শাহজাহান তন্ময় - পর্ব ১৭ - নাবিলা ইষ্ক - ধারাবাহিক গল্প


ভাইবোনদের মধ্যে তন্ময় সকলের বড়ো এবং শ্রদ্ধেয় ব্যাক্তি। তাকে নিয়ে রংতামাশা করাটা কঠিন ব্যাপার বটে। উটকো কিংবা অযথার্থ প্রশ্ন, ডেয়ার দেয়ার কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারছে না। মনেপ্রাণে ভয় পায় কি-না! সেক্ষেত্রে যখন বারবার বোতলের মুখ ওর দিক থামছে, সবাইকে বিশেষ ভাবে চিন্তাভাবনা করতে হচ্ছে। অরু পিনপিনে গলায় শুধায়, 

'এবার আমি ধরি?'

আকাশ কপাল কুঁচকে বলে ওঠে, 

'তুই ভেস্তে দিবি সব। আমি একটা দারুণ ডেয়ার দিব তন্ময়কে, যদি ও ডেয়ার নেয়।'
'কিন্তু! আমিতো একবারও ধরার চান্স পেলাম না ভাইয়া।'

অরুর গলায় একরাশ অভিমান। শাবিহা আড়চোখে নিজের ভাইয়ের দিক চায়। তন্ময় ও অভিমানী অরুর পানে চেয়ে। নিশ্চয়ই সে ও চাচ্ছে অরু প্রশ্ন করুক? ভাইয়ের মন রাখতে শাবিহা আকাশের পিঠে চড় মেরে বলে, 

'ভাইয়া তুমি চুপ করো। এবার আমাদের অরু রানী ধরবে। ধর ধর!'

অরুর মুখশ্রী উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। খুশিতে গদগদকণ্ঠ কন্ঠে বলে, 

'ধরছি তাহলে হ্যাঁ! তন্ময় ভাই আপনি রেডি?'

 রুবি শব্দ করে হেসে বলে, 'ভাইয়া কী ফুটবল খেলতে যাবে যে তৈরি হতে হবে? তুই ধর।'

অরুর খুশিতে ব্যাঘাত ঘটল না। মনের মধ্যে আকাশকুসুম চিন্তাভাবনা আর চোখমুখে প্রত্যাশা নিয়ে শুধায়, 'ট্রুথ নাকি ডেয়ার?'

তন্ময় কিছুটা আগ্রহী বটে। অবশ্য মনেপ্রাণে সে জানে অরু কেমন প্রশ্ন করতে পারে! তবুও বিশেষ ভাবল না। বোকা অরুর গদগদকণ্ঠের জবাবে বলে, 'ট্রুথ!'

অরুকে নড়েচড়ে বসতে দেখা গেল। চোখের মণিতে তারার মেলা হচ্ছে। সে চাচ্ছিল যেন তন্ময় ট্রুথ নেক। উত্তেজিত গলায় প্রশ্ন করে, 

'আপনার মনের মানুষ আছে? থাকলে কে সে?'

নিস্তব্ধতা বয়ে গেল চমৎকার ভঙ্গিতে। শ্বাসপ্রশ্বাস আটকে সবাই তন্ময়ের জবাবের অপেক্ষায়। এই প্রশ্নটি আকাশ ও করার সাহস পায়নি। যদি খেলার পর তন্ময় তাকে চিপা মাইর দেয়? কিন্তু অরুর সাহস আছে। এই মেয়ে বোকা হলেও মাঝেমধ্যে খুব কাজের। সবাই যখন বিশেষ নজরে একবুক প্রত্যাশা নিয়ে আছে সে-মুহুর্তে তাদের প্রত্যাশায় পানি ঢেলে তন্ময় ছোটো কাপটায় থাকা কড়লার রস ঢকঢক করে খেয়ে ফেলে। যার মানে সে এই প্রশ্নের জবাব দিবে না। 

যদি আপনি আপনার ডেয়ার বা ট্রুথ কমপ্লিট করতে না পারেন, সেক্ষেত্রে শাস্তি হিসেবে আপনায় কড়লার রস খেতে হবে। 

সবাইকে নিরাশ দেখাল। বিশেষ করে অরুকে। তন্ময় ঠিক খেয়াল করল। সে তো সর্বক্ষণ এই ইতর মেয়েটাকে ঘুরেফিরে দেখে। তবে অরুকে বেশিক্ষণ নিরাশ দেখাল না৷ পরপরই ওঁকে চিন্তিত দেখাল। হৈচৈ ফেলে উঠে দৌড়ে চলে গেল। ফিরে এলো মিষ্টি নিয়ে। মিষ্টি দেখে তন্ময়ের খেয়াল হলো কড়লার রস খেয়ে তার মুখটা তেতো হয়ে আছে। জিহ্বা চলছে না যেন! অরু মিষ্টির প্লেট বাড়িয়ে দিতেই তন্ময় নিল। কাঁটাচামচ দ্বারা একটা মিষ্টি মুখে পুড়ে নিল ঝটপট। জবেদা বেগম ট্রে-তে সকলের জন্য কমলার জুস নিয়ে এসেছে। প্রত্যেকের হাতে কাঁচের গ্লাস ধরিয়ে সে দাঁড়িয়ে রইল। বাচ্চাদের খেলা দেখবে। কতদিন পর সবগুলোকে একসাথে দেখছে। বিশেষ করে তার মেয়েটাকে। 

এবার তন্ময় বোতল ঘোরালো। বোতলের মুখ গিয়ে ঠেকল আকাশের দিক। তন্ময় প্রশ্ন করল, 

'ট্রুথ নাকি ডেয়ার?'

আকাশ ভুলেও ট্রুথ নিবে না। সে সাহসিকতার পরিচয় দেবে। তাই নিঃসংকোচে বলল, 'ডেয়ার!'

তন্ময় নিচের ঠোঁটে দাঁত চেপে হাসে। হাসিটুকু দেখে ঘাবড়ে ওঠে আকাশ। আর্তনাদ করে বলে, 'ভাই! অদ্ভুত কিছু করতে বলিস না! প্লিজ!'

তন্ময় চোখ মেরে বলে, 'মায়ের শাড়িটা পরে একটা ডান্স চাই।'

মুহুর্তে হৈচৈ পড়ে গেল। অরু আর রুবি ছুটেছে জবেদা বেগমের শাড়ি আনতে। শাবিহা ফোন বের করেছে ভিডিও করবে। লিভিংরুমের টিভিতে মুন্নি বাদনাম হুয়ি গানটা প্ল্যা করা হয়েছে। অন্যদিকে গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে আকাশ। চোখমুখে হতাশা। তার বেলায় এতো জঘন্য কূটনৈতিক আচরণ কেন? এ তো অন্যায়!

আজ ওয়েদার আগে থেকেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছিল বৃষ্টি নামবে। সন্ধ্যার খুব করে ঝড়ঝাপটা শুরু হয়েছে। তীব্র বাতাস। একটু আগে বাতাস থেমেছে, গুড়িগুড়ি বৃষ্টি ঝরছে। ওয়েদার খুব ঠান্ডা। ওয়েদার ডিমান্ড দাঁড়াল গরম গরম খিচুড়ি আর ভর্তা। জবেদা বেগম বাচ্চাদের চাহিদা অনুযায়ী রান্না বসিয়েছেন চুলোয়। 

আকাশের নাচ শেষ হতেই পুনরায় গোল করে বসা হলো। এইবার অরু তন্ময়ের পাশে এসে বসেছে। সবার মধ্যে ও কীভাবে ঢুকে গেল বোঝা মুশকিল। তন্ময় স্পষ্ট অনুভব করছে অরুর ছটফটানি। বৃষ্টি হচ্ছে তো তাই এখন ও অনেক খুশি। বৃষ্টি দেখলেই হল, মেয়েটা খুশি৷ খুব পছন্দ করে মেঘলা আকাশ, শীতল বাতাস, তীব্র বর্ষণ৷ তন্ময়কে প্রায়ই ওঁকে নিয়ে বেরোতে হতো বৃষ্টির মধ্যে। রাতবিরেত বায়না ধরত বৃষ্টিতে ঘুরবে। এমন ও হয়েছে রাত দুটো-তিনটের দিক ওঁকে নিয়ে বেরিয়েছে। গাড়ির কাঁচের সঙ্গে লেপ্টে থেকে বাইরের পরিবেশ মুগ্ধ নয়নে দেখেছে। 

চার-পাঁচ রাউন্ড যাওয়ার পর পুনরায় বোতলের মুখ থামল তন্ময়ের সামনে। রুবি এই সুন্দর ওয়েদারে একটি রোমান্টিক বাংলা শুনতে চাচ্ছিল। তাই তন্ময়ের ডেয়ার নেওয়ায় সে তার ইচ্ছেটা বলে ফেলল। শাবিহাও খুব করে রিকোয়েস্ট করল, 

'ভাইয়া প্লিজ একটা গান হয়ে যাক!'

অরুকেও ভীষণ ভাবে আগ্রহী দেখাল। তন্ময় চুপ হয়ে আছে। ছোটো বেলা থেকেই শুনে এসেছে তার গানের গলা খুব ভালো। সেই সুবাধে ক্লাসরুমে তাঁকে প্রায়শই দাঁড়িয়ে বই রিডিং পড়তে হতো, কিংবা পাঠ্যবইয়ের রচনা বলতে হতো। বন্ধুবান্ধবদের সামনেও কয়েকবার গান গাইতে হয়েছে। গিটার হাতে স্কুল-কলেজে গানের প্রোগ্রাম গুলোতেও গেয়েছে। তবে বড়ো হয়ে গান গাওয়াটা পাব্লিক্যালি তার ইতস্তত লাগে। আনইজি একটা ভাইব দেয়। তাই সচরাচর এভয়েড করে। তবে আজ… গাওয়া যায়। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে মাথা দোলায় সে। তৎক্ষণাৎ শান্ত হয় লিভিংরুম। উদ্দীপনায় ঘেরা সবাই। তন্ময়ের রাশভারী গম্ভীর স্বরে গানের টান পড়লে হুসকি শোনায়। খুবই সফট! আর বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে শুনতে আলাদা ভালোলাগা, মাদকতা কাজ করছে। গান শুরু হতেই শাবিহা মুখে হাত চেপে মিটিমিটি হাসতে থাকে। তার মগ্ধ নজর পাশাপাশি বসা অরু-তন্ময়ের পানে। 

~ এই পৃথিবীর যত সুখ, যত ভালোবাসা…. 
সবই যে তোমায় দেব, একটাই আশা… 
তুমই ভুলে যেওনা, আমাকেএএ…. 
আমি ভালো-বাসি তোমাকেএএএ…..~
________

গভীর রাত৷ বৃষ্টি এখনো প্রখর গতিতে বইছে। ঝপঝপ শব্দ চারিপাশ থেকে। হুটহাট মেঘ ডাকছে শব্দ করে। তন্ময়ের সাথে ঘুমোতে এসেছে দীপ্ত, আকাশ আর অয়ন। তিনজনই ঘুমিয়ে পড়েছে। তন্ময়ও নিদ্রায় ছিল। উঠেছে মাত্রই, ওয়াশরুম যাবে বলে। ওয়াশরুম সেড়ে বেরোতেই মনে হলো এক-গ্লাস পানি খাওয়া দরকার। সে লিভিংরুম পেরিয়ে ডাইনিং যাবে সে-সময় শব্দ শুনতে পেল। ঝপঝপ বৃষ্টির শব্দ সঙ্গে গানের গলা। গানের গলা খানা চিনতে ভুল হলো না। সেই তো এই গান গেল রাতে। তন্ময় এগোয় তার মায়ের রুমের দিক। দরজাটা চাপানো। বারবার বলেছিল দরজা লাগিয়ে ঘুমাতে। দরজাটা হালকা মেলতেই অরুকে দেখা গেল। বারান্দার দরজা মেলে বারান্দায় বসে, দু হাঁটু ভাজ করে। ফোনের স্পিকার কানে ধরা। সেখান থেকেই গানটা বাজছে। 'আমি ভালোবাসি তোমাকেএএ' লাইনটার সঙ্গে অরুও বিড়বিড় করে গাইছে। তন্ময় থমকে দাঁড়িয়ে রইল। পলক পড়ল না দীর্ঘক্ষণ। বুকের ভেতর আর্তনাদ৷ মস্তিষ্ক অচলায়তন যেন! কেন এতো সীমারেখা রয়েছে? 
বয়সের ব্যবধান, সম্পর্কের দ্বিধা কেন এতো বিষাক্ত রূপে দাঁড়িয়ে! সে চাইলেও পারছে না জড়িয়ে ধরতে। দীর্ঘ সময় লাগিয়ে ওই মিষ্টি মুখখানা দেখতে। পারছে না জানাতে যে তার মনের মানুষ আছে। আর সে… তার চোখের সামনে বসে। 

______

চোখের পলকে রমজান মাস চলে গেল। আজ চাঁদরাত। এই রাতে কত আনন্দ হয় শাহজাহান বাড়িতে। তবে আজ কেমন স্তব্ধতা! নির্জনতায় ঘেরা চারিপাশ। মোস্তফা সাহেব বসে সোফায়। হাতে চায়ের কাপ। দৃষ্টি ফ্লোরে। সকাল থেকেই মনমরা হয়ে আছেন। দু-ভাই সামান্য চেষ্টা করেছে তার মনমেজাজ ফুরফুরে করার। তবে ব্যর্থ। এই দিন সকালে ছেলে নিয়ে মোস্তফা সাহেব গাড়ি ভর্তি শপিং করেন। ভাই-ছেলে মিলে একইরকম পাজামা-পাঞ্জাবি কিনে আনেন। সেগুলো ঈদের দিন সকালে পরে নামাজে যান। অথচ এবার তিনি তেমন কিছুই করছেন না। চুপচাপ বসে। সন্ধ্যার পরপর এমন সময় বাড়িতে আকাশ ঢুকল। হাতে অনেক গুলো শপিং ব্যাগ। সেগুলো সোফার মধ্যখানের কাঁচের টি- টেবিলে রাখল। হৈচৈ ফেলে সবাইকে ডাকছে। ছুটে এসেছে বাড়ির গুরুজনেরা, বাচ্চারা। আকাশ হেসে বলল, 

'তন্ময় শপিং করেছে সবার জন্য। এইযে আমারটা আমি নিলাম। যার যার নাম লেখা আছে, নিয়ে নাও। আমি একটু ট্রায়াল দিয়ে আসি!'

নিজের ব্যাগটা নিয়ে আকাশ ওপরে উঠে গেল। মোস্তফা সাহেব গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে। ব্যাগগুলোর দিক তাকিয়ে তিনি অভিমান হলেন বটে, 

'টাকাপয়সা নেই! নিজে চলতে পারে না অথচ শপিং করে পাঠিয়েছে!'

মুখে এক বললেও মোস্তফা সাহেবের বিবশ মুখমণ্ডলের চমৎকার পরিবর্তন এল। তিনি সকলের শেষে নিজের ব্যাগটা নিলেন। সোফায় বসে ধীরেসুস্থে খুললেন। পাজামা-পাঞ্জাবি -কোটি সহ দিয়েছে ছেলেটা। বাপ-চাচাদের একই ডিজাইনার পাজামা-পাঞ্জাবি পাঠিয়েছে। দেখা গেল ছেলের কেনা পাজামা-পাঞ্জাবি পেয়ে মোস্তফা সাহেবের মন-মস্তিষ্ক সচল হলো। তিনি উৎসাহ নিয়ে ভাইদের সহ বাড়ির বাচ্চাদের নিয়ে শপিংয়ে বেরোলেন। বাচ্চারা তো রোজার মাস জুড়েই শপিং করে। তবুও তার থেকে আলাদা ভাবে তো তারা প্রাপ্য। আবার ছেলে আর ছেলের মায়ের জন্যও তো তার ঈদের শপিং পাঠাতে হবে!   
অনেক কাজ তার!

_____

বাড়িতে ঈদের সকালটা অন্যরকম হয়। নামাজ শেষ করে আসতেই তন্ময়ের ওপর আক্রমণ হয় সালামির জন্য। তাই চাঁদরাতেই টাকার এমাউন্ট খামে ভরে তৈরি রাখতে হয়। এবার বাসা আলাদা। তবে সে জানে সকাল সকাল সব চলে আসবে। তাই শপিং করার পথেই টাকা উঠিয়ে এনেছে সাথে কিছু খাম। রাতেই ফিল-আপ করে রাখবে। যাতে সকাল সকাল এরা চাইলেই দিয়ে দেওয়া যায়। 

চাঁদ উঠেছে ভীষণ দেরি করে। চাঁদ উঠতেই মসজিদে ঈদের শুভেচ্ছা জানান দিচ্ছে। একের পর এক কল আসছে 'ঈদ মোবারক' জানাতে। অরুর একটা ম্যাসেজ এলো রাত আটটায়। দু'হাতে মেহেদী পরছে এমন একটি ছবি সহ নিচে লেখা ঈদ মোবারক। তন্ময় তখন জবেদা বেগমকে মেহেদী দিয়ে দিচ্ছিল। একহাতে মায়ের মেহেদী পরা হাতের ছবি তুলে পাঠিয়ে সেও লিখে, 'ঈদ মোবারক।' 
.
.
.
চলবে................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন