খুব সভ্য ভদ্র একদল লম্বাচওড়া পুরুষদের উপস্থিতি ঘটল ইফতারির আগ-মুহুর্তে। তাদের মধ্যে থাকা একমাত্র শুহানি নামের নারীকে দেখাল জেরির মতো। ছোটোখাটো পুচকে। অথচ শুহানি লম্বায় পাঁচফুট ছয়! হাত তাদের একেকজনের ফাঁকা, কিচ্ছুটি নেই। খালি হাতে একেকজন নিঃশব্দে প্রবেশ করছে। এর অবশ্য কারণ রয়েছে বড়সড়। সেবার একগাদা জিনিসপত্র নিয়ে এসেছিল! এবারও যদি তা করে, শান্তশিষ্ট তন্ময় যুদ্ধের ঘোষণা দেবে। সেই যুদ্ধে জ্বলেপুড়ে ছারখার হওয়া ছাড়া করার কিছু থাকবে না। তন্ময় তাদের শান্তশিষ্ট বন্ধু হলেও, ভীষণ ভয়ানক যখন সে সত্যিকার অর্থে রাগে। এতবছরের বন্ধুত্বের ফজিলত হচ্ছে, ছেলেটাকে আগাগোড়া জেনে নেয়া। দুয়ারের সামনে থেকে সবাই ভদ্রতা বজায় রেখে, স্পষ্ট শব্দে সালাম ছুড়ল রান্নাঘরের কাজে ব্যস্ত থাকা জবেদা বেগমের পানে। এরপররপরই আসল চেহারা বেরোলো ভদ্রসভ্য পুরুষ গুলোর।বুড়ো বয়সে এরা জুতোজোড়া আগেফাগে খুলে, চটজলদি বাড়িতে ঢোকার একরকম যুদ্ধ করছে। ঠিক অনেকটা ভার্সিটির অডিটোরিয়ামে সর্বপ্রথম উপস্তিত হবার প্রতিযোগিতার মতো। শুহানি মেয়ে মানুষ বিধায় রক্ষা পেল। আরামসে জুতোজোড়া খুলে প্রথমেই বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে। অলস মুখে ফিরে চেয়ে দেখে এই দামড়া ছেলেদের, অদারুণ দৃশ্যটি।
রুপালী সহ শাহজাহান বাড়ির গার্ডেন কেয়ারটেকার করা ফজিলাতুন্নেছা এবং ড্রাইভার রফিক মিঁয়া উপস্থিত আছেন ফ্ল্যাটের লিভিংরুমে।
তারা তিনজন ভীষণ ব্যস্ত খাবার ভর্তি বড়ো বড়ো বোউল ট্রান্সফার করতে। জবেদা বেগমের হাতের তৈরি ইফতারি সহ হরেকরকমের রান্নাবান্না একেএকে বিল্ডিংয়ের পার্কিং এরিয়ায় রাখা গাড়িতে তোলা হচ্ছে। ঘ্রাণে লিভিং রুমের চারদিকে ম-ম করছে। টিকতে না পেরে মাহিন সহ বাকিগুলো হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়েছে তন্ময়ের রুমে। সেখানেও রক্ষা নেই এই ঘ্রাণ থেকে। পেটের ভেতর থেকে ডাক শোনা গেল। মাহিন হাউমাউ করে উঠল। ক্ষুধা লাগছে এই বিষয়টা মস্তিষ্কে আসতে না দেবার যুদ্ধ নিজের সঙ্গে চালাচ্ছে।
হাত ঘড়িতে নজর দেয়া শেষ শতবার। রিয়ান বিছানায় শুয়ে আছে মুখে বালিশ গুঁজে। সৈয়দ ভালো ছেলের মতো বসে। মুখজুড়ে অসহায়ত্ব লেপ্টে। ইব্রাহিম ফোন টিপছে মনোযোগ সরাতে। তন্ময় সেসময় বেরোলো বাথরুম থেকে। অফিস থেকে সে এসেছে আধঘন্টা আগে। এসেই টুকটাক কেনাকাটা করতে নিচে নেমেছিল। সেগুলো মায়ের হাতে ধরিয়ে গোসল নিয়ে বেরোলো সবেমাত্র। বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে, দৃষ্টি ফেলল দেয়াল ঘড়িতে। পাঁচটা ত্রিশ মাত্র। আজ ইফতারির সময় ছ'টা বারোতে। আধঘন্টার মতো সময় আছে। মাথা মুছে তন্ময় রুম থেকে বেরোয়। খাবারদাবার নেয়া কমপ্লিট। ইতোমধ্যে জবেদা বেগম ডাইনিং সাজাচ্ছেন। তন্ময়কে দেখতে পেতেই তিনি শুধালেন,
'শোন না বাবা! তিন রকমের শরবত করেছি। লেমন, ম্যাঙ্গো আর অরেঞ্জ। আর কিছু করা লাগবে? ওদের কার কোন ফ্লেভারের শরবত পছন্দ জিজ্ঞেস করতেই ত ভুলে গিয়েছিলাম!'
তন্ময়ের জবাব দিতে হলো না। রুম থেকে বেরিয়ে আসা মাহিন দাঁত দেখিয়ে বলল,
'আন্টি আপনার হাতের সাধারণ পানিও অমৃত। তাই এসব চিন্তাভাবনা বাদ! যা দিবেন তাই পেটে ঢুকে যাবে। আর এভাবেও আমার লজ্জাশরম কম। সবই খাব।
জবেদা বেগম হাসলেন। বিড়বিড়িয়ে বললেন, 'পাগল ছেলে!'
আজান দিতে তখনও দশমিনিট বাকি। ইতোমধ্যে চেয়ার জুড়ে সবাই বসে। আজানের অপেক্ষায়। টেবিলে সবরকম ফলফলাদি সাজানো। ঠান্ডা ঠান্ডা তিনরকমের শরবত। ইফতারি মাখাতে শুরু করেছে তন্ময়।
দেখা গেল খাবার খাওয়ার পূর্বে পানি খেয়েই পেট ফুলিয়ে ফেলেছে একেকজন। পর্যাপ্ত খেয়ে, একটু রেস্ট নিয়ে তন্ময় বন্ধুবান্ধব নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। মসজিদে নামাজ পড়ে, ওরা হাইওয়েতে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে। গাড়িটা থেমেছে হাইওয়ের শেষের চায়ের স্টলের সামনে। সবগুলো একসঙ্গে বেরিয়েছে। চা-য়ের সঙ্গে সিগারেট। তন্ময় চা-টা শেষ করে একটা সিগারেট ধরিয়েছে। জ্বলন্ত সিগারেটে কয়েক টান দিতেই সেলফোন বেজে ওঠে। অরুর মুখশ্রী স্ক্রিনে। কল দিচ্ছে! এই অবুঝ মেয়ে অকারণে কল দেওয়ার সাহস করে না। তন্ময় হুটহাট ধমক দেয় বিধায় হয়তো! কোনো কারণে দিয়েছে বোধহয়। তন্ময় রিসিভ করছে না। চোখের সামনেই উচ্চগলায় মাহিন আর রিহান এইটিন প্লাস ভাষায় তর্কাতর্কি করছে। মাহিন তর্কের মাঝেও তন্ময়ের রিংটোন শুনেছে। সঙ্গে সঙ্গে হ্যাংলামি শুরু করে,
'অরু নাকি? কল ধর, ধর না। বন্ধুবান্ধবদের ওপর একটুও বিশ্বাস নেই তোর। এমন অল্পবিশ্বাসে আমরা ভবিষ্যৎ পাড়ি দিব কীভাবে, হ্যাঁ? জানিস কতদূর যাওয়ার আছে আমাদের? ধর কলটা। একদম চুপ থাকব। বিশ্বাস রাখ!'
তন্ময় ফোন বের করল পকেট থেকে। মাহিনের চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে ওঠে। পরমুহূর্তেই ওর চোখের সামনে তন্ময় ফোন খানা সাইলেন্ট করে পুনরায় পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল। মাহিনের উজ্জ্বল চোখের চাহনি নিভে গেল। নাক কুঁচকে বিড়বিড় করল, 'বিশ্বাস ছাড়া বন্ধুত্বের দাম আছে? আজকাল সত্যিকারের বন্ধুত্বের বড়োই অভাব!'
বাড়ির নিচে এসে তন্ময় কল ব্যাক করল। অরু যেন ফোন নিয়েই বসেছে। এক রিংটোন হতেই কল রিসিভ করেছে, 'হ্যালো।'
তন্ময় কাঁধে চেপে ফোন কানে গুঁজে দু'হাতে সিগারেট জ্বালায়। বাসায় ফিরে আর খাওয়া সম্ভব না। সে সচরাচর পরিবারের সামনে সিগারেট খায়না। তাও দিনে দু-একটা। সিগারেটে প্রথম টান মেরে অস্পষ্ট স্বরে শুধায়, 'হু?'
অরুর গলার স্বর ছোটো। অনেকটা ফিসফিসিয়ে বলা! যেন লুকিয়ে-চুরিয়ে কথা বলছে, 'আজ আসতে পারিনি পড়তে।'
আনোয়ার সাহেব সন্ধ্যার আগেই কল করে বলেছিলেন বিষয়টা। তখন অরুর চাপা কন্ঠ ও সে শুনেছে। বারবার বলছিল, 'না আমি যাব পড়তে! কেন না করছ!'
পরপরই মোস্তফা সাহেবের গম্ভীর কন্ঠে চুপ করেছিল মেয়েট। সেসব মনে করেই তন্ময় নিঃশব্দে হাসে। মুখে বলে, 'আচ্ছা।'
'আমি কিন্তু আসতে চেয়েছিলাম।'
'হুম..কেন আসিসনি তাহলে?'
'চাচ্চু বলল আজ থাক। তারপর কিছু কী আর বলা যায়? আমিতো বড়দের খুব শ্রদ্ধা করি। তাদের মুখের ওপর একটা কথাও বলিনা।'
তন্ময়ের ঠোঁটের হাসি দীর্ঘ হয়। চোখে একরাশ স্নেহ, 'হ্যাঁ।'
'জানেন আজ কী হয়েছে তন্ময় ভাই?'
'কি!'
'রোহান স্যারের ইংলিশ ক্লাসের টেস্ট এক্সামে আমার হাইস্কর। স্যার আমাকে একটা পেন দিয়েছেন। আ বিউটিফুল পেন। সাথে অ্যাও বলেছেন আমি খুব লক্ষি মেয়ে। সব পারি কি-না! আমাকে যে বিয়ে করবে সে খুব ভাগ্যবান হবে।'
তন্ময় সিগারেট মুখে কেশে ওঠে। কালো ধোঁয়া উড়িয়ে আহ্লাদী ভঙ্গিতে মাথা দোলায়। দুষ্টুমি মাথায় চাপতেই সে গম্ভীর স্বরে বলে, 'ভুল বলেনি। ঠিকই বলেছে। আমাদের বাড়ির মেয়ে তো আমরা যারতার হাতে তুলে দিব না। ভাগ্যবান কারো হাতেই তুলে দিব।'
অরু কিছুক্ষণ হাসফাস করে কল কেটে দিল। তন্ময় এবার শব্দ করে হেসে ওঠে। ম্যাসেজ রিংটোন বাজতেই স্ক্রিনে তাকায়। অরুর ম্যাসেজ, 'আমি যাকেতাকে বিয়ে করব না। মোটেও না। আমি কাউকেই বিয়ে করব না।'
তন্ময় ধীরেসুস্থে সিগারেট টানে। অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে সামনের রংবেরঙের গাছটার পানে তাকিয়ে রয়। অবুঝ প্রেয়সী,
'দিনরাত বুকের ভেতরটা ক্ষতবিক্ষত করে, আলগোছে মলম লাগায়, অথচ দিনশেষে কিছুই বোঝানা, কিছুই জানেনা।'
____
পরদিন সন্ধ্যার খুব আগেই বাচ্চারা সব হাজির। অরু, দীপ্ত, আকাশ এবং রুবি ঢুকতেই শান্তশিষ্ট ফ্ল্যাট উজ্জ্বল হয়ে উঠল। চেঁচামেচি করে মাথায় তুলেছে সব। তাদের পাশের বাড়ির অয়নকেও বাচ্চাদের পেছনে দাঁড়ানো দেখা গেল। ছেলেটাকে জবেদা বেগম দাওয়াত করে নিয়ে এসেছেন। আজ সকালে বাজারে হাঁটাহাঁটি করার সময় দেখা হয় দুজনের। ভদ্র সভ্য ছেলেটা বাজারের ব্যাগ বয়ে নিয়ে এসেছে অনেকটা রাস্তা। তাই সে দাওয়াত দিয়ে এসেছে আজ আসবার। জবেদা বেগম ব্যস্ত নয়নে দুয়ারের পানে তাকিয়ে। শাবিহা কী আসেনি? মেয়েটাকে দেখার জন্য নয়ন জোড়া প্রত্যাশায়। তিনি ভাবলেন হয়তো আসেনি। সে-মুহুর্তেই শাবিহাকে গোমড়া মুখে ঢুকতে দেখা গেল। জবেদা বেগম চেষ্টা করলেন চোখের জল লুকোনোর। অথচ মেয়ের চোখের সঙ্গে চোখ মিলতেই কেঁদে ফেললেন। শান্ত নেই শাবিহাও। মায়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে কেঁদে ওঠে। তাদের কান্নাকাটি দেখার ফুরসত আসলে অরু আর দীপ্তর নেই। দুজন ঘ্রাণ শুঁকতে শুঁকতে রান্নাঘরে ঢুকেছে।
মায়ের কথামতো তন্ময় ফোন করে চাচ্চুকে জানালো, আজ সবাই এখানেই থাকবে। আনোয়ার সাহেব সম্মতি দিয়েছেন। অবশ্য সে তার বাবার গম্ভীর স্বরে বলা, 'সব বাচ্চারা ওখানে থাকলে ঘরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগবে না!' শুনেছে। মানুষটা তাদের কতটা মিস করছে তা তার হাবভাবেই স্পষ্ট। কথাবার্তা শেষ করে লিভিংরুমের সোফায় বসে। অয়ন আর আকাশ পাশেই। তিনজন তারা ক্রিকেট দেখছে। দীপ্ত বসেছে তন্ময়ের কোলে। হাতে তার তন্ময়ের ফোন। সাবওয়েসার্ফ খেলছে সে। তার ঝাকড়া চুলগুলো তন্ময়ের থুতনিতে ঠেকে। মুখ বন্ধ নেই। বাড়িতে ঘটে যাওয়া সবকিছুই বলছে। একপর্যায়ে বলা শুরু করল অরুকে নিয়ে,
'আপু তো সেই সকাল থেকে পাগলের মতো সারাবাড়ি ঘুরছিল। ঢাকঢোল পিটিয়ে তাড়া দিয়েছে আমাদের। তারজন্যই বিকেল বিকেল চলে এসেছি। আসার কথা ছিল তো সন্ধ্যায়। অরু আপু আমার মাথার ঝুটি-টাও করতে দিল না। জুতো পড়তে নিয়েছিলাম, বলে সেগুলো পড়লে লেট হয়ে যাবে স্যান্ডেল পরতে। বইগুলোও আনতে দেয়নি। হোমওয়ার্ক ও করা হয়নি। ভাগ্যিস কাল ওফ ডে!'
টেলিভিশনে চোখ থাকলেও কান দীপ্তর প্যাচাল শুনতে ব্যস্ত। তন্ময় মন দিয়ে সবটাই শুনল। এবং আরেকটা জিনিস খেয়াল করল। অয়নের দৃষ্টি। উম… বারবার ও শাবিহার দিক তাকাচ্ছে না? বিষয়টা সে ঠিকঠাক বুঝতে পারল, ইফতারির সময়। ছেলেটা অগোচরে লুকিয়ে শাবিহার মুখের দিক তাকায়, আবার চোখ ফেরায়। পবিত্র দৃষ্টি। ছেলেমানুষের পছন্দের সীমানা আকাশ ছোঁয়া। তাদের মনে কখন কে ঢুকে পড়ে বোঝা মুশকিল। অয়নকে সে ছোটো থেকে চেনে। ভীষণ ভদ্র ছেলে। কোনো খারাপ রেকর্ড নেই। তাই আর সে তেমন মাথা ঘামাল না।
অনেকদিন পর সবাই একসাথে হয়েছে। তাই একসঙ্গে অনেক সময় কাটাবে এটাই শাবিহার উক্তি। আড্ডা দিবে, মজা করবে। সেই সুত্র ধরে আটটার পর একজোট হয়েছে সকলে। লিভিং রুমের কার্পেটে গোল হয়ে বসেছে। তাদের মধ্যে একটি পানি ভর্তি ওয়াটার বোতল। এই বোতলটা ঘোরানো হবে। যার দিক বোতল ইশারা করবে তাকে দুটো ওপশন দেওয়া হবে। ট্রুথ নাকি ডেয়ার? ট্রুথ নিলে যা প্রশ্ন করা হবে তার সত্য জবাব দিতে হবে। আর ডেয়ার নিলে সাহসের পরিচয় দিতে হবে। অর্থাৎ যা বলা হবে করতে হবে।
.
.
.
চলবে............................