মেঘের বাড়ি - পর্ব ০৭ - ফারহানা ছবি - ধারাবাহিক গল্প

পড়ুন ফারহানা আক্তার ছবি'র লেখা একটি সামাজিক ধারাবাহিক গল্প মেঘের বাড়ি
মেঘের বাড়ি
মেঘের বাড়ি

সন্ধ্যে নাগাদ তিন মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে তাদের জিনিস পত্র নিয়ে তৈরি হয়ে নিলো৷ মেঘ তার তিন ননদকে থামানোর জন্য যেতে নিলে তৎক্ষনাৎ পেছন থেকে মেঘের হাত টেনে ধরে৷ মেঘ পেছনে তাকিয়ে দেখে সোহেল রাঙ্গানিত চাউনিতে তাকিয়ে থেকে বললো,

"কোথায় যাচ্ছো তুমি?"

"আপুরা চলে যাচ্ছে সোহেল৷"

"যেতে দেও নিজেদের সংসার হোক৷ আর কত দিন বাপের বাড়ি পরে থাকবে?"

সোহেলের কথা শুনে ওর বোনেরা আরও জোড়ে শব্দ করে কাঁদতে লাগলো৷ সবটা দুরে দাড়িয়ে দেখছে জায়েদা বেগম৷ মেয়েদের কান্না দেখে বুকের ভেতরটা যেন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে তার সাথে সাথে মেঘের প্রতি তার হৃদয়ে ঘৃনার পরিমান যেন আরও বেড়ে গেল৷

(১৪)

বড় বাড়িটা আজ ফাঁকা ফাঁকা লাগছে৷ আখি,সাথী,মিলা চলে গেছে৷ বাড়িতে শুধু সোহেল, মেঘ, সবুজ, মনি, তার তিন বাচ্চা এবং তাদের শশুড় শাশুড়ী৷ সেদিন রাতে কেউ তেমন কিছু দাঁতে কাটেনি৷ তবে মেঘ তার দেবরের তিন বাচ্চাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিলো৷ সোহেল দুরে বসে সবটা দেখেই নিজ হাতে মেঘের জন্য খাবার বেরে নিয়ে আসে৷ বাচ্চারা ততক্ষণে খেয়ে ঘুমাতে চলে গেছে৷ সোহেল মেঘের পাশে বসে বলে,

"বাচ্চাদের তো খাইয়ে দিয়েছো এখন নিজের বাচ্চাকে খাওয়াতে হবে তো?"

"ইস একদম ভুলে গেছি৷ সরি!"

"সরি নিজের কাছে রাখো আর দ্রুত খেয়ে নেও৷ এই সময় খালি পেটে থাকা একদম ঠিক না৷ "

বলতে বলতে সোহেল ভাত মেখে এক লোকমা মেঘকে খাইয়ে দিলো৷ জায়েদা বেগম পানি খেতে এসে তার বড় ছেলে আর ছেলের বউের আদিক্ষেতা দেখে পানি না খেয়েই নিজের রুমে চলে গেল৷

জায়েদাকে রেগে থাকতেদেখে আমজাত শোয়া থেকে উঠে বলে,

"জায়েদা কী হয়েছে? এত রেগে আছো কেন?"

"রেগে থাকবো না? ওই নষ্টা মাইয়ার জন্য আমার মাইয়ারা ঘর ছাড়া৷ ওই মাইয়ারে আমি ছাড়বো না৷"

"কী কইতাছো জায়েদা? বড় বউ পোয়াতি আর তুমি কি করতে চাইতাছো জায়েদা? ভুইলা যাইয়ো না বড় বউমার পেটে এই বংশের সন্তান৷"

"মানি না৷ শুনছো মানি না ওই রক্ত আমার পোলার৷ ওই নষ্ট মাইয়ার সন্তান আমাগো বংশের হইতে পারে না সোহেলের বাপ৷"

"থামো জায়েদা তোমার কথা যদি সোহেল যদি জানতে পারে তাহলে কী হইবো তুমি জানো?"

জায়েদা বিছানার উপর বসে বলে,

"আর মাত্র কইডা দিন সোহেলের বাপ৷ একবার সোহেল বিদেশ যাইয়ালোক তারপর দেখবা আমি কী করি৷"

"যাই করো না কেন শুধু একটা কথা মনে রাইখো ওই বড় বউয়ের মধ্যে তোমার পোলার প্রাণ ভোমরা রইছে৷"

"ওই প্রাণ-ভোমরা কেমনে উপরে ফেলতে হয় তা আমার ভালো মতই জানা আছে৷"

আমজাত চোখ বন্ধ করে রইল৷ তিনি জানেন তার স্ত্রী নিজের মনে মনে যা একবার ঠিক করে নেয় সেটাই করে৷


মেঘ সোহেল খাওয়া শেষ করে নিজেদের রুমে চলে গেল৷ দেখতে দেখতে পনেরো দিন কেটে গেল৷ সোহেলের বিদেশ যাওয়া আর মাত্র পনেরো দিন বাকি আছে৷ মেঘের মন ভিষণ খারাপ এটা ভেবেই যে আর কিছু দিন পর সোহেল তাকে ছেড়ে কয়েক বছরের জন্য বিদেশ চলে যাবে৷ আনমনা হয়ে পেয়াজ কাটতে কাটতে হঠাৎ করে হাত কেটে যায় মেঘের৷ অতিরিক্ত রক্ত বের হতে দেখে মেঘ দ্রুত বালতি ভরা পানিতে হাত ডুবিয়ে দেয়৷ সোহেল মেঘকে দেখতে রান্না ঘরে এসে দেখে মেঘ তার হাত বালতিতে হাত ডুবিয়ে রেখেছে৷ পানির রঙ টাও লাল বর্ণ ধারণ করেছে দেখে সোহেল ঘাবড়ে গিয়ে দ্রুত মেঘের হাত বালতি থেকে তুলে দেখে বা হাতটা অনেকটা কেটে গেছে৷ রক্ত পড়া এখনো বন্ধ হয়নি৷ সোহেল চোখ পাকিয়ে মেঘের দিকে তাকিয়ে বলে,

"বলেছিলাম না নিজের খেয়াল রাখতে? এই নমুনা নিজের খেয়াল রাখা?"

মেঘ ভয়ের চোটে মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হলো না৷ সোহেল মেঘকে হাত ধরে বসা থেকে তুলে নিয়ে রুমে গিয়ে রক্ত পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দেয়৷

"ভুলেও যদি বিছানা থেকে তোমায় নামতে দেখি তাহলে তোমার খবর আছে৷"

"আরেহ সামান্য আঙ্গুল কেটেছে৷ একে বারে আঙ্গুল কেটে আলাদা হয়ে যায়নি৷"

"চুপ একদম চুপ বাজে কথা একদম বলবে না৷ চুপচাপ এখানে বিশ্রাম নেও৷"

"আরেহ রান্নাটা এখনো শেষ হয়নি৷"

"আম্মা আছে মনি আছে তারা রান্না শেষ করবে তোমাকে উঠতে হবে না৷"

সোহেল মেঘকে কিছু বলতে না দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল৷

"আম্মা আম্মা কোথায় তুমি?"

জায়েদা তার জায়ের সাথে বসে গল্প করছিলো বড় ছেলের গলা শুনে দ্রুত গতিতে বাড়িতে ঢুকে বলে,

"কি হয়ছে আব্বা ডাকতাছো কেন?"

"আম্মা মেঘের শরীরটা খারাপ আবার হাত কেটে বসে আছে৷ রান্নাটা শেষ হয়নি তুমি আর মনি মিলে রান্নাটা শেষ করো৷"

"বউমার শরীর খারাপ? আর হাত কাটলো কেমনে?"

"পেয়াজ কাটতে গিয়ে হয়তো কেটে গেছে৷ মেঘ রুমে বিশ্রাম নিচ্ছে৷"

"আমি যাইয়া বউমারে দেইখা আসতাছি৷"

জায়েদা মেঘ কে দেখতে যেতে নিলে সোহেল বাধা দিয়ে বললো,

"আম্মা মেঘ ঘুমাচ্ছে ঘুম থেকে উঠলে কথা বলো৷"

"আচ্ছা৷"

মুখে হাসি আর অন্তরে বিষ নিয়ে কোন মতে রাগটা সামলে রান্না ঘরে চলে গেল৷ মনি তার ননদের সাথে দেখা করে বাড়িতে এসে দেখে তার শাশুড়ি রান্না করছে৷ আশে পাশে মেঘকে দেখতে না পেয়ে তার শাশুড়ি কে জ্বিজ্ঞাসা করলো,

"আম্মা বড় ভাই কই? আর আপনি রান্না করতাছেন যে?"

মনির কথা গুলো আগুনে ঘি ঢালার মত কাজ করলো৷ জায়েদা তেঁতে উঠে বললো,

"ওই মহারানির নাকী শরীর খারাপ৷ উনি ঘরে বিশ্রাম নিতাছে৷ এখন কথা কম বইলা কাজে হাত লাগাও৷"

মনি কথা না বাড়িয়ে কাজে হাত লাগালো৷ দিনকে দিন মেঘের শরীর যেন আরও খারাপ হচ্ছে৷ কিছু খেতে পারে না৷ মাছের গন্ধ সহ্য করতে পারে না৷ সোহেল মেঘকে নিয়ে বেশ চিন্তিত৷ মেঘ যে কিছু খেতে পারছে না৷ মেঘ দিনকে দিন দূর্বল হয়ে যাচ্ছে৷ সোহেল এক সপ্তাহ পর মেঘকে ডাক্তারের কাছে গিয়ে চেকয়াপ করিয়ে আনে৷ ডক্টর কিছু ঔষধ দিয়েছে যেটা মেঘ নিয়মিত খাবে৷ মেঘের অসুস্থতার কিছুদিন যাবত বাড়ির সব কাজ মনি এবং তার শাশুড়ি করছে৷ মেঘ চুপচাপ শুধু বিশ্রাম নিচ্ছে৷

(১৫)

কিছুদিন পর রোজা কিন্তু তার আগেই সোহেলের ফ্লাইট৷ মেঘ সেটা জানার পর থেকে কান্না করে যাচ্ছে৷ সোহেল নানা ভাবে মেঘ কে বুঝানোর চেষ্টা করছে৷

"ঈদ টা আমাদের সাথে কাটিয়ে গেলে হয় না?"

"চেয়েছিলাম কিন্তু তা তো সম্ভব না জান৷ পাচঁ দিন পর আমার ফ্লাইট এই কয়দিন প্লিজ সারাক্ষণ আমার সাথে কাটাও৷ ও দেশে ফিরে যাওয়ার সময় তোমার সাথে কাটানো কিছু ভালো স্মৃতি নিয়ে যেতে চাই৷ এখন আর বাচ্চাদের মত কান্না না করে আমার বুকে এসো৷ তোমায় বুকে নিয়ে আমার কলিজা জুড়াতে চাই৷"

মেঘ শান্ত ভালো বাচ্চার মত সোহেলের বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো৷ অন্যদিকে জায়েদা তার বড় মেয়ের বাড়িতে গিয়ে রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে আঁখিকে বললো,

"আর মাত্র কয়ডা দিন আঁখি তারপর ওই নষ্টা মাইয়ারে কেমনে তাড়াতে হয় আমার জানা আছে৷"

"কী করবা আম্মা? বড় ভাবির জন্য আমারে এই ভাঙা বাড়িতে থাকতে হইতাছে৷ দেখো আম্মা আমার হাতের কী অবস্থা ও বাড়িতে থাকতে আমার হাত কী এমন ছিলো? কি সুন্দর মোলায়েম হাত রুক্ষ কালো হয়ে গেছে দেখছো?"

মেয়ের ন্যাকা ন্যাকা কথা শুনে মেঘের উপর রাগটা আরও বেড়ে গেলো৷ আচঁলের গিট খুলে হাজার টাকার নোট মেয়ের হাতে গুজে দিয়ে বলে,

"এহন বাড়ি যাই রান্ধন লাগবো৷ মহারানী তো এখন মাছ মাংসের গন্ধ নাকে গেলে নাকি বমি পায়৷"

"এহ! যত্তসব ঢং আমরা মনে হয় বাচ্চা জন্ম দি নাই? হুন আম্মা বড় ভাবিরে একদম ছাড়বা না৷ একবার ভাই বিদেশ যাক তারপর দেখামু আমি কি জিনিস৷"

"হ এখন সোহেলের যাওয়ার অপেক্ষা৷"


দেখতে দেখতে সোহেলের বিদেশ যাওয়ার সময় হয়ে এলো৷ আগামিকাল সোহেলের ফ্লাইট আজ রাতেই ঢাকার উদ্দেশ্য বের হবে সোহেল৷ সে কথা জানতে পেরে মেঘের মুখটা অন্ধকারে ছেঁয়ে গেলো৷ সোহেল তার জামা কাপড় প্যাকিং করা শেষ৷ জায়েদা বেগম কিছু শুকনো পিঠা, সাথে আরও কিছু খাবার প্যাক করে দিলো৷ সোহেল হাসি মুখে তা নিয়ে নিলো৷ সন্ধ্যে সাতটায় ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা দিবে৷

মেঘ কান্না করতে করতে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে৷ সোহেল মেঘ কে থামাতে পারছে না৷ সোহেল মনে মনে খুব আফসোস করতে লাগলো এত তাড়াতাড়ি কেন তাকে যেতে হচ্ছে৷

দুপুরে আজ বেশ ভালো মন্ধ রান্না হয়েছে৷ আর তা মেঘ নিজের হাতে করেছে সোহেলের জন্য, সোহেল আজ অনেক দিন পর তৃপ্তি সহকারে খাবার খেলো৷ আজ যেহেতু সোহেল চলে যাবে তাই তার তিন বোনকে সোহেল আজ আসতে বলেছে৷ তারাও আজ এসেছে তবে আগের থেকে অনেক বেশি কেয়ারফুল হয়ে গেছে৷ মেঘের সাথে খুব সুন্দর করে কথা বলছে৷ মেঘ বেশ অবাক হয় তার তিন ননদের ব্যবহার দেখে৷ এত ভালো ব্যবহার দেখে বেশ আতঙ্কিত হয় মেঘ৷ মেঘ জানে এই ভালো ব্যবহার সব উপরে উপরে ভেতরে যে তার পিন্ডি চটকাচ্ছে এটা মেঘ ভালো করেই জানে৷ মেঘ মুচকি হেসে তার ননদের সাথে ভালো ব্যবহার করছে৷

সন্ধায় সোহেলকে এগিয়ে দিতে তার বাবা ভাই আর বোনের স্বামী আসে৷ মেঘ ঠোঁট চেপে নিজের কান্না আটকানোর চেষ্টা করতে লাগলো৷ সোহেল যাওয়ার পূর্বে মেঘের কপালে তার ওষ্ঠদ্বয় ছুঁইয়ে দিয়ে বললো,

"জান নিজের এবং আমাদের পুচকুর যত্ন নিবে৷ নিয়মিত খাওয়া দাওয়া করবে আর ডাক্তারের দেওয়া ঔষধ নিয়মিত খাবে৷"

"আর?"

"ভালোবাসি বউ৷"

এই কথাটাই মেঘের হৃদয় জুড়িয়ে দিলো৷ মেঘ সোহেল কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,

"নিজের খেয়াল রাখবেন আর আমাকে প্রত্যেকদিন কল করবেন৷"

"ইনশা আল্লাহ৷"

এর মাঝে সবুজ তার ভাইকে ডাকতে লাগলো৷ সোহেল মেঘের মাথায় হাত রেখে বললো,

"ভালো থেকো৷"


সোহেল যাওয়ার পর মেঘ মন খারাপ করে নিজের রুমে শুয়ে ছিলো হঠাৎ দরজায় কড়া আঘাত পড়তে মেঘ চমকে ওঠে বলে........

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন