জীবন বদলায়। মানুষ বদলায়। একসময়ের অকৃত্রিম ভালোবাসাও একটা সময় এসে অকিঞ্চিৎকর হয়ে পড়ে। সুমনার মত কতশত নারী মুখে কুলুপ এঁটে পড়ে থাকে। তারা চিৎকার করতে চায়। ভয় হয় সমাজের। চিৎকার আটকাতে তারা কামড়ে ধরে নিজ হাত। চোখের অশ্রু আটকাতে বারবার পানি ছিটিয়ে দেয় নিজ মুখে। আ ঘা তে আ ঘা তে জর্জরিত হয়ে উঠে তাদের মন। কোনো এক দিন ডাক আসে ওপাড়ের। মনে চাপা কষ্ট নিয়েই পাড়ি জমায় না ফেরার দেশে। এই পৃথিবীতে সুমনার আপন কেউ নেই। যারা ছিলো তাদের সাথে সেই কবেই সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। সেখানেও ফিরে যেতে পারবেনা। ইদানীং আত্মসম্মানবোধটা বেশ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তার। আপাতত সে নদীর পাড়ে বসে আছে। মেঘনা আজ বেশ উত্তাল। কোনো কারণ ছাড়াই উত্তাল। হিসেব কষছে সুমনা। কোথায় যাওয়া যায়! স্টেশন থেকে ঢাকা এয়ারপোর্টের ট্রেন ছাড়বে সন্ধ্যার দিকে। ঢাকা চলে যাবে কি! সর্বপ্রথম ডিভোর্সের ব্যাপারে একজন ভালো উকিলের সাথে কথা বলতে হবে। সুমনা চাচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব সম্পর্কটা হতে বের হতে। উঠে দাঁড়ায় সুমনা। তার পরিচিত একজন মহিলা উকিল রয়েছেন। বাজির মোড়ে বসেন। দেখা যাক কথা বলে। হাতে যথেষ্ট টাকা আছে। এই টাকাগুলো একান্তই তার। আর কিছু গহনাও আছে।
শাহবাজ বিকেলের দিকে বাড়ি ফিরেছে। প্রিয়াঞ্জনা অধীর আগ্রহে বসেছিলো তার শাহ্ এর জন্য। বেশ ক্লান্ত লাগছিলো শাহ্কে। বিছানায় বসে শার্টের বোতাম খুলছে সে। প্রিয়াঞ্জনা লেবুর শরবত নিয়ে পাশে এসে দাঁড়িয়ে আছে। শাহ্ চোখ তুলে তার পানে চায়। হাত বাড়িয়ে শরবত নিয়ে এক নিমিষেই খালি করে ফেলে গ্লাস।
"ফ্রেশ হয়ে আসুন। ভাত দিচ্ছি।"
"আচ্ছা"
খাওয়া দাওয়া সেরে গল্প করতে বসে দুজনে। খোলা বারান্দা। পাশাপাশি বেতের সোফা রাখা। সোফায় বসলে স্পষ্ট আকাশ দেখা যায়। আজ পূর্ণিমা। বাইরে জোৎস্নার আলো সর্বত্র। প্রিয়াঞ্জনা শুধায়,
"চা বসিয়েছিলাম। নিয়ে আসি?"
"যাও"
প্রিয়াঞ্জনা চা নিয়ে এলো। চাঁদের আলোয় ছাদ আলোকিত হয়ে আছে। মাতাল হাওয়া বইছে চারপাশে।
"কেমন কাটলো আপনার প্রথম ক্লাস?"
"ভালো। তবে আজকালকার ছেলে-মেয়েরা কি যে ইঁচড়েপাকা হয়েছে!"
"কেন কি হয়েছে?"
আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে প্রিয়াঞ্জনা।
"থাক সেসব কথা। এখন বলো কি কি করলে সারাদিন?"
উদাস নয়নে চায়ে চুমুক দেয় প্রিয়াঞ্জনা। ঝকঝকে চাঁদের পানে তাকিয়ে বলে,
"কত কি করলাম। বই পড়েছি, বাড়িওয়ালা চাচি আর উনার মেঝো মেয়ের সাথে গল্প করেছি। রান্না-বান্না করলাম। জানেন কি হয়েছে আজকে?"
"কি?"
"বাড়িওয়ালি চাচির ছোট মেয়ে আমাকে ছাদে দেখে দৌড়ে নিচে চলে গেলো। আমি নাকি ভূত!"
শাহ্, প্রিয়াঞ্জনার গালে আঙুল ছুঁইয়ে বললো,
"ভূত না পরী। আমার পরী।"
"আপনার পরী গান শুনতে চায়। একটা গান শুনান না শাহ্।"
আবদার করে প্রিয়াঞ্জনা। শাহবাজ হাসে। খোলা কন্ঠে গেয়ে উঠে,
"সেই রাতে রাত ছিল পূর্ণিমা
রঙ ছিল ফাল্গুনি হাওয়াতে....
গানের তালে তালে চায়ে চুমুক দিচ্ছে প্রিয়াঞ্জনা। চা, গান, ভালোবাসার মানুষ। প্রিয়াঞ্জনা তাকায় তার শাহ্ এর পানে। জীবন বদলায় তবে মানুষ কি সত্যিই বদলায়? হয়তো কিছু ক্ষেত্রে বদলায়। যার মানুষটা বদলায় না তারা হয়তো সুখীদের দলে পড়ে। প্রিয়াঞ্জনা পৃথিবীতে থাকা সেই সুখী মানুষগুলোর মধ্যেই একজন।
পূর্ণিমা রাতে নাদিয়া ছাদে হেঁটে বেড়ায়। দু'হাত মেলে গাঁয়ে ছুঁয়ায় চাঁদের আলো। দাদি বলতেন এতে নাকি চেহারাও চাঁদের আলোর মতো হয়ে যায়। গোলাপগাছগুলো তো তার পথ চেয়ে আছে। যদিও নাদিয়ার মনটা আজ ভিষণ খারাপ। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠার সময় মোহনীয় কন্ঠস্বর কানে আসে।
"রাত আসে রাত চলে যায় দূরে
সেই স্মৃতি ভুলতে কি আজ পারি....
আবারও বুকে চাপা কষ্ট অনুভব করে নাদিয়া। বসে পড়ে সিঁড়িতে। এত অল্প পরিচয়ে কি করে লোকটা তার সমস্ত অন্তর দখল করে নিয়েছে। কি করে? নিজের প্রতি কিঞ্চিৎ ঘৃণা আসে তার। আবার পরক্ষণেই ভাবে ভালোবাসা তো খারাপ কিছু না। অনেকেই তো দুই বিয়ে করে। ভালোবাসা তো ভাগাভাগি করেও নেওয়া যায়। নাজমা ডাক লাগালেন নাদিয়াকে। নেশা ধরানো কন্ঠ ছেড়ে উঠতে মন চাচ্ছিলো না। তাও উঠে গেলো বাবা-মায়ের ঘরে। বদরুজ্জামান সাহেব ল্যাপটপ হাতে বসে আছেন।
"তুমি পদার্থবিজ্ঞানে ফেল করেছো নাদিয়া।"
গম্ভীর কন্ঠে বললেন বদরুজ্জামান সাহেব। তিনি যে অত্যধিক রেগে আছেন তা তার কন্ঠেই স্পষ্ট। নাদিয়া মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সাইন্স নিয়ে তো সে পড়তে চায়নি। এসএসসি এরপর আর্টস নিয়ে পড়তে চেয়েছিলো। বাবা-মাই তো তাকে জোর করে সাইন্সে দিলো। ভালো স্টুডেন্টরা নাকি সাইন্সে পড়ে। তাছাড়া জিপিএ ফাইভ পেয়ে সে আর্টসে পড়বে তা তার বাবা কোনো মতেই মেনে নিচ্ছিলেন না।
"কি হলো কথা বলছো না কেন?"
হুংকার দিয়ে উঠলেন বদরুজ্জামান। কেঁপে উঠে নাদিয়া। বাবা এমনিতে অনেক আদর করে তাকে। তবে রেজাল্ট খারাপ করলে অনেক বকা দেয়।
"আমি কলেজের শিক্ষক। সবুজ স্যার যখন টিচার্স রুমে সবার সামনে বললেন নাদিয়া পদার্থ বিজ্ঞানে ফেল করেছে। তখন কতটা লজ্জা পেয়েছিলাম সে জ্ঞান আছে তোমার?"
"প্রাইভেট পড়েও এ হাল নাদিয়া?"
নাজমার প্রশ্নেও উত্তর দেয়নি নাদিয়া। পদার্থবিজ্ঞান বিষয়টা তার মাথায় ঢুকে না। এটা কি তার দোষ?
"নাজমা তোমার মেয়েকে বলে দাও আগামীকাল থেকে সে শাহবাজের কাছে পদার্থ বিজ্ঞান প্রাইভেট পড়বে। ছেলেটা অনেক ভালো পড়ায়। আজ প্রথম ক্লাস ছিলো তার। খুবই ভালো পড়িয়েছে। শিক্ষার্থীরা নাকি বেশ প্রশংসা করেছে। আমি কথা বলেছি ওর সাথে। তিনদিন বিকেলে সময় দিবে।"
সকল মন খারাপ দূর হয়ে গেলো নিমিষেই। নাদিয়ার মনে উড়ে বেড়াচ্ছে শত শত প্রজাপতি। বাবা বকেছিলো বলে চোখে পানি চলে এসেছিলো তার। এখন, আহা! আকাশে উড়তে ইচ্ছে করছে।
সুমনা বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ায় কারো মধ্যেই তেমন বিচলিত মনোভাব পরিলক্ষিত হলো না। এ যেন হবারই ছিলো। প্রীতির অবশ্য অনেক খারাপ লাগছে। একা একা লাগছে। তার ভালো বন্ধু বলতেই কেবল ছিলো দুজন সুমনা ভাবী আর প্রিয়া আপা। দুজনেই বাড়ি ছেড়েছে। নতুন মেয়েটা, হ্যাঁ মেয়েটা। কারণ একে ভাবী বলার ইচ্ছে প্রীতির নেই। কেন জানি একে তেমন পছন্দ হয়নি তার। অন্যের সংসারে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। অথচ কোনো আত্মগ্লানি নেই। তার মাও একে নিয়ে আহ্লাদ করেন। মেয়েটা অনেক সুন্দর। চেহারায় একটা সরলতা ভাব আছে। তবে ভিতরটা কুৎসিত। প্রাপ্তি কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। ঝগড়া লাগেনা। কঠিন কথা শুনায় না। কেবল খাটে ম রার মতো পড়ে থাকে। আগামীকাল শুক্রবার। সকালে ছোট করে হলুদ করা হবে। বাড়িতে লোকজন আসছেন। অনেকে অবশ্য সুমনার কথা জিজ্ঞেস করছে। জোহরা কৌশলে এড়িয়ে যান। তাতে কি আর মানুষ বুঝেনা। চাপা একটা গুঞ্জন তো হয়ই। স্বর্ণার বাড়ন্ত পেটের দিকেও বাঁকা নজরে তাকাচ্ছেন অনেকে। অবাকও হন।
.
.
.
চলবে...............................