"সরি। আসলে আপনাকে বললে বিরক্ত হবেন কি না জানা নেই তো, তাই কোহিনুরকে বললাম। অভ্যাস আর কি।"
বড্ড ভাবলেশহীনভাবে উত্তর দিলো পৃথুল। যা আরশিয়ার অহমিকায় লাগল। সে সেদিনের কথার প্রেক্ষিতেই এমন বাকা উত্তর দিচ্ছে তাতে দ্বিমত নেই। আরশিয়া নিজের রাগ গিলে আবার ও শুধালো,
"রাতে কি কাজ? কোথাও কি যাচ্ছেন?"
কিন্তু পৃথুল উত্তর দিল না। সে তার ফাইল গোছাতে ব্যস্ত। ফলে সুপ্ত রাগ আগ্নেয়গিরির রুপ নিল। ফলে আরশিয়া এমন একটা কাজ করে বসল যার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না পৃথুল। যখন বাহিরে যাবার জন্য পা বাড়ালো তখনই ঘরের দরজাটা সজোরে বন্ধ করে দিল আরশিয়া। মুহুর্তেই হাতের ফাইলটা নিয়ে বিছানায় ছুড়ে মারলো। তার সম্মুখে রুদ্রমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার মুখশ্রী কঠিন হয়ে আছে। ফর্সা মুখশ্রীতে ক্রোধের রেশ স্পষ্ট। কঠিন গলায় বলল,
“আমি আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি। যেহেতু সরাসরি প্রশ্ন করেছি সরাসরি উত্তর দিলেই কৃতার্থ হব।”
পৃথুলের সময় লাগল আরশিয়ার আচরণ হজম হতে। শান্ত, চুপচাপ ভাবা মেয়েটির রুদ্ররুপ এতোটা প্রখর হবে কল্পনা করেনি। কিন্তু নিজেকে সামলে নিল নিপুন ভাবে। নিজের বিস্ময় মোটেই প্রকাশ করল না। স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
“আমাকে একটি নিউজের কাজে কক্সবাজার যেতে হবে।”
“সেটা আগে জানানো হয়নি কেন?”
“প্রশ্নটির উত্তর আপনার জানা নেই!”
আরশিয়া এবার একটু দমলো। বক্ষস্থল চিরে নির্গত দীর্ঘশ্বাসটি গোপন করে বলল,
“সরি।”
“সরি?”
“আই এম সরি। সেদিন ওভাবে বলা উচিত হয়নি। আমি বিরক্ত ছিলাম না। আমার মন মেজাজ ভালো ছিল না। সেটার কারণ অবশ্যই আপনি নন। বাট আমার এঙ্গার ইস্যু আসে। আমার প্রচুর রাগ, আর সেটা কুল ডাউন হতে সময় লাগে। তখন আমার স্পেস প্রয়োজন হয়। আমি জানি আপনার এটা জানার কথা নয়। আর আমার মনে রাখা উচিত ছিল যে আমি নিজের বাসায় নেই। কিন্তু ওই মুহূর্তে আমি স্বাভাবিক ছিলাম না। আই এম সরি। আমি সেদিনই বলতাম, কিন্তু আপনি সুযোগ দেননি। অভিমান জমিয়ে রেখেছিলেন। অভিমান করাটা যথার্থ বটে, কিন্তু আমার মনে হয় মাঝে মাঝে মনের কথা মনে রাখলে সেটা শূল হয়ে উঠে, সেই শূলে নিজেই আহত হতে হয় ক্ষণে ক্ষণে। তাই বিবাদ বাধুক, কিন্তু মনের কথা প্রকাশ করা উচিত।“
পৃথুল হাতজোড়া বুকে বেঁধে এত সময় শান্ত চিত্তে শুনছিল আরশিয়ার কথাগুলো। কোনো উত্তর দেয়নি। তার প্রখর দৃষ্টি হামলে পড়ছে আরশিয়ার মুখশ্রীতে। মুখোভাব স্থির, দীর্ঘ নেত্রপল্লবগুলো বহুসময় পর একবার বুঝল। তারপর মুখ খুললো স্মিতভাবে,
“কিন্তু আপনি যে বলেছেন আমার চুপকথাগুলো বুঝতে চান।”
আরশিয়া ঠোঁট কামড়াল। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাল। নতমস্তকে ধীর স্বরে বলল,
“এজন্যই ক্ষমা চাচ্ছি।”
“কিন্তু আমি তো আপনার ক্ষমা বা সরি চাইনি।”
পৃথুলের কথায় মুখ তুলে চাইলো আরশিয়া। খানিকটা অবাক হল, লোকটি এখনো আগের মতই তার দিকে চেয়ে রয়েছে। প্রখরতা বিন্দুমাত্র কমেনি। আরশিয়া একটু সময় নিয়ে মলিন স্বরে বলল,
“আমার রাগের উৎস বড় মামা। আমাদের বিয়েতে যে ভুল বোঝাবোঝি শুরু হয়েছিল তার কেন্দ্রবিন্দু মামা। মামা জানতো আপনার বিয়ের কথা, কিন্তু সে বাবা থেকে লুকিয়ে যায়। একারণে বাবা আপনাদের ভুল বুঝেন, না জানি কত কি মা কে শুনিয়েছেন। ছিঃ ভাবলেও লজ্জা লাগছে। ব্যাপারটা আমি মোটেই মানতে পারিনি। একটা মানুষ এতোটা স্বার্থপর কিভাবে হতে পারে। তার স্বার্থপরতার আজ আপনি এবং এই বাড়ির কি সম্মানটা থাকল বাবার কাছে? না বাবার সম্মান থাকল এই বাড়িতে। আত্নীয়তার সম্পর্কটা তিক্ততায় ভরে গেল। মামার এমন কাজটা আমি মোটেই মানতে পারছিলাম না। সে তো মামা, ভাগ্নীর এতো বড় ক্ষতি করে কি লাভ হল তার?”
আরশিয়ার কন্ঠ কাঁপছে। তার কথাগুলো দলা পাকাচ্ছে। পৃথুলের দৃষ্টি এবার নরম হল। দৃষ্টি এখন চোখ থেকে সরে আরশিয়ার ঠোঁটের নিচের ছোট তিলটিতে আটকালো। কিছুসময় নীরবে দেখল সেটা। তারপর আলতো হাতে ছুঁলো তার নরম গাল। পৃথুলের স্পর্শে ক্ষণিকের জন্য কেঁপে উঠল আরশিয়া। লোম অবধি দাঁড়িয়ে গেল। লজ্জা, ভালোলাগার রঙ গুলো মিলে মিশে একাকার হল। পৃথুল তখন ঠান্ডা স্বরে বলল,
“সবসময় কাঠগড়ায় দাঁড় করানোটা মানুষের প্রবৃত্তিগত স্বভাব হয়ে গিয়েছে। আপনিও সেই স্বভাবের বশীভূত হয়ে গেছেন। আমি বলছি না বড় মামা যা করেছে তা উচিত, তবে মানুষের মস্তিষ্ক থেকে জটিল বস্তু কিন্তু পৃথিবীতে নেই। সাতশত কোটি মানুষের কারোর চিন্তাধারা কারোর সাথে মিলবে না এটাই স্বাভাবিক। মামামশাই ঠিক কেন এই ব্যাপারটি লুকিয়েছেন তা কেবল মামামশাইই জানেন। তাই শিক্ষিকা মহোদয়া, অহেতুক রাগ করবেন না। আপনার কোমল মুখে রাগটি বড্ড বেমানান।”
“আপনার রাগ হচ্ছে না?”
“কেন বলুন তো?”
“বাহ রে! আপনাকে অহেতুক অপমানিত হতে হয়েছে।”
“না হয়েছে, কিন্তু সেই অপমানের বদলে আমি আপনাকে পেয়েছি। শোধ বোধ। সত্যি বলতে মামামশাই, কথাটা না লুকোলে তো আমাদের বিয়েটাই হত না। প্রথমেই আপনার বাবা আমাকে শর্ট লিস্ট করে দিতেন। এর চেয়ে যা হয়েছে ভালো হয়েছে, অন্তত দয়া করে হলেও আমাকে আপনি বিয়ে তো করেছেন।”
বলেই মৃদু হাসল পৃথুল। কিন্তু আরশিয়ার হাসি মিলিয়ে গেল। সে দয়া করে বিয়ে করেনি, করেছে বড়মামার সাথে জেদ করে। আবারো মস্তিষ্ক স্মরণ করে দিল আট দিন কেটে গেছে। আর মাত্র বিরানব্বই দিন। কিন্তু কোথাও একটি আশ্বাস রয়েছে সম্পর্কটি হয়তো শুধু একশত দিনের খোরাক নয়। আরশিয়া বিড়বিড়িয়ে বলল,
“আপনার রাগ কি কমেছে?”
“কি মনে হয়?”
“মনে তো অনেক কিছুই হয়, কিন্তু ঠিক না কি ভুল বুঝবো কি করে?”
স্বর খাদে নামিয়ে কথাখানা বলল আরশিয়া। পৃথুল এবার গাঢ় স্বরে বলল,
“রাতে তৈরি থাকবেন, একটা সারপ্রাইজ আছে।”
বলেই ফাইলটা হাতে নিয়ে নিল। আরশিয়াকে দ্বিতীয় প্রশ্নের সুযোগ দিল না সে। বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। আরশিয়া হতবাক নয়নে তাকিয়ে রইল। ঠোঁটের কোনে প্রসন্নতার কুসুম প্রভা। মানুষটি তার চরিত্রের বিপরীত বটে, কিন্তু মন্দ নয়___________
*******
পড়ন্ত বিকালের শেষ প্রহর। বিরাট কমলা সূর্যটি পশ্চিমে হেলে আছে। আকাশে কমলা রঙ্গের ছিটা প্রগাঢ় হচ্ছে। কোকিলের গান দূর থেকে ধ্বনিত হচ্ছে। সেই গানে মিশে আছে প্রচন্ড বিষন্নতা। বিষাদমাখা গান বুকে লাগছে। না জানে কত কষ্ট সেই মধুসখার। এই বিষন্ন সুরে চোখ আনমনেই ভিজে এল আত্মিকার। যেন প্রকৃতির সব বিষাদ তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। এমন হয় কেন? অজান্তেই কেনো মন খারাপ হয়? তার তো মন খারাপ হবার কারণ নেই। এই তো বাবার সাথেও এখন দ্বন্দ চলছে না, আনহাটাও তার পেছনে লাগছে না। তাহলে শত শত দুঃখ তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে মন ভরে কাঁদলে হয়তো ভালো লাগবে। অথচ চারপাশে কত প্রসন্নতার ছড়াছড়ি, কত উল্লাস। পহেলা বৈশাখের উপলক্ষে তরুনদের মাঝে আলাদা ঝোঁক। ব্যাপারটা আত্মিকাকে বিরক্ত করে, এমনি সময় বাংলায় ইংরেজি মিশিয়ে বলতে তারা দ্বিধাবোধ করে না। এমন কি শুদ্ধ বাংলাও তাদের কাছে মনে হয় হিব্রু কোনো ভাষা। একলাইন নিখুঁত বাংলায় বলতে বললে বলবে, “ডুড, ইটস সো ব্যাকডেটেড”। বিভূতিভূষণ, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদারের গল্প তাদের কাছে নট সো কুল। অথচ পহেলা বৈশাখ এলেই আদ্যোপান্ত বাঙ্গালী হবার ঝোঁক উঠে। তখন পান্তা ইলিশ খেয়ে নিজেকে বাঙালী বানানোর তালে ব্যস্ত হয়ে উঠে তারা। অতীব হাস্যকর লাগে এগুলো আত্মিকার কাছে। এই যে পাশে বসা মেয়েটিকে একটি রবীন্দ্রনাথের কবিতাকে পোস্টারে অংকনের দায়িত্ব দিয়েছে আত্নিকা, অথচ সে এটুকু বুঝতে পারছে না এই পঙক্তির অর্থ। বিরক্তিকর বটেই, কিন্তু বিরক্তিটুকু গিলে নিল আত্মিকা। মৃদু স্বরে বলল,
“নব অতিথিরে তবু ফিরাইতে নাই কভু–
এসো এসো নূতন দিবস!
ভরিলাম পুণ্য অশ্রুজলে,
আজিকার মঙ্গলকলস”---- এখানে কবি অতীতের অশ্রু নিয়েই নতুনকে বরণ করতে চাচ্ছেন। যতই দুঃখ, বিষাদ থাকুক না কেন তিনি নতুনকে ফিরিয়ে দিবেন না, এতোটুকু বুঝলেই হবে।”
“হাও ট্যাকি! তুমি এতো কঠিন শব্দের অর্থ বুঝতে পারো কি করে?”
“আমি পারি, জানি না কি করে। তবে আমি পারি।”
দায়সারা ভাবেই উত্তর দিল আত্মিকা। এর মাঝেই কানে এল একটি গাঢ় স্বর,
“মনে যখন একটা প্রবল আনন্দ একটা বৃহৎ প্রেমের সঞ্চার হয় তখন মানুষ মনে করে, ‘আমি সব পারি’। তখন হঠাৎ আত্মবিসর্জনের ইচ্ছা বলবতী হইয়া ওঠে…………
.
.
.
চলবে..................................................