চুপকথা - পর্ব ০৪ - মুশফিকা রহমান মৈথি - ধারাবাহিক গল্প


বিকালের আকাশে বিক্ষিপ্ত কমলা রঙ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সাথে মিশে আছে অব্যক্ত কিছু গল্প। বাতাসে মনখারাপের বিষন্নতা। বাগানবিলাসী ফুলে ঘেরা বারান্দায় হাটু গেড়ে বসে আছে আরশিয়া। তার মুক্তকেশ গড়াগড়ি খাচ্ছে মেঝেতে। হঠাৎ একটি ধোঁয়া তোলা চায়ের কাপ রাখা হল তার ঠিক সামনে। আরশিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে চাইতেই দেখল পৃথুল পকেটে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে। সে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। ভারি অভিমান তার আবেগগুলো শক্ত হস্তে দমন করল। নয়ত, স্বামী তার জন্য চা বানিয়ে আনবে এটা এক সময়ের ইচ্ছের ঝুলির সবচেয়ে প্রথম ইচ্ছে ছিল। আরশিয়া নিজের অভিমান গুনতে ব্যস্ত তখন কানে এলো গাঢ় কণ্ঠ,
 “আমি ছবিটি তার স্মৃতি আগলে রাখতে স্বযত্নে রাখি নি। রেখেছি সেই স্মৃতিগুলোয় আমার দোষটি কোথায় ছিল সেটা খোঁজার জন্য।”

পৃথুলের কাজ থেকে এমন কিছু শোনার জন্য কিছুতেই প্রস্তুত ছিল না আরশিয়া। সে অবাক হল বটে, কিন্তু প্রকাশ করলো না। দৃষ্টি কমলা রঙে আবৃত আকাশ থেকে নামিয়ে পৃথুলের মুখশ্রীতে নিল। তার শ্যাম মুখে ব্যাথার রেখা সুস্পষ্ট। শুধু তাই নয়, তার কণ্ঠের মাঝেও তীব্র বিষন্নতা পরিলক্ষিত হল আরশিয়ার। পৃথুল অবলীলায় তার পাশে হাটু গেড়ে বসল। মৃদু বাতাসে তার কপালে পরে থাকা কেশগুলো অবিন্যস্ত হয়ে যাচ্ছে বাড়ে বাড়ে। কিন্তু এতে পুরুষটি বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ধীর স্বরে বলল,
 “আপনি ঠিক বলেছিলেন, আমি সত্যি নিখুঁত অভিনেতা। চারটে বছর ধরে অভিনয় করতে করতে পটু হয়ে গেছি। এখন সত্যি নিজেও জানি না আমি কেমন? ভালো? মন্দ? জানি না।”

আরশিয়া নিশ্চুপ চোখে দেখে যাচ্ছে পৃথুলকে। তার মোটা স্বরের বিষন্নতা তার হৃদয়ে জমায়িত অভিমানের পাহাড়কে একটু একটু করে গলাচ্ছে। বক্ষস্থলে জমায়িত প্রশ্নগুলো গলা অবধি এসেও থেমে যাচ্ছে। একটা অদৃশ্য শক্তি তাকে বাঁধা দিচ্ছে। কথায় আছে—“ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়।” আরশিয়ার অবস্থাটি ঠিক তেমন। সে এবার আবেগে ভাসতে চায় না। তাই তো সব প্রশ্নগুলো আবারো তুলে রাখলো হৃদয়ের প্রকোষ্ঠে। তাকে আরোও অবাক করে পৃথুল বলে উঠল,
“আমাদের বিচ্ছেদটা আমার পক্ষ থেকে হয় নি। শতরুপাই প্রথমে লেটারটি পাঠিয়েছিল। অদ্ভুত কথা শুনবেন, তার আগের দিন সে আমাকে সারপ্রাইজ দিতে এসেছিল। সারাদিন আমরা একসাথে কাটিয়েছিলাম, খেতে যাওয়া, ঘোরাঘুরি, শপিং সব। অদ্ভুত না?”
 “সারপ্রাইজ দিতে এসেছিলো মানে?”
 “শুরু থেকে বলি? শুনবেন?”

পৃথুলের কাতর কণ্ঠে আবদারটা ফিরিয়ে দিতে পারল না আরশিয়া। আলতো করে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল। পৃথুল তখন মৃদু হেসে চায়ের কাপটি সামনে ধরল। মৃদু হাসিটি বিস্তারিত করে বলল,
 “চায়ের সাথে যে কোনো গল্প জমে ভাল।”

আরশিয়া খেয়াল করল, তার পাশে বসে থাকা পুরুষটির হাসিটি শুধু মোহনীয় নয়, হৃদয়কাঁপানোও বটে। অজান্তেই হাসির দমকে হৃদস্পন্দনের বেগ তরান্বিত হল। সেই সাথে দমিয়ে রাখা আবেগ গুলো নিজের শেকল ছাঁড়িয়ে হাহাকারে মাতল। পৃথুলের দৃষ্টি শেষ গগণের মস্ত বড় সূর্যটির দিকে। ঘন ঘন দুবার চুমুক দিয়ে গাঢ় স্বরে বলল,
 “আমার এবং শতরুপার বিয়েটা আমাদের মত এরেঞ্জ ছিল। আমার বাবা তখন বেঁচে ছিলেন। উনি পছন্দ করেছিলেন শতরুপাকে। বয়স আমার থেকে কম ছিল তার, বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। আপনি তার ছবি দেখেছেন, সে কিন্তু অনেক সুন্দরী। অনেকটা মোমের তৈরি শিল্পীর অলস সময়ের ভাস্কর্যের মত। বাবার স্বভাবটি ছিল প্রথমে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী। তাই প্রথম দেখাতেই শতরুপাকে তিনি পছন্দ করলেন। আমারও তাকে খুব ভালো লেগেছিল। আমি যেহেতু কম কথা বলি, আর সে ছিলো প্রচুর বাঁচাল। তাই তার কথা শুনতে আমার মন্দ লাগে নি। আমার কখন তার কাছে কথা হাতড়াতে হয় নি। সে বলত আমি শুনতাম। ভালো লাগতো। বিয়ের আগে আমরা মোট পাঁচবার দেখা করেছিলাম। পাঁচ বার আমার ঘুণাক্ষরেও মনে হয় নি তার বিয়েতে আপত্তি। তাই বিয়েটাও নির্বিঘ্নে হল। বিয়ের তিনদিনের দিন আমি জানলাম, তার একজন প্রণয়ন আছে। তাদের সম্পর্ক সাত বছরের। বিশ্বাস করুন আমি সেদিন প্রথমবারের মতো চূর্নবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল আমার পুরো পৃথিবীটাই যেনো বিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। ভালোবাসার যে বীজ আমি ক্ষণে ক্ষণে বহু যত্নে রোপন করেছিলাম, সেই ভালোবাসাকে যেনো কেনো পায়ে পিষে বিনষ্ট করে দিল। সে আমাকে দোষারোপ করল আমি নাকি তার জীবন নষ্ট করেছি। আচ্ছা, আপনিই বলুন আরশিয়া, এতে আমার দোষটি কোথায়? হ্যা, আমার দোষ ছিল। আমি তাকে অতীতের কিছুই জিজ্ঞেস করি নি। আর আমাকে বলে নি। শুধু এটুকু দোষের জন্য এত বড় অপবাদ দেওয়া যায় কি?”

আরশিয়া চুপ করে রইল। উত্তর হাতড়ালো কিন্তু পেল না। এখানে তো পৃথুলের দোষ নেই। শতরুপা যদি তার প্রণয়ঘটিত ব্যাপারটি নিয়ে সিরিয়াস ছিল তবে তার উচিত ছিল প্রথমেই পৃথুলকে জানান। সে তা করেনি। তাহলে কেন দোষ দিল সে?

আরশিয়া শান্ত গলায় শুধাল,
 “একারণেই বিচ্ছেদ ঘটেছে?”
 “নাহ, কারণ এটা ছিল হয়ত। কিন্তু এইজন্যই বিচ্ছেদ ঘটেছে কিনা নিশ্চিত ভাবে বলতে পারছি না। যেহেতু পড়াশোনার খাতিরে আমি তিন বছর বাহিরে ছিলাম, তাই এই বিচ্ছেদ ব্যাপারটা আমার কাছে আহামরি কিছুই ছিল না। কারণ সেখানে হরহামেশাই বিচ্ছেদ ঘটে। আর আমার মতে একটা মানুষের সাথে জোরপূর্বক থাকার চেয়ে আলাদা হয়ে সুখে থাকা শ্রেয়। আমি শতরুপাকে সেটাই অফার করলাম। কিন্তু মেয়েটি আমার উপর চেতে গেল। সে বিচ্ছেদ চায় না। কারণ তার পরিবার তাকে মেনে নিবে না। আর তার পড়াশোনাও চলমান। তাই এখন সে ছন্নছাড়া হতে পারবে না। তার এই আবদারে আমার রাগ হল বটে। কিন্তু গিলে নিলাম। ভাবতাম দেখি কি হয় সামনে। দিন যেতে লাগল, আমার তার সাথে ঘনিষ্টতা বাড়তে লাগল। একদিন হুট করেই বলল, সম্পর্কটাকে নতুনভাবে সুযোগ দিবে। জানেন, সেদিন আমার থেকে সুখি ব্যক্তি বুঝি কেউ ছিল না। সে হাসিমুখে মেনে নিলাম। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ওর ব্যবহারে পরিবর্তন এল। মেয়েটির মাঝে কিছু একটা ছিল জানেন, খুব জলদি মানুষের মন জয় করে নিতে পারত। আমাদের বাসার সকলের চোখের মণি হয়ে উঠল। সময়গুলো এতোটা তীব্রগতিতে যাচ্ছিল যে আমি নিজেকে শতরুপার মাঝে ভাসিয়ে দিলা। এর মাঝে আমাকে রাজশাহী যেতে হল পনের দিনের জন্য। শতরুপা চাইল, সে তার বাবার বাসায় থাকবে। আমিও বাধা নেই নি। আমার মাকে তো দেখেছেন, সে কিন্তু ইহজীবনে টিপিক্যাল শ্বাশুড়িদের মত নয়। ফলে তার কোনও অমত ছিল না। আমি রাজশাহী গেলাম। দশদিনের মাথায় শতরুপা রাজশাহী এল আমাকে সারপ্রাইজ দিতে। এখনকার জেনারেশনদের শতদিন, সহজ্র দিনের কত ট্রেন্ড আছে না! সে আমাকে শতদিনের সারপ্রাইজ দিতে এসেছিল। সেই দিনটা সত্যি অনেক সুন্দর ছিল। যে ছবিটা দেখেছেন সেটি সেদিনের তোলা। আমরা কত সুখি ছিলাম। পর দিন শতরুপা বাড়ি ফিরল। তার পাঁচ ঘন্টার মাঝেই আমার কাছে একটি কুরিয়ার এল, সেখানে ডিভোর্স লেটার। শতরুপা সিগ্নেচার করে দিয়েছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করতে ফোন দিলাম। সে ফোন ধরল না। মা-বাবা আমাকে প্রশ্ন করলেন আমি উত্তর দিতে পারিনি জানেন। কারণ উত্তর আমার কাছে ছিল না। আমি পাগলের মত তার কাছে উত্তর খুঁজেছি। একটা সময় আমি জেদ ধরে বসলাম আমি সাইন করবো না। কিন্তু এই জেদ আমাকে কত ভুগান্তির শিকার ক্রল, সে স্মৃতিগুলো আমি মনে করতে চাই না। বিশ্রী, কালো স্মৃতি সেগুলো। অবশেষে মা আমাকে মিনতি করা শুরু করল। আমার পরিবারের উপর দিয়ে যাওয়া ঝড়টা আমিও আর মানতে পারছিলাম না। তাই শেষমেশ ইতি টানলাম একশত দিনের সংসারকে।”

সূর্য অস্ত গেছে। লাল রঙ টুকু ধীরে ধীরে শুষে নিচ্ছে তমসাদেবী। বাতাসের নিস্তব্ধতা। বেগ মন্থর। বৃষ্টি নামবে বলে বিষন্ন মেঘেরা দল পাকিয়েছে দক্ষিণে। আরশিইয়া নিশ্চুপ। তার মুখে বুলি নেই। পৃথুল একটু সময় নিয়ে বলল,
 “আমি এখনো সেই স্মৃতিগুলোর মাঝে নিজের দোষ খুঁজি। হ্যা আমি আপনাকে নিজ থেকে বলিনি। কারণ তিক্ত স্মৃতি যত ভুলে থাকা যায় ততই ভালো।”

পৃথুল চোখ নামিয়ে তাকালো আরশিয়ার দিকে। তার চোখে শত বেদনার আহাজারি। আরশিয়ার চা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। সে এখন চুমুক দেয়নি। পৃথুল মৃদু হাসল, তারপর বলল,
 “চা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। এই চা খাওয়া আর বিষ খাওয়া সমতুল্য। দিন ফেলে দেই।”

বলেই চায়ের কাপটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। যাবার দিকে পা বাড়িয়ে থেমে গেলো সে। পেছনে ফিরে দেখল আরশিয়া এখনও বসে আছে আগের ন্যায়। পৃথুল ধীর স্বরে বলল,
 “বৃষ্টি নামবে আরশিয়া। ভেতরে আসুন।”

বলেই সে প্রস্থান করল। আরশিয়া এখন ঠায় বসে রইল। মস্তিষ্ক এবং হৃদয়ের দ্বন্দে সে পরাজিত হয়ে গেছে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় সে, আর মাত্র আটানব্বই দিন বাকি_______

*********

সকালে পৃথুলের ঘুম ভাঙল দেরিতে। তীব্র সোনালি কিরণ তখন ঘরের শীতল মোয়াজিকের মেঝেকে উত্তপ্ত করে তুলেছে। পর্দাগুলো সব সরিয়ে একপাশ করা। পৃথুল উঠে চোখ ডলে ঘুম ঘুম চোখে একবার চাইল ঘড়ির দিকে। নয়টা বাজতে চলেছে। তার অফিস আজ দুপুরে। তাই ঘুম যে বেলা অবধি হয়ে গেছে সেদিনে তার খেয়াল নেই। মাঝে একবার তাকাল সে। বিছানাটি শীতল। অর্থাৎ পাশে থাকা রমনী অনেক পূর্বেই বিছানা ছেড়েছে। পৃথুল একদফা হাত বুলাল স্থানটিকে। মেয়েটি কাল থেকেই মৌন। তার গল্প শুনেছে বটে কিন্ত কোনো মতামত সে দেয়নি। সে আদোপি বিশ্বাস করেছে কি না, সেটা জানা হয়নি। অবশ্য যে নাটকীয় কাহিনী তা অবিশ্বাস করাটা অস্বাভাবিক নয়। পৃথুল দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর বিছানা ছাড়তেই ছোট সাইড টেবিলের উপর একটি ভাঁজ করা কাগজ পেল। কাগজটি কিসের তাই দেখার জন্য খুলতেই দেখল গোটা গোটা হাতের লেখা স্বল্প পরিমাপে একটি চিঠি। পৃথুলের চোখ সংকুচিত হল। সে চিঠিটি পড়তে শুরু করলো।
 “সাংবাদিক…………
.
.
.
চলবে.........................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন