মুগ্ধতার ইউটার্ন - নাবিলা ইষ্ক - অনু গল্প


যবে থেকে বুঝতে শিখেছি তবে থেকেই আমার একজন শত্রু রূপে মিত্র আছে। ওর নাম ইশরাত জাহান। আমি ওর থেকে পনেরো দিনের বড়ো। চাঁদপুর আমাদের বাসা। একই এলাকায়, পাশাপাশি। শুধু একটি বড়ো দেয়ালের তফাৎ। এক ছাঁদ থেকে আরেক ছাঁদে লাফিয়ে যাওয়া যায়। আর আমি যাওয়া শুরু করি ছোটোবেলা থেকে। বাবা যখন ব্যাট হাতে নিয়ে দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকত আমাকে একচোট পেটানোর আশায়, আমি তখন লুকিয়ে দেয়াল বেয়ে ছাঁদে উঠে, ছাঁদ টপকে ইশরাতদের বাসায় চলে যেতাম৷ ওখানেই খাওয়ার দাওয়া করে শুয়ে পড়তাম। দেখা গেছে দুদিন টানা ওদের বাসায় থেকেছি বাবা বাড়িতে ঢুকতে দিচ্ছে না বলে! আমাদের পারিবারিক অ্যালবাম দেখতে বসলে, আমাদের দুজনের ছোটো বেলার ছবির দেখা মিলে। দুজন বসে কান্না করছি, হাসছি কিংবা মারামারি করছি। ছোটোবেলায় আমি নাকি ও বাদে কারো সাথে খেলতে চাইতাম না। অন্যদের বলে বেড়াতাম, এই মেয়েটা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। অথচ যত বড়ো হতে থাকলাম তত আমাদের ঝগড়া হতো। বেস্ট ফ্রেন্ডের থেকে শত্রুতাই বেশি! ওর আর আমার মধ্যে শান্তি নামক শব্দটি নেই। দুজন দুজনের পেছনে কেন যেন লেগেই থাকি। তারপরও দিনশেষে অন্তত একবার ওর সাথে তর্ক আমার লাগতেই হবে। নাহলে কেমন খালিখালি লাগে। আমরা একই স্কুলে পড়তাম, একই ক্লাসে। আমি ছিলাম লাস্ট বেঞ্চের ছাত্র। পড়াশোনায় ফাঁকিবাজি করে বেড়াতাম। এমন কোনো দিন নেই আমি কান ধরে বেঞ্চের ওপর দাঁড়ায়নি। এমন কোনো দিন নেই, আমি পেছনে স্যারের লাঠির বাড়ি খাইনি। আর ইশরাত ছিল আমাদের ক্লাস ক্যাপ্টেন। ভীষণ ভালো ছাত্রী। অনেক পড়াশোনা করে। ওঁকে যদি ভুলেও স্যার-ম্যাম ধমক দেয় পড়ার জন্য, ও কেঁদেকেটে বাড়িঘর মাথায় তুলে ফেলত। 

খারাপ ছাত্র হলেও গুন্ডামীতে আমি ফার্স্টক্লাস। ব্যাডবয় ইমেজ আমার। বন্ধুবান্ধব নিয়ে দাদাগিড়ি করতে এক্সপার্ট। মেয়েদের এসবই হয়তো পছন্দ। তাই অনেক প্রেমপত্র পেয়েছি। আর রিলেশন ও কাউন্ট বিহীন করেছি। আমার গার্লফ্রেন্ড গুলো ইশরাতকে সহ্যই করতে পারতো না কেন যেন! রিলেশনের দুদিনের মাথায় গার্লফ্রেন্ড বলত, 

'তোমার ফ্রেন্ডের সাথে সম্পর্ক ভেঙে ফেল! ওই মেয়েটাকে আমার বিন্দুমাত্র পছন্দ না। তোমার সাথে সবসময় লেগে থাকে!'

এবং এই বিষয়টা প্রত্যেকটা গার্লফ্রেন্ড টেনে এনেছে। ওরা কখনোই ইশরাতকে পছন্দ করতো না। কখনোই ওর নামে ভালো কিছু বলত না! যত রকমের বিশ্রী মন্তব্য আছে, সবই করেছে। আমি বিরক্ত নিয়ে শুনতাম। এবং এক লাইনে বলতাম ব্রেক-আপ করো। কারণ আমার ফ্রেন্ডকে আমি চিনি এবং খুব ভালোভাবে চিনি, জানি। চার দিনের গার্লফ্রেন্ড কি বলল ম্যাটার করছে না। মাই ফ্রেন্ড ইজ ড্যাম মোর ইম্পর্ট্যান্ট দ্যান হার! কিন্তু গার্লফ্রেন্ড তখন ব্রেক-আপ বলে চলে গেলেও দুদিন পর ফিরে আসত। যেতে চাইত না আবার প্যানপ্যান করত! 

ওর আর আমার সম্পর্ক পিওর বন্ধুত্বের ছিল। কখনোই ওঁকে আমি ভিন্ন চোখে দেখিনি, ভিন্নভাবে ভাবিনি। ও শুধুই আমার কাছে আমার ব্যক্তিগত কাছের বন্ধু ছিল। আমি যখন কোনো কারণে ভেঙে পড়তাম, ও আমায় ছোটো বাচ্চাদের মতো আগলে বলত, ঠিক হয়ে যাবে! আর অবশ্যই ঠিক হয়ে যেতো। আমি আপসেট হলে ওর কাছেই যেতাম৷ ওকেই জ্বালিয়ে শুনাতাম ঘটনা কি ঘটেছে। ও বিরক্ত হতো তবে শুনত। স্বান্তনা দিতো। ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে আমি বাজেভাবে একটা ব্রেক-ডাউন খাই। আমার দু'বছরের গার্লফ্রেন্ড, যাকে আমি ভালোবেসেছি সত্যিকার অর্থে, যার জন্য পাগল ছিলাম সে ডীচ করল। বাচ্চাকালের প্রথম প্রেম আমার! খুবই ডিপ্রেশনে গেলাম। পড়াশোনায় জিরো তো ছিলামই এবার জিরো থেকে মাইনাস! সেসময়টায় আমি পাগল প্রায়! নর্মাল হতে আমার ছ-মাস লাগল। সে সময়টা আমার পরিবার আর ইশরাত ছিল দেয়ালের মতো। যেই দেয়াল ধরে আমি দাঁড়িয়েছি।

সবকিছু ঠিক ছিল। এভ্রিথিং ওয়াজ অলরাইট! আমি অভারকাম করেছি আমার ব্রেক-আপ। ভেবেছিলাম এরপর এই প্রেমটেম আমায় আর ছুঁবে না। আমি কখনোই আর কারো মায়ায় পড়ব না। ভালোবাসার সাহস ও করব না। কিন্তু আমার পৃথিবী হুট করে ইউ-টার্ন নিল। ইউ টার্ন নেওয়ার কারণ দাঁড়াল ইশরাতের প্রথম প্রেম! আমার বেস্ট ফ্রেন্ড যে কখনো প্রেম করেনি, আমি বাদে কোনো ছেলে ফ্রেন্ড বানায়নি সে রিলেশনে গেল! আমার দুনিয়া তখন ঘুরতে শুরু করল। সবকিছু উলটপালট, দিশেহারা। ও যখন মুচকি হেসে বলত, 'অ্যাই ফায়াজ দাঁড়া, সৌরভ কল করেছে কথা বলে আসি।' আমার হৃদয় জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যেতো। 

আমি মেনে নিতে পারছিলাম না ইশরাত প্রেম করছে। আমি মেনে নিতে পারছিলাম না ও অন্য ছেলের হাত ধরে ঘুরবে। অন্য ছেলের পাশে থাকুক এটাই আমি মানতে পারছিলাম না। আমি অগোছালো হয়ে পড়েছিলাম। আমার কেন এমন অনুভূতি হচ্ছে সেই কারণ ও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এমন অদ্ভুত উত্তেজনায় একটা বিশ্রী কাজ করে বসলাম। আমি আরহাম আংকেলকে বিচার দিলাম। ইশরাতের প্রেমের সম্পর্ক আছে জানালাম। সেদিনই আংকেল ইশরাতের ফোন নিয়ে নিলেন। ওঁকে চড় মেরেছিলেন, খুব বকাঝকাও করেছেন। ছাঁদে ইশরাত আসে লাল গাল নিয়ে। আমার পাশে বসে খুব কান্না করে। আমি ওর কান্না মানতে পারছিলাম না। নিজেকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছিল ভেবেই যে ও আমার জন্য চড় খেয়েছে। আমার কারণেই এভাবে কান্না করছে! ওকে যে চড় মারল এই বিষয়টা মস্তিষ্ক থেকে যাচ্ছিলই না! আমার মনে আছে সেদিন নিজেই নিজের গালে কয়েকবার চড় মেরেছিলাম। 

তবে এরপর একটা ভালো ব্যাপার ঘটল। ইশরাত সৌরভের সঙ্গে ব্রেক-আপ করে ফেলল। দুদিনের প্রেমের ব্রেক-আপ। আমি মহাখুশি। বন্ধুদের ট্রীট দিলাম। আনন্দের শেষ নেই। জীবন আবারও সুন্দর হয়ে উঠল। পরিবর্তন ঘটল এতটুকুই যে আমার প্রিয় বান্ধবীকে এখন বিশ্বসেরা মনে হয়। মনে হয় ওর থেকে সুন্দরী মেয়ে যেন এই পৃথিবীতে নেই। আমার এই চোখ ওর জন্যই বানানো যেন! আড়চোখে, চোরাচাহনি কোনো দৃষ্টি বাদ নেই, যেই দৃষ্টিতে ওঁকে দেখিনি৷ আশেপাশে হাজারো মেয়ে ঘুরছে অথচ আমার চোখে ও ঘুরছে, নাচছে, কথা বলছে হাসছে আরও কত কী! হৃদয় হুটহাট চেঁচামেচি করে, ঠিক কীজন্য করে বুঝি না বা হয়তো বুঝতে চাচ্ছিলাম না! 

সামনে ইন্টারের ফাইনাল। আর মাত্র চার মাস হাতে। রাতের বেলা দুজন ছাঁদে কফি হাতে৷ আসমানে অর্ধখন্ডিত জ্বলন্ত চাঁদ। দুজন সেদিকেই তাকিয়ে ছিলাম। ইশরাত বলল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেতে চায়। ওর টার্গেট ওই ইউনিভার্সিটি। আর সেখানে চান্স পাওয়া কঠিন। আমার মস্তিষ্ক তখন ফাঁকা। বুকটা হাহাকার করে উঠল। আমার মতো থার্ডক্লাশ স্টুডেন্ট তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাবে না৷ কিন্তু ইশরাত পেয়ে যাবে৷ ও দারুণ স্টুডেন্ট! তাহলে কী ইশরাতের সাথে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারব না? আমি মেনে নিতে পারলাম না বিষয়টা। চারটা বছর আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব, ভাবতেই খালি খালি লাগছিল। সারারাত ভাবনাচিন্তা করলাম। ইন্টারে জিপিএ ওঠাতে হবে। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিক্ষায় উত্তির্ন হতে হবে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেতেই হবে। আমি প্রাইভেট টিচার আনালাম বাড়িতে। ইম্পর্ট্যান্ট একেকটা সাবজেক্টের জন্য একেকজন পারফেকশনিস্ট টিচার চুজ করেছি। চারমাসে আমাকে জিপিএ ওঠানোর মতো পড়াশোনা করতে হবে। এবং আমি করেছিই। ইশরাত সহ বাবামা সবাইকে তাঁক লাগিয়ে পড়াশোনা করেছি৷ দিনরাত পড়াশোনা! বাবা তো ভয় পেয়ে বসেছিলেন, যে ছেলেটা তার পাগল হলো কি-না! আমি আসলেই পাগল হয়ে গিয়েছিলাম, বন্ধবীর প্রেমে পাগল! 

পরিক্ষা দিলাম একেকটা দারুণ। আমার আলাদাই কনফিডেন্স ছিল। এবং এতো পড়াশোনার ফজিলত পেয়েছি। জিপিএ এসেছে। ইসরাতেরও। ওর দেখাদেখি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরিক্ষার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। পরিক্ষা দিলাম। ইশরাত চান্স পেয়েছে আর আমিও। দুজন ঢাকায় শিফট হব৷ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ডর্ম পায়নি খালি। তাই বান্ধবীদের সঙ্গে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। আমি হতভাগা অন্ধ প্রেমিক চাচ্ছিলাম ওর আশেপাশে থাকতে। এবং বাবাকে জানালাম আমার একটা ফ্ল্যাট পছন্দ হয়েছে। ওখানে থেকে পড়াশোনা করলে ভালো লাগবে। আমার বাবা তখন আমার ওপর মহাখুশি, মহা গর্বিত। আমি চাঁদ চাইলে সেটাও দিয়ে দেবেন যেন! তাই সে মহানন্দে সেই ফ্ল্যাটটি চার বছরের কন্ট্রাক্টে নিলেন। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে দিয়ে গেলেন। আর ইন্টারে ভালো রেজাল্ট করায় বাইক সে মাস খানেক আগেই কিনে দিয়েছে! 

আমার বেডরুমের জানালা দিয়ে ইশরাতের বারান্দা দেখা যায়। আমি বিছানায় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তাকিয়ে থাকি ওঁকে দেখার আশায়, আহারে জীবন! 

______ 

আমরা এখন অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে। আমাদের একটা ফ্রেন্ডগ্রুপ তৈরি হয়ে গেল। ইশরাত, রাইসা, মুফতি, রুবেল, প্রান্ত, সোহাগ আর আমি। আমরা সাতজন বেশ ভালো বন্ধু। আমার ক্লোজ ফ্রেন্ড হলো প্রান্ত। ও আমার ফ্ল্যাটেই শিফট হলো। যেহেতু ওর ঢাকায় বাসা না। বাকিরা কমবেশি ঢাকায় স্থানীয়। তাই ও আর আমি বেশিই ক্লোজ। সেই ফজিলতে ও জেনে নিল আমার মনের কথা। এবং প্রতিনিয়ত খোঁচাত। যেন বান্ধবীর প্রতি ক্রাশ খেয়ে বড় ভুল করে ফেলেছি৷ 

শীতকালীন ছুটিতে সবাই মিলে প্লান করলাম ট্যুর দিব৷ কই যাওয়া যায়? ভেবেচিন্তে ওরা বেছে নিল সেন্টমার্টিন৷ আমি কয়েকবার গিয়েছি তবে ইশরাত সহ অনন্য অনেকেই যায়নি। তাই রওনা হলাম বুধবার রাতে। ব্যাগপত্র গুছিয়ে আমি প্রান্ত তৈরি। ফোনে শুনলাম বাকিরাও তৈরি। বেরিয়ে পড়েছি। ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে ইশরাতকে কল করলাম। ও ধরছে না। ধরছে না, ধরছে না এমন সময় হুট করে ধরে জানাল ও যাবে না। ওঁকে এক্ষুনি বাসায় ডেকেছে। তারমানে চাঁদপুর যেতে হবে। গলায় ওর একরাশ কান্নার ঢেক। আমার অবস্থা তখন অস্থির। এতো জল্পনা কল্পনা আমার। সব ভেস্তে যাবে? আমি ব্যস্ত গলায় শুধালাম, 

'কি হয়েছে হঠাৎ?'
'তোরা যা প্লিজ। আমার জন্য প্ল্যান ক্যান্সেল করিস না। আমি যেতে পারব না।'

আমি তবুও জোর করতে থাকলাম। কলের ওপর কল দিচ্ছি। রিসিভ করছে না। ওদের বিল্ডিংয়েও ঢুকতে পারছি না। রাগ, অভিমান, মনা খারাপ সব একত্রে। আমার যেতে ইচ্ছে করছে না আর। কিন্তু বন্ধুদের কেম্নে বলি? ওদের এতো আনন্দ এতো উত্তেজনা! অগ্যত ইশরাতকে ছাড়াই রওনা হলাম। সারাটা রাস্তা মন খারাপ। বন্ধুদের আনন্দ আমায় ছুঁতে পারছে না৷ কয়েকবার ভাবলাম ফিরে যাই। প্রান্তর মুখের দিকে তাকিয়ে আর ফিরে আসা হলো না। স্লিপিং বাসের টিকিট বুক করা আমাদের। আমরা বাসের সামনে। বাস ছাড়তে এখনো আধঘন্টা। আমরা সবাই পাশের চা স্টলে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছি। চা খাওয়া শেষ। সময় ফুরিয়ে গেল। বাস ছাড়বে। আমরা রওনা হলাম বাসে উঠব। এসময় মনে হলো ইশরাতের গলা শুনলাম। সবাই চমকে ফিরে তাকালাম। ইশরাত ল্যাগেজ হাতে দৌড়ে আসছে। ঠিক আমার দিকে। সঙ্গে বুকের ভেতর শান্তিও চলে এল। মুখ উজ্জ্বল হলো। আনন্দে আমার সৌন্দর্য বাড়ল নাকি? ও এসে বড়ো করে হেসে বলল, 

'বাসায় গিয়ে লাগলে বাবার বকাঝকা খাব। তবুও এই ট্রিপ মিস করব না। চল, চল!'

খুশিতে আমি কাঁদতে পারলে আনন্দ পেতাম মনে হয়। এরপর থেকে আমার খুশির শেষ নেই। সম্পূর্ণ বাস জার্নি আনন্দে উপভোগ করলাম। পাশাপাশি পা ঝুলিয়ে বসে জম্বেশ গল্প করলাম। আমাদের একপাশে শুধু আমরাই সাতজন। তাই আমাদের এঞ্জয়ম্যান্টে কোনো বা হাত ঢুকেনি৷ 

একসময় হঠাৎ ইশরাত আমার ফোন চাইল। ওর ফোন ও ওফ করে ফ্ল্যাটে রেখে এসেছে। এখন ছবি তুলবে। আমি দিলাম লক খুলে ফোন। ভুলেই গিয়েছিলাম ফোনে ইশরাত হাজার রকম ছবি আছে। ব্যাপারটায় মাথায় আসতে আসতে ইশরাত দেখে ফেলল। ও আমার দিক বাকা চোখে তাকাল। ফিসফিস করে ধমক দিল, 

'অ্যাই গাধা! তোর ফোনে আমার এতো ছবি কেন? আমার ফোনেও তো আমার এসব ছবি নেই। কিরে.. কথা বলিস না কেন? অ্যাই ফায়াজ! আশ্চর্য ত। তুই চুপ করে আছিস কেন হতচ্ছাড়া!' 

আমি একদম চুপসে আছি। এলোমেলো চোখে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম। যেন কিছুই শুনি ন। ফোনটা আলগোছে কেড়ে নিয়ে চুপচাপ থাকলাম। সারারাস্তা ইশরাত আমার দিকে অগ্নি চোখে তাকিয়ে। একা পেলেই ঝাপিয়ে পড়বে যেন! পড়লও। টেকনাফ নেমে যখন সবাই আশেপাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত ওসময় ও আমার সামনে দাঁড়াল৷ লম্বায় আমার বুকের সমান পড়া মেয়েটা হুমকি ধামকি দিতে শুরু করল, 

'কিরে তোর সাথে কথা বলতেসি শুনছিস কেন! কখন থেকে প্রশ্ন করছি উত্তর দিচ্ছিস না যে! এতসব ছবি কেন তোর ফোনে?'

আমি রেগে গেলাম। মাথাটা জ্বলে উঠল। কিছুটা ধমকের সুরেই বললাম, 

'তো কি হয়েছে? ছবি আছে, থাকুক। তোর সমস্যা কী? তোকে কি ছবি গুলো কামড়াচ্ছে?'
'কামড়াবে কেন! আমি জিজ্ঞেস করছি। আমার ছবি রেখেছিস আমি জিজ্ঞেস করতে পারি না!'
'না পারিস না। আমার ফোনে কার ছবি ,দ্যাটস 
মাই ম্যাটার। যা সর, ছবি তোল গিয়ে।'

ইশরাত হাসফাস করে, রেগেমেগে চলে গেল। আমি বাঁচলাম যেন। ধরা পড়ে যাচ্ছিলাম প্রায়! টেকবাফ থেকে আমরা গ্রিনলাইন জাহাজে চড়লাম। একরাত থাকব সেন্টমার্টিন। গতকাল রাতে কামব্যাক করব। আমাদের কটেজ বুকিং আছে আর ফেরার জাহাজ ও। তাই সমস্যা নেই বললেই চলছে। দু'ঘন্টা লাগল আমাদের সেন্টমার্টিন পৌঁছাতে। আমি আর ইশরাত পাশাপাশিই ছিলাম। দুজন ছুইছুই হয়ে হাঁটছি৷ ও বারবার তাকাচ্ছে। ওর তাকানো যে এতো বিপদজনক হবে কে জানত! আমার হার্টবিট হুরহুর করে বাড়ছে। মেরুদণ্ড বেয়ে ঘাম ছুটছে। ভীষণ ইলেকট্রিক্যাল অনুভূতি!  

কটেজে উঠলাম। ছেলেমেয়ে আলাদা আলাদা ভাগাভাগি হলো। সবাই ক্লান্ত। ফ্রেশেন-আপ হয়ে বেরোতে বেরোতে বিকেল। খাওয়া দরকার। সবাই মিলে খেতে বেরোলাম। খাওয়াদাওয়া করে ঘুরতে শুরু করলাম। ঘুমানোর থেকে ঘুরাটাই গুরুত্বপূর্ণ যেন! ঘুরতে ঘুরতে আমি আর ইশরাত আলাদা হয়ে গেলাম। কেম্নে হলাম জানা নেই। কারণ আমি বেক্কল ওকেই ফলো করছিলাম তাই বাকিরা কোথায় গেল জানি না! হঠাৎ ইশরাত ঘুরে তাকাল। কোমরে দু-হাত দিয়ে ধমকে বলল, 

'তুই আমায় ফলো করতেছিস কেন?'
'তুই কী ভালোভাবে কথা বলতে পারিস না? চেতে ওঠার কী আছে? ঘুরতেছি। এখন তোকে ফলো করে ঘুরি বা ওদের, ব্যাপার তো একই না?'
'তোর ব্যাপারটা সুবিধার লাগছে না৷ তুই কি তোর কোনো গার্লফ্রেন্ডকে আমার দ্বারা মানাতে চাচ্ছিস?'
'কি আশ্চর্য! গার্লফ্রেন্ড কোথা থেকে এলো? আমি প্রেম করিনা শতাব্দী ধরে। তোর চোখের সামনেই তো। কই গার্লফ্রেন্ড দেখছস একটাও?'

ইশরাত যেন ভাবতে বসল। বড়ো অবাক গলায় বলল, 

'আসলেই তো। তোকে তো প্রেম করতে দেখছি না। ব্যাপারটা খেয়ালও করিনি। কিরে, প্রেমট্রেম কী করিস না? নাকি ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাকা হয়ে গেছিস!'

আমার গায়ে লাগল ওর কথার ধরণ। ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাকা হলাম কই? ওর প্রেমে পড়েই তো চুপসে গেলাম। আমি চুপচাপ থাকলাম। একটু গম্ভীর বটে। ও হাসছে। ইশারাতের হাসি সুন্দর। চুল উড়ছে আর ও হাসছে। দারুণ দৃশ্য। আমি চোরাচাহনি দ্বার কতবার যে দেখলাম জানি না। হাওয়া বইছে। আমরা সৈকতের সামনে। নীলচে পানি সূর্যের আলোয় জ্বলজ্বল করছে। ইশরাত ছুটে গেল পা ভেজাতে। আমি দেখছি ওর বাচ্চাদের মতো পা ভেজানো। পেছন পেছন আমিও গেলাম। পা ভিজিয়ে ফিরে এসে সৈকতের সামনে বসলাম। প্রবল বাতাস। দুজন কথাবার্তা বলতে শুরু করলাম৷ আমি প্রশ্ন করলাম, 

'হঠাৎ আংকেল ডাকছেন কেন? কী হয়েছে? '

ইশরাত সময় নিল তবে যা বলল তা শোনার জন্য আমি বিন্দুমাত্র প্রস্তুত ছিলাম না, 

'ভালো প্রস্তাব এসেছে। বাবা চাচ্ছেন না এই পাত্র হাত ছাড়া হোক। ট্রিপ শেষ হলে হয়তো শীগ্রই বিয়ের দাওয়াত পাবি৷'

আকাশটা আমার মাথায় টুপ করে পড়ল৷ মস্তিষ্ক থ্যাতলে দিল যেন। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, 

'কি! তোর বিয়ে! মানে? এতো তাড়াতাড়ি? আংকেল কি পাগল হলেন? আশ্চর্য। অসম্ভব। তুই বিয়েটিয়ে করতে পারিস না।'

ইশরাত অদ্ভুত চোখে তাকাল। থমথমে গলায় শুধাল, 

'কেন পারিনা? আমি মেয়েমানুষ। মেয়েমানুষের তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেলা ভালো।'
'তুই…

আমি উঠে গেলাম। হনহনিয়ে চলে এলাম। মাথা টাথা কাজ করছে না। রাগে আমার সবকিছু জ্বালিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। একটার পর একটা সিগারেট খেলাম। তাতেও কিছু হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না! চোখের সামনে সন্ধ্যা নামল। হুশ ফিরল প্রান্তর ডাকে, 

'ফায়াজ! কিরে তুই এখানে? তোর সাথে ইশরাত নেই? ওঁকে তো দেখছি না।'

আমি থমকে গেলাম কিছুক্ষণ। পরপর দৌড় লাগালাম। সৈকতের পাশে ইশরাত এখনো বসে। স্রোতের নৃত্য দেখছে বসে বসে। আমি রাগী গলায় বললাম, 

'তুই এখনো এখনে বসে কেন? যা কটেজে।'

ইশরাত আমার দিকে ফিরে তাকাল, 'তুই যা। আমি থাকব কিছুক্ষণ।'
'মানে? রাত হচ্ছে। ওঠ।'
'আমি থাকব বললাম ত।'
'ফাজলামো করছিস? সবাই তোর অপেক্ষায়। ওঠ ইশরাত।'
'তুই যা এখান থেকে। আমি থাকব।'
'তুই উঠবি নাকি কোলে তুলব?'

ইশরাত অবাক চোখে ফিরে তাকাল, 'কোলে তুলবি মানে? তোর মাথাটা গেল?'
'আমি কিন্তু সিরিয়াস ইশরাত।'
'আশ্চর্য।'

আমি তাড়াহুড়ো পায়ে এগিয়ে গেলাম। আঁধারে সৈকতের সামনেই ইশরাতকে কোলে তুলে নিলাম। মেয়েটা পাতলা। আমার বিন্দুমাত্র কষ্ট করতে হলো না। ওর নরম কোমর ছুঁয়ে আমার ইলেক্ট্রইক শক লাগল যেন। ওদিকে ইশরাত হতভম্ব, হতবাক। কিছুক্ষণ পর চেঁচিয়ে উঠল। হৈচৈ ফেলে নামল। প্রায় আমার ওপর ঝাপিয়ে পড়ে প্রশ্ন করল, 

'এসবের কি মানে? তুই এমন করলি কেন?'
'কী মানে হবে?'
'তু..তুই…. 
'আমি কী? কোলে তুলেছি। ধরেছি এইতো! তুই উঠতে চাচ্ছিলিস না তাই।'
'তারজন্য তুই এমন করবি!'
'হ্যাঁ করব। আমি আরও অনেক কিছুই করতে পারি। শুনবি?'
'ফায়াজ….'

ইশরাত হতবিহ্বল। ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না যেন! আমি তাকিয়ে ওর দিকে। আমি চাচ্ছি আজ সব দেয়াল ভেঙে ফেলতে। ওঁকে ছুঁয়ে দিতে। মনের কথা জানাতে। আমি কাছে এগোলাম। ঝুকলাম ওর দিক। মুখজুড়ে সৌন্দর্য। চাঁদের অপূর্ব আলোয় ওর সবকিছু মুগ্ধকর। আমার লাগামহীন মুখ খুললাম। যেই মুখের ভাষা কখনো ইশরাত শোনেনি, 

'আমি ভালো ফ্লার্টিং করতে জানি। চুটিয়ে প্রেম করতে জানি। ভালোবাসতে জানি। কিসিংয়ে এক্সপার্ট। হুটহাট কোলে তুলতে পারব, বডি বানিয়েছি।'

ইশরাত আমার দিক তাকিয়ে। অবাক চোখে। মুখশ্রীতে অবিশ্বাস লেপ্টে। আমি আমার মনের কথাগুলো বলে ফেললাম, 

'আমায় ডেট করতে পারিস।'
'কেন ডেট করব তোকে?'
'ভালোবাসি তাই।'

আমি ভাবলাম ইশরাত চেঁচিয়ে উঠবে। হয়তো আমায় গালমন্দ করবে বা মারতে আসবে। কিন্তু আমি স্বপ্নেও ভাবিনি ও কাঁদবে। বাচ্চাদের মতো বসে কাঁদতে থাকল। আমি আচমকা এমন ঘটনায় হতভম্ব। বিচলিত গলায় জিজ্ঞেস করতে থাকলাম, 'তুই কি কষ্ট পেলি? চাইলে আমায় মার, তাও কাঁদিস না।'

কিন্তু কে শুনে কার কথা। ও মনের সুখে হাউমাউ করে কাঁদছে। আমি ওর সমানতালে বসলাম। থুতনি তুলে পুনরায় শুধালাম, 

'কাঁদতেছিস কেন? প্লিজ কাঁদিস না৷ তোর কান্না আমায় পোড়ায়!'

ইশরাত ঝাপিয়ে পড়ল আমার বুকে। জাপ্টে ধরল শক্ত করে। অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, 

'এতো সময় নিলি কেন? আমিতো মরেই যাচ্ছিলাম। আমিতো ভেবেছিলাম তুই কখনোই আমার হবি না।'

আমার জীবনের দ্বিতীয় এবং মুগ্ধতার ইউটার্ন বুঝি এটাই ছিল। 
.
.
.
সমাপ্ত…............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন