চুপকথা - পর্ব ০৫ - মুশফিকা রহমান মৈথি - ধারাবাহিক গল্প


পৃথুল দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর বিছানা ছাড়তেই ছোট সাইড টেবিলের উপর একটি ভাঁজ করা কাগজ পেল। কাগজটি কিসের তাই দেখার জন্য খুলতেই দেখল গোটা গোটা হাতের লেখা স্বল্প পরিমাপে একটি চিঠি। পৃথুলের চোখ সংকুচিত হল। সে চিঠিটি পড়তে শুরু করলো।
 “সাংবাদিক,
আপনি যেহেতু চিঠিটি পড়ছেন অর্থাৎ আমি আপনার সামনে নেই। অনেকটা ইচ্ছে করেই থাকিনি। কথাগুলো মুখোমুখি বলার ইচ্ছে হল না। কারণ কথাগুলো বলার সময় আমার মাঝে জড়তা কাজ করত। উপরন্তু আপনার মুখোভাব দেখার সাহস হল না। তাই গা ঢাকা দিলাম। ভাববেন না আমি ভীতু। আমি মোটেই ভীতু নই। শুধু কিঞ্চিত দ্বিধাগ্রস্থ। 

আপনি যখন আমাকে নিজের হৃদয়ের চুপকথাগুলো বলছিলেন, আমি অবিশ্বাস করিনি। আবার সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারছি না। আমার খুব বাজে একটি স্বভাব আছে, আমি চট করেই কোনো কিছু বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করতে পারি না। তাই তো আপনার বিয়ের সত্যটি উন্মোচন হলেও অন্তর থেকে তা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। করলে এই বিয়েটা করতাম না। আবার কাল যখন আপনি নিজের ব্যর্থতাগুলো বলছিলেন, সেগুলোও সম্পূর্ণ বিশ্বাস হচ্ছিল না। আমি তো আপনার মত অভিনেতা নই। তাই কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব করে থাকতেও পারছি না। আমার একটু সময় লাগবে। সময় লাগবে নিজেকে বোঝার, আপনাকে বোঝার। কেউ বলেছিল, “তোমার ব্যক্ত কথা বোঝার ক্ষমতা তো সবাই রাখে, কিন্তু ক'জন আছে যে তোমার চুপকথাও বুঝতে পারে?”---- আমি আপনার চুপকথা বুঝতে চাই, সাংবাদিক। আপনার কাছ থেকেও সেটাই প্রত্যাশা আমার। জানি অনেক বড় কিছু চেয়ে ফেলেছি, প্রয়োজনীতা নেই এই পাহাড় সম দায়িত্বখানা নিজ কাঁধে নেবার। কিন্তু আমার এটুকু প্রাপ্য। ভুল বললাম কি? 

আমি জড়বস্তু নই, আমার অনুভূতিগুলো দূর্বল। আপনার প্রতি সেগুলোর দূর্বলতা অধিক। তাই আমি দ্বিতীয় সুযোগ দিতে চাই। দুজন দুজনাকে চিনার, জানার। আমার বড় সাধ ছিল বিয়ের পর প্রেম করব। বান্ধবীদের তাচ্ছিল্যের মাঝেও সেই সাধ মিয়ে যায়নি। বাধ্যবাধকতা নেই আপনারও একই সাধ থাকবে। তবে যার সাথে বাধ্যর্ক অবধি পাড়ি দিব, তার সাথে ছলনা মানায় না। তাই নিজের অন্তস্থলের লুকায়িত প্রকোষ্ঠ্যের তালাটি ভেঙে ফেললাম। আশা রাখছি, আপনিও এমন কিছুই করবেন।

আপনি বিয়ের প্রথম রাতে বলেছিলেন, আমি যেনো কোনো প্রত্যাশা না রাখি। কথাটা রাখতে পারলাম না। আমি প্রত্যাশা রাখবো, হাজারবার রাখবো। কারণ প্রত্যাশাহীন মানুষ জীবিত থেকেও মৃত। আর আমি বার বার মরতে চাই না। এই কথাটা আপনার উপর ও প্রযোজ্য। মৃত্যুর আগেই মরবেন না। জীবন অনেক সুন্দর। জীবনের প্রথম মানুষটি অধিকাংশ সময় ভুল হয়। হয়ত, সে ভালো কিন্তু আমাদের জন্য নয়। আপনার ক্ষেত্রেও হয়তো এমন ই কিছু হয়েছে। কিন্তু আমি চাই না আমার প্রথম মানুষটি ভুল হোক। আপনিও নিশ্চয় শতরুপা হতে চান না। মনের সাথে জোর করার প্রয়োজন নেই। তবে চেষ্টা তো করতেই পারি।

আমার মতে দুজন মানুষের একে অপরকে ভালোবাসতেই হবে সেটা কিন্তু জরুরি নয়, ভালোবাসা অনেক বৃহৎ একটি শব্দ। চট করেই সেটা হয় না। চেষ্টা করলেই অজানা মানুষের সাথে জীবন পার করা যায়, কিন্তু ভালোবাসা যায় না।

আমি যখন ভার্সিটিতে পড়তাম, আমি রাজশাহী ভার্সিটির হোস্টেলে থাকতাম। সেখানে আমার যে রুমমেট ছিল, তার সাথে আমার পূর্বপরিচিতি ছিলো না, বন্ধুত্বও ছিলো না। আমরা ভিন্ন ডিসিপ্লিনে ছিলাম। অথচ সেই মেয়েটির সাথে আমি চার বছর কাটিয়েছি। জগড়া হয়েছে, মনোমালিন্য হয়েছে তবুও সেটা স্থায়ী হয়নি। অনেক সময় আমাদের মধ্যে কথাও বন্ধ থাকতো বহু সময়ের জন্য। কিন্তু আমাদের ফাটল ধরেনি। কারণ আমাদের মধ্যে কোনো দায় ছিল না। ঝামেলা বাধলে এটে থাকার জবরদস্তি ছিল না। ভাবতাম, চার বছরই তো। এর পর মুক্তি। সেজন্যই আমরা দুজন দুজনকে নিজ থেকেই আপন করার সুযোগ পেয়েছি। এই উদাহরণটি দেবার কারণ, আমরাও কিন্তু এখন অনেকটা তেমন। অথচ আমার এবং আমার রুমমেটের সম্পর্ক আর আপনার এবং আমার সম্পর্কে আকাশ পাতাল পার্থক্য। আমি আর আপনি বিয়ে নামক ভীষণ ভারি বন্ধনে আবদ্ধ। দু অক্ষরের শব্দটির ভারে দুজনই কুপোকাত হয়ে যাচ্ছি। তাই একে অপরকে আরোও বাজে ভাবেই জড়িয়ে ফেলছি। কেননা বিষয়টাকে আমরা হালকা করি। আপনি বলেছেন, আপনি মুক্তমনা। জোর করে সাথে থাকার পক্ষপাতী নন। আমিও আলাদা নই। তাই আমি চাই আমাদের এই বৈবাহিক জীবনটা জোরপূর্বক না হোক। শুধু দায়িত্ব কিংবা দায় পড়ে থাকা এই শব্দগুলো যেন এই সুন্দর সম্পর্কে না থাকুক। সময় লাগুক, আপত্তি নেই। তবে সম্পর্কটা যেন তিক্ত না হয়। যার সাথে বার্ধক্য কাটাবো তার সাথে তিক্ততা বেমানান। আমার সাথে আপনি অমত প্রকাশ করতেই পারেন। 

সর্বোপরি এই চিঠির সারমর্ম, আমি নিজেদের চিনার সুযোগ চাই। আপনি কি সেই সুযোগ আমাদের দিবেন? আমি চিঠি লিখেছি বিধায় আপনার লিখতে হবে এমন প্রয়োজনীয়তা নেই। তবে উত্তরটি আমার চাই।

ইতি,
আরশিয়া

[বিঃদ্রঃ স্বামীর নাম ধরে ডাকাটা বড্ড মডার্ণ। আমি মানুষটা একালের হলেও বড্ড সেকেলে। তাই “সাংবাদিক” সম্বোধন বেছে নিলাম।]

পৃথুল চিঠিটি হাতে দিয়ে বসে রয়েছে। তার ঠোঁটের কোনে অমলিন হাসি। সে বিছানা ছেড়ে চিঠিটি স্বযত্নে উঠিয়ে রাখল একটি কাঠের বক্সে। তারপর ওয়াশরুমে গেল ফ্রেশ হতে। 

কোহিনূরের কথার ঘোড়া তীব্র বেগে এগুচ্ছে। এর মাঝেই সুমী বেগম কাজ করছেন। পৃথুল রান্নাঘরের সামনে গেলো। দরজায় হাত বুকে ভাঁজ করে বলল,
 “আরশিয়াকে দেখেছ মা?”
 “ও তো কলেজে গেছে রে।”

বেগুনের তরকারিটা নাড়তে নাড়তেই কথাখানা বললেন সুমী বেগম। পৃথুল হ্যা না কিছু না বলেই কিছু সময় দাঁড়িয়ে রইল। কালো চোখজোড়া মেঝেতে এটে আছে। তখন সুমী বেগম বললেন,
 “ভাইজান বলছিলেন, বউভাতের কথা। আমি বলেছি পৃথুলের থেকে জেনে জানাব। নিয়ম অনুযায়ী তো আজ হবার কথা ছিল। কিন্তু আরশিয়া আবার বলল তার নাকি ছুটি নেই”
 “তাই বলেছে বুঝি।”
 “হ্যা, তুই কি বলিস?”

পৃথুল ডাইনিং এর চেয়ারটা টেনে বসল। কোহিনূর রান্নাঘর থেকে পরোটার হটপট'টা টেবিলে রাখল। হাসিমুখে বলল,
 “নতুন ভাবি বানাইছে।”

পৃথুল কিছুটা অবাক হল। মেয়েটির মাঝে এমন পরিবর্তন কল্পনা করেনি সে। পরোটা একটি প্লেটে নিতে নিতে শান্ত কণ্ঠে বলল,
 “বৌভাত না করলে হয় না?”
 “মোতালেব ভাই ফোন করেছিলেন। যতই হোক ও বাড়ির আত্নীয়দের একটা চক্ষুলজ্জার ব্যাপার আছে।”
 “বেশ, তুমি যেটা ভাল বুঝো। পরোটা ভাল হয়েছে। আমার চা'টা রুমে পাঠিয়ে দিও।”

খাওয়া শেষেই উঠে পড়ল পৃথুল। হাত ধুয়ে গা এলিয়ে দিল বিছানায়। বৌভাত মানেই জনসমাগম। কলিগরা আসবে। বিয়ের সময় খুব একটা মানুষকে দাওয়াত দেয় নি। কিন্তু বৌভাতে তো সেটা করলে হবে না। মানুষ আসবে, কথা উঠবে। আবারও রুদ্ধশ্বাসে সহ্য করতে হবে। ভাবতেই গাল ফুলিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস বের হল। ঘড়ির দিকে একদফা তাকাতেই দেখল এগারোটা বাজে। অফিস যেতে হবে।

**********

মোতালেব সাহেব বসার ঘরে বসে আছেন। আনহা বাড়ি নেই। আত্নিকা আজ কলেজে যায়নি বিধায় তার মুখোমুখি হতে বাধ্য হয়েছে। বড়মামাকে স্বভাবগত কারণে বড্ড অপছন্দ তার। কিন্তু মুখে প্রকাশ করার জো নেই। “বেয়াদব” ট্যাগ কপালে ঝুলাতে নারাজ সে। তাই হাসিমুখে কড়া করে কষমিষ্টি চা বানাল সে। হাসান সাহেব থমথমে মুখে বসে আছেন। তিনি জানেন মোতালেব সাহেব কি বলতে এসেছেন। মোতালেব সাহেব চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন,
 “বেয়াইন ফোন দিয়েছিল। বৌভাত এর নিমন্ত্রণ দিলেন।”
 “আমি যাচ্ছি না।”
 “ছেলেমানুষী থামাও হাসান।”
 “কোনটা ছেলেমানুষী ভাইজান? ওই ঠক যোচ্চরদের বাসায় নিজের মেয়েকে না দেওয়া? নাকি তাদের ঘরে একবিন্দু পানিও মুখে না তোলা?”
 “দুটোই।”

মোতালেব সাহেবের কণ্ঠে কাঠিন্য পরিলক্ষিত হল। তিনি বেশ হুংকার দিয়েই বললেন,
 “ও বাড়ি তোমার মেয়ে আছে, কুটুম হয়েছে তারা। এখন এসব মানায় না। ভুলে যেও না, তোমার কাজে কিন্তু মেয়ের সম্মান ও আছে।”
 “আমি তো এই কুটুম বানাতে চাইনি।”
 “তাহলে কি চেয়েছিলে? মেয়ে আয়বুড়ো থাকবে! শোনো হাসান তুমি বা তোমার মেয়ে আমার উপর রেগে থাকতেই পা্রো কিন্তু আমি আমার ভাগ্নীদের কথা ভেবেই করেছি।”
 
হাসান সাহেব চুপ করে রইলেন মোতালেব সাহেবের কথা শুনে। স্ত্রী গত হবার পর থেকে লোকটি ছায়ার মতো তার পাশে ছিলেন এতে সন্দেহ নেই। তার গোড়ামি অসহ্য লাগলেও মনে আশ্বাস ছিল, লোকটি তাদের ক্ষতি চায় না। কিন্তু আরশিয়ার সাথে যা হল, তাতে আশ্বাসটি নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে। হাসান সাহেব এবার খুব শান্ত গলায় শুধালেন,
 “ভাইজান, সত্যি করে বলুন তো। এই ছেলের প্রথম বিয়ের ব্যাপারটা আপনি সত্যিই জানতেন না?”

হাসান সাহেবের নির্লিপ্ত প্রশ্নে হতচকিত হলেন মোতালেব সাহেব। তার মুখশ্রীর রঙ পালটে গেল। কি উওর দিবেন কিছু সময় হাতড়ালেন। তারপর অর্ধ খাওয়া চায়ের কাপটা সেভাবে রেখেই উঠে দাঁড়ালেন। যাবার সময় শুধু এতোটুকু বললেন,
 “বৌভাত আগামী শুক্রবার। আর তুমি যাচ্ছ।”

**********

নীলাম্বরের সাদা মেঘগুলোর মুখ ভার। চৈত্রের শেষ গানে বিষন্নতা। তীব্র গর্জন ধরণীর হাড়পিঞ্জর কাঁপিয়ে দিচ্ছে। কিছুসময় তর্জন গর্জন করে তাদের এবার কান্নার পালা। অমনি শীতল বারিধারায় সুবোধ কিশোরীর ন্যায় স্নান করতে শুরু করল পৃথিবী। তীব্র সমীরের ঝাপটায় লুটোপুটি খাচ্ছে কিশোলয়। বাতাসে ভেজা মাটির গন্ধ। এত মনোমুগ্ধকর পরিস্থিতিতে বেশ ঝামেলায় পরল আরশিয়া। সকালের রৌদ্রছটা দেখে ছাতি আনেনি সে। খরা রোদের ছয় ঘন্টা পর এমন কিছু হবে সে তো অকল্পনীয় ছিল। তীব্র বৃষ্টির মাঝে অসহায়ের মতো একাডেমিক বিল্ডিং এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে। একটি রিক্সাও দেখছে না। রিক্সা থাকলে হয়ত এই ভুগান্তি হত না। অফিসের স্টাফদের কাছে অন্যসময় ছাতা থাকে। কিন্তু আজ নেই। এদিকে মেঘরাজির বিষাদও শেষ হবার নয়। তাই নিরুপায় হয়ে ভিজে যাবার সিদ্ধান্ত নিল আরশিয়া। ব্যাগখাতা ছাউনি বানিয়ে যেই চারকদম হাটা শুরু করল অমনি মাথার উপর বৃষ্টি পড়া থেমে গেল। মাথা তুলে তাকাতেই দেখল তার মাথার উপর একটি নীল ছাতি এবং সম্মুখে পৃথুল দাঁড়িয়ে আছে…………
.
.
.
চলবে...............................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন