"আমরা কোথায় যাচ্ছি শাহ্?"
শাহবাজ হেসে উত্তর দেয়,
"সুফিয়া ভাবি দাওয়াত করেছে তোমাকে। প্রথমে আমরা সেখানেই যাবো।"
"আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আজ যদি তারা না থাকতো আপনি কোথায় থাকতেন, শাহ্! কিছু কিছু মানুষের সাথে র'ক্তের সম্পর্ক থাকেনা তবে আত্মিক টান থাকে। রিমন ভাই আর সুফিয়া ভাবীকে না দেখেই তাদের প্রতি অসম্ভব রকমের আত্মিক টান অনুভব করি শাহ্। আমার প্রাণভোমরা তারা আগলে রেখেছেন।"
রিকশা চলছে। আজ যেন প্রিয়াঞ্জনার মুখে খই ফুটেছে। কত কত কথা বলছে মেয়েটা! শাহবাজ শুনছে, হাসছে, জবাব দিচ্ছে। এই অপার্থিব সুখ আর কোথাও পাওয়া যায় না। সুফিয়া আজ ছোটখাটো আয়োজন করেছে। মুরগীর গোশত, পোলাও, ডিম ভুনা আর ডাল। চৌকিতে বসে প্রিয়াঞ্জনার থালায় বড় পিসটাই তুলে দিচ্ছিলো সুফিয়া। আর প্রিয়াঞ্জনা অবাক হচ্ছিল। আজকালকার যুগে এমন ভালো মানুষও হয়?
"তেমন কিছু করতে পারিনি।"
লাজুক কন্ঠে বারবার বলছে সুফিয়া। রিমনকেও বেশ লজ্জিত দেখালো। প্রিয়াঞ্জনা খাওয়া শেষে সুফিয়ার দুহাত ধরে বলে,
"আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা কিভাবে প্রকাশ করবো আমার জানা নেই আপু। আপনারা খুব ভালো।"
প্রথমবারের মতো শাহবাজের ঘরে প্রবেশ করে প্রিয়াঞ্জনা। কিছুক্ষণ পর তারা বেরিয়ে যাবে। নতুন গন্তব্য। নতুন সংসার। যে ছেলেটা এসি ছাড়া থাকতে পারতোনা তার মাথার উপর ছোট একখানা পাখা। নরম তুলতুলে খাটে যে ছেলের ঘুমিয়ে অভ্যাস আজ সে একটা চৌকির উপর ঘুমায়। শক্ত চৌকি। প্রিয়াঞ্জনা বহু কষ্টে নিজেকে আটকায়। বারবার চোখ ভিজে উঠতে চাচ্ছে তার। মানুষের জীবনে উত্থান-পতন আসে। বসুন্ধরা ফ্ল্যাটে থাকা, দামি গাড়িতে চড়া শাহবাজ চৌধুরী আজ টিনের ছোট একটি ঘরে ঘুমাচ্ছেন। জীবন সত্যিই খরস্রোতা নদীর মতন। কখনো জোয়ার কখনো ভাটা। টুকটাক সবকিছু গুছিয়ে শাহবাজ, প্রিয়াঞ্জনা বেরিয়ে পড়ে বিকেলের দিকে। পরশুদিন হতে শাহবাজের ক্লাস শুরু হবে।
ভেলানগর থেকে বাসে উঠতে হবে। ব্রিজ দিয়ে অপর পাড়ে যেতে হবে। ব্রিজে উঠে দাঁড়ায় দুজনে। নিচে মেইন রোড। কত রকমের গাড়ি সাঁই সাঁই করে চলছে। মৃদু বাতাস বইছে। নীলচে আকাশ। রেলিং এ হাত রাখে প্রিয়াঞ্জনা। তার হাতের উপর শাহবাজ নিজের হাত রাখে। ঠিক যেভাবে ধরেছিলো বিয়ের প্রথম দিন গাড়িতে।
"I am always with you"
শাহবাজ নরম কন্ঠে আশ্বাস দেয়। প্রিয়াঞ্জনা হালকা হেসে বলে,
"আমি জানি শাহ্"
হুট করেই মেইন রোডে বিকট শব্দে তারা সেদিকে তাকায়। একটি বিয়ের গাড়ি এ'ক্সি'ডেন্ট করেছে বাসের সাথে। বরবধূ ভিতরেই ছিলেন। লোকজনে ভরে গেছে চারপাশ। প্রিয়াঞ্জনা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে। নববধূকে অচেতন অবস্থায় বের করা হলো। লালশাড়ি গাঁয়ে। গলগল করে র'ক্ত বের হচ্ছে তার মাথা থেকে।
এসব দেখে শরীর অবশ হয়ে আসছে প্রিয়াঞ্জনার। শক্ত করে সে আঁকড়ে ধরে শাহবাজের হাত। জীবন অনিশ্চিত। কেউ জানেনা কখন তার সাথে কি হবে।
"তোমার খারাপ লাগছে প্রিয়াঞ্জনা? পানি খাবে?"
"হুম"
নিচে নেমে বাসে উঠে বসে দুজনে। প্রিয়াঞ্জনা পানি পান করে চোখ বুজে শাহবাজের কাঁধে মাথা রাখে। এই কাঁধে মাথা রেখে আল্লাহ যদি তার মৃ'ত্যুও দেন তাহলেও তার আফসোস নেই। শাহবাজ শক্ত করে আঁকড়ে ধরে প্রিয়াঞ্জনাকে। এই একজনই তো তার প্রিয় মানুষ। এই মানুষটাই যে তার সব।
________________
দুপুরের দিকেই সারা বাড়িতে ছড়িয়ে পড়েছে প্রিয়াঞ্জনা নেই। ড্রয়িংরুমে থমথমে মুখে বসে আছে সবাই। সবচেয়ে বেশি অসহায় মুখ প্রীতমের। প্রিয়াঞ্জনাকে ছাড়া তার বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন পূরণ সম্ভব নয়। সে দরজা আটকে সুমনাকে বেশ আ ঘা ত করেছে। এখন সুমনা অচেতনের মতো পড়ে আছে প্রিয়াঞ্জনার ঘরে। প্রীতিকে মে রে ছে ন জোহরা। প্রীতি বারবার এক কথাই বলছে, "আমি এ ব্যাপারে কিছু ই জানিনা।" স্বর্ণাও স্বামীর সাথে সাথে থাকছে। স্বামীকে এটাসেটা পরামর্শ দিচ্ছে
"আমার ওসি বন্ধুকে ফোন দিবো? থানায় একটা জিডি করলে কেমন হয়?"
জোহরা সহমত পোষণ করলেন। কিন্তু বাঁধা দিলেন প্রবীর। তিনি বেশ কিছুক্ষণ যাবত চুপ করে আছেন। মূলত তিনি ধারণাই করছিলেন এমন কিছু হবে। গত পরশুদিন ছাদে প্রিয়াঞ্জনার সাথে কথা হয়েছিলো তার। ছলছল চোখে বেশ আকুতি করে বলেছিলো,
"আমাকে আমার মতো করে বাঁচতে দেও বাবা। ঐ মানুষটা ছাড়া আমার বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।"
তিনি প্রশ্ন করেছিলেন,
"সন্তানের ভালো দিকটা কি বাবার দেখা উচিত না?"
"টাকা-পয়সা কখনো সুখ-শান্তি বয়ে আনতে পারেনা বাবা। আমি শাহবাজকে ভালোবাসি। ওকে ছাড়া থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ফাহিমের মতো দুশ্চরিত্র ছেলেকে তো জীবনেও আমি মেনে নিতে পারবোনা।"
"কি চাও তুমি?"
"নিজের মতো বাঁচতে চাই। কথা দাও বাবা কোনো ঝামেলা করবেনা?"
"কোনো সময় এই বাড়িতে আর আসতে পারবানা। বাবা-মা নয়তো শাহবাজ চৌধুরী যেকোনো একটা বেছে নিতে হবে তোমাকে।"
প্রিয়াঞ্জনা থমকে গিয়েছিলো। আকাশ পানে তাকিয়ে কেঁদেছিলো বেশ কিছু সময়। তারপর অশ্রুসিক্ত গলায় বলেছিলো,
"আমার তাকে চাই বাবা। আমার তাকেই চাই।"
দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন প্রবীর। মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন,
"তোমার যা ইচ্ছা করো। তোমার মা যেন না জানে।"
জীবনে প্রথমবারের মতো বাবাকে জড়িয়ে ধরেছিলো প্রিয়াঞ্জনা। চোখ ভিজে উঠেছিলো প্রবীরেরও। দীর্ঘদিন বিদেশে থাকার কারণে এই মেয়েটিকে কখনো স্নেহ, আদর করতে পারেন নি তিনি। কেমন যেন দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিলো তার আর তার মেয়ের মাঝখানে। জোহরা, প্রীতম যা বোঝাতো তিনি তাই সঠিক মনে করতেন। তবে এখন মনে হচ্ছে মেয়ে যথেষ্ট বড় হয়েছে। তাকে তার মতো করেই জীবন অতিবাহিত করতে দেওয়া উচিত।
"এই কি হইলো তোমার? কিছু বলো!"
জোহরা বেগমের বাজখাঁই গলায় বাস্তবে ফিরেন প্রবীর। গম্ভীর কন্ঠে বলেন,
"যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। এখন আর এসব নাটক করে লাভ নাই।"
"এগুলো কি বলো। বা ট পা রের কাছে মেয়ে দিবো। যার কোনো ভবিষ্যত নাই?"
"মেয়ে যথেষ্ট বড় জোহরা। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারে। ও যদি শাহবাজের কাছে থাকতে চায় তাহলে আমরা আর কি বা করতে পারি। আর সবাই কে বলে রাখি আজকের পর থেকে এ ব্যাপারে যেন কোনো কথা না হয়।"
আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকলেন জোহরা। ক্রন্দনরত সুরে বললেন,
"আজকের থাইকা আমার প্রিয়া নামে কোনো মেয়ে নাই, নাই, নাই।"
প্রীতম উঠে ঘরে চলে আসে। যেখানে বাবা-মা কোনো পদক্ষেপ নিতে চাচ্ছেনা সেখানে সে যদি আগ বাড়িয়ে কিছু করতে যায় তাহলে মা নিশ্চিত সন্দেহ করবেন। ফাহিমকেও কথা দেওয়া। তিনমাসের মধ্যে ডিভোর্স সেরে তার সাথে প্রিয়াঞ্জনার বিয়ে দিয়ে দিবে। বাবা তো নিজে উকিলের সাথে কথা বলেছে। কি এমন হলো যে তিনি এমন পাল্টে গেলেন। স্বর্ণা পাশে বসে আছে। আমেরিকা তো তারও যাওয়ার শখ। কিন্তু প্রিয়াঞ্জনা তো পরিকল্পনা শুরুর আগেই পানি ঢেলে দিলো। তারা পরিকল্পনা মোতাবেক বিয়ে করলো, বাচ্চা নিলো। বাসায় নিজের একটা স্থান দখল করলো স্বর্ণা। আরো কত পরিকল্পনা বাকি ছিলো তাদের। সব শেষ।
"কি জবাব দিবে ফাহিম ভাইকে?"
"তাই তো ভাবছি।"
চিন্তিত দেখাচ্ছে প্রীতমকে।
সুমনার জ্ঞান ফিরে প্রীতির ডাকে। কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়েছিলো সে। আজ খুব আ ঘা ত করেছে প্রীতম। ব্য থায় চোখমুখ র'ক্তবর্ণ হয়ে আছে সুমনার। প্রীতি সুমনার ভাতের থালা বেডের পাশে ছোট টেবিলে রেখে ডেকে তুলে সুমনাকে। সুমনার হাতে ভলিনি ৫০ এম জি স্প্রে করে দেয়। দুটো হাত মা রের দাগে কালসিটে হয়ে আছে। প্রীতি হতভম্ব কন্ঠে বলে,
"অমানুষ একটা। হাতের কি অবস্থা করছে। ছিঃ! তাকে ভাই বলতেও আমার ঘৃ ণা হচ্ছে।"
.
.
.
চলবে..............................