প্রিয়াঞ্জনা - পর্ব ২৪ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প


চাতক পাখি হা করে আকাশপানে চেয়ে থাকে। আর্তনাদ করে এক ফোঁটা বৃষ্টির জন্য। অনেক সময় দেখা যায়, বৃষ্টির মৌসুম ছাড়াই শীতকালে অথবা অসময়ে আকাশে কোনোরকম মেঘ, আন্ধার ছাড়াই হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি নামে। এরকম হঠাৎ বৃষ্টি হলে গ্রামের মুরুব্বীরা বলেন, চাতক পাখির আর্তনাদ আর প্রার্থনায় মিকাইল ফেরেশতা বৃষ্টি দিতে বাধ্য হয়েছেন। সেই বিশ্বাস থেকেই আগের দিনে গ্রামবাংলায় চৈত্র-বৈশাখে অনাবৃষ্টি আর খরা দেখা দিলে, খড়কুটো দিয়ে প্রতীকী চাতক পাখি বা চাতকমূর্তি বানিয়ে; সেটিকে খোলা মাঠে আকাশের দিকে অনেক উঁচু করে রাখা হতো। যাই হোক সে এক ভিন্ন প্রসঙ্গ। তবে চাতক পাখি বৃষ্টি পেলে কতটা আনন্দিত হয় সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। মানব মনও অনেকসময় চাতক পাখির ন্যায় হয়ে উঠে। নির্দিষ্ট একটি জিনিস পাওয়ার জন্য দিনের পর দিন আল্লাহর কাছে আকুল আবেদন করে। তারপর একদিন চাতক পাখির বৃষ্টির মতোই পেয়ে যায় সে জিনিস। মুখ ফুটে কখনো বলেনি কিন্তু একটি সন্তান শাহবাজের নিকট সেই চাতক পাখির বৃষ্টির মতোই। পুরুষ মানুষের পুরুষত্বে সবচেয়ে বেশি আ ঘা ত লাগে তখন, যখন তাকে মানুষ বাঁঝা হিসেবে অপবাদ দেয়। অপবাদ দিয়ে বলে, 'তুমি বাচ্চা দিতে অক্ষম। তুমি বাঁঝা।'
ভরা মজলিসে যখন প্রিয়াঞ্জনার মা তাকে এই অপবাদ দিয়েছিলো আত্মসম্মানে বড্ড লেগেছিলো তার। সূর্য ডুবে যাওয়ার পর মুহূর্তে প্রিয়াঞ্জনা যখন বললো,'আপনি বোধহয় বাবা হতে চলেছেন শাহ্।' সেই হতে ঠাটা পড়া মানুষের ন্যায় বসে আছে শাহবাজ। প্রিয়াঞ্জনা তার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গিয়েছে। বারবার জিজ্ঞেস করছিলো,'আপনি খুশি হননি তাই না শাহ্?'
শাহবাজ কোনো জবাব দেয়নি। একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে তার পাগলিনী। অন্ধকার হয়ে আসছে চতুর্দিকে। মাগরিবের আজান দিয়ে দিয়েছে কিছুক্ষণ পূর্বে। মসজিদে যেতে হবে। শুকরিয়া আদায় করতে হবে। তবে ছোট বাচ্চার মতো ঘুমিয়ে থাকা আদরিণীকে জাগানোর ইচ্ছে তার হচ্ছেনা। আলতো করে কোলে তুলে নেয় তাকে। মেয়েটা কিছুই খায় না। একদম শোলার মতো পাতলা যেন! তীব্র আবেগে শাহ্ একখানা ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয় প্রিয়াঞ্জনার কপালে। পা বাড়ায় বাড়ির পথে। নিজের ঘরের বারান্দায় বসেছিলো নাদিয়া। নিচতলায় ঘর হলেও প্রশস্ত বারান্দা আছে এই বাড়িতে। সন্ধ্যে নাস্তা আর চা নিয়ে বসেছিলো সে বারান্দায়। গেট খোলার শব্দে সেদিকে তাকায়। হলদে টিমটিমে লাইটের আলোয় নিজের প্রিয় মানুষটার কোলে প্রিয় মানুষের প্রিয় মানুষ। কি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে! নাদিয়া এক পলক তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। এ যাতনা সহ্য করা দায়। কেন সে ভুল মানুষটাকে মন দিলো? জ্বলে যাচ্ছে অন্তর। নাদিয়া তীব্র আক্রোশে ঘরে ছুটে যায়। বারান্দার দরজা লাগায় উচ্চ শব্দে। নিরবতায় সে শব্দ বিকট শোনায়। শাহবাজ অবাক হয়। শব্দের উৎস ধরতে পারেনা অবশ্য। প্রিয়াঞ্জনা গভীর ঘুমে। ঘুম ভাঙেনি তার। নিজেদের 'চন্দ্রবিলাস' নামক স্বপ্নের কুঠিরে প্রবেশ করে শাহ্। অতি যত্নে অর্ধাঙ্গীকে শুইয়ে দেয় খাটে। উঠতে নিলে দেখে বুকের কাছটায় সফেদ শার্টটা আঁকড়ে ধরে আছে তার প্রিয়াঞ্জনা। ছাড়িয়ে নেয় সে। টুপি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে মসজিদের উদ্দেশ্যে। আজ অনেক খুশি শাহ্। অনেক বেশি খুশি। 

কেউ ভাসে পদ্মজলে
কেউ পু ড়ে অঙ্গারে 

জ্বলন্ত অঙ্গারে পু ড় লে কেমন য ন্ত্র ণা হয় প্রাপ্তি জানেনা। তবে সে যেরকম জীবন অতিবাহিত করছে তা হয়তো সেই য ন্ত্রণার চাইতেও অধিক। একটু আগেই চা ভালো হয়নি বলে তার হাতে গরম চা ঢেলেছে ফাহিম। প্রাপ্তি বারান্দায় উদাসী হয়ে বসে আছে। এই বারান্দায় বসলে শহরের অনেকটুকু দেখা যায়। অন্ধকারে ঢেকে গেছে শহর। জ্বলজ্বল করে জ্বলছে বাতি। প্রাপ্তি দেখতো তার ভাই প্রীতম এই কাজ করতো। সুমনা ভাবী কতটা করতো তাদের পরিবারের জন্য! প্রাপ্তির মাঝেমধ্যে মনে হতো সুমনা তার ভাবী না। সুমনা তাদের বাড়ির কাজের মহিলা। প্রীতম ভাইয়ের এত লাঞ্ছনা সয়েও পড়ে থাকতো তাদের বাসায়। প্রাপ্তি কখনো প্রতিবাদ করেনি। প্রীতি করতো আর প্রিয়া আপা করতো। সে দেখেও না দেখার ভান করতো। এমন কতদিন গিয়েছে ভাবীর বিরুদ্ধে ভাইকে উস্কে দিতো সে। আর ভাই মা র তো সুমনা ভাবীকে। এমন করতো প্রাপ্তি মায়ের কথায়। এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। এই পৃথিবীতে কেউই অপরকে কষ্ট দিয়ে নিজে ভালো থাকতে পারেনা। ভুক্তে হয় তাকে। চরম মূল্য দিতে হয়। ফুপিমা ডাকতো প্রাপ্তি। বছরে একবার হয়তো প্রাপ্তিদের বাসায় যেতেন। কত আদর করতেন! এই একটা মাস সেই ফুপিমারই অন্য রূপ দেখেছে প্রাপ্তি। একজন মানুষের এত রূপ থাকতে পারে? পান থেকে চুন খসলেও প্রাপ্তিকে সেটার চরম মূল্য দিতে হয়। সেই ভয়াবহ রাতের পর প্রতিটি রাতই এমন কেটেছে তার। মাকে বলার চেষ্টা করেছিলো। মা এক ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়েছে তাকে। স্বামী-স্ত্রীর গোপন কথা অপরকে জানানো উচিত নয়। মা কঠোর ভাবে তাকে একথা বলে দিয়েছেন। সে লাজলজ্জার মাথা খেয়ে অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বলেছিলো,
"মা, আমি অনেক ব্যথা পেয়েছি। উনি আমার সাথে খুবই জঘন্য আচরণ করেছেন। তুমি প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করো আমাকে।"
"চুপ, বেয়াদব মেয়ে। আরেকবার এসব কথা মুখ দিয়ে বের করলে খবর আছে তোমার। প্রথমবারে এমন হয়ই।"

আর একটা কথাও মাকে বলেনি প্রাপ্তি। এতটা অসহায় লাগে নিজেকে! চারদিন পর ফাহিম এবং তার মা আমেরিকা চলে যাবেন। প্রাপ্তি থাকবে তার বাবা বাড়ি। যাওয়ার কিছুদিন পর প্রাপ্তিকে আমেরিকা নেওয়া হবে প্রথমে। পরে নেওয়া হবে প্রীতম কে। ড্রয়িং রুমে বসে হেসে হেসে এমনই প্রীতমকে বলেছিলো ফাহিম। 
"প্রাপ্তি, বারান্দায় তুমি?"

চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়ায় প্রাপ্তি। ডাকার সাথে সাথে সামনে না গেলে শাস্তি পেতে হবে তাকে। 
"জ্বি, বলুন।"

ওয়ারড্রব থেকে লাল শাড়ি বের করে ফাহিম। প্রাপ্তির সামনে এনে তার হাতে দেয়। মুখে বলে,
"আমার দুজন বন্ধু আসবে কিছুক্ষণ পর। আমাকে যেভাবে খুশি করো তাদেরও সেভাবে খুশি করবে।"

প্রাপ্তি ছোট মানুষ। জটিল কথা বুঝতে বেশ সময় লাগে তার। শুধায়, 
"মানে?"

অমনি গালে শক্ত করে চেপে ধরে ফাহিম। হুংকার ছেড়ে বলে,
"ঢং করিস! বুঝিস না? শুতে হবে তাদের সাথে। ওরা আমার ভালো বন্ধু বুঝেছিস?"
প্রাপ্তি অবাক হয়। হতবাক হয়। যাতনা জড়ানো কন্ঠে বলে,
"আমি পারবোনা।"

এবারে গালে দানবীয় চড় পড়ে। ফাহিম চিৎকার করে বলে, 
"তোর ভাইয়ের কাছ থেকে তোকে আমি টাকা দিয়ে কিনেছি। তোর ভাই তোকে বিক্রি করে দিয়েছে আমার কাছে। জুয়া খেলে শু*রের বাচ্চা। তোর 
হা রা মী ভাই টাকা আর বিদেশ যাওয়ার লোভ সামলাতে পারেনি। আমি যা বলবো তাই তোকে করতে হবে।"

নিজের ভাইয়ের নামে এমনসব কথা শুনে বিস্ময়ে ফাহিমের পানে তাকিয়ে থাকে প্রাপ্তি। 
.
.
.
চলবে..........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন