ঘরে লোকারন্যে একাকার হাল। ছোট করে অনুষ্ঠানটি এত বিকট হবে জানা ছিল না। পৃথুলদের আত্নীয়দের অভাব নেই। কাচ্চাবাচ্চা সবাই হাজির। ইতোমধ্যে মোতালেব সাহেব রাও চলে এলেন। আরশিয়ার চোখজোড়া খুঁজছিল বাবাকে। পাঁচদিন হয়ে গেছে বাবার কণ্ঠ শুনে না। কিন্তু হতাশা ছাড়া কিছুই মিলল না। হাসান সাহেব আসেন নি। আত্নিকা এবং আনহা বোনকে পেয়েই জড়িয়ে ধরল। সকলের থেকে আড়ালে তাদের নিজ ঘরে নিয়ে গেল আরশিয়া। বোনেরা কথার ঝুলি খুলে বসল। আরশিয়া সুবোধ শ্রোতার মত শুনতে লাগল। কথায় কথায় সে বলে উঠল,
“বাবা আসলো না যে?”
“আরে বাবার আর বড়মামার ফাটাফাটি হয়েছে।”
আনহা বেলাগাম কথায় তাজ্জব হল আরশিয়া। অবাক কণ্ঠে বলল,
“ফাটাফাটি কেন?”
“আরে মামা তো জানত পৃথুল ভাইয়ের বিয়ের কথা।”
আনহার কথা শেষ হবার পূর্বেই আত্মিকা তাকে কনুই দিয়ে গুতো দিল, যাতে সে থেমে যায়। আনহা মেয়েটি তার বড় দুবোন থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত। চঞ্চল, ছটপটে, বাঁচাল মেয়ে। একদিকে আত্নিকার ক্ষেত্রে যেমন বুক ফাটে কিন্তু মুখ ফুটে না প্রযোজ্য, অন্যদিকে আনহার ক্ষেত্রে বলা যায় “মুখ তো নয় ফুলঝুড়ি”। অবশ্য মেয়েটি জন্ম থেকেই মা হারা। তাই তার ছেলেমানুষী গুলো হাসান সাহেবের কাছে রত্ন সমান। তাই তো মাঝে মাঝে কিছু জিনিস যে গোপন ও রাখতে হয় সে জানে না। আত্নিকার গুতোকে কাজ দিল। আনহা থেমে গেল। কিন্তু আরশিয়ার প্রশ্নের ঘোড়া থামলো না। থমথমে গলায় বলল,
“মামা জানতো মানে?”
“না বুবু কিছু না। জানোই তো আনহা একটা অকথিত ছাগল। ওর কথা তুমি বিশ্বাস ও করছো? বাবা এমনিই আসেনি। জানোই তো বাবার রাগ।”
আত্নিকা নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ব্যাপারটা সামলানোর চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। কারণ তার কথাটা বিশ্বাস হল না আরশিয়ার। সে শীতল কণ্ঠে বলল,
“মামা কি জানতো আত্নিকা?”
“আসলে বুবু……”
“আমি জানতে চেয়েছি মামা কি জানতো?”
আরশিয়ার শীতল কণ্ঠে আত্নিকার শিরদাঁড়া বেয়ে হিমস্রোত বেয়ে গেল। বোনের মেজাজ সম্পর্কে খুব ভালো করেই জানা আত্মিকার। আরশিয়াকে দেখতে ঠাণ্ডা স্বভাবের হলেও তার ক্রোধের অগ্নির তেজ প্রচণ্ড ভয়ানক। মুহুর্তেই সব পুড়িয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে। আত্মিকা এবার ইনিয়ে বিনিয়ে বলল,
“মোমেনা আন্টি সম্বন্ধ আনার পর বাবা বড় মামাকেই দায়িত্ব দিয়েছিল খোঁজ খবর নেবার। বড় মামাই খোঁজ খবর নিয়েছিল পৃথুল ভাইয়ের সম্পর্কে। ফলে তার বিয়ের ব্যাপারটাও সে জেনেছিল। কিন্তু সব গোপন করে বাবাকে বলেছেন খেলের মাঝে খুঁত নেই। বাবা মোমেনা আন্টিকে প্রশ্ন করতেই উনি গড়গড় করে সব বলে দিয়েছেন। এই কথাটাই যখন বাবা মামাকে জিজ্ঞেস করেছেন তখন মামা অস্বীকার করেছেন। ফলে দুজনের মধ্যে প্রচুর কথা কাটাকাটি হয়েছে। ফলে জেদ করেই বাবা আসেন নি। মামার উপর এত রাগ হয়েছে বাবার যে একবার তো বলেই দিল,
“বাহিরের মানুষকে অপবাদ দিয়েছি অথচ নিজের ঘরেই চোর লুকানো”। এতে মামাও চটেছেন।“
আরশিয়া চোখজোড়া শান্ত। সে দ্বিতীয় প্রশ্ন করল না, নিজের মতামত দিল না। মুখোভাব দেখে আন্দাজ করা কঠিন তার মস্তিষ্কে কি চলছে। আত্মিকার সাহস ও হল না জিজ্ঞেস করার। আরশিয়া উঠে দাঁড়াল। ধীর স্বরে বলল,
“বাহিরে খাবার ব্যবস্থা। তোরা চাইলে এখানেও খেতে পারিস।”
“আমরা বাহিরেই খাই?”
“যেমনটা তোদের ইচ্ছে।”
আনহা আরশিয়ার দিকে খুব একটা লক্ষ না করলেও আত্মিকা তার বুবুকে চিনে। সে যে মোতালেব সাহেবের উপর ভীষণ ভাবে চেতে রয়েছে তা বুঝতে বাকি রইল না। শুধু এই ভরা সমাবেশে কথা কাটাকাটি না হলেই ভালো_____
*******
বসার ঘরে সকলের খাবারের ব্যবস্থা করা হল। খাওয়া দাওয়ার পর্ব খুব সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন হল। আরশিয়ার কাছে তার শ্বশুরবাড়ির সম্মান করাটা বেশি জরুরি বিধায় সে মোতালেব সাহেবের সাথে কথাও বলল না। পৃথুলের ছয় সাতজন কলিগ এসেছে। সকলের কেন্দ্রবিন্দু আরশিয়া। ফলে বোনদের সঙ্গ তাদের ছাড়তেই হল। আনহা মিশুক হওয়ায় তার সমবয়সী পৃথুলের বোনদের সাথে মিশে গেল। আর আত্মিকা দাঁড়িয়ে রইল বারান্দার এক কোনে। সুমী বেগমের বাগানের শখ। তাই তো বারান্দা ময় ফুলের গাছ। গোলাপ, গন্ধরাজ, শিউলি, বাগানবিলাস, পাতাবাহারে ঘেরা বারান্দা। ভেতরের কোলাহলের থেকে এই জায়গাটিই শান্তির। মৃদু বাতাসের সাথে ফুলের মিষ্টি গন্ধ মিশে আছে। যা জ্বলন্ত হৃদয়কে শীতল করতে যথেষ্ট। চোখ বুজে যখন এই সৌন্দর্যে নিজেকে বিলীন করতে ব্যস্ত তখনই একটি গাঢ় কণ্ঠে সম্বিৎ ফিরল,
“একাকীত্ব মাঝে মাঝে নিজেকেও গ্রাস করে। তাই তো বলা হয় মানুষ সামাজিক জীব।”
কথাটা শুনতেই পেছনে তাকাল আত্মিকা। একটি কালো পাঞ্জাবি পরিহিত রাইয়ানকে হাতে একটি বাটি নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখল। তার ঠোঁটের কোনে ভুবন ভুলানো হাসি। আত্মিকা দৃষ্টি ফিরিয়ে সাদা গোলাপ গাছটি দিকে দিল। স্বাভাবিক স্বরে বলল,
"একাকীত্বের থেকে শান্তি আর কিছুতে নেই। এখানে নিজের মত থাকা যায়, অন্তত খোলস পড়তে হয় না।"
“ভুল কথা, তাহলে সৃষ্টিকর্তা এতো মানুষ কখনোই পৃথিবীতে দিতেন ই না। আদম (আঃ) এর জন্য ও কিন্তু আল্লাহ হাওয়া (আঃ)কে সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ কেউ ই একাকীত্ব বরন করতে পারে না। আপনিও একাকীত্ব পছন্দ করেন না বেয়ান। তা না হলে এই লোকারণ্যে নিজের বোনকে দেখতে আসতেন না। এটাকে এভাবে বলতেই পারি, আপনার অচেনা মানুষ পছন্দ নয়।”
“জানেন যখন তাহলে বিরক্ত করছেন কেন?”
নির্বিকার চিত্তেই প্রশ্ন ছুড়ল আত্মিকা। রাইয়ান এই নিয়ে তিনদিন যাবৎ তার পিছু নিয়েছে সেটা বুঝতে বাকি নয় আত্মিকার। প্রথমে ভেবেছিল এটা কাকতালীয় ব্যাপার। কলেজের পর রিক্সা না পাওয়ায় লিফট দিয়েছে। কিন্তু লাগাতার তিন দিন ব্যাপারটার কাকতালীয়তার উপর সন্দেহ হচ্ছে আত্মিকার। আসার পর থেকেই ছেলেটির নজর তার উপর। যা তাকে বিরক্ত ও করছে। কিন্তু তার প্রশ্নকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে রাইয়ান বলল,
“মিষ্টি খাবেন, চমচম?”
“আমি মিষ্টি খাই না।”
“তাই এতো তিতো। একটু মিষ্টি খেলে দেখবেন মুখ থেকেও মিঠা কথা বের হবে?”
“সেটার প্রয়োজনীয়তাবোধ করছি না।”
“আমি করছি।”
রাইয়ানের কথায় অবাক হল আত্মিকা। কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই রাইয়ানের ডাক পড়ল। হাতে থাকা মিষ্টির বাটিটা ধরিয়ে দিল সে। স্বর খাঁদে নামিয়ে বলল,
“আমাকে না বলে যাবেন না।”
বলেই ছুটলো সে অন্দরমহলে। আত্মিকা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। দেখল উন্মাদ ছেলেটির চলে যাওয়া। আচ্ছা সে কি চায়?
******
মেহমানদের যাওয়ার পালা শুরু হল। মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে আরশিয়া সকলের বিদায় দিল। এবার পালা নিজ বাড়ির লোকেদের বিদায়ের। মোতালেব সাহেব এসে ভাগ্নির মাথার পরম আদরে হাত বুলালেন। আবেগী স্বরে বললেন,
“নিজের খেয়াল রেখো মা।”
সুমী বেগমের উদ্দেশ্যে বললেন,
“আমার মেয়েটি জেদি, নিজের মেয়ের মত দেখবেন ভাবি।”
মোতালেব সাহেবের কথাগুলো বিষের ন্যায় ঠেকলো আরশিয়ার কাছে। এত অভিনয় একটি মানুষ কি করে পারে! নিজের ভাগ্নির প্রতি এতটা ক্ষোভ তার। সব জেনেও গোপন করেছে সে। ভাগ্যিস বিয়ের দিন সত্য উন্মোচিত হয়েছে। নয়তো একটি মিথ্যের ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়তো আরশিয়ার। এতোটা পাষন্ড মানুষ হয়? দাঁতে দাঁত পিষে নিজেকে শান্ত রাখল সে। বোনদের জড়িয়ে ধরে বলল,
“বাবার দিকে খেয়াল রাখিস। আমি খুব দ্রুত আসব।”
যাবার সময় আবার রাইয়ানের সাথে দেখা হল আত্মিকার। কিছু না বলেই একটি পেনড্রাইভ ধরিয়ে দিল সে। অবাক দৃষ্টিতে তাকাতেই চোখ টিপ্পনী দিয়ে বলল,
“ফেলবেন না। আমার দু দিনের কষ্টের ফল।”
********
মেহমান যাবার পর শ্বাশুড়ি মা এবং কোহিনূরের সাথে সব গুছিয়ে নিল আরশিয়া। আগামীকাল কলেজ যাবে না। সারা গায়ে অসহনীয় ব্যাথা হচ্ছে। সব কাজ সেরে নিজ ঘরে গেল আরশিয়া। বিছানায় গা এলিয়ে দিল। মাথা ব্যাথা করছে। এর মাঝেই পৃথুল এসে বসল তার পাশে। খানিকটা উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বলল,
“ড্রাইভে যাবেন? লং ড্রাইভ?”
পৃথুলের কথাটা শুনতেই চোখ মেলে তাকাল আরশিয়া। মৃদু কণ্ঠে বলল,
“আজ না, অন্য একদিন।”
“আজই চলুন না। কাল আমার অফ, আপনার ও অফ। আর ওয়েদারটাও ভাল। এখন গেলে দেখবেন ভালো লাগবে। একটা জায়গা আছে খুব ভালো ফুসকা, চটপটি পাওয়া যায়। চলুন না?”
“আমি তো একবার বললাম আমার ভালো লাগছে না, কেনো এক কথা বারবার বলছেন?”
আরশিয়ার কথায় রুক্ষতা স্পষ্ট বোঝা গেল। পৃথুল থতমত খেয়ে গেল। খানিকটা অপ্রস্তুত হল। নিজের অনধিকার চর্চায় বেশ লজ্জিত হল সে। সে ভেবেছিল বাহিরে গেলে আরশিয়ার ভাল লাগবে। কেন না বাবা না আসার কথা জানার পর থেকেই মেয়েটি কেমন চুপসে গিয়েছিল। তবুও তার সম্মান রক্ষার্থে সকলের সাথে হাসি মুখে কথা বলেছে, গল্প করেছে। স্বামী হিসেবে এটা তার দায়িত্ব ছিল, কিন্তু সে হয়ত একটু বেশি করে ফেলেছে। তাই ধীর স্বরে বলল,
“সরি, আপনাকে বিরক্ত করার মোটিভ আমার ছিল না।”
আরশিয়া বুঝতে পারল, সে ভুল করেছে। একজনের ক্ষোভ অন্যজনের উপর বর্ষাণো যৌক্তিক নয়। কিন্তু সে কিছু বলার পূর্বেই পৃথুল ঘর ত্যাগ করল। ফলে পুরো ঘরে একাই থেকে গেল আরশিয়া…………
.
.
.
চলবে.............................................