চন্দ্রগ্রহণ - নাবিলা ইষ্ক - অনু গল্প


!!১!!

চন্দ্রগ্রহণ দেশের উন্নতি জাদুবিদ্যায় নির্ভরশীল। যার জাদু যতটা শক্তিশালী সে ততটাই ধনী এবং বিত্তশালী। চন্দ্রগ্রহণের বর্তমান যুবরাজ জোসেফ তুর্কিশ একজন বিশ্বসেরা জাদুগর। শোনা যায়, সে আঙুলে আঙুল ঘষে একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে যাতায়াত করতে পারদর্শী। চোখের পলকে আসমান কাঁদিয়ে বর্ষণ নামাতে জানে, সূর্য লুকিয়ে পৃথিবীতে রাত নামাতে পারে। চন্দ্রগ্রহণ দেশে সে সবথেকে শক্তিশালী এবং সম্মানিত ব্যক্তি। এবং দেশের জনগণের বড্ড আদরেরও বটে। তার জন্য জানপ্রাণ উজাড় করতে প্রস্তুত দেশের সকল কুমারী রূপবতী নারীগণ। 
তরুণীদের রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়া এই যুবরাজ এখনো অবিবাহিত। না রয়েছে তার কোনো রক্ষিতা। তার ছোটো ছোটো ভাইদের ইতোমধ্যে বেশকিছু রক্ষিতা রয়েছে। নিজেদের রাত কাটানোর জন্য নিত্যনতুন সঙ্গী সর্বদাই উপস্থিত রয়। তবে যুবরাজ জোসেফ ভিন্ন। নারীতে সে কোনোকালেই আকর্ষিত ছিল না। কিন্তু…. এমন ভাবে এক নারীতে সে আকৃষ্ট হবে কে জানতো? তাও এতটা গভীর ভাবে! 

_____

গতকাল জোসেফ রাইসাল শহরে এসেছে। রাইসাল শহর দেশের সবথেকে ছোটো শহর। এই শহরকে ছোটোখাটো সুখী শহরও বলা হয়। পরিপাটি করে সাজানো এই শহরটি ভ্রমণের জন্য সেরা। এই কারণ বসত গতবছর জোসেফ কোটি-কোটি টাকা এখানকার মিনিস্টারকে দিয়েছে, যেন আরও সুন্দর এবং আকর্ষণীয় করা হয়। টাকা দেওয়াটা বিফলে যায়নি। আগের তুলনায় দ্বিগুণ সুন্দর হয়ে উঠেছে। চারিপাশে ফুল আর ফুল। হরেকরকমের পরিষ্কার সবুজ গাছপালা। তাদের টেক-কেয়ার হয়তো প্রত্যেকদিন করা হয়। পাখিদের কিচিরমিচির সর্বত্র জুড়ে। বড়ো বড়ো নীলচে পানির নদী গিয়েছে এদিক-ওদিক দিয়ে। পরিষ্কার পানির তলদেশে কি হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে নির্নিমেষ। ছোটো ছোটো জাহাজ হেলেদুলে চলেছে। স্বপ্নের এই শহরে ঢুকেই মন ভালো হয় জোসেফের।
তবে এবার সৌন্দর্য উপভোগ করতে সে আসেনি। এসেছে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে। কাজটি হচ্ছে ইনার পাথর নেওয়া। ইনার পাথর একরকম অদ্ভুত পাথরের তৈরি শক্তির মাধ্যম। জাদুগরদের এই ইনার পাথর শক্তি জোগায়, তাদের পিপাসা মেটায়, তাদের শক্তি রক্ষার অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায়! এবং এই ইনার পাথর যেকেউ বানাতে জানে না৷ তাদের বানাতে হতে হয় অত্যাধিক বুদ্ধিমান এবং শক্তিশালী। চন্দ্রগ্রহণে কর্যকরি এই ইনার পাথর চমৎকার ভাবে খুব কম কারিগর বানাতে জানেন। এবং সব কারিগর দ্বারাই জোসেফ লাখ লাখ ইনার পাথর বানিয়ে রেখেছে। কিন্তু সত্য বলতে আজ পর্যন্ত কেউ তার মনের মতো ইনার পাথর বানিয়ে দিতে সক্ষম হয়নি। তাই সে দেশ জুড়ে লোক লাগিয়ে রেখেছে। দেশের কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে, কোনো এক চমৎকার কারিগরের হদিস। এবং গত সপ্তাহে জোসেফ একজন নতুন কারিগরের নাম শুনে। যে রাইসাল শহরে থাকে। পশ্চিমান্তে। পাহাড়ের চুড়ায়। তার একটি ছোটো দোকান আছে। ফুলের দোকান। তবে সেখানে ফুল বিক্রি হয় না। হয় শক্তিশালী সব চমৎকার ইনার পাথরের। যা বানায় একজন নারী। চমৎকার বুদ্ধিমান এবং শক্তিশালী সেই নারীর নাম আম্রানা, আম্রানা রাফ। নামটা অনেকটাই মিলে যাচ্ছে, রাইসাল শহরের মিনিস্টার আম্রাহাভ রাফ-এর সঙ্গে। কৌতূহল বসত জোসেফ খোঁজখবর নিতে লোক পাঠায়। মাত্রই খোঁজ নিয়ে ফিরেছে জোসেফের বিশ্বস্ত বডিগার্ড নিদ্রেগ। মিনিস্টার আম্রাহাভ-এর পূর্ব-ইতিহাস সহ বায়োডাটা খোলামেলা বলতে শুরু করে। জোসেফ বিরক্ত হয়। নিদ্রেগের কথার মধ্যে বাঁধ সাধে, 

'আহ! এতো কেমিস্ট্রি শুনে কী করব? কারিগর আম্রানা কী হয় মিনিস্টার আম্রাহাভের?'
'বড়ো কন্যা। আজ চার বছর ধরে আলাদা থাকছেন ম্যাডাম আম্রানা। পিতার সাথে কোনোরকম সংযোগ রাখতে চাচ্ছেন না। পিতা আর কন্যার মধ্যে গুরুতর ঝগড়াঝাটি চলছে। সেটার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মিনিস্টার আম্রাহাভের বর্তমান স্ত্রী মানে আম্রানা ম্যাডামের সৎ মা। আর….'

জোসেফ হাত দুলিয়ে চুপ থাকার নির্দেশ দিয়ে বলে, 

'তার মানে দাঁড়াচ্ছে মিনিস্টার আম্রাহাভ আপাতত আমার কোনো কাজের না। ওনাকে আসতে নিষেধ করে দাও। দেখা যাবে তিনি আরও ঝামেলা তৈরি করলেন। আমি একটি পজিটিভ ইম্প্রেশন ক্রিয়েট করতে চাচ্ছি। ইম্প্রেশ হয়ে হয়তো মিস আম্রানা আমাকে চমৎকার ইনার পাথর তৈরি করে দিতে পারেন।'
'যুবরাজ। তিনি দিতে বাধ্য। এই দেশের ভবিষ্যত রাজার জন্য কে চাইবে না চমৎকার ইনার পাথর বানিয়ে দিতে?'

জোসেফ স্বর্নের ঘোড়ার গাড়িতে বসে। যেটি খুব ধীরেসুস্থে এগোচ্ছে। সোনালী কাঁচের জানালা খুলে দিতেই মিষ্টি বাতাস শরীর ছুঁয়ে দিল। বাহিরের দৃশ্য গুলো আটকে দিয়েছে, তার চারিপাশে থাকা সাদাকালো ঘোড়ায় চড়া বডিগার্ডরা। তাদের হুকুম করল সামনে যেতে। এবং আনন্দের সহিত উপভোগ করতে বসল চারিপাশ। রাস্তাঘাট সম্পুর্ন বন্ধ। যুবরাজ যেই রাস্তা দিয়ে যাবে, সেখানে জনগণ থাকতে পারবে না, এটাই নিয়ম। দূর দূরান্ত থেকে উঁকিঝুঁকি দেওয়া ছাড়া শহরবাসীর করার কিছুই নেই। 

____

পাহাড়ের চুড়ায় ওঠানামা যুবরাজের জন্য ঝুকিপূর্ণ। এ-ক্ষেত্রে করনীয় কী? বডিগার্ড নিদ্রেগ শক্তপোক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে। কাঠকাঠ গলায় জানায়, 

'যুবরাজ মাফ করুন। তবে আপনার ওখানে ওঠা সুরক্ষিত নয়। আমায় বিশ্বাস করে পাঠান। আমি তথ্যসূত্র এনে দিচ্ছি।'
'উফ নিদ্রেগ! বড্ড কথা বলো তুমি। আমি স্বচোক্ষে দেখতে চাচ্ছি। এতো সুন্দর ইনার পাথর যেই নারীর হাতে তৈরি হয়, তাকে দেখার তৃষ্ণা যে খুব গাঢ়তর। আমাকে তো যেতেই হবে। দেখি সরো।'

যুবরাজকে রুখে রাখা অসম্ভব! তাই নিদ্রেগ বডিগার্ড দিয়ে গোলাকৃত সীমানা তৈরি করল। যুবরাজ মধ্যে থাকবে। এবং সুরক্ষিত। এভাবেই তাকে ওঠানামা করতে হবে। বিশ মিনিট সময় ব্যয় করতে হলো, আঁকাবাঁকা পাহাড়ের চুড়ায় পৌঁছাতে। অত্যন্ত সুন্দর চুড়ার ওপরটা। একদম স্নিগ্ধ একটুকরো ফুলবাগান যেন! এমন কোনো ফুল নেই, যা এখানে নেই। চারিপাশে ফুল গাছে মাখোমাখো। ফুলের ঘ্রাণে আশপাশ ম-ম করছে। পরিপাটি সুন্দর এই দৃশ্যে চোখ বুলাতেই, শরীরের ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। মন-মস্তিষ্ক শীতল। জোসেফ বিড়বিড় করে, 

'মনোমুগ্ধকর।'

ফুলগাছে মোড়ানো দোকানটি নিবিড়ভাবে লেপ্টে এককোনায়। দোকান নয় আসলে! একটি ফুলে মোড়ানো বাড়িই বলা যায়! জোসেফ অনুমান করল, মিস আম্রানা চমৎকার ফুল প্রেমী মানুষ। তিনি অত্যন্ত ফুল পছন্দ করেন। পিঠে দু'হাত গুঁজে জোসেফ সময় নিয়ে চারিপাশ ঘুরেফিরে দেখল। তারপর এগোয় দোকানটির দিক। নিদ্রেগ ইতোমধ্যে শক্ত, গম্ভীর গলায় উচ্চস্বরে দাপুটে ভঙ্গিতে ডেকে ওঠে, 

'আছেন কেউ ভেতরে? চন্দ্রগ্রহণের যুবরাজ এসেছেন। সামনে এসে দেখা দিন ততক্ষণাৎ।'

ছুটে বেরিয়ে এলো বিশ-একুশ বছরের একজন যুবতী। স্কার্ট পরে সে। শ্যামলা গায়ের রঙ। চোখ জোড়া বড়সড় হয়ে আছে। স্ব-চোক্ষে দেশের যুবরাজকে দেখে একপ্রকার আহাম্মক বনে গিয়েছে যে, ভদ্রতা বজায় রাখতে ব্যর্থ। নিদ্রেগ তাড়া দেয়, 

'আপনি কি ম্যাডাম আম্রানা?'

যুবতী মাথা নাড়ায় তড়িঘড়ি করে। সাবধানতা সহিত জানায়,  

'জি না স্যার। আমি কেয়ারটেকার লুসি। ম্যাডাম আসছেন। যু..যবরাজ বসুন, প্লিজ।'

হাওয়ার গতিতে ছুটে গিয়ে একটি দারুণ ফুলে মোড়ানো চেয়ার এনে দিল লুসি। জোসেফ স্মিথ হেসে বসে। পায়ের ওপর পা তুলে। সামান্য চেয়ারও ফুলের। আম্রানা কি তাহলে ফুলের বিছানায় ঘুমোয়? গোসল করে বুঝি ফুলের পানি দিয়ে? আর শরীর ঢাকার জন্য কী সে ফুলে মোড়ানো কাপড়চোপড় পরিধান করে? এসব ভেবেই তার ঠোঁটের হাসি গাঢ় হয়। সে লুসির উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে, 

'কতদিন ধরে এখানে কাজ করছেন?'
'আজ্ঞে যুবরাজ, দশ বছর ধরে। ওইতো.. ম্যাডাম এসে পড়েছেন।'

জোসেফ সেদিকে বিচক্ষণ নজর ফেলে। এবং তারপর নিজের বিমুগ্ধ নজর সরাতে ভুলে যায়। একজন আবেদনময়ী যুবতী নারী তার সামনে। চমৎকার ভঙ্গিতে হেঁটে আসছে। ধবধবে ফর্সা উজ্জ্বল মুখশ্রী। হরিণী চোখ, সরু নাক, গোলাপি ভরাট ঠোঁট। সৃষ্টিকর্তা যেন নিজ হাতে তৈরি করেছেন তাকে। এবং তার চুল… চন্দ্রগ্রহণে নারীদের চুল বড়ো করায় কোনো সৌন্দর্য নেই বলে মনে করা হয়। তবে সামনের এই নারীর চুল অসম্ভব বড়ো। এবং এটাই লোভনীয় লাগছে দেখতে। কোমর ছাড়িয়ে গিয়েছে চুলগুলো। হাঁটার তালে তালে তা দুলছে। এতো চমৎকার! জোসেফের ইচ্ছে করছিল ওই চুল ধরতে। ওগুলো কি সত্য চুল? জোসেফ দৃষ্টি ঘুরিয়ে ফেলে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে পুনরায় আম্রানার পানে তাকায়। এক দৃশ্যমান পোশাক পরে আছে আম্রানা। ধবধবে লালচে ফর্সা কোমর ঠিক জোসেফের চোখের সামনে। সেখানে ছোটো ফুলের চিকন মালা। পুনরায় চোখ সরিয়ে নেয় জোসেফ। নারীজাতি যে এতো মুগ্ধময়ী সে আগে খেয়াল করেনি। নাকি তাদের মুগ্ধ তার চোখে মনে হয়নি? 

আম্রানা বিনয়ী হাসে। স্বাগতম জানায়। চমৎকার ভঙ্গিতে কথা বলে, 
'যুবরাজ কী ধরনের ইনার পাথর চাচ্ছে?'
'আমার সাথে যেমন ইনার পাথর যায়, ঠিক তেমন।'
'এমন ইনার পাথর বানানো কঠিন বটে। যুবরাজের শক্তির তুলনামূলক ইনার পাথর বানানো সহজ কথা নয়। তবে আমি চেষ্টা করতে পারি। আমাকে সপ্তাহ খানেক সময় দিতে হবে।'
'অবশ্যই। আপনার যত সময় ইচ্ছে নিন।'

 আম্রানা দু আঙুলে চুটকি বাজাতেই হাতের তালুতে একটি নীল রঙের আকর্ষণীয় আলোকিত চিকচিকে পাথর উপস্থিত হয়। দূর হতেই তা জ্বলজ্বল করছে। উপলব্ধি করা যাচ্ছে অসাধারণ শক্তির। জোসেফ দাঁড়িয়ে পড়ে। চোখে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে এগিয়ে যায়। আম্রানার হাতের তালু থেকে পাথরটি নেয়। আম্রানা বলে, 

'এই পাথরটি গতবছরের তৈরি। সবথেকে ব্যয়বহুল পরিশ্রম করতে হয়েছে এটার পেছনে।'

বলতে বলতে উদাস হয়ে পড়ে আম্রানা। মুখ জুড়ে হতাশা, অলসতা। বিষয়গুলো চোখে এড়ায় না জোসেফের। সামনের এই নারীকে প্রথম দেখাতেই তার মনে হয়েছে অলসদের রানী। একটু হেঁটেই থেমে যাচ্ছে যেন কোনো এক চেয়ারে পাকাপোক্ত ভাবে বসতে পারলে বাঁচে। আর জোসেফ এখান থেকে গেলেই সে শান্তি পাবে। জোসেফ পাথরটি নিজের হাতের তালুতে নিয়ে চোখ বুঁজে। মুহুর্তেই নিজের ভেতরে মিলিয়ে যায় ইনার পাথরটি যেন তার জন্যই এই পাথর তৈরি। জোসেফ মুগ্ধ গলায় বলে,  

'আমার পছন্দ হয়েছে। আমি এটা নিয়ে নিচ্ছি। এবং আপনার হাতের তৈরি বিশেষ পাথরটির অপেক্ষা করছি। এখন বলে বাধিত করুন, কি মূল্য চাচ্ছেন এই পাথরের বিনিময়ে?' 

হাসে আম্রানা। সাদা চকচকে দাঁত দেখিয়ে বলে, 

'এই পাহাড়ের চুড়াটা। আমি আমার নামে চাচ্ছি, আদোও কী তা সম্ভব?'
'চূড়া আপনার নয়?'
'উহু। এই দেশের রাজা এবং মিনিস্টারের আমানত। আমি ভাড়া দিয়ে থাকি প্রত্যেক বছর।'
'আজ থেকে এই পাহাড়ের চুড়াটি আপনার। আমি কাগজপত্র পাঠিয়ে দিব।'
'ধন্যবাদ, যুবরাজ।'

সঙ্গে সঙ্গে জোসেফ ঘুরে তাকায় নিদ্রেগের পানে। চোখের ইশারায় বোঝায়, কাজটা এখনই হওয়া চাই। বোঝার ন্যায় নিদ্রেগ বলে, 

'জি। ব্যবস্থা করা হবে৷'

জোসেফ ঘাড় ফিরিয়ে আম্রানার দিক তাকায়। মুগ্ধ গলায় বলে, 

'খুব চমৎকার সাজিয়েছেন জায়গাটিকে। স্নিগ্ধ এবং শান্ত। আশপাশটা দেখতে চাচ্ছি। যদি সঙ্গ দেন, ভালো লাগবে!'
'অবশ্যই কেন না! এ-তো আমার সৌভাগ্য।'

জোসেফ বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করল, আম্রানার চোখ জুড়ে একদল অনিচ্ছা। মুখে মধু অন্তরে তার বিষ। ব্যাপারটা অন্যভাবে বললে দাঁড়াচ্ছে, অন্তরে অলসতা চোখমুখে হাসি। বেশ মজাই লাগছে জোসেফের। সে ইচ্ছে করে থেকে গেল। 

দক্ষিণ দিকে নদী গিয়েছে পাহাড় ঘেঁষে। সেখানে সাড়ি বেঁধে ফুলের টব। পরিষ্কার পানির তলদেশে কালারফুল রঙের সাধারণ সব পাথর। চকচক করছে। সেদিকে বিচক্ষণ নজর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জোসেফ প্রশ্ন করে, 

'খুব ফুল পছন্দ করেন?'
'খুব ভালোবাসি।'
'কোন ফুল সবথেকে বেশি ভালোবাসেন?'
'ব্ল্যাকরোজ।'
'এই পর্যন্ত আশেপাশে কিন্তু একটিও ব্ল্যাকরোজ দেখিনি আমি।'

আম্রানা সামনে এগোয়। টবে পানি দিতে দিতে বলে, 

'ওই ফুলগুলো সীমিত পাওয়া সম্ভব। তাই শুধু ভেতরে রাখা হয়। চারিপাশে রাখার মতো অহরহ তো নেই। ব্ল্যাকরোজ সচরাচর পাওয়া মুশকিল। যা সংগ্রহে আছে সবই আমার বারান্দা জুড়ে।'

জোসেফের ইচ্ছে করল আম্রানার বেডরুম সহ বারান্দা খানা নিজ চোখে দেখার। তবে তা মোটেও সঠিক ইচ্ছে নয়। পূর্নতা পাবে বলে মনেও হয় না। 

যুবরাজ যেতেই, আম্রানা অলস ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে পড়ে। যেন রাজ্যের কাজ করে সবে বসেছে। মাথা নিচে ফেলে আসমানে তাকিয়ে হায়-হুতাশ করে ওঠে, 

'খুবই যন্ত্রণাদায়ক। মাথাটা ধরে গেল। রাজা-যুবরাজাদের সাথে দেখাসাক্ষাৎ খুবই কষ্টদায়ক। গুনে গুনে ত্রিশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। মাথা নত করা ত আছেই। মাথাটা মনে হয় খুলে পড়ে যাবে লুসি। পা জোড়াও ব্যথায় টনটন করছে৷ লাস্ট কবে আমি এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম মনে নেই। রাজ বাড়ির প্রজারা কীভাবে এমন হয়ে থাকে? ত্রিশ মিনিটে দম বন্ধ হয়ে আসছিল আমার। এতো সিকিউরিটি, এতো মানুষজন বাপ্রে! আমার….'

লুসি ভয়ার্ত দৃষ্টি পেছনে রেখে আম্রানাকে থামিয়ে বলে, 

'ম্যাডাম! আপনি বরং চুপ থাকুন।'
'তা থাকা যায়। তবে কেন? তুমি কী কষ্ট পেলে নাকি? তুমি তো আবার যুবরাজকে খুব পছন্দ করো।'

লুসির মুখটা লাল হয়ে উঠল। লজ্জায় হতভম্ব সে চোখমুখ ঢেকে ফেলে। জোসেফ বোকার মতো দাঁড়িয়ে। সে পুনরায় ফিরে এসেছে একটি গাছ নিতে। আম্রানার কথাবার্তা শুনে থেমে যেতে হলো। সে চাচ্ছে না আম্রানাকে লজ্জায় ফেলতে। লুসিকে চুপ থাকার ইশারা করে, দ্রুত চলে আসে।

______

দুদিনের মাথায় একটি ঘোড়ার গাড়ি এসে থামে পাহাড়ের চুড়ায়। গাড়িটা ঢুকেছে গুপ্ত্ রাস্তা ধরে। আম্রানা শুয়ে ফল খাচ্ছিল। হঠাৎ ডাক পড়ায় বিরক্ত হয় চরম। বাধ্যতামূলক বিছানা ছেড়ে বেরোয়। এবং অবাক না হয়ে পারে না। ব্ল্যাকরোজ ভর্তি একটা ঘোড়ার গাড়ি। এসব রাজকীয় ঘোড়ার গাড়ি রাজ বাড়ির। গোলাপ গুলো নামাচ্ছে বারোজন লোক। তাদের পোষাকের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে তারা রাজবাড়ী থেকে। একজন চশমা পরিহিত ভদ্রলোক এগিয়ে আসে। নিজের পরিচয় দেয়। এবং জানায় এগুলো পাঠিয়েছে যুবরাজ জোসেফ নিজে। আম্রানা হেসে মাথা দোলায়। যুবরাজকে তার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাতে বলে। এবং দাঁড়িয়ে থাকে যতক্ষণ না রাজবাড়ির মানুষ প্রস্থান করে। তারা যেতেই সে ব্যস্তপায়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে। বারান্দায় গিয়ে পা তুলে বসে৷ লুসি দ্রুত পায়ে এসে হাজির হয়। ভারী লাজুক এবং উৎসুক গলায় বলে, 

'যুবরাজ মনে হয় আপনায় পছন্দ করেছেন ম্যাডাম!'

আম্রানা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে একটি আঙুর মুখে নেয়। চিবুতে চিবুতে বলে, 

'লুসি। কে সে জানো নিশ্চয়ই? রাজ্যের যুবরাজ। আগাম রাজা। এতো নারী রেখে সে আমায় পছন্দ করবে? অদ্ভুত! আমি তাকে যেই ইনার পাথর দিয়েছি, তা খুব দামী। সেক্ষেত্রেই হয়তো এতটা করছেন! সে যাইহোক…আমার হয়ে তার চিঠির জবাব দিয়ে দাও না প্লিজ!'
'আপনি ত চিঠিটা পড়েননি!'
' দেখি পড়ে শোনাও তো।'

অস্থির ভঙ্গিতে মাথা দুপাশে দোলায় লুসি। তার জীবনে সে এমন ধাঁচের অলস মানুষ চোখে দেখেনি। কে বলবে এই অলস মানুষটা আবার হুট করে রাতের পর রাত টানা জেগে পাথর বানায়? নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে, একেক আকর্ষণীয় ইনার পাথর তৈরি করে? এরজন্যই হয়তো বাকি সময়টা এখান থেকে এখানে যেতে চায় না৷ লুসি রাজকীয় চিঠি বাক্সটা খুলে, ধীরেসুস্থে। ধরতেও হাত কাঁপছে তার। খুব সুন্দর ইংরেজি অক্ষরে লেখা কিছু বাক্য। লুসি পড়তে শুরু করে, 

'ফুলের থেকেও অধিক সুন্দর আপনি। সেই সুন্দর মানুষের জন্য আমার পক্ষ থেকে সামান্য উপহার। উপহার গ্রহণ করে ধন্য করুন।
 ~ জোসেফ তুর্কিশ '

বাক্যগুলো পড়ে লুসি কুমারী মেয়েদের মতো মুখ চেপে ধরে। গাল দুটো লাল। যেমন চিঠিটা তার জন্য এসেছে। অথচ আম্রানা হাঈ তুলল। তার টানা কদিন ব্যস্ত থাকতে হবে। ভাবতেই মাথা ধরছে। সে লুসিকে দেখেও দেখল না যেন। মরার মতো পড়ে থেকে বলল,

'কোমর ব্যথা করছে লুসি। একটু টিপে দাও। আর হ্যাঁ, খুব সুন্দর একটা চিঠি লিখে ব্যাক করতে হবে। যুবরাজ বলে কথা! প্রশংসা না করলে হয়? পৃথিবীর যত প্রশংসা আছে করতে হবে। সেক্ষেত্রে তুমি পার্সিকে ডেকে পাঠাও। ও চিঠি লিখায় ওস্তাদ।'

লুসি অসন্তুষ্ট হয়। চোখ পাকিয়ে তাকায়। তার ম্যাডাম একজন সাংঘাতিক অলস নারী সাথে রসকষহীন মানুষ। আরে এটা কী যে সে? রাজ্যের যুবরাজ। যার জন্য সব নারী পাগল। সে সেধে চিঠি দিয়েছে। তা পেয়ে রাতের ঘুম হারাম হবার কথা তা না! লুসি চায় আম্রানা এক পাজি জীবনসঙ্গী পাক। যে তাকে দিনরাত জ্বালাতন করবে। তখন সে দেখবে এতো অলসতা কই থাকে আম্রানার। 

______

সামনে জোসেফের জন্মদিন। এই দিনটি উদযাপন করা হয় খুব বড়ো করে, রাজ্যজুড়ে। প্রাসাদ মাস ধরে সাজানো হয়। সবথেকে দামী এবং বড়ো কেক বানানোর প্রস্তুতি চলে। মাস জুড়ে সব রাজপথের লোকজনের কাছে ইনভাইটেশন কার্ড পৌঁছায়। এবার আশ্চর্যজনক ভাবে, ইনভাইটেশন কার্ড আলাদাভাবে গিয়েছে আম্রানার কাছে। সচরাচর মিনিস্টার আম্রাহাভের নামেই কার্ড যায়। এবং সে উপস্থিত হয় তার স্ত্রী, বড়ো ছেলে এবং ছোটো মেয়ের সঙ্গে। যেহেতু আম্রানা আসতে মোটেও ইচ্ছুক নয়। 

জন্মদিনের আগেরদিন রাতেই ইনভাইটেশন পাওয়া ব্যাক্তিদের বাড়ির সামনে গিয়ে পৌঁছায় রাজকীয় ঘোড়ার গাড়ি। ঘোড়ার গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আম্রানা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে। এক শহর হতে আরেক শহর ভ্রমণ করতে হবে ভাবতেই তার বিরক্তির শেষ নেই। আবার সেখানে গিয়ে মাথা নত করে রাখা, কম কথা বলা, সাবধানে চলা, ভালোমন্দ দেখে রাখা, এসব ফরমালিটিস পূরণ করতে হবে। আর তা তার মতো অলস মানুষের জন্য কষ্টকর। কিন্তু তবুও তাকে যেতে হবে, সে বাধ্য। এই ইনভাইটেশন কার্ড তাকে বাধ্য করছে। রাজবাড়ীর নিমন্ত্রণ অবমাননা করা তার মতো সাধারণ মানুষের জন্য বিপদজনক। সেধে গর্দান কে*টে ফেলার নিমন্ত্রণ দেওয়া, অন্য ভাষায়। অগ্যত তাকে নিজ শহর ছেড়ে ভ্রমণে বেরোতেই হবে। 

!!২!!

আম্রানার শরীরে শোভা পাচ্ছে জাঁকজমকপূর্ণ গাউন। শুভ্র রঙের গাউন জমিন ঘেঁষে ছুটেছে। লম্বা বাহারী চুলের ওপর ফুলের ক্রাউন গুঁজে রাখা। হেলেদুলে চললে গাউনের চারিপাশ উড়েফিড়ে বেড়ায় সর্বত্র। সে আপাতত বড়ো আয়নাটির সামনে দাঁড়িয়ে। নিজেকে অলস ভঙ্গিতে দেখে নিচ্ছে। লুসির হাতে উঁচু হিলের জুতো জোড়া। সে জুতো জোড়া আম্রানার পায়ের সামনে রেখে বলল, 
'ম্যাডাম! পরে নিন।'
'হু….' বেশ আনমনেই জবাব দেয় আম্রানা। মস্তিষ্ক যেন অন্যকোথাও। 

লুসি আড়চোখে পিটপিট করে তাকিয়ে শুধায়, 
'কিছু ভাবছেন?'
'ভাবছি, এ-ই মুহুর্তে একটা জাদু হোক, আর আমার যাওয়াটা বন্ধ হোক।'

লুসি কৈ মাছের মতো ফুলে উঠল, 
'আহ ম্যাডাম! আপনার মধ্যে কোনো রসকষ নেই। জানেন রম্না, টৈসি, অ্যালিনা এরা কতটা অবাক হয়েছে? আমার সামনে কীভাবে কেঁদে উঠল দেখেননি তো! বারবার করে বলছিল, কোনোভাবে তাদের নেওয়া যায় কি-না! প্যালেস দেখার খুব সখ ওদের! আর ওরা তো যুবরাজের বড়ো ভক্ত। তাকে টেলিভিশন ছাড়া দেখেনি অবদি। আপনাকে হিংসে করছিল। আর আপনি কি-না..কেমন যেন! ওরা যদি জানে আপনাকে যুবরাজ নিজ হাতে চিঠি লিখে পাঠিয়েছে, তাহলে তো মরেই যাবে।'

আম্রানা বড্ড বিভ্রান্তিতে পড়ল যেন! টানা চোখ জোড়া নাড়িয়ে তাকায় লুসির পানে। ভারী অদ্ভুত গলায় প্রশ্ন করে, 
'তোমার কী সত্যি মনে হচ্ছে যুবরাজ আমায় পছন্দ করন?'
'হ্যাঁ। একশোভাগ নিশ্চিত।'
'কেন? কেন এতো নিশ্চয়তা? আমার যেসব ক্রেতা আছেন, তারা সবাই আমাকে নিমন্ত্রণ করেন। উপহার পাঠান। তাহলে?'
'আর সকলে আর যুবরাজ এক হলেন বুঝি? আপনি কিচ্ছু বুঝেন না।'

লুসি মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে রইল। আম্রানা তখন ভাবনায় বিভোর। যুবরাজ তাকে পছন্দ করবে কেন? সে তো কোনো কারণ দেখছেনা। আদোও কী তা সম্ভব? লুসি মুভি দেখে-দেখে মাথাটা খুইয়েছে নিশ্চয়ই। 

লুসি ফুলের চিরুনি এনেছে। সেটি দিয়ে আম্রানার সোনালী রঙের চুলগুলো আঁচড়ে দিতে শুরু করল। একগাল হেসে বলল, 
'ম্যাডাম মনে হচ্ছে আপনি এক দেশের সুন্দরী রাজকন্যা। হুরপরী বললেও কম হবে।'
'অপ্রোয়জনীয় প্রশংসা শুনিয়ে, তুমি আমার মন অনেকাংশে ভালো করে দিলে।'
'আমি কিন্তু মোটেও আপনার মন ভালো করার জন্য বলিনি। মন যা বলছে, মুখে তাই বলে ফেললাম।'
'আচ্ছা। আমি তোমায় বিশ্বাস করলাম। আর তোমাকে ও অসম্ভব দারুণ লাগছে।'

লুসি লাজুক ভঙ্গিতে ধন্যবাদ জানায়। পরপর তাড়াহুড়ায় নিজেদের জিনিসপত্র গোছগাছ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এইতো এক্ষুনি বেরোতে হবে তাদের। নিচে তাদের জন্য ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। রাজবাড়ীর মানুষদের অপেক্ষায় রাখা, মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। 

আম্রানা তখন বড়ো কাচের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে। আকাশে তারাদের মেলা। তারাদের মধ্যে অর্ধখন্ডিত চাঁদের অবস্থান। এই সুন্দর আসমানের দৃশ্য দেখতে বসলে, আম্রানার মন ভালো হয়। বেঁচে থাকার সখ জাগে, পৃথিবী দেখার ইচ্ছে জাগে। 

ওদিকে অদূরে দাঁড়ানো লুসি হঠাৎ থমকে পড়ে। চোখ যায় অদূরে দাঁড়ানো আম্রানার পানে। কাজ বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তার সামনের দৃশ্যটি চোখ ধাধানো। এক অপরুপ চিত্র এই যেন! গাউন, ক্রাউন পরিহিত অসম্ভব সুন্দর আম্রানা… সঙ্গে এই অপরুপ সুন্দর চাঁদের আকাশ, সবমিলিয়ে রূপকথার দৃশ্য। লুসি চটপট ক্যামেরা খুঁজে বের করে আনে। কয়েকটি ছবি সে গোপনে তুলে। ছবিগুলো খুব সুন্দর এসেছে। লুসি ভেবে ফেলল ছবিগুলো বের করে, ফ্রেম করাবে। বড়ো করে টাঙাবে আম্রানার বেডরুমে। 

____

সাদা রাজকীয় ঘোড়ার পাশে দাঁড়িয়ে আছে হেনরি ফোর্ড। মধ্যবয়সী হেনরি যুবরাজ জোসেফের একান্তগত ঘোড়া চালক। ব্যাক্তিগত ভাবে যুবরাজের নির্দেশ অনুযায়ী আসা তার। চল্লিশের কোঠায় বয়স ঠেকেছে এবার। মনের দিক থেকে এখনো কুড়িতে বয়স আটকে।
হেনরি ভীষণ কৌতূহলে আছেন আপাতত। তাদের যুবরাজ আলাদাভাবে তাকে একজনকে সহিসালামত রাজবাড়ি আনার নির্দেশ দিয়েছেন থেকেই, তার মারাত্মক কৌতুহল। কে সে যাকে যুবরাজ এতো আপ্যায়নের সহিত আনতে চাচ্ছেন? ভাবুক তিনি মুখ জুড়ে লম্বা লম্বা দাড়িগোঁফ গুলো ডান হাতে হাতড়ে নিলেন। শব্দ কানে আসতেই, সৈনিকের ন্যায় টানটান ভঙ্গিতে সোজা হয়ে দাঁড়ান। দেখতে পান আম্রানাকে। যুবরাজ বুঝি এই নারীকেই সহিসালামত আনার নির্দেশ দিয়েছেন? আড়চোখে হেনরি পলক ফেলে কয়েকবার দেখে নেন। দূর হতে মনে হচ্ছে দুটো আসমানের চাঁদ হেঁটে আসছে। 

গাড়ির ভেতরে চড়ে আম্রানা ভীষণ চমকাল সঙ্গে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। লুসির কথা গুলো কানে বাজতে শুরু করল পুনরায়। যুবরাজ কী আসলেই তাকে পছন্দ করে? নাহলে এতকিছু করার মানে কী? ভেতরটা রেশমের তুলতুলে বিছানা পাতা। চারিপাশে ফুলের সমাহার। একটি সাদা ছোটো টেবিল। যেখানে সাদা কাচের টি-ফ্ল্যাক্স এবং টি-কাপ। এতো আয়োজন আম্রানার ঠিকঠাক হজম হলো না। অন্যদিকে লুসি মিটিমিটি হাসছে। তার হাসির রহস্য আম্রানা বুঝতে পারছে কিন্তু এবার আর অস্বীকার করল না। তার ও মন এবার খচখচ করছে।
 
লুসি মিহি গলা বলে, 'চা দেই?'
'খেতে ইচ্ছে করছে না।'
'বিশ্রাম নিন?'
'শুতে ইচ্ছে করছে না।'
'তাহলে?'

আম্রানার এখন আর কিছুই ভালো লাগছে না। বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছে। এতো দ্রুত বেগে হৃদয় ছুটছে কেন? 

______

চন্দ্রগ্রহণের রাজধানী শহর হলো চাঁদপুর। চাঁদপুর নাম হবার ছোটো একটি কারণ অবশ্য রয়েছে। এই শহর থেকে চাঁদ ভীষণ কাছে। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে যেন। আসমানে চাঁদের দেখা মিললে, চাঁদপুর কখনোই আঁধারে লাগে না। চাঁদের ঝলকে সব ঝলমলে হয়ে রয়। আম্রানা শহরটি জানালা দিয়ে দেখছিল। সবকিছু ব্যস্ত এবং স্বচ্ছল। জনসংখ্যা বেশি সাথে হৈচৈ, হৈ-হুল্লোড়। সাথে সম্পূর্ণ চাঁদপুর আজ উজ্জ্বল এবং নিজ রঙে সেজেছে। যুবরাজের জন্মদিন বলে কথা। অদূর হতেই আম্রানা রাজবাড়ি দেখতে পাচ্ছে। টেলিভিশনে শতবার দেখলে স্বচক্ষে সামনাসামনি এই প্রথম। রাজবাড়ির যাবার রাস্তা হলো নীলত্ব পানির নদী। তারমানে দাঁড়াচ্ছে ওই ছোটো নদী পেরিয়ে যেতে হবে রাজার একান্তগত রাজ্যে৷ যেই নদীতে ছোটো ছোটো রাজকীয় পংখীরাজ নৌকায় ভর্তি। রাজবাড়ির লোকদের ব্যাপার আলাদা। তারা নৌকা চড়ে যায় না। তারা গুপ্ত রাস্তা দিয়ে যায়, যেটি নদীর ভেতরে করা। চারিপাশে এতো এতো সৈন্য! সৈনিক গুলো শক্তপোক্ত ভাবে পাহারাদার হয়ে দাঁড়িয়ে।

 ঘোড়ার গাড়িটা থেমেছে অদূরে। হেনরি এসে নিজে দরজা খুলে দেয়। হাত বাড়ায় আম্রানার দিক। আম্রানা হাতে হাত রেখে নেমে আসে। স্নিগ্ধ বাতাস বইছে। নদীটি কাছ হতে দেখতে আরও দারুণ। সূর্যের স্পর্শে জ্বলজ্বল করছে। পানি গুলো হাতে নেওয়ার লোভ জন্মেছে তার। নৌকায় চড়ে যাবার পথে লোভী সে দু'হাতে পানিগুলো হাতে ছুঁয়ে ও নিয়েছিল। 

লুসি কখন থেকে একনাগাড়ে কথা বলে চলেছে। ফিসফিসিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করছে। ও খুবই উত্তেজিত… বড্ড বিচলিত। পারছে না দৌড়ে রাজবাড়ী ঢুকতে। নৌকা থেকে নামাতে সৈন্য এগিয়ে এলো। সাহায্য করল তাদের। আম্রানা চোখ ঘুড়িয়ে দেখছে আশপাশ। কালো পোষাক পরহিত একজন ভদ্রলোক এলেন তাদের কাছে। নাম নেদ্রিক৷ তিনি রাজবাড়ির কেয়ারটেকার। হাতের ইশারায় ভেতরে নিমন্ত্রণ করলেন। আম্রানা এগিয়ে যাচ্ছে ভদ্রলোকের সঙ্গে। বিরাট বড়ো দরজা খুলে গেল। তারা ঢুকছে ধীর পায়ে আগ্রহী দৃষ্টিতে। অনেক কর্মী, অনেক সৈন্য। জাঁকজমকপূর্ণ চারিপাশ। এখনো বেশ কাজ চলছে গোছানোর৷ এই প্রাসাদ সপ্তাহ খানেক নিয়ে ঘুরেফিরে দেখলেও হয়তো দেখা শেষ হবে না। অতিথিদের আগমন ঘটবে সন্ধ্যায়। তারা অতি দ্রুতই চলে এলো বুঝি! সবে দুপুর বারোটা! ভদ্রলোক তাদের পাহাড় সমানের মতো সিঁড়ি গুলো বাইয়ে ওপরের দিকটায় নিয়ে যাচ্ছেন। মাথা নত করে রাখা আম্রানার হৃদয়ে পাথর চাপা পড়ল যেন। পা জোড়া খুলে পড়ে যাবে নিশ্চিত। ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে পড়ল কিছু সময়ের মধ্যে। তাদের একটি সুন্দর কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো। কক্ষের দরজা খুলে দিয়ে ভদ্রলোক, একটা ছোটো বাক্স বের করলেন পকেট থেকে। সেটি দু'হাতে এগিয়ে ধরলেন। আম্রানা নিতেই তিনি বললেন, 'বিশ্রাম নিন ম্যাম।'
এবং পরপরই জায়গা ত্যাগ করলেন। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বাক্স খুলল আম্রানা। একটি কাগজ। সেটি খুলে চোখের সামনে ধরল, 'ভীষণ ভাবে দুঃখিত আপনায় নিজে আপ্যায়ন করতে পারিনি। শীগ্রই ফিরব।'
~ জোসেফ 

বাক্সটা লুসির হাতে ধরিয়ে আম্রানা বিছানায় শুয়ে পড়ল। আর দাঁড়াতে সক্ষম হলো না ক্লান্ত পা জোড়া! নরম বিছানায় শরীর লাগতেই, চোখজোড়াও লেগে গেল। মিনিট লাগল না ঘুমিয়ে পড়তে। লুসি বিন্দুমাত্র চমকাল না। বরং এগিয়ে গিয়ে ঘুমন্ত আম্রানার শরীরে মাখমের তুলতুলে কম্বল মেলে দিল। সাদা পর্দা গুলো লাগিয়ে দিল। কক্ষটি আঁধারে করে দিতেই আম্রানার কপালের মধ্যে পড়ে থাকা ভাজ খানা মিলিয়ে গেল। লুসি বড়ো সোফাটায় নিজের ফোন নিয়ে বসল। আসার পথে যেসব ছবি তুলেছে সেগুলো সোশ্যালমিডিয়ায় আপলোড দিতে শুরু করল। 

______

দরজায় করাঘাতের শব্দ। দুটো সাধারণ টোকা মাত্র। এতেই ধড়ফড়িয়ে জাগ্রত হয় লুসি। তাড়াহুড়ায় নিজেকে ধাতস্থ করে নেয়। এগিয়ে যায় আম্রানাকে তুলতে। দুবার ডেকেও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। মরার মতো ঘুমিয়ে। তার ম্যাডাম বিশ্ব ডুবিয়ে ঘুমিয়ে থাকার দারুণ যোগ্যতা অর্জন করে রেখেছেন। অগ্যত নিজেই গিয়ে দরজা খুলে দেয়। জোসেফ দাঁড়িয়ে, রাজপুত্রর সাজে। চুল থেকে পায়ের জুতো পর্যন্ত চকচকে পারফেকশনিস্ট। লুসি নজর সরিয়ে তড়িঘড়ি গলায় সালাম ঠুকে। জোসেফ ভেতরে দৃষ্টি রাখে। বড়ো সাদা বিছানায় ঘুমন্ত আম্রানাকে খানিক দেখা যাচ্ছে। কাছাকাছি থেকে দেখতে পারলে বেশ শান্তি পেতো সে। তবে সেটি করা মোটেও শোভনীয় বিষয় হবে না। গলার স্বর নামিয়ে বলে, 

'আজ জার্নি করেছে অনেকটা পথ। নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত!'

লুসির বলতে ইচ্ছে করল, 'সে সারাজীবন, সারাদিন, চব্বিশঘন্টা ক্লান্ত থাকে কোনো কারণ ছাড়াই।'

তবে সেসব না বলে মুচকি হেসে মাথা দোলায়। জোসেফ বলে, 'খাওয়াদাওয়া করা প্রয়োজন। তাকে জাগিয়ে তুলুন। বলুন যুবরাজ তার সঙ্গে লাঞ্চ করতে চাচ্ছে। আমি অপেক্ষা করব।' 

লাগাতার মাথা দোলায় লুসি। যুবরাজ নিজের সৈন্য সেনা নিয়ে যেতেই দম ফেলে। দ্রুত পায়ে তুলতে ব্যস্ত হয় আম্রানাকে৷ কয়েকবার তাকে ডাকার ফজিলত দাঁড়ায় এক রামধমক, 'উফ! বিরক্ত করো না।'

লুসি করুণ গলায় পুনরায় ডাকে, 'আমি ডাকতে চাচ্ছি না, তবে বাধ্য৷ দ্রুত উঠুন ম্যাডাম। যুবরাজ নাহলে আমার গর্দান ফেলে দিবে।'

আম্রানা হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে। চারিপাশে তাকায়। মস্তিষ্ক সচল হয়। মনে পড়ে সে রাজবাড়ী। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে শুধায়, 'কটা বাজে?'
'তিনটা বিশ। যুবরাজ এসেছিলেন। আপনায় লাঞ্চের জন্য যেতে বলে গিয়েছেন।'
'যাওয়ার কি দরকার! পাঠিয়ে দিলেই তো হয়!'

মুখে এক বললেও আম্রানা উঠে দাঁড়ায়। ফ্রেশ হতে শুরু করে। যুবরাজকে তো আর অপেক্ষায় রাখা যাবে না। বেশ তাড়াহুড়োই করতে হয় তাকে। তৈরি হয়ে দুজন বেরোতেই দেখে, দরজার বাহিরে দাঁড়ানো রয়েছে প্রহরী। সেই মাথা নত করে এগোনোর ইশারা করে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এদিক-ওদিক দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ঘুম থেকে উঠে পেটে ক্ষুধা নিয়ে এতো নড়াচড়া করা আম্রানার মোটেও ভালো লাগল না। অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়া তার রাজবাড়ী এবং রাজবাড়িতে থাকাটা সুখকর লাগল না। সে আজকের জন্মদিনের অনুষ্ঠান শেষ করে রাতেই ফিরে যাবে। 

রাজকীয় খাবার ঘরে চারিপাশে প্রহরী দাঁড়িয়ে। মধ্যে বড়ো কাঁচের ডাইনিং। জোসেফ বসে সামনের রাজাদের চেয়ারে। পায়ের ওপর পা তুলে ডান হাত গালে চেপে বসে৷ আম্রানাকে দেখেই সে হাসে। হাতের ইশারায় বসতে ইশারা করে। আম্রানা বসে৷ সে বসতেই নিঃশব্দে টেবিলে গরম গরম হরেকরকমের খাবার পরিবেশন শুরু হলো। জোসেফ প্রশ্ন করল, 

'আসতে সমস্যা হয়নি তো?'
'জি না।'
'রাজবাড়ী কেমন লাগল?'

নিঃসন্দেহে রাজবাড়ী প্রশংসনীয়, 'রাজকীয়।'

হাসে জোসেফ। বলে,'লাঞ্চ সেড়ে নিন, আপনাকে কিছুটা ঘুরিয়ে দেখাই।'

আম্রানার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল যা জোসেফের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ধরা পড়ল। খাওয়া শেষ করে সৈন্যসেনা সহ জোসেফ আম্রানাকে নিয়ে বেরোলো। পাশেই লুসি হাঁটছে। আশপাশ দেখার উত্তেজনা তার মধ্যে অপরিসীম। সেই উত্তেজনা আম্রানার মধ্যে দেখলে জোসেফ হয়তো আনন্দই অনুভব করত! জোসেফ আড়চোখে তাকায় আম্রানার দিক। মেয়েটা কেন যে এখান থেকে ওখানে যেতে চায় না! ও যদি ঘুরাফেরা পছন্দ করত জোসেফ ওঁকে পুরো চন্দ্রগ্রহণ ঘোরাত! আফসোস!

_____

পৃথিবী আঁধার হতেই রাজকীয় রাজবাড়ীর আলোয় জ্বলজ্বল করে ওঠে। বিশেষ অতিথিদের আগমন ঘটে। ধীর গতিতে হলে টুন চলছে। তালে তালে অনেকে হেলেদুলে নাচছে। গিটারিস্টদের ব্যান্ড পাশেই উপস্থিত। পিয়ানো বাজানোর ব্যবস্থা রয়েছে। আম্রানা লুসিকে নিয়ে আলগোছে নেমে এসেছে। দুজন ড্রিংক হাতে এক কোণায় দাঁড়ানো। অদূরে নিজের বাবাকে দেখতে পায় সে। মিনিস্টার আম্রাহাভ ব্যস্ত অন্য অতিথিদের সঙ্গে আলাপে। এরমধ্যেই যুবরাজের আগমন হয় রাজা-রানীর সঙ্গে। জোসেফ লাল কোট পরে আছে কালো প্যান্টের সঙ্গে। ভীষণ আকর্ষণীয় লাগছে দেখতে। উপস্থিত কুমারীদের দৃষ্টি তার মানেই। আম্রানাও আড়চোখে বেশ কয়েকবার তাকাল। নিঃসন্দেহে তাদের যুবরাজ কুমারী মেয়েদের প্রিন্স চার্মিং। ভেবেই হাসে আনমনে। লুসি ফিসফিসিয়ে বলে, 

'যুবরাজকে ভালো লাগছে। আপনার সাথে দারুণ মানাবে।'
'কীসব বলছ!'
'কীসব নয়। এখন আমি একদম শিয়র আছি। যুবরাজ আপনায় পছন্দ করেন। সে আসা অবদি এদিকে গুনে গুনে চার বার তাকিয়েছে। সবার সাথে হাত মিলিয়ে দেখবেন এখানেই আসবে সে!'

হাসফাস করে আম্রানা। সত্যিই কি তাই? লুসির কথা সত্যি হলো কিছুক্ষণ পর। জোসেফ বড়ো বড়ো পা ফেলে এদিকে আসলো। আম্রানার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, 'আসুন আপনার সাথে মা-রানীর দেখা করাই।'

লুসি আলগোছে আম্রানাকে পেছন থেকে ঠেলে দিল। মনে মনে হাজার প্রশ্ন নিয়ে আম্রানা এগোল জোসেফের সঙ্গে। ব্যস, উপস্থিত সকলের দৃষ্টি এখন আম্রানার পানে। কে এই নারী যে জোসেফের পাশে দাঁড়িয়ে? এটাই সকলের মনের উক্তি। রানী অ্যালিজা বরং খুশিই হলেন আম্রানাকে দেখে। যেন সে আম্রানার সম্পর্কে শুনেছে এমন ভঙ্গিতে বলল, 'তুমি এসেছ? আমিতো তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছিলাম৷ তোমার বাবা এসেছেন তো?'

আম্রানা অপ্রস্তুত হলো। এরমধ্যে মিনিস্টার আম্রাহাভ ও রাজার ইশারায় এগিয়ে এলেন। মেয়ের পাশে দাঁড়ালেন। সে মাত্রই আম্রানাকে খেয়াল করেছেন। অবশ্য তিনি আগে থেকেই জানেন মেয়ে তার আসবে। এসময় আম্রানাকে এবং মিনিস্টার আম্রাহাভকে আশ্চর্যের সপ্তমে পাঠিয়ে রানী অ্যালিজা বলে উঠলেন, 'ভারী রূপবতী মেয়ে আপনার মিনিস্টার। পুত্র আমার এভাবে এভাবে তো আর পাগল হয়নি।'

শ্বাস গলায় আটকে রইল আম্রানার। মিনিস্টার আম্রাহাভের চোখ ও বড়ো বড়ো হয়ে আছে। মণি বেরিয়ে আসবে যেন৷ রাজা জাদ্যিদ ও হেসে বললেন, 'খুব শীগ্রই আমাদের তাহলে সম্পর্ক তৈরি হতে চলেছে। আমি অবশ্য আপনার সঙ্গে এই বিষয়ে পূর্বেই আলোচনা করতে চেয়েছিলাম। জোসেফ বলল আরও কিছু মাস যাক৷'

মিনিস্টার আম্রাহাভ বোঝার ন্যায় মাথা দোলালেও সে কিছুই বোঝেনি আসলে৷ তার বুঝতে ভীষণ সময় লাগল। তার মেয়ে ভবিষ্যত রাজার রানী হতে চলেছে, এই রাজ্যের রানী, যুবরাজের যুবরানী! আড়চোখে আম্রানার দিক তাকাল। আম্রানা নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে। বোঝাই যাচ্ছে সে বড়ধরনের শকে রয়েছে। 

বাবা-মেয়ে রাজবাড়ীর মানুষদের থেকে আলাদা হতেই, মিনিস্টার আম্রাহাভ মেয়েকে প্রশ্ন করেন, 

'তোমার সঙ্গে যুবরাজের… '

আম্রানা বাবার প্রশ্ন বুঝে নিয়েছে যেন। তাড়াহুড়ো গলায় পরিষ্কার ভাবে বলে, 'না। কিছুই নেই। কোনো সম্পর্ক নেই।'
'যুবরাজ তোমায় পছন্দ করেন। বিবাহ করতে চান। তোমার কী মতামত?'

মতামত? মানে কী! আম্রানার মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে গেল। এমন কিছুর জন্য একদমই প্রস্তুত ছিল না। অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে ইতোমধ্যে। হলের হরেকরকম বাতির রঙগুলো বদলে উঠছে ক্ষনে-ক্ষনে। গান বাজছে ধীর শব্দে। পুরুষ-নারীর জুটি মিলিয়ে ধীর গতির আধুনিক নাচে মঞ্চ মাতিয়ে আছে। যে যার পছন্দের মানুষের হাত চেয়ে এগিয়ে আসছে মঞ্চে। দুলে-দুলে নিজেদের মতো নেচে বেড়াচ্ছে। 

 জোসেফ হাতের ড্রিংকটা একটানে শেষ করে। অদূরে দাঁড়ানো আম্রানার দিক এগুতে শুরু করে। আড়চোখে না চাইতেও আম্রানা জোসেফকেই অনুসরণ করছিলো। বাবার উক্তির পর থেকে সে এক মোহে আছে যেন! জোসেফকে এদিকে আসতে দেখেই ঘাবড়ে গেল। পা-জোড়া অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে পিছুপা হতে শুরু করল। সেদিকে ধ্যান নেই জোসেফের। সে শক্তপোক্ত পুরুষালী শরীর নিয়ে আম্রানার সামনে এসে দাঁড়ায়। শরীরের ওপর অংশ ঝুকিয়ে, ডান হাত বাড়িয়ে দেয়। যার অর্থ সহজ! আপনার সাথে নাচতে পারি?

মোহে থাকা আম্রানা অপ্রস্তুত হাতটি বাড়িয়ে দেয়। আঁকড়ে ধরে জোসেফের হাত। মুহুর্তে নিজের বাহুতে তাকে টেনে নেয় জোসেফ। কোমরটি শক্তপোক্ত একটি হাতের আয়ত্তে চলে যায়। শরীরে শরীর স্পর্শ হয়। নিঃশ্বাসের আদানপ্রদান একত্রিত হয়ে উঠল। আম্রানার ডান-হাত জোসেফের হাতে, বা-হাত জোসেফের কাঁধে। জোসেফের তালে-তালে, তার পায়ের গতির সঙ্গে পা মিলিয়ে.. দুলে দুলে নাচতে শুরু করল। গানের সঙ্গে নাচের তালে দুজনের ঘনিষ্ঠতা প্রখর হলো। আম্রানা দমবন্ধ হয়ে আসছে। শরীর বয়ে উত্তেজনার সৃষ্টি হচ্ছে। নজর তুলে আশেপাশে বিশেষ করে জোসেফের পানে তাকানোর সাহস হচ্ছে না। হঠাৎ কানে নিশ্বাস ফেলার অনুভূতি পায়। চোখ বন্ধ করে রাখা আম্রানা জোসেফের গভীর গলার স্বর শুনতে পায়,  

'আম্রানা!'

আম্রানা ঝটপট চোখ মেলে তাকায়। দুজনের দৃষ্টি মিলতেই জোসেফ বলে, 

'শুধু আমার দিকে তাকাবেন। আমি ছাড়া এখন অন্য কোথাও তাকানো যাবে না। চোখ বোঝা যাবে না। এটি আমার আদেশ। যুবরাজের আদেশ। অমান্য করলে আপনার জন্য গুরুতর শাস্তি রয়েছে।'

চমকে ওঠে আম্রান। বড়সড় হয়ে ওঠে চোখ জোড়া। বাধ্য মেয়ের মতো তাকাতে হয় ওই নেশাতুর নয়ন জোড়ায়। বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করে উঠছে। সর্বঙ্গে বয়ে চলেছে শিহরণ। অবাধ্য হতে চায় তার চোখ। কিছুতেই চোখে চোখ রাখতে পারছে না। লজ্জা-সংকোচ একসঙ্গে ভীড় জমিয়েছে যেন! 

চলতে থাকা গানে একটি বাক্য ভেসে এসেছে, 'পছন্দ করি পছন্দের থেকে বেশি।' সে মুহুর্তে চোখে চোখ রাখা জোসেফ বলে ওঠে, 

'আপনাকে ভীষণ পছন্দ করি। সারাজীবনের জন্য নিজের করতে চাই, আমার বানাতে বিয়ে করতে চাই। উইল ইউ ম্যারি মি আম্রানা?'

______

আম্রানা জবাব দেয় না। বরং নাচের পরপর সে লুসিকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। এক্ষুনি চলে যাবে। আর কিছুক্ষণ থাকলে পাগল হয়ে যাবে নাহলে শ্বাসকষ্টে মরে যাবে। লুসি অবশ্য অনেকবার বুঝিয়েছে তাকে এখন যাওয়াটা ঠিক হবে না! কিন্তু কে শোনে কার কথা? রাজকীয় ঘোড়াটা রাজবাড়ী থেকে বেরোতেই আটকে রাখা শ্বাসটুকু ফেলে আম্রানা। উত্তেজিত লুসি আম্রানার হাত জোড়া জাপ্টে ধরে বলে, 

'আমি বলেছিলাম না ম্যাডাম যুবরাজ আপনায় পছন্দ করে? প্রথম দিনই বুঝেছি। আপনি তো আমার কথা বিশ্বাসই করলেন না। এখন বিশ্বাস হলো? আমিতো ভীষণ খুশি।'

আম্রানা চোখ বন্ধ করে আছে। জানালা খোলা জায়টুকুতে কনুই রেখে ভাবনায় বিভোর। এমন সময় তীব্র গতিতে ঘোড়াদের আসার শব্দ হতে লাগে। চিকন বাসির একটি শব্দ হয় পরপর। সেটি শুনে তাদের ঘোড়ার গাড়িটি দাঁড়িয়ে পড়ল। এই বাসির শব্দের মানে দাঁড়ায়.. থামো! আশেপাশের সব থামতে বাধ্য হবে, হয়। এই শব্দ শুধু রাজবাড়ীর সৈন্য করে থাকে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থায়। রাস্তার সবকিছু থমকে থাকার সুযোগ নিয়ে একগাদা ঘোড়া ছুটে এগিয়ে আসছে। আম্রানার শান্ত হওয়া হৃদয় পুনরায় দ্রুত বেগে ছুটতে শুরু করেছে। লুসি হুড তুলে দেখে বাইরেটা। আম্রানাকে দ্রুত গলায় জানায়, 

'ম্যাডাম যুবরাজ আসছেন।'

এবং কিছুক্ষণের মধ্যে ঘোড়ার গাড়িটি অনেকগুলো ঘোড়া দিয়ে আটকে ফেলা হয়। জোসেফ তার রাজকীয় ঘোড়া থেকে নেমে আসে। ইতোমধ্যে লুসি বেরিয়ে এসেছে। সালাম ঠুকেছে। জোসেফ মাথা দোলায়। ধীর গলায় বলে, 

'আমার কিছু কথা আছে আপনার ম্যাডামের সাথে। এখানে অপেক্ষা করুন।'

মাথা দোলায় লুসি। জোসেফ অনুমতি না নিয়ে উঠে পড়ে গাড়ির ভেতর। আম্রানা এক কোণায় জড়সড় হয়ে বসেছে। ঘাবড়ে আছে। বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়েছে। জোসেফ হেসে শুধালো, 

'জবাব না দিয়ে কেন এসেছেন? আমি যুবরাজ কখনো উত্তরের অপেক্ষা করিনি। আপনি প্রথম ব্যাক্তি যে আমাকে করিয়েছেন। বলে আসার প্রয়োজনবোধ ও করেননি!'
'আম..আমার শরীর খারাপ করছিল তাই…মাফ করবেন। ভুল হয়ে… '
'মাফ করছি না। বরং শাস্তি দিব। যেই শাস্তি আপনার শরীর আরও দ্বিগুণ খারাপ করবে।'

আম্রানা কথাগুলো বোঝার সময় পায়নি। মস্তিষ্ক সচল হবার পূর্বেই জোসেফের শক্ত হাতটা তার ঘাড়ের পেছনটা চেপে ধরে। একটানে নিজের মুখের সামনে নিয়ে আসে। পরপর শক্তভাবে ঠোঁটে ঠোঁট স্পর্শ হয়। শুধু স্পর্শ করে জোসেফ ছাড়ে না। গভীর এক চুমু আদানপ্রদান করে। ছোটো কামড় দিয়েই সরে আসে সে। ভেজা ঠোঁট দাঁত চেপে বলে, 

'আমার জন্য তৈরি হন আম্রানা। আপনাকে নিজের করে নিতে শীগ্রই আসব।'

জোসেফ যেভাবে এসেছে সেভাবেই চলে গেল। হতবিহ্বল আম্রানা সেভাবেই বসে। এমন একজন মানুষ সে যে কি-না এক থেকে দুজন মানুষ একরুমে দেখতে পারে না। বড়ো বাড়িঘর পছন্দ করে না। অতিরিক্ত নিয়ম কানুন পছন্দ করে না। সেই সে এমন একজনের নজরে এলো যে হাজার হাজার নিয়ম কানুনের মাঝে থাকে। শত বাড়ির ন্যায় বড়ো বিলাসবহুল প্যালেসে থাকে। শতশত সৈন্য, চাকরের আনাগোনা চলে যেখানে সেখানে তার ভাগ্য লেখা হলো? এই এতটুকু জীবনে একটুবেশি অলসতামি করেছিল বলেই বুঝি এমনটা হলো তার সঙ্গে? 
.
.
.
সমাপ্ত............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন