তীব্র বৃষ্টির মাঝে অসহায়ের মতো একাডেমিক বিল্ডিং'এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে। একটি রিক্সাও দেখছে না। রিক্সা থাকলে হয়ত এই ভুগান্তি হত না। অফিসের স্টাফদের কাছে অন্যসময় ছাতা থাকে। কিন্তু আজ নেই। এদিকে মেঘরাজির বিষাদও শেষ হবার নয়। তাই নিরুপায় হয়ে ভিজে যাবার সিদ্ধান্ত নিল আরশিয়া। ব্যাগখাতা ছাউনি বানিয়ে যেই চারকদম হাটা শুরু করল অমনি মাথার উপর বৃষ্টি পড়া থেমে গেল। মাথা তুলে তাকাতেই দেখল তার মাথার উপর একটি নীল ছাতি এবং সম্মুখে পৃথুল দাঁড়িয়ে আছে। পৃথুলকে এই অবেলায় নিজের সম্মুখে দেখে খানিকটা নয়, বেশ ভালো ভাবেই চমকালো আরশিয়া। সুমী বেগমের কাছ থেকে নিজের স্বামীর নিত্যদিনের কাজের চার্টটি আজ সকালেই জেনে নিয়েছিল আরশিয়া। সে নিজেকে মোটেই পতিব্রতা স্ত্রী হিসেবে আখ্যায়িত করতে চাচ্ছে না, কিন্তু যার সাথে আগামী সাতানব্বই দিন এক ছাদের নিচে থাকবে তার সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞান থাকা উচিত। তা না হলে নিজেদের চেনার যে মিশনে সে নেমেছে তা ব্যর্থ হবে। এবং সাতানব্বই দিন পর যখন হৃদয় ফলাফল চাইবে তখন তাকে শুন্যতার ঝুলি ধরিয়ে দিতে হবে। সুমী বেগমের ভাষ্যমতে মঙ্গল বার এবং বৃহস্পতিবার পৃথুলের অফিস টাইম দুপুর বারোটা থেকে রাত এগারোটা অবধি। এই সময় সে মোট দুই সময়ের সংবাদ পাঠ করে। একটি সময় দুপুর দুটো এবং আরেকটি রাত দশটা। সুতরাং এই সময় তার এখানে থাকার প্রশ্নই উঠে না। ফলে বিস্মিত কন্ঠে অস্পষ্ট স্বরে আরশিয়া শুধালো,
“আপনি এখানে?”
পৃথুল আরশিয়ার প্রশ্নে অতিশয় অপ্রস্তুত হল। মাথা চুলকে আড়ষ্টকন্ঠে বলল,
“আসলে বৃষ্টি হচ্ছিল তো, তাই ভাবলাম আপনাকে নিয়ে যাই।”
আরশিয়া অবাক দৃষ্টিতে সামনে থাকা বিব্রত পুরুষটির দিকে তাকিয়ে আছে। পরণে কালো শার্ট, বুকের কাছে একটি বোতাম খোলা বিধায় বুকের লোমগুলো সামান্য দৃশ্যমান হচ্ছে। চুলগুলো জেল দিয়ে বেশ কায়দা করেই আছড়ানো। হাতা কণুই অবধি গোটানো। হাতের কালো বেল্টের ঘড়ি। বেশ পরিপাটি পুরুষ, অথচ শ্যমমুখখানায় জড়তা। সে আরশিয়ার চোখেও চোখ রাখছে না। পৃথুলের মুখ দেখে আরশিয়ার নিজের ক্লাসের পরা না পাড়া সেই শেষ বেঞ্চের ছাত্রটির কথা মনে পড়ল। যাকে কিছু জিজ্ঞেস করলেই সে মাথা চুলকে গাইগুই করে। আরশিয়ার হাসি পেল, কিন্তু তা দমিয়ে রাখল। সামনে থাকার পুরুষটির কালো শার্টের একাংশ ভিজে গেছে। তবুও সে ছাতিখানা আরশিয়ার মাথায়ই ধরে রেখেছে। এমন সময় পাশ থেকে হেটে যাওয়া তিনজন ছেলে সজোরে সালাম দিয়ে উঠল,
“ম্যাডাম, আসসালামু আলাইকুম।”
ছেলেগুলোর সালামে সম্বিৎ ফিরল আরশিয়ার। সে মাথা নাড়িয়ে সালামের উত্তর দিল। ছেলেগুলো একবার পৃথুলের দিকে তাকায় একবার আরশিয়ার দিকে। তাদের মুখে মিটিমিটি হাসি। তাদের সদ্য বিবাহিত ম্যাডামের মাথায় এই বৃষ্টিস্নাত বিকেলে একটি পুরুষ ছাতি ধরে রেখেছে, ব্যাপারখানা তাদের বিনোদন দিচ্ছে। একজন তো বলেই বসল,
“ইনি কে ম্যাডাম?”
“আমার হাসবেন্ড।”
অকপটেই উত্তর দিল আরশিয়া। ফলে তাদের মাঝে চাঞ্চল্য বাড়ল। অপরজন তো বলেই বসল,
“স্যারকে দেখেছি খবর পড়েন। উনি মাঝে মাঝে গানও গান।”
নিজের স্বামীর জনপ্রিয়তা দেখে একটু হলেও অবাক হল আরশিয়া। একটি ছেলে অটোগ্রাফ চাইল। পৃথুল এতে বেশি অপ্রস্তুত হল। কিন্তু আরশিয়ার মুখ চেয়ে অটোগ্রাফ দিতে কার্পন্য করল না। অটোগ্রাফ নেওয়া শেষে আরশিয়া বলল,
“বৃষ্টি হচ্ছে, এখন বাড়ি যাও তোমরা।”
ছেলেগুলো মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল। তারা চলে যেতেই পৃথুলের দিকে তাকাল সে, তার কান রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সদ্য আঠারো বছরের কিশোর প্রেম করতে যেয়ে ধরা খেয়েছে। আরশিয়া ধীর স্বরে বলল,
“স্বামী স্ত্রীকে নিতে এসেছে এটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। এতে লজ্জা বা লুকানোর কিছু আছে বলে আমি মনে করি না।”
“আপনি সত্যি লজ্জিত নন?”
“নাহ! লজ্জা পাবো কেন বলুন তো?”
পৃথুল উত্তর দিল না। শুধু মোলায়েম হাসি হেসে বলল,
“বাড়ি যাওয়া যাক?”
“ছাতা কি একটা?”
“হ্যা।”
খানিকটা আড়ষ্ট স্বরে উত্তর দিল পৃথুল। আরশিয়া তখন মৃদু কণ্ঠে বলল,
“তাহলে একটু এগিয়ে আসুন, আপনি ভিজে যাবেন।”
পৃথুল কিছুসময় গাঢ় নয়নে আরশিয়ার মুখপানে চেয়ে রইল। তারপর বিনাবাক্যে এগিয়ে দাঁড়াল আরশিয়ার পাশে। ছাতির পরিধি অধিক না হওয়ায়, দুজনের দুরত্বখানা অচিরেই গুচে গেল। এতোটাই সন্নিকটে চলে এসেছে যে শরীরের পারফিউমের গন্ধটাও নাকে এসে লাগছে। মেয়েটির কেশের মৃদু, সূক্ষ্ণ গন্ধ বৃষ্টির ভেজা স্যাঁতসেঁতে মাটির গন্ধকে মিলিয়ে দিয়েছে। পৃথুলের মন্দ লাগছে না। তার গাঢ় নয়ন মেয়েটির শুভ্র মুখশ্রীর দিকে হামলে পড়ছে। বুভুক্ষুর মত দেখছে তাকে। যেন শত বছরের তৃষ্ণা মেটানোর আজই শেষ সময়।
*******
কাদা স্যাঁতসেতে পরিবেশ, রাস্তায় পানি জমেছে গোড়ালি অবধি। বৃষ্টির বেগ কমে এসেছে। কিন্তু ধার এখন থামেনি। আকাশের বিক্ষোভ কানে আসছে। রিক্সার দেখা নেই। এই ক্লান্ত বৃষ্টিতে যেন হতদরিদ্র মানুষগুলোও বিশ্রাম নিচ্ছে। গা ঘেষে হাটছে দুটো মানবমানবী। পৃথুলের হাতে ছাতিটি। আরশিয়ার চোখজোড়া রিক্সার তল্লাশে শুধু এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দৃষ্টি ঘোরাচ্ছে। দুজনের মাঝে কোনো কথা নেই, শুধু নিস্তব্ধতা। যা তাকে আরো ক্লান্ত করে দিচ্ছে। ভেবেছিল পৃথুল হয় উত্তর দিতে এসেছে। কিন্তু এমন কিছুই হল না। সে শুধু জড়, স্থির পদার্থের মত ছাতি ধরে তাকে দেখছে। আরশিয়ার ধৈর্যচ্যুত হয়ে বলল,
“পাশে কেউ থেকেও যদি নির্বাক থাকতে হয় তবে ঘুমিয়ে থাকাই শ্রেয়।”
“আমি মানুষটা বক্তা হিসেবে ভালো নই।”
পৃথুলের তৎক্ষণাৎ উত্তরে আরশিয়া মুখ তুলে চাইল। তারপর অবাক কণ্ঠে বলল,
“আপনি নাকি খবর পড়েন? ভালো বক্তা না হলে আপনাকে চাকরি দিল কি দেখে? পরিচিতি নাকি ঘুষ টুষের কারসাজি?”
“আমি উপস্থাপনা ভালো পারি বলেই যে ভালো বক্তা হব এমন কোনো কথা নেই। আর সেখানে তো আমাকে কথা নিজ থেকে বলতে হয় না। সাজানো কাগজ উগড়াতে হয়।”
“আমার জানা মতে আপনাদের তর্ক বিতর্কেও পটু হতে হয়।”
“কিন্তু আপনার আর আমার সম্পর্কটি তো তর্ক বিতর্কের নয়।”
“হলে খুব একটা মন্দ হবে না। অন্তত পানসে ভাবটা কাটবে।”
“ঝগড়া করতে বলছেন?”
“সেই উছিলায় আপনার কণ্ঠ শোনা যাবে। আপনি নিশ্চয়ই জানেন আপনার গাঢ় কণ্ঠ বেশ এরাউসিং।”
“জি, অনেকেই আমার কণ্ঠের প্রশংসা করে। আমি নাকি খুব সুন্দর করে কথা বলি।”
“তা এই অনেকে'টা শুধু রমনী নাকি পুরুষও আছে?”
আরশিয়ার প্রশ্নে হেসে উঠল পৃথুল। কি স্বচ্ছ হাসি। আরশিয়া অনিমেষ নয়নে তাকিয়ে রইল তার দিকে। লোকটি নিঃসন্দেহে সুদর্শন। তার বয়সের ছাপ এখনো মুখশ্রীতে আসেনি। পৃথুল হাসি থামিয়ে বলল,
“মোমেনা আন্টি বলেছিলেন আপনি খুব শান্ত চুপচাপ। কথাটার সত্যতা পাচ্ছি না।”
“চুপচাপ অর্থ বোবা নয়।”
“হার শিকার করলাম। তর্কের কথা যখন বললেনই, তবে বলেই দেই। আমি পেশায় সাংবাদিক নই, সংবাদ উপস্থাপক। তাই সাংবাদিক সম্বোধনটি মানাচ্ছে না।”
“জানি, কিন্তু সংবাদ উপস্থাপকের সাথে চিঠির আবেগটি ঠিক বেমানান লাগছে। সবসময় আপনাকে ডাকতে হলে কি ডাকবো--- “এই সংবাদ উপস্থাপক এখানে আসুন।” ইশ! কি বাজে শুনাচ্ছে। মনে হচ্ছে কোনো যুদ্ধে কমান্ড করা হচ্ছে। এর চেয়ে সাংবাদিক ঢের ভালো।”
আরশিয়ার যুক্তিতে হার শিকার করল পৃথুল। মৃদু হেসে বলল,
“চা খাবেন? বৃষ্টিতে মানায় ভালো।”
“কে খাওয়াচ্ছে?”
“আজ আমি খাওয়ালাম। নতুন সম্পর্কের শুভারম্ভ খালি মুখে করতে নেই।”
কথাটা শুনতেই আরশিয়ার হৃদয় থমকে গেল। হৃদস্পন্দন বেসামাল হল মুহূর্তেই। কাঙ্খিত কথাখানা অনাকাঙ্খিত সময়ে শোনার এই হল কুফল। অজান্তেই আঠাশ বছরের নারীকে অষ্টাদশীতে নামিয়ে দেয়। আবেগ তো জাগতিক দুনিয়ার বয়সের হিসেব বুঝে না__________
*********
শুক্রবার, চাঞ্চল্যময় জীবনের অঘোষিত বিরাম। পৃথুলদের বাড়িতে অবশ্য বিরামের বালাই নেই। সকলের মাঝে আমেজ। খাওয়া দাওয়া, রান্নার মাঝে নাভিঃশ্বাস উঠে যাবার যোগাড়। অবশেষে সকল কাজের সুষ্ঠ সম্পাদন শেষে নিজ ঘরে গেল আরশিয়া। শাড়ি পড়ার মত তলোয়ার ঝুলিয়ে দিয়েছেন সুমী বেগম। তাও কাতান শাড়ি। শাড়িটির ভার দেখেই শুকনো ঢোক গিলল আরশিয়া। কিন্তু কিছুই করার নেই। পড়তেই হবে। অবশেষে শাড়ি পড়ার মত পর্বত জয়ের পর যখন নিজের ভেজা চুল আছড়াতে ব্যস্ত তখনই ঘরে আগমণ ঘটল পৃথুলের। কিছু সময় অনিমেষ চোখে আরশিয়ার মুখোপানে চাইলো সে। তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আরশিয়া অপেক্ষা করছিল কিছু একটা হয়ত পৃথুল বলবে। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটল না। বরং তার পাঞ্জাবিটি নিয়েই ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। আরশিয়া অবশ্য এতে কিঞ্চিত স্বস্তিও পেল। খামোখা লজ্জায় মিশে যাওয়া থেকে খা খা হৃদয় থাকা ভালো। অবশ্য তাকে কি একেবারেই ভালো লাগছে না? এক দফা আয়নায় নিজেকে দেখল সে। তারপর লম্বা সাঁপের ন্যায় চুলগুলো খোপায় বাধল। তত সময়ে কলিং বেল বেজে গেছে। অর্থাৎ সং এর মত দাঁড়িয়ে অতিথি অ্যাপ্পায়ন শুরু।
ঘরে লোকারন্যে একাকার হাল। ছোট করে অনুষ্ঠানটি এত বিকট হবে জানা ছিল না। পৃথুলদের আত্নীয়দের অভাব নেই। কাচ্চাবাচ্চা সবাই হাজির। ইতোমধ্যে মোতালেব সাহেব রাও চলে এলেন। আরশিয়ার চোখজোড়া খুঁজছিল বাবাকে। পাঁচ দিন হয়ে গেছে বাবার কণ্ঠ শুনে না। কিন্তু হতাশা ছাড়া কিছুই মিলল না। হাসান সাহেব আসেননি। আত্নিকা এবং আনহা বোনকে পেয়েই জড়িয়ে ধরল। সকলের থেকে আড়ালে তাদের নিজ ঘরে নিয়ে গেল আরশিয়া। বোনেরা কথার ঝুলি খুলে বসল। আরশিয়া সুবোধ শ্রোতার মত শুনতে লাগল। কথায় কথায় সে বলে উঠল,
“বাবা আসলো না যে?”
“আরে বাবার আর বড় মামার ফাটাফাটি হয়েছে।”
আনহান বেলাগাম কথায় তাজ্জব হল আরশিয়া। অবাক কণ্ঠে বলল,
“ফাটাফাটি কেন?”
“আরে মামা তো জানত পৃথুল ভাইয়ের বিয়ের কথা…………
.
.
.
চলবে............................................