কবুল বলার কিছু সময় পূর্বেই জানা গেলো বিয়েটা পৃথুলের প্রথম বিয়ে নয়। এর পূর্বেও পৃথুলের বিয়ে হয়েছে। এবং সেই বিয়ের স্থায়ীকাল একশত দিন। পৃথুলের প্রথম বিয়ের খবর জানাজানি হতেই বিয়ের বাড়িতে বেশ আলোড়নের সৃষ্টি হলো। হুল্লোড়, আনন্দ বিষিয়ে নিমিষেই শুরু হলো বিশ্রী বাকযুদ্ধ। আরশিয়ার বাবা হাসান মাহমুদ রীতিমতো রণমূর্তি রূপ ধারণ করেছেন। আবেগের প্রবণতায় প্রতারণার অপবাদ দিয়ে বসলেন পৃথুলের মা এবং বড় চাচাকে। ছেলের এত বড় খুদ থাকা সত্ত্বেও তারা কি করে লুকিয়ে গেলো। শুধু তাই নয় এখন বলছে এটা সামান্য ভুল বোঝাবুঝি। হাসান সাহেব ক্ষিপ্ত স্বরে বললেন,
“ফাজলামি? ফাজলামি পেয়েছেন? এখন রং তামাশা করেন আর বলেন আমরা জানতাম না। আমাদের কি ছোট্ট খোকা মনে হয়? মানুষ চিনি না আমরা। ঢের চিনি আপনাদের মতো প্রতারকদের।”
“ভাই আমরা সত্যি জানতাম না এই সম্পর্কে আপনাদের ধারণা নেই। মোমেনা ভাবি যে ব্যাপারটা চেপে যাবেন কল্পনা করিনি। এ কারণে আমি ভাবিকে অনেক বার জিজ্ঞেস করেছি, আমার ছেলেকে নিয়ে কোনো আপত্তি নেই তো। তাহলে এখন কেনো এই অপবাদ দিচ্ছেন। আর বিয়েটা তো আমার ছেলে ইচ্ছেকৃত ভাঙ্গেনি। আমার ছেলের কোনো খুঁত নেই।”
পৃথুলের মা সুমী বেগম আকুতির স্বরে কথাটা বললেন। তার আকুতি, অনুনয়বিনয় সব অগ্রাহ্য করেই রুক্ষ কণ্ঠে বললেন,
“রাখেন, যত মিথ্যে আর ছলনা।”
এদিকে পৃথুল নির্বিকার। তার গতিবিধি শান্ত। শুধু একবার মাকে সামলাতে এসেছিল। শান্ত স্বরে বলেছিলো,
“বাদ দেও না মা, এরচেয়ে বরং বাড়ি যাই।”
কিন্তু সুমী বেগম মানলেন না, তার যে আরশিয়াকে মনে ধরেছে। মায়ের মনের বিশ্বাস গুলো বিচিত্র হলেও তার দৃঢ়তা পরিমাপের ক্ষমতা বোধহয় কারোর নেই। তাই তো এত কিছুর মাঝেও সে নিজের পুত্রের বিক্ষিপ্ত, চূর্ণবিচূর্ণ জীবন সাজাতে উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছেন। কারণ তার বিশ্বাস আরশিয়া নামক নারীটি তার ছেলের অগোছালো জীবনকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিবে। ফাটল স্থানগুলো পূরণ করে দিবে অনিমিষেই।
ভেতরের ঘর থেকে চেঁচামেচি গুলো বিকট ভাবেই কানে পৌছাচ্ছে। খাটের উপর লাল বেনারসী পরিহিতা শুভ্র, শান্ত মুখশ্রীর নারীর নির্মল চোখজোড়া ছলছল করছে। এই চোখে কিছুক্ষণ পূর্বেও হাজারো স্বপ্ন ছিলো। আজ সেই স্বপ্নগুলোই একে চূর্ণ বিচূর্ণ হচ্ছে। সেই ভাঙা স্বপ্নের ধাঁরে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে আরশিয়ার কোমল হৃদয়। বক্ষস্থল জুড়ে নিদারুণ তিক্ত যন্ত্রণা ছেয়ে আছে। বাহিরের শব্দ দূষণগুলো আরশিয়ার কানে গরম শিকের মতো ঠেকছে। ভেতর ঘরে উপস্থিত সকলের মুখ থমথম করছে। তাদের কানাগোসাগুলো গরম তেলের মতো ঝলসে দিচ্ছে নারীর অশান্ত মস্তিষ্ক। কি অপরাধ ছিল তার! কেন তার সাথেই এমনটা হতে হল! আজকের দিনটা আরশিয়ার জীবনের শ্রেষ্ঠতম দিন হবার কথা ছিল।
পৃথুলের সাথে আরশিয়ার বিয়েটা সম্পূর্ণরুপে পারিবারিক ভাবে। কলেজ শিক্ষিকা মেয়ের আঠাশ বছর পেরিয়ে যাবার পর ও বিয়ে হচ্ছে না ব্যাপারখানা নিয়ে তার পরিবারের মানুষেরা প্রচন্ড চিন্তিত ছিলেন। বিশেষ করে বড় মামা মোতালেব হক। একেই মা মরা মেয়ে, সে একাও নয়। তিনবোনের বড় সে। উপরন্তু বয়স আঠাশ পেরিয়ে উনত্রিশে পা রাখবে তিন মাস পর। তার ধারণা মেয়েদের বয়স বাইন মাছের মতো, শুধু পিছলে পিছলেই বেড়ে যায়। আর একজনের বিয়ে না হলে কি করে অন্যদের সুযোগ আসবে? এদিকে হাসান সাহেবের সেই মতামত নয়। তার কথা মেয়ে আমার প্রভাষক, সে লাখে নয় কোটিতে একজন। কিন্তু তার কথাকে প্রচন্ড রোষের সাথে থামিয়ে দেন মোতালেব হক। সম্বন্ধীকে নিতান্ত শ্রদ্ধা করার জন্য তাকে দমে যেতে হয় অচিরেই। উপরন্তু তার জীবনে মোতালেব সাহেবের প্রচুর ঋণ। তাই তো তার এক আত্নীয়া মোমেনা বেগমের পছন্দের ছেলের সাথেই বিয়ে পাকাপাকি হয়। পৃথুল পেশায় সংবাদ উপস্থাপক। বেশ উচ্চপদে আছে, নম্র, ভদ্র, দেখতেও বেশ সুদর্শন। মেয়ের সাথে মানিয়েছিল বটে। তাই অমত করেন নি। অন্যদিকে আরশিয়ার ছেলেটিকে পছন্দ হয়েছে। আঠাশ বছরের জীবনে এই প্রথম তার মনে কোনো পুরুষ শিহরণ জাগিয়েছে। কিশোরী বয়সে যখন অন্য বান্ধবীরা সদ্য প্রেমের আবেগে নিজেদের ডুবিয়েছিল, তখন আরশিয়া নিজের বইয়ের পাতার ভাঁজে ব্যাস্ত রেখেছে। কারণ তার এই ক্ষণিকের আবেগগুলো সস্তা লাগে। একুশ শতকের মানুষ হলেও তার মন এখনো সেই নব্বই এর দশকেই পড়ে আছে। নিজের আবেগগুলো কাঠের ফ্রেমে তুলে রেখেছে সে। তার কাছে হুট করে ব্রেকআপ হুট করে প্যাচআপ গুলো প্রচন্ড বিরক্ত লাগে। সে স্বপ্ন দেখেছে বিয়ের পর চিঠি প্রেমের। চুপচাপ শান্ত মেয়েটির এতোদিনের সঞ্চিত আবেগ তুলে দেবার স্বপ্ন দেখেছিলো পৃথুলের মাঝে। যখন লোকটি চায়ের মধ্যে বিস্কিট ডুবিয়ে খাচ্ছিল, ব্যাপারটা ভালো লেগেছিল আরশিয়ার। আরশিয়াকে ফ্যালফ্যালিয়ে চেয়ে থাকতে দেখে সে বলেছিলো,
“আমার অভ্যাস এটা, আশাকরি কিছু মনে করেননি।”
তার গাঢ় কন্ঠ কানে মিছরির মতো ঠেকেছিলো। আরশিয়া মাথা নাড়িয়েছিলো। না, সে মনে করে নি। উলটো বলেছিলো,
“আপনার চিঠি লিখতে ভালো লাগে?”
“মেইলের জগতে চিঠি?”
“হ্যা, আমার ভালো লাগে। আসলে চিঠিতে যে আবেগ থাকে তা মেইল বা এসএমএস এ নেই। চুপকথাগুলো কাগজের সাথে মিশে প্রণয়ণের বুকে ঝড় তৈরি করে বলে আমার ধারণা। আমি আপনাকে চিঠি লিখবো। আপত্তি নেই তো?”
“নাহ, শুধু আমার হাতের লেখা খুব বাজে। দেখতে তেলাপোকার পায়ের মত। বুঝতে পারবেন?”
“পারব।”
কত স্বপ্ন, কত আবেগ। সেই স্বপ্ন গুলোকে আঁচলে বেধে নিজেকে সাজিয়েছিলো আরশিয়া। কিন্তু একটু আগেই বাবার মোবাইলে একজন ম্যাসেজ করে জানালো “পৃথুল আগ থেকেই বিবাহিত” ব্যাস। বিয়ের আমেজ পরিণত হলো অভিযোগের যুদ্ধময়দান। ভেতরটায় হাহাকার। মা থাকলে হয়তো তার কোলে মাথা রাখা যেত। কিন্তু সেই দিকেও দূর্ভাগা। বাহিরে এখনও বিয়ে হবে কি না নিয়ে তর্কযুদ্ধ চলছে। আরশিয়ার মনের ভাঙা জানালাটা আজ নড়বড়ে। কিভাবে সামলাবে এই উচাটন!
হাসান সাহেবকে শান্ত করা দায় হয়ে ঠেকেছে। পৃথুলের বড় চাচা শান্ত স্বরে বললেন,
“ভাই, এটা ভুল বোঝাবুঝি। মানছি দোষের অধিকাংশ ভাগ আমাদের। কিন্তু এখন বিয়ে ভাঙা টা কি মানায়? আমাদের এতোটুকু বিশ্বাস হচ্ছে না আপনাদের?”
“তাহলে বলুন কেনো বিয়েটা ভেঙেছিল? কেনো মেয়েটি একশত দিনের মাথায় সংসার ভেঙ্গে দিয়েছে?”
“আসলে……”
বলেই একবার তাকালো পৃথুলের নিশ্চুপ মুখখানার দিকে। পৃথুল মাথা নামিয়ে নিলো। তার কপালে তীব্র ভাঁজ, খুব বিরক্তি ফুটে উঠলো তার মুখশ্রীতে। অতীত দিয়ে জলঘোলাটা করাটা মোটেই ভালো লাগছে না। এখানে তাদের তো দোষ নেই। দোষ এই বাড়ির এতোদিন কেনো খোঁজ নেওয়া হল না। তারা জিজ্ঞেস ও করল না। পৃথুল তো লুকাতে চায় নি। সে ভেবেছে মোমেনা আন্টি সব জানিয়েছেন। এখন সবকিছুই বিরক্ত লাগছে। বিয়ে নামক জিনিসটা কোনোকালেই তার জন্য শুভ নয়। সর্বদাই প্রলয়ই এনেছে। আজ ও অন্যথা হল না।
পরিস্থিতি যখন খারাপের দিকে মোতালেব সাহেব তখন রাশভারী কন্ঠে বললেন,
“বিবাহ বিচ্ছেদটা কি সম্পূর্ণভাবে হয়েছে?”
“জি, সব শেষ। এখন নয় বছর চারেক আগেই।”
সুমী বেগম অতিউৎসাহে উত্তর দিলেন। তিনি যেনো আশা ফিরে পেলেন। উনার কথা শুনে হাসান সাহেবের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন,
“তাহলে এখানে এত মাতামাতির কিছু দেখছি না হাসান।”
হাসান সাহেবের ক্রোধ সপ্তম আসমান ছুলো। গজগজ করে বললেন,
“মানে কি? ভাইজান তাই বলে একটা ডিভোর্সি ছেলের সাথে বিয়ে দিব? আমার মেয়ে কি ফেলনা?”
মোতালেব তার কথাটি সম্পূর্ণরুপে উপেক্ষা করে বললেন,
“আমি আরশিয়ার সাথে কথা বলব। সে যদি আপত্তি করে তবে বিয়ে হবে না। কিন্তু সে যদি আপত্তি না করে তবে এই বিয়ে হবে এবং এখনই হবে।”
কথাটি শুনেই প্রতিবাদ করলেন হাসান সাহেব। কিন্তু সেই প্রতিবাদের ধার ও ঘেষলেন না মোতালেব সাহেব। শুধু শান্ত কন্ঠে বললেন,
“আর ও দুটো মেয়ে আছে তোমার হাসান। একটি মেয়েকে নিয়ে এত আদিক্ষেতা কিন্তু ভালো না। সব কিছুর মাত্রা থাকা প্রয়োজন।”
*********
আরশিয়ার ঘরের মহিলারা সবাই বাহিরে। তার সম্মুখে বড় মামা বসে আছে। তার মুখে পান। বেশ আয়েশ করেই চিবুচ্ছেন তিনি। আরশিয়া নত মস্তক বসে আছে। তার কঠিন নয়ন মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। চূর্ণবিচূর্ণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় মনটা এখন জানে না মামা কি বলতে চান। কিন্তু তার মুখ দেখে এটুকু বুঝতে পারি নেই সে বিয়ে সংক্রান্ত কিছুই বলবেন। পানের পিকটা বাটিতে ফেলে গম্ভীর স্বরে নীরবতার বধ করলেন মোতালেব সাহেব,
“দেখ, বিয়েটা তোমার বাবা বা আমি করবো না। বিয়েটা করবে তুমি। সংসার করবে তুমি। তাই সিদ্ধান্ত তোমার। আমি শুধু এটুকু বলবো, তোমার পরে আরোও দুটো বোন আছে। একজন বিয়ের বয়সেও উত্তীর্ণ হয়েছে। আজ যদি বিয়ে ভাঙে থু থু তোমার হবে। এই সমাজ কখনই পুরুষের দোষ দেখে না। তোমার বয়স ও অনেক। উপরন্তু বিয়ে থাকা দোষের কিছু নয়। মনের মিল হয়নি ভেঙে গেছে।”
“তাই বলে একশ দিন মামা!”
“হতেই পারে। এতে এতোটা সন্দিহান হবার কিছুই নেই। এখন তুমি বল কি চাও?”
আরশিয়া মৌন রইল। তার কথাগুলো গলাতেই আটকে গেল। মাঝে মাঝে বড় সন্তান হওয়াটা বরদানের থেকে অভিশাপ বেশি মনে হয়। তা না হলে কি আজ তার গলা দু বোনের খরা ঝুলানো হত? মামা মিনি্ট দুয়েকের মাঝে আবারো শুধালো,
“বিয়ে টি কি করবে না তুমি?”
“করব, কিন্তু আমার কিছু শর্ত আছে……………
.
.
.
চলবে..........................................