শাহবাজ আজ কলেজে গিয়েছে। শিক্ষক হিসেবে ক্লাস নেওয়ার অভিজ্ঞতা তার আছে। ঢাকার অলিগলিতে অনেক টিউশনি করিয়েছে সে। তবুও আজ কিছুটা নার্ভাস ছিলো। প্রিয়াঞ্জনা অবশ্য এমন এক কাজ করেছে যে শাহবাজ সব টেনশন ভুলেই গেছে। যাওয়ার সময় নিজ থেকে চুমু খেয়েছিলো শাহবাজের গালে। তারপর ঠেলে ঘর থেকে বের করে দরজা আটকে দিয়েছিল। তার শাহ্ অত্যধিক খুশি হয়েই বাড়ি ছেড়েছে আজ। শাহবাজ যখন আশেপাশে থাকে তখন প্রিয়াঞ্জনার সময় এত মধুর কাটে! এত স্নিগ্ধ লাগে প্রিয়াঞ্জনার! ছাদ থেকে পুকুর দেখা যাচ্ছে। পুকুরে নীলচে আকাশের প্রতিচ্ছবি। পেঁজা পেঁজা তুলোর মতো মেঘেরা আপন গতিতে ছুটে বেড়ায়। পানিতেও তাদের দুষ্টু চলন বুঝা যায়। প্রিয়াঞ্জনা তাই দেখছে দাঁড়িয়ে। দু'হাত রেলিং এ ভর করে মেঘেদের আনাগোনা দেখতে ভালোই লাগছে।
নাদিয়া আজ কলেজে যায়নি। কলেজ তার কাছে ভয়ংকর জায়গা। সেখানে গেলে তার অসুখ করে। বাবা আবার শিক্ষক সে কলেজের। ভদ্রতার মুখোশ পরে থাকতে হয় তার। যা অতি কঠিন কাজ। আজ ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছিলো। তাই মেঝোপা তাকে বকেছে। সে নাস্তা করেনি। মন খারাপ হলে সে ছাদে আসে। তার গোলাপ গাছগুলোর সাথে কথা বলে। তারপর রাগ কমে। নাদিয়ার রাগটাও বেশ অদ্ভুত। হঠাৎ করে এত রাগ উঠে! মন চায় সব ধ্বংস করে দিক। আবার রাগ যখন পড়ে যায় তখন আফসোস হয়। যাই হোক সে এখন বেশ বিস্মিত। বিস্মিত হওয়ার কারণ আছে। ছাদে রেলিং এ ভর করে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটির পরনে লালশাড়ি। চুল ছেড়ে রাখা। চুলগুলো কোমড় সমান। এই ভরদুপুরে এখানে মেয়ে আসলো কোথ থেকে! নাদিয়া ভয়ে দু'পা পিছিয়ে গেলো। পাশের বাড়ির জলি আন্টি বলেছিলেন তাদের বাড়ির ওয়ালের উপর নাকি লালশাড়ি পরে একটা মেয়ে হাঁটে। সে অবশ্য বহুদিন আগের কথা। তখন তারা এ বাসায় নতুন এসেছিলো। মা অবশ্য এই কথার সুন্দর একটি ব্যাখা দাঁড় করিয়েছেন। তার মায়ের মতে এই বাড়িটি জলিরা রাখতে চেয়েছিলো। বনিবনা হয়নি। শেষ পর্যন্ত বদরুজ্জামান সাহেব রেখেছেন। এজন্য জলি এসব কথা বলে বেড়ায়। এত বছরে তেমন কিছুই তারা দেখেনি। তবুও ভূতের ভয় নাদিয়ার রয়েই গেছে। আজ তো জলি আন্টির কথাই সত্যি মনে হচ্ছে। নাদিয়ার আবোল তাবোল ভাবনার মাঝেই প্রিয়াঞ্জনা পিছনে ফিরলো। খুব আদুরে দেখতে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নাদিয়ার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার দশা। ভরদুপুরে চুল ছেড়ে, লালশাড়ি পরনে এত সুন্দর মেয়ে ছাদে দাঁড়িয়ে আছে! এই মেয়ে নির্ঘাত ভূত। নাদিয়া চিৎকার করে উঠে, 'ভূত!, ভূত!'
ভ্যাবাচ্যাকা খায় প্রিয়াঞ্জনা। ভূত! কোথায় ভূত? নাদিয়া দুহাত উপরে তুলে ভূত ভূত গান গাইতে গাইতে সিঁড়ির দিকে দৌড় লাগালো। প্রিয়াঞ্জনাও ছুটলো তার পিছনে। নাদিয়া খেয়াল করলো ভূতটা তার পিছনে আসছে। 'ওরে আল্লাহ রে!' একি মুসিবত। নিচে নেমে সামনে পেলো মেঝোপা আর মাকে। মেঝোপাকে জড়িয়ে ধরলো নাদিয়া। প্রিয়াঞ্জনা এসে দাঁড়ালো পিছনে।
"কিরে কি হয়েছে তোর?"
মেঝোপার প্রশ্নে নাদিয়া বললো,
"ছাদে লালভূত।"
নাজমা কপাল চাপড়ে বললেন,
"ওরে গাঁধা, জলির কথা এখনও মাথায় ঢুকিয়ে রাখছিস। ও প্রিয়াঞ্জনা। শাহবাজের সাথে না তোর দেখা হইছে? শাহবাজের বউ।"
ভূত না হওয়ায় নাদিয়া ঠিক যতটা খুশি হয়েছিলো, তার থেকে কয়েক হাজার গুণ বেশি কষ্ট পেয়েছে শাহবাজের বউ এই কথাটা শুনে। প্রিয়াঞ্জনাসহ সবাই খিলখিল করে হাসছে। কেবল থমকে আছে নাদিয়া। কোনো কথা না বলেই চলে যায় নিজ ঘরে।
প্রিয়াঞ্জনার বেশ অনেকক্ষণ কথা হয় নাজমা এবং তার মেঝো মেয়ের সাথে। প্রিয়াঞ্জনাকে ঘরে নিয়ে পুলি পিঠাও খেতে দেন নাজমা। যদিও বেশিদিন হয়নি। তবুও হৃদয়ের কোথায় যেন হু হু করে উঠে। মায়ের কথা মনে পড়ে। অজান্তে চোখ ভিজে উঠে প্রিয়াঞ্জনার। কাজের বাহানা দিয়ে চলে আসে উপরে। তাদের 'চন্দ্রবিলাস' নামক ছোট নীড়ে। মন খারাপ করে আর কি হবে। বাবা তো বলেছিলেন হয়তো পরিবার নয়তো শাহবাজ। প্রিয়াঞ্জনা তার শাহ্কে বেছে নিয়েছে। প্রিয়াঞ্জনা ফোন লাগায় তার শাহ্কে। কথা বলে অনেকক্ষণ। মনের কালো মেঘ দূর হয়ে যায় নিমিষে। রান্না-বান্নার কাজে লেগে যায় সে। শাহবাজ বিকেলে ফিরবে।
ফাহিমের সাথে প্রাপ্তির বিয়ে ঠিক হয়েছে। আগামী শুক্রবার বিয়ে। তেমন আয়োজন হবেনা। বাড়িতেই ছোট পরিসরে অনুষ্ঠান হবে। প্রাপ্তি মুখ ফুটে একটা কথাও বলেনি। ঐদিন রাতে ফাহিমের মা প্রাপ্তিকে পছন্দ করে চেন পরিয়ে গিয়েছেন। এত দ্রুত ঘটছে সবকিছু। প্রীতি, প্রাপ্তি কিছু বুঝেই উঠতে পারছেনা। সুমনা চোখের সামনে এসব অনিয়ম দেখেও কিছু বলেনি। প্রতিবাদও করেনি। কোনো কিছুতেই তার কোনো আগ্রহ নেই। বাসায় নতুন করে কাজের বুয়া রাখা হয়েছে। অথচ সুমনা আসার পরে কাজের বুয়াকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন জোহরা। আজকাল তাকে কোনো কাজের কথা বলা হয় না। সেও ঘর থেকে বেশি একটা বাইরে বের হয়না৷ স্বর্ণাকে খুবই আহ্লাদ করেন জোহরা। আজ সকালে ধমকে দুধের গ্লাস হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন। সুমনার যখন বাচ্চা পেটে ছিলো তখন ভারী ভারী কাজ করাতেন তাকে দিয়ে। বাচ্চা পেটে নিয়েই সুমনা বালতি ভর্তি কাপড় ছাদে নিয়ে যেতো। ঘর মুছতো। তার বাচ্চা নষ্ট হওয়ার সমস্ত দোষ পড়েছিলো তার ঘাড়ে। আদোও কি সব দোষ তার? এই যে এখন সে মা হতে পারবেনা এর পিছনে কি জোহরার হাত নেই? অবশ্যই আছে। প্রেগ্ন্যাসির পুরো সময়টাই কেটেছে জোহরার মন জুগিয়ে। তাও মন পেলো না সুমনা। আর হয়তো পাবেও না৷ এখন অবশ্য সুমনা এসবের ধারও ধারে না।
বিকেলের দিকে বাড়ি ছাড়লো সুমনা। কখন বেরিয়েছে কেউ টের পায়নি। মেইন গেটের বাইরে রাস্তায় যখন দাঁড়ালো তখন বুকের ভিতর অসহনীয় ব্যথা শুরু হলো তার। শারীরিক ব্যথা নয় মনের ব্যথা। এই ব্যথার কোনো চিকিৎসা নেই। এত বছরের সংসার ফেলে অজানার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো সুমনা। পিছনে ফিরে সে তাকায়নি। কাঁদেনি। কেবল শূন্য লাগছিলো সবকিছু। যখন লাল বেনারসি পরে এ বাড়িতে প্রবেশ করেছিলো তখন কত স্বপ্ন ছিল চোখে। একটা সুন্দর সংসার। একটা পরিবার। সুমনা সকল পিছুটান ফেলে সামনে এগিয়ে যায়। প্রীতম নামের মানুষটা তার জন্য ম রে গেছে। সেই যে ভার্সিটিতে সাপের হাত থেকে রক্ষা করেছিলো সে ছেলেটা মা রা গেছে। সুমনা এই পৃথিবীতে একা। একদম একা।
.
.
.
চলবে.......................