শাহজাহান তন্ময় - পর্ব ১৯ - নাবিলা ইষ্ক - ধারাবাহিক গল্প


নিজেকে সবসময় নিয়ন্ত্রণে রাখা তন্ময় আজ একটু ব্যাকুল বটে। প্রেয়সীকে দেখার তৃষ্ণা তার মিটছেই না। কতবার ঘুরেফিরে অরুকে দেখল তার হিসেব নেই। অরুও আজ বড্ড বিরক্ত করছে। চুপটি করে এক জায়গায় একদন্ড বসছে না। পুরো ফ্ল্যাট জুড়ে ওর বিচরণ। একটু তার সামনে বসলে কি সমস্যা? বসুক চুপটি করে। তন্ময় লুকিয়ে অগোচরে দেখবে। এখন কী দেখা ও মানা? লিভিংরুমের সোফায় এমন টেবিলল্যাম্পের মতো সে বসে কার জন্য? অরুর জন্যই তো। নাহলে তন্ময় নিজের রুমে থাকতো। 

টেলিভিশনের চ্যানেল পাল্টাতে নিতেই আড়চোখে খেয়াল করল প্লেট হাতে অরু ছুটে আসছে। ওপাশটা দিয়ে না গিয়ে, ঠিক তার সামনে দিয়ে যাবে। এবার তন্ময় অজান্তেই এক অদ্ভুত কাজ করে বসল। ডান পা খানা হঠাৎ মেলে দিল৷ অরু ছুটতে গিয়ে তার পায়ের সঙ্গে হোঁচট খেল। গিয়ে পড়ল তন্ময়ের ওপর। হঠাৎ গভীর সংস্পর্শে এসে তন্ময় কিংকর্তব্যবিমুঢ়! ওতপ্রতভাবে জড়িয়ে আবিষ্কার করল, মস্তিষ্ক থমকে আছে। হাত জোড়া দ্রুত বেগে অরুকে সামলাতে গিয়ে পড়েছে অরুর কোমরে। এমনটা মোটেও প্রত্যাশা করেনি। বুঝতেই পারেনি অরু এভাবে তার ওপর পড়বে। এই বিষয়টা মস্তিষ্কে ছিলো না। লজ্জাজনক এক অবস্থায় পড়ে অরুও হতভম্ব। হাসফাস মাথা তুলে তাকাতেই তন্ময়ের ছন্নছাড়া, উদগ্রীব দৃষ্টিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো। সেভাবেই দ্রুত উঠতে নিয়ে আরেকবার পড়ল। তৎক্ষণাৎ করুণ গলায় বারংবার সরি বলে চলল। 

অরু হন্তদন্ত ভঙ্গিতে উঠে আসল। এক দৌড়ে চলে গেল। রেখে গেল তাজ্জব তন্ময়কে একা। তন্ময় দীর্ঘক্ষণ সেভাবেই বসে। কিছুক্ষণ শ্বাসপ্রশ্বাস ও চলাচল হতে বিরত ছিল। মস্তিষ্ক সচল হতেই দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে ফেলল। গলাটা শুকিয়ে গেল। পানি খাওয়া দরকার। ভেতরটা এমন শব্দ করছে কেন? মনে হচ্ছে তার এই দ্রুতবেগে চলা হার্টবিট পুরো এলাকা শুনতে পাবে৷ চোখজোড়া বন্ধ করতেই ওই নরম শরীরের সংস্পর্শের দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠছে। 

চটজলদি উঠে নিজের রুমে চলে এলো। সোজা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। দমবন্ধ হয়ে আসছিল। প্রকৃতির বাতাস দীর্ঘক্ষণ উপভোগ করেই শান্ত হলো। তারপর নিজের পায়ের দিক নজর দিলো। ইচ্ছে করছে পা-টা ভেঙে ফেলতে। তখন কেন এমন বিশ্রী কাজটা করল? অরু নিশ্চয়ই ভয় পেয়েছে। হাইপার না হয়ে পড়ে মেয়েটা! 

_____

অরুর কথা ভেবে তন্ময় সিদ্ধান্ত নিল ঘুরতে বেরোবে সবাইকে নিয়ে। মাইন্ড ফ্রেশ হবে। এভাবেও ওরা ঈদের দিন ঘুরতে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে থাকে৷ সেই সকাল থেকে ঘ্যানঘ্যান করছিল বেরোবার জন্য। শাবিহা জবেদা বেগমের রুম থেকে বেরিয়ে এলো তন্ময়ের রুমে। করুণ গলায় শুধালো, 

'বিকেল হতে চলল। নিয়ে যাবে না? নিচে গাড়িও পাঠিয়েছে বাবা। চলো না ভাইয়া।'
'পাঁচমিনিটের মধ্যে সবাই নিচে নাম। আসতেছি।'

শাবিহার চোখমুখ উজ্জ্বল হলো। রুবি, অরু, দীপ্ত ওদের ডাকতে ডাকতে ছুটে বেরিয়েছে। তন্ময় ততক্ষণে পাজামা-পাঞ্জাবি পরিবর্তন করে ফেলেছে। এবার কালো পাঞ্জাবি পরেছে সাদা পাজামার সাথে। সিলভার রঙের বড়ো হাত ঘড়িটা পরেছে৷ স্যাট করা চুলে আরেকবার ব্রাশ ছোঁয়াল। পারফিউম শরীরে স্প্রে করছে ওসময় দীপ্ত এলো দ্রুত পায়ে। ছোটোখাটো স্বাস্থ্যবান দীপ্ত ঝাকড়া চুলগুলো দুলিয়ে বলল, 

'ভাইয়া আমার চুল করে স্যাট দাও প্লিজ।'

তন্ময় হেয়ারস্প্রে হাতে নিল। দীপ্তর চুলে মেরে চুলগুলো আঁচড়ে পরিপাটি করে দিল। দীপ্ত সরল-সুন্দর হেসে আরেকটি আবদার করল, 

'পারফিউম প্লিজ।'

তন্ময় পারফিউম ও ওর শরীরে স্প্রে করে দিল। নিজেকে শুঁকতে শুঁকতে দীপ্ত ফটফট করে বলতে থাকল, 

'এই পারফিউমটা খুব ফেভারিট। শুধু আমার না অরু আপুর ও।'

অরু অবাক হলো বটে। ভীষণ আগ্রহ নিয়ে শুধালো, 

'তুই কীভাবে জানলি?'
'জানব না? আমি যখনই এই পারফিউম দেই আপু রাগ হয়। রাগী গলায় বলে দিতে না। এটা শুধু তন্ময় ভাইয়ার পারফিউম শুধু সেই দিবে, এসব বলে। আবার লুকিয়ে এই পারফিউমের ঘ্রাণ ও শুঁকে।'

তন্ময় হেসে কথা ঘুরিয়ে ফেলল, 

'যা দেখ সবার হয়েছে কি-না!'
'আচ্ছা।'

মানিব্যাগ, সেলফোন পাঞ্জাবির পকেটে ভরে বেরিয়ে গেল। কেউ নেই লিভিংরুমে। সবগুলো জবেদা বেগমের রুমে হৈচৈ করছে। তন্ময় তাদের নিচে নামতে বলে বেরিয়ে আসে৷ লিফটে নামছে দেখে দ্রুত নাম্বার টিপে। গ্রাউন্ডফ্লোর! তাদের ফ্লোরে থামতেই দরজা খুলে। ভেতরে একজন উপস্থিত। তন্ময় তেমন খেয়াল করেনি। ভেতরে ঢোকে। দরজা লাগবে ওসময় ছুটে আসতে দেখে দীপ্তকে। তাই পা বাড়িয়ে লিফট আটকায়। দীপ্ত হেসেহেসে ঢুকে তন্ময়ের পাশে দাঁড়ায়। দু'হাতে বড়ো ভাইয়ের হাত ধরে রাখে। কৈ মাছের মতো নাচতে নাচতে শুধায়, 

'আমরা কোথায় যাচ্ছি ভাইয়া?'
'কোথায় যেতে চাচ্ছে আমাদের দীপ্ত?'
'আই লাইক টু ওয়াচ সি।'
'সি? একদিনের মধ্যে গিয়ে সি দেখে ফেরা তো হবে না৷ আজ অন্যকোথাও যাই৷ পড়ের বার সমুদ্রের ট্রিপে যাব, ওকে?'
'ওকে। তাহলে অন্যকোথাও কই যাচ্ছি?'
'আশেপাশে।'

দীপ্ত পেছনে দাঁড়ানো সুন্দর মেয়েটিকে খেয়াল করল। ভদ্রতার খাতিরে হাসল সে। ছোটো গলায় বলল, 

'হ্যালো আপু।'

মেয়েটি খুশিই হলো। চোখমুখ উজ্জ্বল। নিচু হয়ে দীপ্তর নাকে টোকা দিল, 

'হ্যালো সুইটহার্ট। কী নাম তোমার?'
'দীপ্ত। আপনার আপু?'
'ভীষণ সুন্দর নাম তোমার দীপ্ত। আমার নাম রেবেকা। নাইস টু মিট ইউ।'
'মি টু রেবেকা আপু।'

রেবেকা মুগ্ধ হয়। বড়ো ভাইয়ের মতো ছোটো ভাইও মুগ্ধকর। রেবেকা আরেকবার লম্বাটে তন্ময়ের দিক তাকায়। লিফট থামতেই বেরোয় তিনজন। দীপ্ত এখনো এটাসেটা নিয়ে কথাবার্তা বলছে রেবেকার সঙ্গে। তন্ময় বাম হাতে হাত ধরে দীপ্তর৷ গাড়ির সামনে এসে পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢোকাল। শাবিহা চাবি দিয়ে গিয়েছিল৷ কিন্তু সে আনতে ভুলে গিয়েছে। দীপ্ত খেয়াল করে বলল, 

'ভাইয়া আমি নিয়ে আসি?'
'আচ্ছা। তাড়াতাড়ি এসো।'

দীপ্ত যেতেই তন্ময় খেয়াল করল মেয়েটা এখনো দাঁড়িয়ে। অপ্রস্তুত রেবেকা বলল, 

'হ্যালো, আমি রেবেকা। সিক্সথ ফ্লোরের।'
'হ্যালো।'

তন্ময় ভদ্রতাসূচক মাথা দোলায়। সেসময় তার সেলফোন বেজে ওঠে। তন্ময় দেখে ইব্রাহিমের কল। এক্সকিউজ মি বলে অদুরে এসে কল রিসিভ করে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে৷ বন্ধুবান্ধব বেরোনোর প্ল্যান করছে। তন্ময় জানাল সে রাতে ফ্রি। এখন বেরোচ্ছে। সে হিসেব ধরেই ইব্রাহিম বলল, 

'তাহলে বারোটার পর। লং ড্রাইভে বেরোই। আমি জানাচ্ছি বাকিদের।'
'আচ্ছা।'
'অ্যাই শোন। তোর ছুটি কদিন?'
'নয়দিন!'
'একটা ট্যুর দিলে কেমন হয়?'
'মা বাসায় একা!'
'উপস ভুলে গেছি। আচ্ছা রাখি!'

দীপ্ত চলে এসেছে। চাবি তন্ময়ের হাতে দিল। পেছনে শাবিহা, অরু, রুবিও হাজির। রেবেকা তখন নিজের গাড়ির সামনে। ঢুকবে ওসময় শাবিহাকে দেখে হাসল। তারা সেম ব্যাচের ছিল। ভালো খাতির আছে টুকটাক। সেই সুবাধে আলাপ করতে বসল। তন্ময়ের ডাকে শাবিহা বলল, 

'পড়ে আলাপ হবে। এখন আসি।'
'আচ্ছা।' 
.
.
.
চলবে.............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন