“এই সমাজ কখন ই পুরুষের দোষ দেখে না। তোমার বয়সও অনেক। উপরন্তু বিয়ে থাকা দোষের কিছু নয়। মনের মিল হয়নি ভেঙে গেছে!”
“তাই বলে একশ দিন মামা?”
“হতেই পারে। এতে এতোটা সন্দিহান হবার কিছুই নেই। এখন তুমি বল কি চাও?”
আরশিয়া মৌন রইল। তার কথাগুলো গলাতেই আটকে গেল। মাঝে মাঝে বড় সন্তান হওয়াটা বরদানের থেকে অভিশাপ বেশি মনে হয়। তা না হলে কি আজ তার গলা দু বোনের খরা ঝুলানো হত? মামা মিনিট দুয়েকের মাঝে আবারো শুধালো,
“বিয়ে টি কি করবে না তুমি?”
“করব, কিন্তু আমার কিছু শর্ত আছে!”
আরশিয়ার ঠাণ্ডা স্বর মোতালেব সাহেবের অহমিকায় আঘাত হানল। তার চোখে মুখে রাজ্যের বিরক্তি। ভাগ্নিটা সর্বদাই ধারালো বাক্যের বানে পরাস্ত করে তাকে। বাপের আশকারাতে এমনটা হয়েছে বলে ধারণা তার। আরশিয়া কখনোই অহেতুক কথা বলে না। খুব সীমিত কথা তার। কিন্তু সেই কথার ধার থাকে প্রচুর। আজও অন্যথা হল না। মোতালেব সাহেব খানিকটা বিরক্তি নিয়ে বললেন,
“কি শর্ত?”
“আমি বিয়েটা করবো ঠিকই। কিন্তু আমি তার সাথে সংসারটা একশত দিনের জন্যই করবো। একশত দিন পর যদি আমার মনে হয় সে মানুষটি ভাল তবে আমি হাসিমুখে তার সাথে সারাটা জীবন কাটাব, কিন্তু এই একশত দিনের মাঝে আমি যদি তাকে মনে ঠাঁই না দিতে পারি তবে আমি সব ছেড়ে ছুড়ে চলে আসব। তখন আমাকে কোনও কথা শুনানোর চেষ্টা করবেন না।”
আরশিয়ার এমন তাজ্জব শর্ত শুনে মোতালেব সাহেব চোখ কপালে তুললেন। ভরাট গলায় বললেন,
“ছেলেখেলা নাকি বিয়ে?”
“সেটা তো আমার ও প্রশ্ন মামা, ছেলেখেলা নাকি বিয়ে? নাকি আমার জীবনটা আপনার কাছে তাসের ঘর মনে হচ্ছে। যদি তাই হয় সেই তাসের ঘরের মালিকটিও আমি। সুতরাং আমার উপর কিছু চাপিয়ে দেবার আগে আমার মতামতটুকু নেওয়া প্রয়োজন। আপনি চাচ্ছেন বিয়েটা হোক। আমিও তাই চাইছি। হোক বিয়েটা। শুধু সেই বিয়েটার পরিণতিটা আমার হাতেই থাকুক।”
“একশত দিন পর যদি তোমার তাকে ভালো না লাগে তখন কি বিয়ে ভেঙে দিবে? লোকে কি বলবে?”
“কেন মামা? আপনার পছন্দ সুপাত্র কি শুধু একশত দিনের জন্যই টেকসই?”
আরশিয়ার পালটা প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলেন মোতালেব সাহেব। ভাগ্নির শর্ত উটকোই নই অবান্তরও বটে। মেয়েটি শোকে মস্তিষ্ক, বুদ্ধি সব জলাঞ্জলি দিল। মোতালেব সাহেবের কণ্ঠ এবার নরম হল, ধীর স্বরে বললেন,
“দেখো, আরশিয়া মা। আমরা সামাজিক জীব। আমাদের কাজ করার পূর্বে লোকের কথা ভাবতে হয়। চিন্তা করতে হয় মানুষ কি ভাববে?”
“মানুষ কি ভাববে সেটা যদি আমরাই ভাবি তবে মানুষ কি ভাববে? আমার কাছে সমাজ টা আমার বাবা এবং দুই বোন। আমি জানি তারা এই সিদ্ধান্তে অমত করবে না। বাকি রইল আপনি আর মামী মা। আপনাদের খোঁচা মারা না শুনলেই আমার সমাজ সুন্দর। বলুন মামা, আপনি শর্তে রাজী?”
মোতালেব সাহেবের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। নরম আবহাওয়ার মাঝেও অস্বস্তি লাগছে। বৃদ্ধের বুক কাঁপছে। তিনি সোফায় বসলেন। কপালে চিন্তার ঢেউ। মেয়েটির অনড়। তার জেদ সকলে জানে। এই জেদের বসেই বিয়েটা দেওয়া এতটা মুশকিল হয়েছে। কোনোমতে তাকে রাজি করানো গেছে এখন মেয়েটি আবারও বেকে বসছে। এটা তো মানা যায় না। তাই বেশ কিছুসময় একাগ্রতার সাথে চিন্তা করলেন। তারপল শীতল কন্ঠে বললেন,
“বেশ আমার আপত্তি নেই। তবে আমারও দুটি শর্ত আছে!”
“বলুন।”
“প্রথমত তুমি এই শর্তের কথাটা তোমার বাবাকে জানাবে না। হাসান এই বিয়েতে রাজী নয়। সুতরাং তোমার শর্ত তাকে বলা যাবে না। শুধু আমাদের মধ্যেই এই শর্তটা থাকবে। আর দ্বিতীয় শর্ত হল, জোরপূর্বক নিজের মনকে কঠোর বানিয়ে রাখা যাবে না। জানি, তোমার মনে অনেক ক্ষোভ জমে আছে। কিন্তু সেই ক্ষোভে প্রভাবে তোমার মন এবং মস্তিষ্ক যেনো পক্ষপাতিত্ব না করে।“
আরশিয়া হাসলো। তার হাসিতে মিশে রয়েছে একরাশ তাচ্ছিল্য। সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তিটি সত্যি তার আপনজন ই তো? সমাজের জং ধরা কাঠামোতে মানুষটার চিন্তাধারাতেও জং ধরেছে। বক্ষস্থলে চাঁপা দীর্ঘশ্বাসটি ফেলে ধীর স্বরে বলল,
“আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন, এই শর্তটি কেউ জানবে না।”
************
অবশেষে একই সুতোয় বাঁধা পড়ল আরশিয়া এবং পৃথুল। সুমী বেগমের মুখে উপচে পড়ছে প্রশান্তির হাসি। পৃথুলের বড় চাচা একটু হলেও নিশ্চিন্ত হলেন। কিন্তু হাসান সাহেবের মুখ কঠিন, তিনি তার মেয়ের সিদ্ধান্তে মোটেই প্রসন্ন নন। এত বুদ্ধিমান মেয়ে এমন একটি সিদ্ধান্ত কি করে নিল! কি করে এই ছেলেকে বিয়ে করা মত দিলো সে! কিন্তু মোতালেব সাহেবের কারণে তাকে জিজ্ঞেস করার সুযোগটিও পান নি তিনি। বিয়ে সম্পন্ন হবার পর পর সুমী বেগম আরশিয়ার কপালে চুমু আঁকলেন, গদগদ স্বরে বললেন,
“মা, তোমাকে কি বলে ধন্যবাদ দিব জানা নেই। শুধু একটি কথা বলব, আমাদের ঘরে কোনো কিছুর অভাব পাবে না তুমি।”
আরশিয়া উত্তর দিলো না। বড় মামার সাথে জেদ করে বিয়েটা করেছে। এর পরিণতি কোথায় তার নিজের ও অজানা। সকলের আড়ালে আত্মিকা তার হাত চেপে ধরল। ফিসফিস করে বলল,
“বুবু, তোকে বড় মামা জোর করেনি তো?”
আরশিয়া বিস্ময়ের চোখে তাকালো। আত্মিকা মেয়েটি তার থেকে বয়সে বেশ ছোট। মাত্র অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী সে। কিন্তু তার বুদ্ধি এবং পরিপক্কতা অবাক করছে আরশিয়াকে। মেয়েটি এখনো উত্তরের প্রতীক্ষায় বসে রয়েছে। আরশিয়া মৃদু হাসলো তারপর বলল,
“নাহ! নিশ্চিন্তে থাক। বাবাকে দেখে রাখিস। আর আনহার দিকে খেয়াল রাখিস।”
আরশিয়া বললেও আত্নিকার মনের খচখচানি কাটলো না। এখনও মনে হচ্ছে, বুবু কিছু লুকোচ্ছে। কিন্তু মৃদু হাসির রমনীটির নিখুঁত অভিনয়ের কাছে হার মানল আত্নিকা।
বিদায় লগ্নে হাসান সাহেবকে পাওয়া গেল না। মেয়ের উপর অভিমান করে তিনি সেখানে উপস্থিত হলেন না। ফলে আরশিয়াও বাবা ছাড়াই গাড়িতে উঠল। হাতের উলটো পিঠে লেপ্টে থাকা বিষাদের উপকথাগুলো বাবার আড়ালেই থেকে গেলো। যাবার সময় মামাকে অনুনয় করে বলল,
“বাবার দিকে খেয়াল রাখবেন।”
মোতালেব সাহেব সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে আশ্বস্ত করলেন আরশিয়াকে। তুলে দিলেন ফুলে সুসজ্জিত গাড়িতে। সুমী বেগমকে বললেন,
“মেয়ে দিচ্ছি ভাবি, দেখে রাখবেন।”
গাড়িতে পাশাপাশি বসলেও দুজনের মধ্যে দূরত্ব ক্রোশের সমান। মনের দরজায় ঝুলছে তালা। বাহিরের চাঁদহীন আকাশের দিকে চেয়ে আছে আরশিয়া। আর পৃথুল নিজের মোবাইলে ব্যস্ত। তাদের চুপকথা গুলো নিস্তব্ধতার রুপে গাড়িতে বিদ্যমান।
বউ বরণের আনুষ্ঠানিকতার পর আরশিয়াকে নিয়ে যাওয়া হল পৃথুলের ঘরে। মাঝারি আকারের ঘরটি খুব সিমসাম গোছের। আড়ম্বর শব্দটির আ ও সেখানে দেখা গেল না। একটি ডডাবল সাইজ খাট, একটি আলমারি, টেবিল চেয়ার এবং একটি বইয়ের শেলফ। সেখানে রয়েছে শ খানেক বই। সমরেশ মজুমদার, শরতচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হুমায়ুন আহমেদ---সকলকেই শেলফ বদ্ধ করা হয়েছে। আচ্ছা যে মানুষটি এত বই পড়ে সে কি মিথ্যে বলে? সে কি প্রতারণা করতে পারতে? হয়ত পারে! ঘরের দক্ষিণের বৃহৎ জানালার কাছে গেলো আরশিয়া। আকাশটা আঁধারে নিমজ্জিত। চাঁদহীন আকাশে কিছু টিমটিমে তারা সেই আঁধার চিরে নিজেকে উম্মোচিত করে আছে। তবুও যেনো তাদের আজ সুন্দর লাগছে না আরশিয়ার। বাতাসে মিশে আছে স্বপ্ন ভাঙার আর্তনাদ। সব কিছু তিক্ত লাগছে। হঠাৎ দরজা ঠেলার শব্দে ধ্যান ভাঙল। পেছনে ফিরতেই অপছন্দের মানুষটিকে দেখলো সে। পৃথুল গামছা নিতে নিতে বিব্রত কন্ঠে শুধালো,
"আপনি জেগে আছেন?"
"এড়িয়ে যাবার ধান্দায় ছিলেন বুঝি?"
জড়তাহীন স্বরে প্রশ্নটি শুধালো আরশিয়া। ফলে বিব্রত বাড়লো বই কমলো না। পৃথুল অস্বস্তি কাটাতে হাসল। মৃদু মলিন হাসি। তারপর গাঢ় কন্ঠে বলল,
"আপনি সত্যিই বুদ্ধিমতিদের তালিকায় পড়েন।"
নথুলের প্রশংসামিশ্রিত কথাটি হয়তো অন্য সময় ভালো লাগতো কিন্তু আজ বিষের মত লাগছে। অভিমান, ক্ষোভ তরল রুপে চোখে জড় হয়েছে। বিষাদমাখা স্বরে তাই প্রশ্ন ছুড়ল,
"আমাকে ঠকানো হলো কেন? আপনাদের পরিবারের হাবভাব দেখে তো ঠকবাজ মনে হয় না। মার্জিত, শিক্ষিত; তাহলে আমার ক্ষেত্রে এমনটা হলো কেনো?"
"ভুল ভাবছেন আপনি, আমরা কেউ আপনাকে বা আপনার পরিবারকে ঠকাইনি। মোমেনা আন্টি আমার প্রথম বিয়ের কথাটা লুকিয়ে গেছেন সেটা আমি বা মা জানতাম না। আমি জানলে এটা কখনো আড়াল করতাম না।"
"তাই বুঝি? কিন্তু আপনিও আমাকে বলেননি!"
"বলিনি কথাটা ভুল, আপনি জিজ্ঞেস করেননি। আর পুরোনো কাসন্দি যেচে পড়ে ঘাটতে ইচ্ছে করেনি।"
"তা ইচ্ছে হবে কেন? আপনার দোষ ধরা পড়ে যেতো যে! কোন পুরুষ আছে যে একটি মেয়ের সাথে একশ দিনও সংসার করতে পারে না?"
পৃথুল উত্তর দিলো না। শুধু চুপ করে সকল অভিযোগ মাথা পেতে নিলো। আজ তার চুপকথা বোঝার সাধ্য হয়তো আরশিয়ার নেই। থাকলে বুঝতো দোষটি তার নয়। পৃথুল গাঢ় স্বরে বলল,
“ক্লান্ত লাগছে, ধকল তো কম যায়নি। আর নিশ্চিন্তে থাকুন, আমি আপনার প্রতি দায়িত্বে কোনো ঘাটতি রাখবো না। শুধু নিজের প্রত্যাশাগুলো আমার উপর চাপিয়ে দিবেন না। আশাহত হতে হবে। প্রত্যাশাহীন মানুষেরা কখনোই অন্যের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে না।”
বলেই ওয়াশরুমে চলে গেলো। আরশিয়ার ঠোঁট ভেঙে কাঁদতে ইচ্ছে করল। কিন্তু বাবা বলেন,
“অশ্রু হলো মুক্তো। অহেতুক স্থানে তা খরচ করবি না”
তাই কান্নাগুলোও জমিয়ে রাখলো সে বক্ষস্থলের এক নির্জন আঙিনায়।
**********
আরশিয়ার ঘুম ভাঙলো খুব সকালে। বাহিরের আঁধার এখনো কাটেনি। কোকিলে কুহু ডাক কানে আসছে। বাতাসে তখন মাটির ঘ্রাণ। গতরাতে কি বৃষ্টি হয়েছিলো? হাট করে খোলা জানলার কাছে একবার তাকালো। তারপর তাকাল পাশের শীতল স্থানে। লোকটি কখন উঠেছে জানে না। জানার ইচ্ছেও নেই তার। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানা ছাড়ল সে। নামাজের পাটি খুজতে খুলল আলমারী। গতরাতে পৃথুল বলেছে আলমারী বামের অংশ তার। সেখানেই নিজের জামাগুলো রেখেছে আরশিয়া। কিন্তু কিছু জিনিস সেখানে আটে নি। ফলে পৃথুলের জায়গাতেও অঘোষিত ভাবে রেখেছে সে কিছু জিনিস। অনেক জিনিসের কারণে বেশ গ্যাঞ্জাম হয়ে গেছে আলমারীতে। তাই নামাজের পাটি বের করতেই জামা কাপড়ের ডিবি নিচে পরে গেল। ইস্ত্রি করা জামা কাপড়ের ভাঁজ নষ্ট হয়ে যাবে ভেবেই বিরক্ত হলো আরশিয়া। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আবার গুছাতে হল সবকিছু। তখনই পৃথুলের শার্টের ভাঁজ থেকে একটি ছবি হাতে পড়ল। কৌতুহল মানুষের সবথেকে বড় শত্রু। সেই কৌতুহলই আবারও ক্ষত বিক্ষত করল আরশিয়াকে। কারণ ছবিটি একটি হাস্যজ্জ্বল দম্পতির যেখানের পুরুষটি এখন তার স্বামী…………
.
.
.
চলবে............................................