চুপকথা - পর্ব ১০ - মুশফিকা রহমান মৈথি - ধারাবাহিক গল্প


“নব অতিথিরে তবু ফিরাইতে নাই কভু–
এসো এসো নূতন দিবস!
ভরিলাম পুণ্য অশ্রুজলে,
আজিকার মঙ্গলকলস।”---- এখানে কবি অতীতের অশ্রু নিয়েই নতুনকে বরণ করতে চাচ্ছেন। যতই দুঃখ, বিষাদ থাকুক না কেন তিনি নতুনকে ফিরিয়ে দিবেন না, এতোটুকু বুঝলেই হবে।”
 “হাও ট্যাকি! তুমি এতো কঠিন শব্দের অর্থ বুঝতে পারো কি করে?”
 “আমি পারি, জানি না কি করে। তবে আমি পারি।”

দায়সারা ভাবেই উত্তর দিল আত্মিকা। এর মাঝেই কানে এল একটি গাঢ় স্বর,
 “মনে যখন একটা প্রবল আনন্দ একটা বৃহৎ প্রেমের সঞ্চার হয় তখন মানুষ মনে করে, ‘আমি সব পারি।’ তখন হঠাৎ আত্মবিসর্জনের ইচ্ছা বলবতী হইয়া ওঠে।”

মাথা তুলে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো সম্মুখে দাঁড়ানো সৌম্য পুরুষটির দিকে। নীল একটি পাঞ্জাবী তার পরণে। হাতা কনুই অবধি গুটিয়ে রেখেছে। বুকের কাছটার বোতাম দুটো খোলা। ফলে শরীরের কিছুটা অংশ ও নজরে পড়ছে। অবিন্যস্ত চুলগুলো অবহেলায় পড়ে আছে কপালে। একটি চোখ ঢেকেও গেছে। হাতদুখান আয়েশ করে পকেটে গোজা। সূর্যের ঠিক বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে সে। চোখে রিমলেস চশমা। চশমাটি ঠিক ঢং করার জন্য নাকি আসলেই চোখে সমস্যা সেটা জানা নেই আত্মিকার। আগে যতবার রাইয়ানের সাথে দেখা হয়েছে সে কখনোই চশমায় তাকে দেখেনি। ফলে বলা বাহুল্য সে সবসময় চশমা পড়ে না। হতে পারে এখানে নিজেকে জাহির করার জন্য চশমা পড়া। কারণ এই ভার্সিটির বিভিন্ন ক্লাবের মধ্যে একটি হচ্ছে সাংস্কৃতিক ক্লাব। রাইয়ান সেই ক্লাবের জেনারেল সেক্রেটারি। ফলে কিছুটা গাম্ভীর্য আনার জন্য চশমা পড়াটা ভালো উপায়। আজকাল অনেকেই নিজের ভাব বর্ধনে চশমার ব্যবহার করে। এটা অনেকটা সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজও করে। রাইয়ানের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ছেলেটিকে আজ পুরুষ মনে হচ্ছে। সূর্যের আলো তার শ্যাম সৌন্দর্যকে বৃদ্ধি করছে। আত্মিকার তাকে শেষের কবিতার অমিতের ন্যায় লাগলো। তার মাঝে অবশ্য অমিতের বৈশিষ্ট্যগুলোও নিমজ্জিত। মুখশ্রী, হাসি সবকিছুতে চাঞ্চল্য। শ্যাম মুখশ্রীতে দাঁড়ির বালাই নেই। টিপটপ একেবারে। আর মনটা রকমারি ফুলের গন্ধে মুখরিত। আত্মিকা দৃষ্টি নামিয়ে নিল, নিজের কাজে মনোনিবেশ করতেই মানুষটি তার দিকে ঝুকে পড়লো। কিছুটা কাছে এসে মোটা স্বরে বলল,
“ময়ুরাক্ষী উপন্যাসে একটি কথা ছিল, “কঠিন মানসিক যন্ত্রণায় কাউকে দগ্ধ করার আনন্দের কাছে সব আনন্দ ফিকে।”--- আপনি মনে হয় সেই কাতারেই পড়েন।”
 “আমার জন্য আপনি মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন বুঝি?”

বিস্মিত স্বরে শুধালো আত্মিকা। রাইয়ান নিজের অবহেলিত চুলগুলো ঠেলে ব্যাকুল স্বরে বলল,
 “আমি কিন্তু মিথ্যে বলছি না, সত্যি ভুগছি। এই যে ধরুন শান্ত নদীর মত প্রবাহমান জীবনে অচিরেই ঝড় তুললেন, তাও মাঝ নদীর মরণ ঝড়। যন্ত্রণা হবে না? তারপর ধরুন আবেগ বশীভূত হয়ে বাংলা সিনেমা থেকে ছেপে প্রেমনিবেদন অবধি করে দিলাম। এখন ফলাফল কি হবে তা নিয়েও চিন্তা। সেখান থেকেই মানসিক যন্ত্রণা। এমন টেনশন আমার অংক পরীক্ষার ফলাফলের সময়ও হয় না। আপনার বাবা যা রাগী পিস, আমাকে নির্ঘাত পুলিশে দিবেন। একদিকে ক্যারিয়ারে জ্বলবে কমতেলের লন্ঠন আর পরিবারের সামনে ইজ্জতের ফালুদা। চিন্তা হওয়া জায়েজ কি না বলুন?”
 
আত্মিকা মৃদু হাসল। রাইয়ান ছেলেটার শব্দের খেলা তাকে বরাবরই অভিভূত করেছে। তৃতীয় পরিচয়ে যে কফির অফার দেয় সে যে শব্দের ব্যবহারে পারদর্শী হবে তাতে সন্দেহ নেই। স্মিতস্বরে বলল,
 “আপনার জেনারেল সেক্রেটারি পদটার পেছনের কৃতিত্বটা ভালোই প্রকাশ পাচ্ছে। মানুষকে কথার ছলে মোহিত করতে আপনি তো পারদর্শী দেখছি।”
 “আপনার বিদ্রুপে মোড়ানো কথাটাও প্রশংসার খাতায় টুকে রাখলাম। বেয়ান বলে কথা।”
 “আপনি সময় নষ্ট করছেন।”
 “কেন বলুন তো?”
 “আমার মতো আত্মকেন্দ্রিক মানুষের সাথে ফ্লার্ট করাটা সাপের আগে বিন বাজানোর সমকক্ষ।”
 “তাহলে বলছেন, আমার দুদিনের কষ্টের ফলাফল শূণ্য? আমি ফেল করেছি?”
 “অনুরাগ নামক এভারেষ্ট সমপর্যায়ের শব্দটি যদি দুদিনের একটি ভিডিও দ্বারা জয় করতে চান, তবে আসলেই আপনি ঢাহা ফেল করেছেন। আর সামান্য ভিডিও বানিয়ে তাকে ইম্প্রেস করার চেষ্টা, দু একদিন তার পেছনে ঘোরা, কেবল আকর্ষণ বা টাইম পাসের জন্য তাকে প্রেমনিবেদন করা এই কাজগুলো খুবই ছেলেমানুষী লাগে আমার। কতটুকু জানেন আমার সম্পর্কে? ভালোবাসা শব্দটি এতোটা ঠুংকো? দেখলাম আর মুড়িমাখার মতো সহজেই তা হয়ে গেল। মশাই অনুরাগ হাতের মোয়া নয়। আপনি এই কষ্টটি অন্যের পেছনে করুন। ফলাফল ভালো হবে।”

হাসি মুখে শান্ত গলায় কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়ালো আত্মিকা। আর বসে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না। অনেক শব্দের অপচয় করে ফেলেছে। এত কথা স্বল্প পরিচিত মানুষের সাথে শেষ কবে বলেছে মনে নেই। সব গুছিয়ে নিল। চলে যাবার সময় কিছু মনে পড়ল। ব্যাগ থেকে পেনড্রাইভটা বের করল। সেটি এগিয়ে স্মিত স্বরে বলল,
 “ছবিগুলো সত্যি সুন্দর হয়েছে, বুবুকে দিয়ে দিবেন। আমি ওর কাছ থেকে নিয়ে নিব।”

বলেই পা বাড়ালো নিজ গন্তব্যে। রাইয়ান নিষ্পলক দৃষ্টিতে তার যাবার পানে চেয়ে রইল। ঠোঁটে দুর্বোধ্য হাসি। আনমনেই বলল,
 “ইন্টারেস্টিং।”

***********************

বাস ছাড়ল সন্ধ্যের বাদে। তিক্ত গরম মিলিয়ে যাচ্ছে থমথমে শীতলতায়। কাচের জানালায় মাথা ঠেকিয়ে ব্যস্ত শহরের দিকে তাকিয়ে আছে আরশিয়া। ইট পাথরের শহরের কতই না ব্যস্ততা। সেই ব্যস্ততায় নিজের ছোট্ট শান্তির কুঠুরি ছেড়ে সে যাচ্ছে কক্সবাজার। যে সারপ্রাইজের কথা পৃথুল বলেছিল সেটা এটাই। কর্মব্যস্ত মানুষ হলে যা হয়, কাজের মোড়কে হানিমুন উপহার দিয়েছে আরশিয়াকে। কক্সবাজারে তার কিছু জরুরি কাজ পড়ে গেছে। সেই উদ্দেশ্যে যার যাওয়া, সাথে বগলদাবা করে বউকেও নিয়ে যাওয়া। একের ভেতর দুই। প্রথমে ব্যাপারটা খুব আপত্তিকর মনে হলেও স্বাভাবিক ভাবেই নিল আরশিয়া। লোকটি যে শত কাজের মুখেও তাকে স্মরণ করেছে এটাই অনেক। পৃথুল প্রচন্ড অবাক করছে আরশিয়াকে। লোকটির নিজ থেকে এগিয়ে আসাটা খানিকটা ভাবাচ্ছেও। সে নিজেই বলেছে প্রত্যাশা না রাখতে। অথচ প্রত্যাশা রাখার কারণগুলো সেই দিচ্ছে। মানুষ কতটা অদ্ভুত তাই না। আরশিয়া শান্ত চোখে তাকালো বাহিরের দিকে। অতর্কিতেই বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। কালবৈশাখী ঝড় হবে হবে করছে। বৈশাখের ঝা ঝা গরমের পর শীতল বর্ষণ হলে মন্দ হবে না। বাবার বৃষ্টি খুব পছন্দ। ঝড় বৃষ্টির রাতে আম কুড়ানোর মজা লুটবার জন্য তিনি ছাদে আমগাছ ও লাগিয়েছেন। ব্যাপারটা হাস্যকর বটে কিন্তু ছোটবেলায় এই হাটু অবধি গাছ থেকেই পড়া আম কুড়িয়ে সুখ নিত তিনবোন। বাবার কথা মনে পড়তেই মনটা মিয়ে গেল আরশিয়ার। নয় দিন হয়ে গেছে বাবা তাকে ফোন দেননি। এমনটা এই প্রথম হল, যে বাবা মেয়ের কন্ঠ না শুনলে উতলা হয়ে উঠতেন সেই বাবা এখন তার সাথে সম্পর্ক নষ্ট করেছেন। ব্যাপারখানা কষ্টের বটেই। আরশিয়া ফোনটা বের করল, বাবার নাম্বারটা ডায়াল করবে কি না দ্বিধাগ্রস্ত। 
 “ফোনটা করুন।”

পৃথুলের কণ্ঠে চমকে উঠল আরশিয়া। পাশে তাকাতেই দেখল লোকটি চিপস, কোকাকোলা, চকলেট এক রাজ্য জিনিস কিনে অবশেষে উঠেছেন। ঘামে তার কালো শার্টটা ভিজে জবজব করছে। বুকের কাছের একটা বোতাম খুলে পেছনে ঠেলে দিল কলারটা। আরশিয়া ম্লান স্বরে বলল,
 “বাবা ফোন ধরবে না।”
 “না দিয়েই বুঝলেন কি করে? আগে ডায়াল তো করুন।”
 “সে অনেক জেদি। জেদের সামনে সব ঠুংকো তার কাছে।”
 “জেদি মানুষদেরও দূর্বলতা থাকে। সেই দূর্বলতার কাছে তারা হার মানেই। হ্যা, দূর্বলতার উপর ও জেদ দেখায় তবে সেই জেদটা কাচের মত হয়। একটা ঠুন লাগলেই চুরমার হয়ে যায়। তাই একটা ঢিল দিতেই পারেন।”

আরশিয়া মনে খানিকটা সাহস পেল। ফোন করলো বাবাকে। বাজতে বাজতে কেটে গেল। অপরপাশে কেবলই শূন্যতা। আরশিয়া হতাশ হল বটে। কিন্তু আবারো ফোন করল। দ্বিতীয় বার ফোন করবে। না ধরলে আর করবে না। দ্বিতীয় বার ফোনটা চারবার বাজতেই রিসিভ হল, কিন্তু কোনো কথা শোনা গেল না। অপরপক্ষ মৌনতা পালন করছেন। আরশিয়া ধীর কন্ঠে বলল,
 “বাবা?”

তাও মৌন রইল চারপাশ। আরশিয়া হতাশ হল। বাবার কণ্ঠ শোনা গেল না। পৃথুল ইশারায় বোঝালো, “কথা বলুন।”

আরশিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলল,
 “তুমি কথা বলবে না বাবা? বেশ বল না। আমি তোমাকে খুব মিস করছিলাম। তাই ফোন দিয়েছি। আমি ভালো আছি বাবা, এই তো উনি আমাকে কক্সবাজার ঘুরতে নিয়ে যাচ্ছেন। এখানে আমাকে খুব ভালোবাসে সবাই। তুমি নিজের খেয়াল রেখো বাবা। আত্মিকা আর আনহাকে বিরক্ত কর না। ঔষধ খেও, খাবারে অরুচি হলেও কষ্ট করে খেও। রোজা রাখতে পারলেই কেবল রেখো। আমাদের বাস ছেড়ে দিয়েছে। আমি পৌছে ফোন দিব। ফোনটা ধরো।”

অপাশ থেকে ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ কানে এলো। জেদের বসে কথা না বললেও মানের ভার অশ্রুতে পরিণত হয়েছে এতে সন্দেহ নেই। অসামান্য এই টান বাবা-মেয়ের। জেদ-রাগ আছে অথচ ভালোবাসা এখনো অম্লান। আরশিয়া ফোনটা কেটে দিল। তার চোখ ভিজে এসেছে। গলার কাছে বিষাদ দলা পাকাচ্ছে। পৃথুল রুমাল এগিয়ে দিয়ে ধীর স্বরে বলল,
 “মুছে নিন, কাজল লেপ্টে যাবে।”

আরশিয়া রুমালটি নিল। মুছে নিল বিষাদজোয়ার। তারপর ধীর কণ্ঠে শুধাল,
 “আপনি জানলেন কি করে, মানুষটার জেদের দেওয়াল ভাঙবে?”
 “তার সাথে আমার বড্ড মিল আছে তো তাই একটা আঁধারে ঢিল ছুড়লাম।”
 “তাহলে আপনারও দূর্বলতা আছে? তার নামটি জানতে পারি কি?”…………
.
.
.
চলবে..........................................…....

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন