প্রিয়াঞ্জনা - পর্ব ২২ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প


বিয়েটা হয়েই গেলো। অনাড়ম্বরভাবে। মায়ের চোখ শাসানো দেখে প্রাপ্তি বুঝতেও পারেনি কখন সে কবুল বলে ফেলেছে। প্রীতি সেখানে উপস্থিত ছিলোনা। তার মন কেমন যেন করছে। তাদের বাসায় দুইটা শিউলি ফুলের গাছ আছে। বিল্ডিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তারা। 'জমজ গাছ' বলে পাড়ার লোকে। প্রাপ্তি, প্রীতির বয়স আর গাছ দুটোর বয়স একই। ফুলে ফুলে মুখরিত হয়ে থাকতো দুটো গাছ। সবুজ পাতার মাঝে কমলা আর সাদা ফুলগুলো যেন অজানা কল্লোলে মেতে উঠতো। সু ঘ্রাণে ভরিয়ে তুলতো চারপাশ। গতকাল রাতে মন খারাপ করে হাঁটছিলো প্রীতি। মা যা করছেন তা অন্যায়। সেও বুঝতে পারছে। তবে প্রতিবাদ করা নিছকই বোকামি। তখনই প্রীতি দেখে একটি শিউলি গাছ কেমন নেতিয়ে পড়েছে। পাতাগুলো নির্জীব হয়ে আছে। সেই অজানা কল্লোলও তার নেই। ছেৎ করে উঠে প্রীতির অন্তর। তবে কি এটা কোনো অশনি সংকেত? মন খারাপ বেশি করে জাপটে ধরে তাকে। কেবল ঠোঁট আওড়ে বলে,
"মা ভুল করছো। বড় ভুল করছো।"
তারপর রাত পেরিয়ে ভোর আসে। ভানু তার প্রতাপ বিস্তার করে আসমানে। নীল আর লালের মিশ্র খেলা দেখা যায়। স্বর্ণা মহা উৎসাহে হলুদের শাড়ি পরিয়ে দেয় প্রাপ্তিকে। হলুদ ছোঁয়ানো হয়। ছাদের একপাশে রমণীরা হাসাহাসি করে। মশকরা, টিটকারি করে। প্রাপ্তির ছোট প্রাণ যেন নিষ্প্রাণ। কলসি ভরে পানি ঢালা হয়। একসময় পরানো হয় লাল শাড়ি। তারপর? 
তারপর বিয়েটা হয়ে যায়। কাকেরা কা কা করছিলো বাইরে। ফাহিমের মুখে বিস্তৃত হাসি। খাওয়া দাওয়া শেষে বিদায়ের পালা। প্রাপ্তি কান্না করেনি। কেবল মূর্তির মত দাঁড়িয়ে ছিলো। প্রীতি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছে। সে বুঝতে পারছে তাদের ঘরটা খালি হয়ে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে সবাই চলে যাচ্ছে। প্রাপ্তি মায়ের পানে তাকিয়ে মনে মনে ভাবে,'আমি তো তোমার সব কথা শুনতাম মা। আমার সাথে কেন এমন করলে তুমি?' মুখ ফুটে কিছু বলেনা। গাড়িতে উঠে বসে। ফাহিম তার হাত ধরে৷ একটু শক্ত করেই ধরে। অজানা একটা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যায় প্রাপ্তি। নরসিংদী শহরের দশ তালা উঁচু এক ভবনের সামনে গাড়ি থামে। ফাহিমের মা প্রাপ্তিকে গাড়ি থেকে বের করেন। লিফটে ওঠে তারা। ফাহিমদের সকল আত্মীয় স্বজন বিদেশে থাকে। বরযাত্রী বলতে তেমন কেউ ছিলোনা। ফাহিমের কিছু বন্ধু আর দুয়েকজন আত্মীয়। তারা প্রস্থান করেছে। ফ্ল্যাটটি খুবই বিলাসবহুল। রীতিনীতি শেষ করে ফাহিমের ঘরে বসিয়ে রেখে যাওয়া হয় প্রাপ্তিকে। ছোট মেয়েটা ভয়ে, শঙ্কায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ঘরে প্রবেশ করে ফাহিম। প্রাপ্তিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ে তার উপর। প্রাপ্তি স্তব্ধ হয়ে যায়। কি হচ্ছে? কেন হচ্ছে? আদোও কি তার সাথে এসব হওয়ার ছিলো? একসময় তীব্র ব্যথায় চিৎকার করে উঠে প্রাপ্তি। অনেক চিৎকার করে। কিভাবে অনুভূতি ব্যক্ত করা যায় প্রাপ্তির জানা নেই। তবে মনে হচ্ছে সিংহ শরীর থেকে এক থাবা মাংস নিয়ে গেলে যেমন লাগে তেমন লাগছে প্রাপ্তির। ফাহিম একবারও চিন্তা করেনি মেয়েটা ছোট। বয়স অল্প। সে নিজের কামনা মিটায়। একবার নয় কয়েকবার। মাঝরাতের দিকে অসহ্য যন্ত্রণায় জ্ঞান হারায় প্রাপ্তি। বেশ র ক্ত পাত হয়েছে তার।

মাঝরাতের দিকে ঘুম ভেঙে যায় প্রিয়াঞ্জনার। ধড়মড় করে উঠে বসে। খুব তৃষ্ণা পেয়েছে। কেমন শূন্য লাগছে ভিতরটা। মনটা বড় অস্থির লাগছে। ডান হাত দিয়ে কপালের ঘামটা মুছে নেয়। শাহবাজও সজাগ হয়ে যায়। 
"কি হয়েছে প্রিয়াঞ্জনা?"
"জানিনা শাহ্, কেমন অস্থির লাগছে।"
"পানি খাবে?"
"হুম"

শাহবাজ উঠে লাইট জ্বালায়। গ্লাস ভরে পানি এনে দেয় প্রিয়াঞ্জনার হাতে। ঢকঢক করে পানি পান করে প্রিয়াঞ্জনা। হাত,পা কাঁপছে তার। শাহবাজ তা খেয়াল করে। জড়িয়ে ধরে প্রিয়াঞ্জনাকে। 
"খুব খারাপ লাগছে?"
"বুঝতে পারছিনা। মনে হচ্ছে আমার যে কষ্ট পাওয়ার কথা তা অন্য কেউ পাচ্ছে।"

কথা জড়িয়ে আসছে প্রিয়াঞ্জনার। শাহবাজ মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় তার। ঘুমিয়ে পড়ে প্রিয়াঞ্জনা। 
সকালবেলা প্রিয়াঞ্জনা অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। পরোটা বানাচ্ছে এখন। শাহবাজ কিছুক্ষণ পর কলেজের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যাবে। নিজে রেডি হওয়ার পাশাপাশি টুকটাক সাহায্য করছে প্রিয়াঞ্জনাকে। সকালবেলা নাস্তা হিসেবে পরোটা আর চা তাদের দুজনেরই খুব পছন্দ। 
"একটা টিউশনি পেয়েছি প্রিয়াঞ্জনা।"

পরোটা খেতে খেতে বলে শাহবাজ। 
"ভালো খবর? কাকে পড়াবেন?"
"বাড়িওয়ালা চাচার ছোট মেয়ে। নাদিয়াকে।"
"মেয়েটা কি যে দুষ্টু শাহ্! আশেপাশের অনেকে ওর নামে বিচার নিয়ে আসে।"

তারা গল্প করছিলো আর খাচ্ছিলো। গরম চা জিহ্বায় লাগে প্রিয়াঞ্জনার। শাহবাজ ব্যস্ত হয়ে উঠে। ভালোবাসা পেতে সবারই ভালোলাগে। এই যে প্রিয়াঞ্জনার সামান্য ব্যথায়ও শাহবাজ এত ঘাবড়ে যায় এমন কি সবসময় হবে? হুট করেই এমন ভাবনা প্রিয়াঞ্জনার মস্তিষ্কে চলে আসে। অবান্তর! এমন হতেই পারেনা। প্রিয়াঞ্জনা উড়িয়ে দেয় নিজের ভাবনা।

সারাদিন কলেজ শেষে শাহবাজ বাড়ি ফিরে বিকেলে। প্রিয়াঞ্জনা অপেক্ষায় ছিলো। পুকুর পাড়টায় যাওয়ার ইচ্ছে বহুদিনের। শাপলা ফুলের দলেরা যেন হাত বাড়িয়ে ডাকছে তাকে। কি অপূর্ব সুন্দর পুকুরটা। চারদিকে গাছে ঘেরা। মাঝখানে শতবর্ষী পুকুর। ঈষৎ সবুজ টলমল পানিতে ফুটে আছে কতশত শাপলা৷ ছাদ থেকে প্রিয়াঞ্জনা অবাক নয়নে চেয়ে থাকে। কি সুন্দর! 
"চলুন শাহ্। আজ পুকুরপাড়ে যাই।"
"চলো। পাঁচটা থেকে নাদিয়াকে পড়াতে যাবো বলে আসছি।"

প্রিয়াঞ্জনা ঘড়িতে দেখে চারটা পঞ্চান্ন বেজে গিয়েছে। এখন গেলেও বেশিক্ষণ বসতে পারবেনা। 
"থাক, আজ যাবো না শাহ্। আপনি বরং আজ পড়াতে যান। আমরা কালকে যাবো।"
"ঠিক আছে। তুমিও আমার সাথে নিচে চলো তাহলে৷ চাচির সাথে বসে গল্প করলে।"
"তা যাওয়া যায়। বিথীর সাথে কথা হলো সেদিন। মেয়েটা খুব ভালো। অনার্সে পড়ছে।"
"চাচার মেঝো মেয়ে?"
"হুম"

শাহবাজ ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয় প্রিয়াঞ্জনার কপালে। শুধায়,
"একা একা খারাপ লাগে তোমার? বাড়ির কথা মনে পড়ে?"

প্রিয়াঞ্জনা শাহবাজের বুকে মাথা রেখে বলে,
"না, শাহ্। আপনি সাথে আছেন না আমার। তাছাড়া একা থাকার তো আমার অভ্যাস আছে।"
"তখন সময়টা ভিন্ন ছিলো প্রিয়াঞ্জনা। তুমি ভার্সিটি, পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে। বাড়িতে ফোন করে কথা বলতে পারতে। এখন তো...

থেমে যায় শাহবাজ।
"চাচি সেলাই কাজ পারেন। আমি ভাবছি শিখবো। সময়ও কাটবে? আমি কি শিখবো শাহ্?"
"তোমার যা করতে ভালোলাগবে তাই করবে। আমার পারমিশন লাগবে বোকা মেয়ে!"

শাহবাজের পাল্টা জবাবে মন প্রসন্ন হয়ে উঠে প্রিয়াঞ্জনার। তার শাহ্ আলাদা। সবার চেয়ে আলাদা।

শাহবাজের কাছে মোবাইলে কল আসে। প্রিয়াঞ্জনা নাজমা আর বিথীর সাথে গল্প করছে ড্রয়িং রুমে। শাহবাজ বসে আছে ডাইনিং টেবিলে। নাদিয়া বই, খাতা আনতে গিয়েছে। কল রিসিভ করে শাহবাজ।
"হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?"
"ওয়ালাইকুম আসসালাম। চিনেছেন?"
"জ্বি।"
"ছয়মাস সময় থেকে কিন্তু কিছুদিন মাইনাস হয়ে গেছে। ভাববেন না আপনি শিবপুরে আছেন আমরা জানিনা। টাকা রেডি রাখবেন।"

কল কেটে দেয় আগন্তুক। কয়েকটা দিন তো সুখেই ছিলো শাহবাজ। আবার সেই পিছুটান। টেনশনে মাথার রগ ফুলে উঠে তার। কি হবে ভবিষ্যতে? আড়াই কোটি টাকা! এত টাকা কোথায় পাবে শাহবাজ? তারা যদি কেস করে দেয়? ঝামেলার উপর আরেক ঝামেলার সৃষ্টি হবে। মামাদের কর্মে
 বি ষি য়ে উঠে অন্তর। বিশ্বাসঘাতকদের বিচার সৃষ্টিকর্তার হাতে ছেড়ে দেয় শাহবাজ। একটা কথা সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে ভবিষ্যতে বড় কোনো ঝড় আসতে চলেছে। 
 নাদিয়া বই নিয়ে পাশের একটি চেয়ারে এসে বসে। সাজগোছ করেছে সে। ঠোঁটে গোলাপি লিপস্টিক, চোখে গাঢ় করে কাজল। চুল ছেড়ে রাখা। নতুন একটি থ্রি-পিসও পড়েছে। ও বোধহয় জানেনা তার এসব সাজসজ্জা শাহবাজকে একটুও প্রভাবিত করছেনা। শাহবাজ পড়াচ্ছে নিজের মতো করে। একবার ফিরেও তাকাচ্ছে না নাদিয়ার পানে।
.
.
.
চলবে..............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন