকে। ভাড়াটিয়ারা আজকাল তার দিকে কেমন নজরে যেন তাকায়। কারো চোখে করুণা, কারো চোখে তাচ্ছিল্য। খুব লজ্জা লাগে সুমনার। নিজের হাতে সাজানো, গুছানো সংসারটা শেষ হয়ে গেলো তার। আজ নিজেকে অপাংতেয় মনে হয়। সব অপরিচিত লাগে। নিজের মুখে দু'হাত ছুঁয়ায় সুমনা। সে শ্যামবর্ণ। ঐ মেয়ে ফর্সা। তার বয়স বেশি। ঐ মেয়ের বয়স কম। সে বাচ্চা জন্ম দিতে অক্ষম। আর ঐ মেয়ের গর্ভে সন্তান। সুমনা চায় না। তবুও বারবার নিজের সাথে স্বর্ণার তুলনা করে বসে। সুমনা সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। এই বাড়িতে তার কোনো পিছুটান নেই। কিন্তু কোথায় যাবে! কি করবে! ও অনার্স পাশ। কিন্তু চাকরি কি এতই সহজ! ডিভোর্সি মেয়েদের তো সমাজ দুচোখে সহ্য করতে পারেনা। তবুও নিজের সিদ্ধান্তকেই পাকাপোক্ত করে সুমনা। সে এই বাড়ি ছাড়বে তাও অতি শীঘ্রই। কারো গলা খাঁকারির শব্দে উদাস নয়নে সেদিক পানে চায় সুমনা। মইনুল সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। সুমনা নজর ফিরিয়ে নেয়। মইনুল সাহেবের দৃষ্টি অন্যরকম। সুমনা এই দৃষ্টির অর্থ বুঝে। প্রীতম যখন তাকে ভালোবাসার সাগরে ভাসিয়েছিলো তার দৃষ্টিও ঠিক এমনই ছিলো। এবার আর কোনো ভুল করবেনা সুমনা। কোনো পুরুষকেই এখন সে আর বিশ্বাস করেনা। বাকিটা জীবন একাই কাটিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে তার। মইনুল দাঁড়িয়ে রইলেন।
ফাহিম এবং তার মা এলো রাতের বেলা। হুলস্থুল কান্ড। দুহাত ভরে এনেছে ফাহিম। ফল থেকে শুরু করে মিষ্টি সব। ফাহিমরা দূর সম্পর্কের আত্মীয় প্রবীরের। তবে সম্পর্ক ভালো। ফাহিমের বাবা মা রা গেছেন। সে তার মাকে নিয়ে আমেরিকায় থাকে। বড়বোন আছে একটা। পরিবার নিয়ে কানাডা থাকে। নরসিংদীর বালুচরে তাদের নিজস্ব একটা ফ্ল্যাট রয়েছে। তাছাড়া তেমন সম্পত্তি এদেশে করেনি তারা। বেশি তো থাকা হয় না। অনেক মাস পরপর আসে। যার বিয়ে তার খবর নাই, পাড়া-পড়শীর ঘুম নাই। কথাটা শতভাগ মিলে গেলো প্রাপ্তির সাথে। সন্ধ্যায় সে মইনুল স্যারের কাছে পড়লো। আর রাতেই মা এসে বলছেন প্রীতি যেন তাকে একটা শাড়ি পরিয়ে রেডি করে ড্রয়িং রুমে নিয়ে আসে। কারণ ফাহিম তাকে দেখতে এসেছে! আকাশ থেকে পড়লো প্রাপ্তি! মানে কি! ফাহিম ভাইয়ের সাথে তো প্রিয়া আপার বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো। মা ন্যাওটা হওয়ায় মায়ের উপরে কোনো কথা বললোনা প্রাপ্তি। কিন্তু সব রাগ গিয়ে পড়লো প্রিয়াঞ্জনার উপর। প্রীতি মুচকি মুচকি হেসে তাকে শাড়ি পরিয়ে দিচ্ছে। বেশ হয়েছে। ঐদিন প্রাপ্তির জন্যই বাড়িতে বড় ঝামেলা হয়েছিলো।
"কি রে চুপসে আছিস কেন? বাবা-মা যা করে তাতেই নাকি সন্তানের মঙ্গল? তোর নীতিবাক্য না এটা?"
"খুব মজা পাচ্ছিস তাই না?"
"খুব"
টেনে বললো প্রীতি। হঠাৎ করেই কেঁদে দেয় প্রাপ্তি। প্রীতির মন গলে যায়। যত হোক জমজ বোন তো! যদিও তাদের চেহারায় মিল নেই। বরং প্রাপ্তির চেহারা প্রিয়া আপার সাথে মিলে। প্রীতির খুব মায়া হলো। মা যে কেন এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ করছে! প্রীতি, প্রাপ্তির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
"থাক, কাঁদিস না। ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।"
.
.
.
চলবে...........................