চুপকথা - পর্ব ১২ - মুশফিকা রহমান মৈথি - ধারাবাহিক গল্প


আরশিয়ারা কক্সবাজারে পৌছালো ভোরের দিকে। ভোরের আলো এখনো ফোটেনি, পাখির কিচিরমিচির বাতাসে মিশে আছে। সিবিচের কাছেই একটি হোটেলে উঠল তারা। হোটেলে পৌছেই গা এলিয়ে দিল আরশিয়া। জার্নিটা ক্লান্তিময় ছিল না। কিন্তু অনেকক্ষণ বসে থেকে মাজা ধরে এসেছে। পৃথুল ব্যাগ রাখল। ব্যাগ থেকে নিজের জিনিসপত্র বের করেই ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো সে। বিশমিনিট পর সাহেব বনে বের হল। আরশিয়া জিজ্ঞেস করতেই বলল,
 “আমার আজ কিছু কাজ আছে, আপনি নাস্তা অর্ডার করে নিয়েন। আমার অপেক্ষায় থাকবেন না। চাইলে বিচটা ঘুরে দেখতে পারেন।”
 “আপনি নাস্তা করবেন না?”
 “ওখানেই করে নিবো। আসলে সবাই অপেক্ষা করছে তো।”

বলেই বেরিয়ে গেলো পৃথুল। আরশিয়া যেখানেই বসে রইলো একা। সন্ধ্যে নাগাদ যখন পৃথুল ফিরলো, তখন ঘরে নীরবতা। আরশিয়াকে ডাক দিতেও কোনো সাড়া নেই। সাড়া না পেতেই বুকে কামড় পড়ল পৃথুলের। ওয়াশরুম দেখলো, ব্যালকনি দেখলো। আরশিয়া নেই। ঘর শুণ্য, নিস্তব্ধ। ঘরের নীরবতা তার দিকে যেন তেড়ে এলো। মুহূর্তেই মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে গেলো। মেয়েটি কোথায় গেলো? হঠাৎ করেই যেন দুঃস্বপ্নগুলো হাতছানি দিল। এমনই একদিন তাকে একা করে শতরুপা চলে গিয়েছিলো, কোনো কারণ দেখাইনি, কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। ফেলে গিয়েছিলো শুধু শূন্যতা। তবে কি আরশিয়াও তাকে ফেলে চলে গেলো? আবার কি অজান্তেই ভুল করে ফেলল সে? ক্লান্ত শরীরটা অসাড় হতে লাগল। দুহাত দিয়ে মাথা চেপে বিছানায় বসে পড়ল সে। নিজেকে সামলাতে সময় লাগলেও সে সামলে নিল নিজেকে। এখন হতাশ হবার সময় নয়। আরশিয়াকে খুজতে হবে। পকেট থেকে ফোন বের করে আরশিয়াকে ফোন করতে লাগল সে। ফোনটা বেজে উঠল ঘরের মধ্যেই। আরশিয়া ফোন নেয়নি। ফলে আরোও বেশি ভয় জেকে ধরল পৃথুল কে। ছুটে গেল রিসেপশনে। ভাগ্যিস মোবাইলে আরশিয়ার একটি ছবি ছিল। পৃথুল ছবি তুলতে বেশি সাচ্ছ্বন্দ বোধ করে না। যদিও সংবাদ উপস্থাপক, সারাক্ষণ তার কাজ ক্যামেরার সামনে থাকা। কিন্তু এই ক্যামেরাকে অত্যন্ত অপছন্দ তার। সেকারণে তার সাথে আরশিয়ার কোনো ছবি নেই। বাসায় দাওয়াতের দিন রাইয়ান আরশিয়ার বেশ কিছু ছবি তুলেছিল। সেগুলোর একটি তার কাছে আছে। সেটি রিসিপশনের মেয়েটিকে দেখিয়ে শুধালো,
 “এই মেয়েটিকে কি দেখেছেন? আমার স্ত্রী সে। কিন্তু সে রুমে নেই। ফোন ও রেখে গেছে।”

পৃথুলের উদ্বিগ্নতা দেখে রিসিপশনের মেয়েটি ঘাবড়ে গেল। পৃথুল রীতিমত কাঁপছে। মেয়েটি ধীর কণ্ঠে বলল,
 “স্যার, ম্যাডাম বোধ হয় একটু বেরিয়েছেন। আপনি লন বা সি বিচের দিকটা দেখতে পারেন।”

পৃথুল এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না। লন, সি বীচ প্রতিটা স্থান তন্নতন্ন করে খুঁজলো। যাকে পাচ্ছে তাকেই ছবি দেখিয়ে শুধাচ্ছে,
 “এই মেয়েটিকে দেখেছেন?”

উত্তরে শুধু হতাশাই জুটলো তার। দেখতে দেখতে সন্ধ্যে রাতের নিগূঢ়তায় পরিণত হলো। সিবীচের নীল সাগরের উত্তাল ঢেউ, মানুষের আনন্দ কলরবের মাঝেও পৃথুল শূন্য। তার ভেতরটা যেনো দাবানলের আগুনে দগ্ধ হচ্ছে। তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে সব। ব্যর্থতা যেন চূর্ণবিচূর্ণ করে দিচ্ছে। গলা ছেড়ে চিৎকার করতে পারলে হয়তো শান্তি লাগতো! কিন্তু পুরুষদের যে কাঁদতে নেই, ভাঙতে নেই________

রিক্ত হাতে যখন হোটেলে ফিরলো তখন বাজে রাত এগারোটা। এতটা সময় সে সিবীচেই খুঁজেছে আরশিয়া। উপায়ন্তর না পেয়ে থানাতেও রিপোর্ট করতে গিয়েছিলো কিন্তু তারা চব্বিশ ঘন্টা দেখতে বলেছেন। ডায়রি করবেন চব্বিশ ঘন্টা পর। খুব ক্লান্ত লাগছে শরীরটা। পা চলতে চাইছে না। সকাল থেকে টকশ জনিত কাজে ব্যস্ত ছিল সে। কক্সবাজার পৌছাতেই বসের ফোন আসে। “সাগরের তীরে প্রিয় তারকার তরে” অনুষ্ঠানটি কক্সবাজারেই শুট হবে। অনুষ্ঠানের উপস্থাপক পৃথুল। যদিও সে সংবাদ উপস্থাপক, তাও এই অনুষ্ঠানের জন্য প্রডিউসার তাকেই বেছেছেন। মানা করতে পারেনি, ভেবেছে সেই ফাঁকে আরশিয়ারও ঘোরা হবে। হোটেলে আরশিয়াকে রেখে যাবার ইচ্ছে তার ছিল না। কিন্তু যে তারকার সাথে শুট হবে সে নাটকের জন্য ব্যস্ত, শিডিউল পাওয়া গেছে শুধু সকালের। তাই তো ছুটে গিয়েছে পৃথুল। কাজের জন্য খাওয়াটাও ঠিক মত হয়নি। ভেবেছিলো এসে একেবারে ডিনার করবে আরশিয়ার সাথে, তারপর বীচে ঘুরতে যাবে। কিন্তু তা হল কোথায়। মাঝে মা ফোন দিয়েছিলো, তাকে বলার সাহস হল না পৃথুলের। তাদের কথার ধরণে মনে হয়নি আরশিয়া ঢাকা গেছে। তবে কি ওর কোনো বিপদ হল? মাথা কাজ করতে চাইছে না। শরীর নিথর হয়ে যাচ্ছে। সব বেশী ক্লান্ত যেন হৃদয়।

বেক্ষাপ্পা পায়ে হোটেলে প্রবেশ করতেই লবিতে কারোর হাসির গুঞ্জন কানে এলো। স্বচ্ছ, মনোমুগ্ধকর হাসি। শুভ্র মুখশ্রীতে মুক্তদানার মত লাগছে হাসিটা। যেন নিগূঢ় আঁধারের তীব্রতাকে চিরে উদিত হলো কুসুম প্রভা। পৃথুল সেই হাস্যজ্জ্বল মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে আছে নিলীন দৃষ্টিতে। তারপর স্লথ পায়ে এগিয়ে গেল মেয়েটির কাছে। কিছু না বলেই জড়িয়ে ধরলো সে। ক্লান্ত স্বরে বলল,
 “আপনি কোথায় ছিলেন? জানেন কত খুঁজেছি আপনাকে?”

পৃথুলের অতর্কিতে জড়িয়ে ধরাটা প্রচন্ড অবাক করলো আরশিয়াকে। সে যেনো সপ্তম আসমান থেকে পড়লো। সামনে থাকা ব্যক্তিবর্গ হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তাদের মুখে রা নেই। আরশিয়া কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কিছু সময় দাঁড়িয়ে রইল। পৃথুলের দৃঢ় বন্ধন ছাড়ানোর সাধ্য নেই যেন। পৃথুলের শরীর ঈষৎ কাঁপছে। আরশিয়া ইতস্তত স্বরে বলল,
 “আমি তো এখানেই ছিলাম, ঘুরে দেখছিলাম আশপাশটা।”

পৃথুল এবার কিছুটা স্বাভাবিক হল। গাঢ় দৃষ্টিতে চাইলো আরশিয়ার দিকে। তার নীরব দৃষ্টির মর্মার্থ বুঝলো না আরশিয়া। তার অস্বস্তি বাড়লো। পৃথুলের শান্ত, দিঘীর মত নজরের দিকে তাকাতেও যেন ভয় হচ্ছে। এর মাঝেই সামনে থাকা মানুষের মাঝের একটি ছেলে বলে উঠল,
 “ইনি কে হন আপনার?”

ছেলেটির কণ্ঠে সম্বিত ফিরলো পৃথুলের। সে আরশিয়াকে ছেড়ে দিল। প্রখর দৃষ্টিতে তাকালো ছেলেটির দিকে। এই ছেলেটির সাথেই কি এতোটা সময় ছিল আরশিয়া? সে কোনো প্রশ্ন করার আগেই আরশিয়া বললো,
 “ইনি আমার হাসবেন্ড, পৃথুল আহমেদ। আর উনার নাম নিশাদুল ইসলাম সৈকত। উনি এবং উনার ফ্যামিলি এখানে ঘুরতে এসেছে।”

পৃথুল হ্যান্ডসেক করলো সৈকতের সাথে। সৈকত তার বাবা-মা, বোনের সাথে এসেছে। এতো সময় পর পৃথুল খেয়াল করলো এখানে আরোও তিনজন রয়েছে। সে ম্লান হাসি দিয়ে সবার সাথে সম্ভাষণ করলো। আরশিয়া উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বলল,
 “আপনি তো শুটে চলে গেলেন। রুমে আমি একা। একা একা কি ভালো লাগে? তখনই নিধি আন্টির সাথে পরিচয় হলো। আন্টি খুবই মিশুক। আমার মনেই হয়নি আমি বাহিরের কেউ। সময় যে কখন কেটে গেছে টের পাইনি। আপনি কি অনেকক্ষণ হয়েছে এসেছেন?”

পৃথুল প্রতিত্তরে বলল,
 “আপনার মোবাইলটা কোথায় আরশিয়া?”

এতো সময় বাদে আরশিয়ার খেয়াল হল সে মোবাইল নিয়ে আসেনি। জিভ কেটে বলল,
 “বোধ হয় রুমে। আপনি ফোন দিয়েছিলেন?”
 “হ্যা, আমি সন্ধ্যায় ফিরেছি। আপনাকে রুমে না পেয়ে পাগলের মতো খুঁজেছি। শুধু তাই নয়। আমি তো পুলিশ স্টেশন ও ঘুরে এসেছি। বলা তো যায় না কখন কোন বিপদ হয়। একটা এসএমএস করলে হয়তো ভালো হত। আমি রুমে যাচ্ছি। খুব ক্লান্ত লাগছে।”

পৃথুল বিষন্ন কণ্ঠে কথাগুলো বলেই রুমের দিকে হাটা দিল। আরশিয়ার বুঝতে বাকি রইল না, সামান্য মোবাইল না নেবার জন্য পৃথুলকে কতটা ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে। সে স্বল্প পরিচিত মানুষদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েই নিজ ঘরে গেলো। রুমে যেয়েই দেখলো বিছানাতে গা এলিয়ে রয়েছে পৃথুল। চোখের উপর হাত। শার্টটা ঘামে ভিজে লেপ্টে আছে। প্যান্টে বালির স্তর। চুলগুলো অবিন্যস্ত। এতোটা সময় আরশিয়া সেটা খেয়ালও করেনি। কিছুটা জড়তা নিয়ে পৃথুলের পাশে বসলো সে। ধীর কণ্ঠে বলল,
 “আপনি আমাকে এতোটা সময় খুঁজেছেন?”
 
আরশিয়ার প্রশ্নে কপালে ঠেকানো হাতটি নামাল পৃথুল। ক্লান্ত বিষন্ন দৃষ্টিতে চাইলো। পৃথুলের চাহনী বরাবরই গভীর। না চাইতেই সেই চাহনীতে নিজেকে নিমজ্জিত করতেই হয়। আরশিয়া দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ালো। দৃষ্টি বিছানার চাদরের দিকে। পৃথুল অত্যন্ত শীতল স্বরে বলল,
 “আপনি আমার স্ত্রী আরশিয়া, আপনাকে নিয়ে কি আমার চিন্তা হওয়া উচিত নয়? অবশ্যই হবে। এখানে আপনি নতুন। সকালে আমি ভালো করে কথা বলার সুযোগও পাইনি। সুতরাং এসে আপনাকে না দেখলে আমার চিন্তা হবে। আমার ধারণাও নেই, আমার উপর কি যাচ্ছিল? আপনার যেখানে ইচ্ছে আপনি যেতে পারেন আমার আপত্তি নেই। শুধু একটু জানিয়ে যাবেন। ঘর পোড়া গরু তো সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ডরাই।”

বলেই উঠে গেলো পৃথুল ব্যাগ থেকে একটি কালো টিশার্ট, আর শর্ট নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। এই প্রথম আরশিয়া নির্বাক হয়ে গেল। শিক্ষিকা হয়েও যুক্তি দাঁড় করাতে পারলো না সে। পৃথুল গোসল সেরে এলো। টাওয়ালটা ছড়িয়েই শুয়ে পড়ল। আরশিয়া ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
 “খাবেন না, সাংবাদিক?”
 “আমার ক্ষুধা নেই।”

বলেই শুয়ে পড়লো সে। চোখ বন্ধ করে বলল,
 “পারলে লাইটটা অফ করে দিবেন।”

আরশিয়া আর কিছু বলার সুযোগ পেল না। জামা কাপড় বদলে লাইট অফ করে সেও ঘুমিয়ে পড়ল। রাতের খাবারটা কারোরই খাওয়া হল না। 

রাতের গভীরতা বাড়ার সাথে সাথে নিস্তব্ধতাও বাড়লো। সাগরে উত্তাল ঢেউ এর কলরব কানে আসছে। শান্ত সাগরটা যেনো উম্মাদনায় মেতেছে। এতোটা শান্তির মাঝেও ঘুম আসছে না আরশিয়ার। পাশের মানুষটা অন্য কাথেই পরে রয়েছে। আরশিয়ার অস্বস্তি হচ্ছে। পৃথুলের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কিছু কিছু সময় কথা ঠোঁট অবধি এসেও থেমে যায়। আজ তার অবস্থাও তেমন। হাহাকার থামানোর উপায় জানা নেই। হঠাৎ করেই কাবু হৃদয়ের সাহসী হতে ইচ্ছে হলো। আস্তে করে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো সে পৃথুলকে। আস্তে করে মুখখানা ঠেকালো পৃথুলের কাঁধে। খুব আস্তে বলল,
 “সরি।”

পৃথুলের সাড়া নেই, হয়তো ঘুমিয়ে আছে। তবুও সে সেভাবেই জড়িয়ে ধরে রইলো। কখন যে ঘুমে বুজে এলো জানা নেই। ঘুমের মাঝেই অনুভূত হল কেউ বুঝি হাতটা খুব শক্ত করে মুঠোবন্দি করেছে। এটা কি বাস্তব নাকি ঘোর জানা নেই_______

*******

অনুষ্ঠান শেষ, এখন শুধু তার ক্যামেরাবন্দি স্মৃতিগুলো দেখার অপেক্ষা। এটাতে আনন্দ। আজ থেকে বহুবছর পর যখন সেই ছবিগুলো দেখা হবে, অবলীলায় সেই মুহূর্তটা জীবন্ত হয়ে যাবে। এজন্যই যুগ যেমনই হোক না কেনো ছবির প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে না। আগে এলব্যামে করে সেই স্মৃতি জমিয়ে রাখা হতো। এখন ইন্সটাগ্রাম, ফেসবুক, গুগল ড্রাইভ, গুগল ফটোস না জানি কতকি হয়েছে! তাই এলব্যামের চল উঠতে বসেছে। মোবাইল তো আছেই, এলব্যামের কি প্রয়োজন। কিন্তু আত্মিকা তেমন নয়। তার এলব্যাম করতে ভালো লাগে। এই যে সকাল থেকে বসেছে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানের ছবি বাছতে। কোন কোনটা এলব্যামে সাজাবে, সেটা নিয়েই সে ব্যস্ত। ছবি গুলো সকালেই প্রত্যুষ দিয়েছে। এখন বাছাই পর্ব চলে।

শত ছবির ভিড়ে হুট করেই একটা ছবিতে আটকে গেলো মাউসের কার্সার। ছবিটা তার এবং রাইয়ানের। রাইয়ান মগ্ন হয়ে গিটার বাজাচ্ছে, আর আত্মিকা তাকিয়ে আছে রাইয়ানের দিকে। মুহূর্তটা হয়তো কয়েক সেকেন্ডের কিন্তু মনে হচ্ছে না জানি কত কত যুগ সে তাকিয়ে রয়েছে। কাব্যিক ভাষায় বললে বলা যাবে, যেন লাবন্য তার সেতার হাতের অমিতের দিকে তাকিয়ে আছে। আচ্ছা সে কি সর্বদাই এতোটা মুগ্ধতা নিয়েই তাকায় রাইয়ানের দিকে? নাকি ছবি তার সাথে ছলনা করছে। ছবিটা একবার ডিলেট করতে ইচ্ছে হল। কিন্তু করলো না। ল্যাপটপেই সেভ করে রেখে দিল। এই ছবির এলব্যাম বানানোর মানেই নেই। 

ছবির বাছাই পর্ব শেষে যখন ফেসবুকে প্রবেশ করলো। নোটিফিকেশন সামনে এল। “রাইয়ান আহমেদ” নামক ব্যাক্তিটি তাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট দিয়েছে। প্রোফাইলে প্রবেশ করতেই দেখলো কভার ফটো পরিবর্তন করেছে। এবং সেখানে তাদের দুজনের একটি ছবি দিয়েছে। ছবিটি আগের ছবির সম্পূর্ণ বিপরীত, এখানে আত্মিকা গানে মগ্ন এবং রাইয়ান তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। নিবিড় সেই দৃষ্টি। আত্মিকা আনমনেই হাসল। তারপর রিকুয়েস্ট এক্সসেপ্ট করেই বেরিয়ে গেল। কেন যেন ছেলেটিকে খুব অসহ্য লাগছে না এই মুহূর্তে। ভবিষ্যতের কথা কে জানে?

***********

কক্সবাজারে পৃথুলের কাজ প্রায় শেষ। ঘোরাঘুরিতেও কোনো কমতি নেই। সদ্য পরিচিত নিধী আন্টি এবং তার পরিবারের সাথে বেশ ভালোভাবেই মিশে গিয়েছে আরশিয়া। পৃথুল যখন কাজে ব্যস্ত থাকে তখন সে তাদের সাথেই সময় কাটায়। সেই সুবাদে সৈকত ছেলেটির সাথেও আরশিয়ার ভালোই খাতির হয়েছে। তার বড় লেন্সের ক্যামেরাতে আরশিয়ার ছবিও তুলে দেয়। ছেলেটির সাথে আরশিয়ার সম্পর্কটা খুব স্বাভাবিক হলেও পৃথুলের কাছে তা মোটেই ভালো লাগছে না। তার অজানা কারণেই ছেলেটিকে বিরক্ত লাগছে। তার মতে ছেলেটি গায়ে ঢলে পড়া স্বভাব আছে। আরশিয়ার প্রতি সে অতিরিক্ত কেয়ারিং। গত পরশুর কথা, সবাই মিলে ইনানী বিচে গিয়েছিলো। হঠাৎ করেই আরশিয়ার জুতো ছিড়ে গেলো। একেই রোদ্দুরের বর্বরতা, গরম বালি। ছেড়া জুতোতে বেশ বিপদেই পড়লো সে। পৃথুল বলল,
 “চলুন একটা জুতো কিনে ফেলি?”

ওমা ছেলেটি নিজের জুতো খুলে দিলো। তারপর ছ্যাচড়ার মত বলল,
 “এখন ভিড়ে গেলেই আটকে যাবেন। আমার স্লিপার পরতে পারেন।”

ছেলেটির এমন কাজ একের অধিক রয়েছে। আরশিয়া ব্যাপারটিকে হেলাফেলা করলেও পৃথুলের চক্ষুশূল হচ্ছে তার এমন আচারণ। আরে বলদ তার স্বামী তার পাশে রয়েছে। এমন ফাজলামি না করলেও চলবে। এই ছেলেটির কারণেই পৃথুলের ঘোরার মনই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু শুধু এই মেয়েটির জন্য সে রাজি হচ্ছে। মেয়েটি সারাটাদিন একা থাকে, সেই ফ্যামিলি না থাকলে বোর হয়েই শেষ হয়ে যেত। তাই মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না। তবে আজ সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আরশিয়াকে নিয়ে একাই বের হবে। তাই যখন আরশিয়া শুধালো,
 “আপনি কি দরিয়ানগর কেভ দেখতে যাচ্ছেন আমাদের সাথে?”
 “না।”

নির্লিপ্ত গলায় উত্তর দিল পৃথুল। একটু থেমে বলল,
 “আপনিও যাচ্ছেন না।”
 “বুঝলাম না।”
 “বুঝিয়ে বলছি। এখন আমরা স্বামী স্ত্রী বের হব। এবং ওই পরিবারের সাথে নয়।”

পৃথুলের আচারণ বোধগম্য হল না আরশিয়ার। কয়েকদিন ধরেই নিধী আন্টিদের কথা বললেই পৃথুল মুখ বাকাচ্ছে। এক অব্যক্ত অনীহা তার। সে তো আন্টিকে কথা দিয়েছে। মহিলাটি খুবই ভাল। অপরিচিত মেয়েকে এতো আপন করে নিয়েছে যে আরশিয়া তাকে কিছুতে বারণ করতে পারে না। আরশিয়া ধীর স্বরে বলল,
 “কিন্তু আমি তো আন্টিকে বলে দিয়েছি।”
 “এখন বলে দিন যাবেন না, আপনার হাসবেন্ডের সাথে বের হবেন।”
 “এটা কি করে হয়?”
 “কেনো হয় না? আমিও তো আমার কলিগদের মানা করে দিয়েছি।”
 
আরশিয়া উত্তর খুঁজে পেলো না। কিন্তু পৃথুলকে হতাশ করতেও ইচ্ছে হল না। তাই নিধী আন্টিকে বলে দিল সে যাবে না। কিন্তু চরম অবাক হল যখন পৃথুল বলল,
 “আমরা দরিয়ানগর যাচ্ছি।”
 “তাহলে তাদের সাথে যেতে কি অসুবিধা হতো?”
 ‘আমার অসুবিধা রয়েছে।”
 “সাংবাদিক আপনি অদ্ভুত আচারণ করছেন না? একা একা ঘোরার চেয়ে দলবলে ঘোরাটি ভালো নয়? ওদের সাথে গাইড ছিল।”
 “না ভালো নয়। কারণ ওখানে আমি ইনসিকিউর ফিল করি।”…………
.
.
.
চলবে...............................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন