হাত ঘড়িতে রাত একটা ত্রিশ। এসময় দৈনন্দিন রাতে চারিপাশ নিস্তব্ধতায় ঘেরা থাকে। তবে আজ ভিন্ন! এতটা রাত হয়েও আজ চারিপাশে হৈচৈ, বাচ্চাদের ছুটাছুটি, হৈ-হুল্লোড়ে প্রকৃতি সতেজ। হুটহাট আতব বোম আকাশে ছুঁড়ে মারা হচ্ছে। কালারফুল সব রঙের মেলা আসমান জুড়ে।
তন্ময় এই ভাড়া বাড়ির ছাঁদে সচরাচর ওঠে না। শেষ উঠেছিল অরুকে নিয়ে। এরপর আজই চাঁদরাতের বেলায় আসা। আজ রাতের চাঁদ অসম্ভব সুন্দর হয়ে থাকে। দেখতে আদুরে লাগে, আনন্দ লাগে। এই দিনে ছাঁদে দাঁড়ানো তন্ময়ের পছন্দের কাজ। তাদের বাড়িতে হলে তার পিছু পিছু সবাই থাকত। শাবিহা, রুবি, অরু, দীপ্ত, আকাশ সব! চেয়ার গোলাকার করে পেতে সবরকম নাস্তা দিয়ে ভরিয়ে ফেলত। খেতো সেসব আর আড্ডা দিত। মিউজিক ছেড়ে নিতো লাউডস্পিকারে।
গরম গরম কফি থেকে এখনো ধোঁয়া উড়ছে। তেতো তেতো একটা ঘ্রাণ নাকে এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে। কফিটা তন্ময় তেতো খায়। সুগার আর মিল্ক অতি সামান্য ব্যবহার করে। তার এই তেতো কফি বাড়ির কেউ খেতে পারে না। অরু তো একবার খেয়ে বমি করতে করতে হয়রান। ওর আবার সুইট টুথ! মিষ্টি ভীষণ পছন্দের। ভালোভাবে খেয়াল করলে বোঝা যায় অরু আর সে সম্পূর্ণ বিপরীত ধাঁচের মানুষ। কোনো কিছু তাদের কমন নেই। এরজন্যই হয়তো বলা হয়, মানুষ নিজের বিপরীত চরিত্রের মানুষের প্রেমে পড়ে!
ফোন বাজছে। বা-হাতে সেল-ফোন বের করে তন্ময়। স্ক্রিনে মাহিনের কল ভেসে এসেছে। কফির মগে চুমুক দিয়ে কল রিসিভ করে। কানে চাপতেই মাহিন চেঁচিয়ে ওঠে,
'দোস্ত!'
'হ্যাঁ। কোথায় তুই?'
'তোদের বাসার নিচে। তুই বাসায় তো? বিয়ার নিয়ে আসছি উইদ চিকেন। আন্টি কোথায় একটু দেখ। দরজাটা ধীরে খুলবি আমি এক দৌড়ে তোর রুমে। আন্টি দেখলে ঝাড়ু মারবে কপালে।'
তন্ময় নিঃশব্দে হাসে। বলে,
'ছাঁদে আয়।'
'তুই ছাঁদে? দাঁড়া আসতেছি।'
তন্ময় উঁকি মারে নিচে। ওইতো মাহিনের গাড়ি দাঁড়িয়ে। গাড়িটা এভাবে রাস্তায় পার্ক করে এসেছে! ছেলেটা শুধরাবে না। কেউ যদি ডাক নেয় এখন? মিনিট পাঁচেকের মধ্যে দৌড়ে উঠে আসে মাহিন। হাফপ্যান্ট আর টি-শার্ট পরেই চলে এসেছে। তন্ময়ের কাঁধে শক্ত করে বাহু রাখে। শব্দ করে বলে,
'দোস্ত ঈদ মোবারক।'
'ফোনে না বললি একবার।'
'কোথায় লেখা একবার বলা যাবে দুবার না?'
'আচ্ছা। ঈদ মোবারক।'
'আয় আয়, চিকেন ঠান্ডা হলে আর মজা নেই। বিয়ার গরম হলে তেজ নাই।'
দুজন বেঞ্চে বসল। তন্ময় ও টাইগার প্রিন্টের হাফ প্যান্ট পরা৷ বাহুতে কালো শার্ট জড়িয়ে। টি-শার্ট সব জবেদা বেগম ধুয়ে দিয়েছেন। তাই আজ শার্ট পরেই থাকতে হচ্ছে। বাড়িতে কম্ফোর্টন্যাস মেইন। আর তন্ময় টি-শার্টে বেশ কম্ফোর্ট ফিল করে।
মাহিন চিকেনগুলো বের করেছে। বিয়ার একটা তন্ময়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে আরেকটা খুলে চুমুক বসায়। চিকেনের ঘ্রাণে আশপাশ ম-ম করছে। বিয়ার হাতে তন্ময় ধীর গলায় শুধায়,
'বাকিরা কোথায়?'
মাহিন ব্যস্ত মুখে একটা চিকেন চিবুতে শুরু করেছে,
'বলি নাই। বাবার সাথে কথা কাটাকাটি করে চলে এসেছি।'
তন্ময় পুনরায় পকেটে হাত দেয় ফোন বের করতে। প্রশ্ন করে,
'বিয়ে নিয়ে তর্ক করছিস?'
'আর বলিস না! তার আমার বিয়ে নিয়ে অনেক মাথা ব্যথা। নিজে বিয়েশাদি করে যৌবন শেষ করেছে। এখন আমার পেছনে পড়ে!'
ইতোমধ্যে তন্ময় গ্রুপ কল করছে। রিয়ান সবার পূর্বে কলে ঢুকল। থমথমে গলায় বলল,
'এটা ঈদ না অন্য কিছু রে ভাই! কোনো আনন্দ নাই। তোরা কই? কেউ আমারে এসে একটু নিয়া যা। ভালো লাগতেসে না।'
মাহিন রসিকতার সুরে বলল,
'তুই কী লেডি যে গিয়ে আনতে হইব? আইসা পড়।'
সৈয়দ ও কলে জয়েন করেছে। ও অবাক কণ্ঠে বলে,
'আমারে ছাড়া তোরা দুজন একসাথে কি করস?'
'প্রেম। প্রেমের সাগরে হাডুডু খেলি। খেলতে চাইলে আয়।'
'খেলমুনা মানে? ফোর্থ সিকুয়েন্সে খেলমু।'
ওপাশে তাড়াহুড়ো পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ওরা হয়তো বেরোনোর জন্য তৈরি। রিয়ান চেঁচিয়ে উঠল,
'আইতাছি দাঁড়া।'
'দাঁড়াতে পারমু না। বইসা চিকেন খাই উইদ বিয়ার অ্যান্ড উইদাউট ইউ।'
'অ্যাই তন্ময়। ওরে থামা দোস্ত। আমার মাথাটা তো গরম করে ফেলতেছে।'
আধঘন্টার মধ্যে শুহানি বাদে সবাই হাজির। ওরা হয়তো উড়োজাহাজ করে এসেছে। একেকটা বড়ো শ্বাস ফেলছে সিঁড়ি বেয়ে ওঠায়। লিফটের জন্য ও ওয়েট করেনি। সবাই একত্রে বসে আড্ডায় মশগুল। চাঁদরাতে তাদের হাসাহাসির শব্দে রিনঝিন করছে সম্পূর্ণ ছাঁদ।
রিয়ান হুট করে বলে উঠল,
'ভাবীরে তো ঈদ মোবারক জানাইলাম না। তন্ময় একটা কল দে। অরুর সাথে কথা বলি।'
'দরকার নেই।'
তন্ময় তো দিবে না বলে ঠাঁই হয়ে আছে। কিন্তু এবার থামাথামি নেই রিয়ান, মাহিনের। দুজন যখন বারংবার আবদার করছে সেসময় শান্তশিষ্ট সৈয়দ ও বলল,
'কল দে না। ওর সাথে মিট ও তো এই অবদি করালি না। আমাদের কী ইচ্ছে হতে পারে না ওঁকে দেখার? জানিস তোর মুখ থেকে ওর কিউট কিউট কাহিনী শুনে কত আনন্দ পাই? আমিতো মরে যাবার আগে একবার অন্তত তোদের পাশাপাশি দেখতে চাচ্ছি।'
মাহিন ও সুরে সুর মেলালো, 'দোস্ত মুখে লাগাম রাখমু। কোনো বাজে কথা বলমু না। কল দে না…'
ওদের কন্টিনিউস ঘেঙানো শুনে তন্ময় দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে। পেরে না ওঠে অবশেষে ফোন বের করে কল লাগায়। ঘুমিয়েছে নাকি মেয়েটা কে জানে! অবশ্য আজ ঘুমানোর কথা নয়। ও টৈটৈ করে সম্পূর্ণ বাড়ি ঘুরছে। কল কানেক্টেড হলো মুহুর্তে। মাহিন ইশারায় লাউডস্পিকারে দিতে বলল। তন্ময় অসহায় ভঙ্গিতে দিল। ওপাশ থেকে অরুর চিকন মেয়েলি উত্তেজিত গলার স্বর শোনাল,
'হ্যালো তন্ময় ভাই!'
'হু। ঘুমাস নি?'
'উহু। আমার চোখে ঘুম নেই। আজ তো আমরা সবাই আপনাকে, বড়ো মা'কে মিস করছি। মিস করব না? এটাই তো প্রথম ঈদ আমাদের আলাদাভাবে। আপনি মিস করছেন?'
মাহিন জ্বলজ্বল চোখে চেয়ে। ওর হাত রিয়ানের হাতে। দুজন দুজনের সাথে লেপ্টে তন্ময়ের দিক তাকিয়ে। যেন কোনো রোমান্টিক সিনেমার রোমান্টিক সিন দেখছে। তন্ময় হালকা কেশে বলে,
'হু। তুই বাদে সবাইকে মিস করছি।'
অরুর গলার স্বর বেড়ে গেল,
'কেন কেন! আমাকে কেন মিস করছেন না? হয়তো আমি একটু মেসি, একটু অদ্ভুত। আপনাকে খুব বিরক্ত করি তাই বলে মিস করবেন না?'
বন্ধুবান্ধবদের কার্যকলাপ দেখে তন্ময় থামল। এদের সামনে কথা বলা যাবে না। তাই কথা ঘুড়িয়ে প্রশ্ন করল,
'কই তুই?'
'আমি বারান্দায়।'
'আচ্ছা। শোন.. উহুম! আমার বন্ধুরা একটু কথা বলবে তোর সাথে। কথা বলবি?'
চমকানো অরু জবাব দিতে পারল না। এর পূর্বেই মাহিন কেড়ে ফোন নিয়ে নিল। স্বতঃস্ফূর্ত গলায় সালাম জানালো,
'আসসালামু আলাইকুম। অরু তুমি কেমন আছো?'
থেমে থেমে অপ্রস্তুত অরুর জবাব এলো,
'ওয়া আলাইকুমুস সালাম ভাইয়া। আমি ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন?'
জবাব দিল রিয়ান,
'আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ। ঈদ মোবারক অরু।'
মাহিন ও চেঁচাল, 'ঈদ মোবারক।'
এবার হাসির শব্দ শোনাল ওপাশ থেকে। অরু হেসে হেসে বলল, 'ঈদ মোবারক ভাইয়া।'
আরও কিছু বলবে পূর্বেই তন্ময় ফোন কেঁড়ে নিয়ে কেঁটে দিল। বুকের ভেতর তার ড্রাম বাজছে। অরু এভাবেই ভীষণ এগিয়ে তার দিক। যদি কোনো ইঙ্গিত পেয়ে বসে তাহলে এবার মাথার উঠে নাচবে। আর তার বন্ধুবান্ধবদের মুখ তো পিএইচডি করা। কি না কি বলে ফেলে, রিস্ক নেওয়া যাবে না।
_______
সূর্যের সংস্পর্শে নয়ন জোড়া যেতেই তন্ময়ের নিদ্রা কাটল। দরজায় টোকা পড়ছে। জবেদা বেগম ডাকছেন। তন্ময় উঠে বসল। দেয়াল ঘড়ি আটটায় ঘুরছে৷ ঈদের নামাজে যাবে বলে তৎক্ষণাৎ উঠে গেল। গোসল নিয়ে বেরোতেই নাকে খাবারের সুভাস ভেসে এল। জবেদা বেগম কাঁচের বাটিতে গরুর দুধের গরম সেমাই নিয়ে এসেছেন। আদুরে গলায় বললেন,
'খেয়ে দেখ তো সব ঠিকঠাক আছে নাকি!'
তন্ময় এক চামচ খেয়ে প্রশংসা করল,
' সবসময়ের মতো সুস্বাদু। '
হেসে জবেদা বেগমের পুনরায় রান্নাঘরে ঢুকেন। তন্ময় রুমে যায় তৈরি হতে। কিছুক্ষণ শপিং ব্যাগটার পানে তাকিয়ে থাকে৷ মোস্তফা সাহেব পাঠিয়েছেন এটা। তন্ময় গতকাল রাতেই খুলে দেখেছে। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবির স্যাট, কালো কোটি দিয়ে। কালো জুতো পাঠিয়ে দিয়েছে। তন্ময় তার বাবার দেওয়া পাজামা-পাঞ্জাবি পরল শেষমুহুর্তে। শরীরে আতর আর চোখে সুরমা দিল। হাতে সাদা মাথা টুপি নিয়ে বেরোল। জবেদা বেগম ছেলেকে দেখে মুগ্ধ হলেন। লম্বা তন্ময়ের মাথা টেনে কপালে চুমুও খেলেন,
'বাচ্চাদের আসতে বলিস।'
'আচ্ছা। বলব।'
বাবাচাচাদের সাথে সাধারণত তাদের এরিয়ার জনপ্রিয় মসজিদেই নামাজ আদায় করে। আজও সেখানেই রওনা হলো। তার মন বলছে মোস্তফা সাহেব সেখানেই দাঁড়িয়ে হয়তো। হলোও তা। মোস্তফা সাহেব, আনোয়ার সাহেব, ওহী সাহেব, আকাশ এবং দীপ্ত পাজামা-পাঞ্জাবি পরে টুপি মাথায় দাঁড়িয়ে। তার দেওয়া কাপড়চোপড় পরেছে সবাই। তন্ময়কে দেখেই দীপ্ত ছুটে এসে লাফিয়ে কোলে চড়ল। আনোয়ার সাহেব ও হেসে হেসে ডাকলেন। ভাইপো-র সাথে কোলাকুলি করলেন। তাদের ঘিরে আছে এলাকার চেনাজানা বেশ কিছু ভদ্রলোক। একসময় বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়াল তন্ময়। ভীষণ গম্ভীর কণ্ঠেই মিনমিন গলায় বলল,
'ঈদ মোবারক।'
পরপরই দীপ্তকে নিয়ে মসজিদে ঢুকল। মোস্তফা সাহেব হাসলেন। তিনিও 'ঈদ মোবারক' বিড়বিড় করে আওড়ালেন।
_____
বেলা এগারোটায় হাজির হলো শাহজাহান বাড়ির বাচ্চাকাচ্চাদের দলবল। এসেই তন্ময়ের থেকে সালামি নিতে ব্যস্ত। তন্ময় একেক করে সবাইকে টাকার খাম দিয়ে দিয়েছে। শেষে অরু এলো। অরু তার দেওয়া গাউন পরেছে। সাদা রঙের প্লেইন গাউন । সাথে সাদা জর্জেটের গর্জিয়াছ ওড়না, যা একসাইডে নেওয়া। সেই সাথে সুন্দর করে সেজেছে। চুলগুলো কার্ল করে খোলা রেখেছে। আজ কাজল ও পরেছে ডার্ক করে। পরিপাটি এই অরুকে তন্ময় কয়েকবার দেখল। এবং ইচ্ছে করল না খাম-টা তাড়াতাড়ি দিতে। একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দিবে যেন অরু চোখের সামনে কিছুক্ষন থাকে। সেই কারণ ধরে প্রশ্ন করে,
'কি সমস্যা?'
'আমার সালামি?'
'তোর কীসের সালামি?'
অরু চোখ বড়ো বড়ো করে ফেলল,
'আমার খাম কোথায়?'
তন্ময় উঠে দাঁড়াল। আয়নার সামনে চুল ঠিক করা ভঙ্গিতে বলল,
'নেই।'
'অ্যাহ। দিন আমার খাম। তাড়াতাড়ি।'
তন্ময় কিছুক্ষণ ভাবল,
'সালাম করেছিস যে সালামি দিব?'
'এই কথা! এক্ষুনি করছি।'
অরু সুন্দর ভাবে সোজাসাপটা হয়ে দাঁড়াল। ভদ্র-শালীন ভঙ্গিমায় বলল,
'আসসালামু আলাইকুম তন্ময় ভাইয়া। দিন এবার।'
তন্ময় অগোচরে হাসল। গম্ভীর হওয়ার নাটক করে বলল,
'হয়নি। এক কাজ কর.. একপ্লেট বিরিয়ানি নিয়ে আয়। তারপর দেখি…. '
অরু নাক ফোলাল। অভিমানী গলায় বলল,
'লাগবে না সালামি।'
হনহনিয়ে চলে যেতে নিচ্ছিল তন্ময় দ্রুত হাত টেনে ধরল,
'দাঁড়া দাঁড়া। দিচ্ছি।'
অরু হেসে উঠল। সালামির খাম পেয়ে খুশিতে সে আসমানের সপ্তমে। নিজে ঘুরেফিরে ড্রেস দেখিয়ে শুধায়,
'কেমন লাগছে?'
তন্ময় শুধু তাকিয়ে রইল। কিছু বলছে না দেখে অরু কতক্ষণ লাজুক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর হুট করে ছুটে বেরিয়ে গেল। তন্ময় ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে,
'আসমানের চাঁদের থেকেও সুন্দর!'
.
.
.
চলবে..............................