প্রিয়াঞ্জনা - পর্ব ৩৩ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প


প্রীতির বিয়ে হয়ে গিয়েছে মাস তিনেক আগে। প্রীতি বিয়ে নিয়ে খুবই ভয় এবং শঙ্কায় ছিলো। কিন্তু শ্বশুর বাড়িতে এসে আবিষ্কার করলো মানুষগুলো ভিষণ অমায়িক। তার স্বামী কখনো তাকে কোনো কিছুতে জোর করেনা। সত্যি বলতে বড়আপার প্রতি শাহবাজ ভাইয়ার ভালোবাসা দেখে তারও ইচ্ছে জাগতো এমন কেউ আসুক তার জীবনে। আল্লাহ তা পূরণ করেছেন। তবুও মায়ের প্রতি একটা সুপ্ত অভিমান তার আছে। 
প্রাপ্তির পেটে বেড়ে উঠছে অনাগত সন্তান। ফাহিম বলে দিয়েছে এই সন্তান তার নয়। এই সন্তানের কোনো দায়ভারও সে নিতে পারবেনা। মাকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলেছিলো প্রাপ্তি। মা তাকেই দোষ দিচ্ছেন। কেন এসব সে আগে জানায়নি! বাইরে জানাজানি হলে তারা মুখ দেখাতে পারবেন না। ফাহিমের সাথে কথা বলেছেন তিনি। ফাহিম তাকে জানিয়েছে বহু আগে থেকেই প্রাপ্তি অন্য সম্পর্কে ছিলো। বিয়ের পরও ফাহিম এবং তার মা বাসায় না থাকলে প্রেমিক বাসায় আনতো প্রাপ্তি। এসব শুনে প্রাপ্তি স্তব্ধ, বাক শূন্য। ফাহিমকে জোহরা এসব জিজ্ঞেস করায় সে মনোকষ্ট পেয়েছে। এই উছিলায় প্রীতমকে জানিয়েছে সে তাকে আমেরিকা নিয়ে যাবেনা। প্রীতম যখনই সুযোগ পাচ্ছে যা নয় তাই বলে প্রাপ্তিকে অপমান করছে। জোহরা বেগমও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। প্রবীর এসব কিছুই জানেন না। তাকে এসব জানাতে নিষেধ করেছেন জোহরা। তিনি চাচ্ছিলেন বাচ্চাটাকে নষ্ট করে ফেলতে। তা সম্ভব হয়নি। তিনি যতদিনে জেনেছেন প্রাপ্তির পেটে বাচ্চা বড় হচ্ছে ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিলো। বাসায় এসব কথা জানানোতে ক্ষুব্ধ হয়ে যায় ফাহিম। ভিডিওটি ছড়িয়ে দেয় ইন্টারনেটে। দ্রুত গতিতে তা ছড়িয়ে পড়ে। প্রবীর সাহেবকে মানুষজন সরাসরি এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছেন। ছিঃ, ছিঃ হচ্ছে চারপাশে। জোহরা প্রাপ্তির ঘরে ঢুকেই তার গালে
 চ ড় বসিয়েছেন। প্রীতমও তার গায়ে হাত তুলেছে। ইচ্ছে মতো কথা শুনিয়েছে প্রাপ্তিকে। রাগে, ক্ষোভে ছাদে চলে আসে প্রাপ্তি। খা খা রোদ উঠেছে আজ। জোহরের আজান দিচ্ছে। আকাশ পানে তাকিয়ে প্রাপ্তি শুধায়,
"আমার দোষটা কোথায়, আল্লাহ? আমার জীবন কেন এত অভিশপ্ত!"

কান্নায় ভেঙে পড়ে রেলিং ঘেঁষে বসে পড়ে। পেটে বাড়ন্ত বাচ্চার প্রতি অনেক মায়া হয় তার। আজ একটা জীবন কেড়ে নিবে সে। পৃথিবীর আলো দেখার আগেই পৃথিবী ছাড়তে হবে তাকে। পেটে হাত রেখে ক্রন্দন সুরে বলে,
"আমাকে ক্ষমা দিও ময়না। আমার আর কোনো উপায় ছিলোনা।"

ঠিক যেখানে সুমনা দাঁড়িয়েছিলো কাকতালীয় ভাবে সেখানে দাঁড়ায় প্রাপ্তি। চোখ বন্ধ করে একটা নিঃশ্বাস নেয়। খুব কষ্ট হচ্ছে তার। মায়ের প্রতি, ভাইয়ের প্রতি, বাবার প্রতি খুব অভিমান হয় তার। ফাহিমের প্রতি হয় রাগ। তবে একটা জিনিস সে উপলব্ধি করেছে, বড় আপা যা করেছে ঠিকই করেছে। ভালোবাসার জন্য করেছে। বড়আপার প্রতি আজ তার কোনো রাগ, ক্ষোভ নেই। কিছু কাক তীক্ষ্ণ শব্দে কা কা করছে চারপাশে। না, আজ কোনো মইনুল আসেন নি। তীব্র এক শব্দে কেঁপে উঠে চারপাশ। কাকের দল গলা ছেড়ে কা কা করছে এবার। একসময় চোখ বন্ধ হয়ে আসে প্রাপ্তির। জাগতিক সব মায়া ত্যাগ করে পরকালে পাড়ি জমায় সে। 

বেশ কিছুক্ষণ পর এক ভাড়াটিয়া বাড়ির পিছনে 
মৃ তদেহ আবিষ্কার করলেন। থেঁতলে গেছে মা থা। র'ক্তে ভরে গিয়েছে মেঝে। দ্রুত উপরে গিয়ে স্বর্ণাকে এই খবর জানান তিনি। স্বর্ণা, প্রীতম, প্রবীর, জোহরা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন নিচে। জোহরা গগনবিদারী চিৎকার করে উঠলেন। পুলিশ এলো। লা শ নিয়ে গেলো। বাড়িতে আহাজারি শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রীতিও স্বামী সমেত ছুটে আসে। শাহবাজকে ফোন দেয় বারবার। তবে নাম্বার বন্ধ পায়। কারণ এই নাম্বার অনেক আগেই ব্যবহার করা বন্ধ করেছে শাহবাজ। প্রিয়াঞ্জনারও নাম্বার বন্ধ। প্রবীর সহ্য করতে পারলেন না এইসব। বারবার চোখের সামনে প্রাপ্তির মুখ ভেসে উঠছে। বাবা বলে ডাকছে তাকে। ব্রেইন স্ট্রোক করলেন তিনি। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে। আফসোস বাঁচানো যায়নি। জোহরা জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেলেন। নিজেকে অপরাধী মনে হয়। আজ তার কারণেই সাজানো-গোছানো সংসারটা শেষ হয়ে গেলো। চোখের সামনে নিজ হাতে সবকিছু শেষ করেছেন তিনি। অপরাধবোধে রাতের ঘুম হয়না তার। এদিকে শুনেছেন জায়গা জমি বিক্রি করে সব টাকা জু য়া খেলায় লাগিয়ে দিচ্ছে প্রীতম। জমিজমার কাগজ সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে দেখলেন সকল সম্পত্তি প্রীতমের নামে। প্রীতমের সাথে তার ঝগড়া, ঝামেলা চলছে। বিভিন্ন সময় তার এবং প্রবীর সাহেবের সিগনেচার নিয়ে সবকিছু নিজের নামে করে নিয়েছে প্রীতম। ঘরের সব কাজ এখন তাকে করতে হয়। একসময় সুমনাকে তিনি কত কষ্ট দিয়েছেন। কাপড় ধোয়া মনমতো না হলে বারবার ধোয়াতেন। যাবতীয় রান্না-বান্না, ঘর পরিষ্কার সব করাতেন। সময় পাল্টেছে। স্বর্ণা কোনো কাজই করেনা। সারাদিন নিজের মতো থাকে মেয়েকে নিয়ে। ছেলেটা সব সম্পত্তি শেষ করে দিচ্ছে। নিজে খাটছেন কলুর বলদের মতো। এই হয়তো তার প্রাপ্য শা স্তি। কিছুদিন পর থাকার ছাদটাও মাথার উপর থাকবে কিনা সন্দেহ। 

প্রিয়াঞ্জনা এবং শাহবাজের ঘর আলো করে মেয়ে সন্তান এসেছে। শাহবাজ নাম রেখেছে আলো। মেয়েটা হওয়ার পর থেকে সবকিছুতেই দ্বিগুণ বরকত হচ্ছে। হাসপাতাল দৌড়াদৌড়ি এই নিয়েই সময় কাটছিলো তাদের। বাড়ির ফেরার পর এক পরিচিত ভাইয়ের মাধ্যমে প্রাপ্তি এবং বাবার খবর পেলো তারা। মন মানেনি প্রিয়াঞ্জনার। শাহবাজ, আলোকে নিয়ে নিজ গাড়িতে চড়ে ছুটে এলো নরসিংদী। প্রিয়াঞ্জনাকে দেখামাত্রই হু হু করে কেঁদে উঠলেন জোহরা। ক্ষমা চাইলেন বারবার। শাহবাজের কাছেও ক্ষমা চাইলেন। প্রীতম কোনো কথা বলেনি। স্বর্ণাও না। প্রীতির সাথেও দেখা হয় প্রিয়াঞ্জনার। বোনকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদে প্রীতি। দুবোন মিলে বাবা-বোনের কবর জিয়ারত করে। মায়ের প্রতি যা অভিমান ছিলো তা শেষ হয়ে যায় প্রিয়াঞ্জনার। মায়ের ক্রন্দনরত মুখটা দেখার পরপরই মাকে ক্ষমা করে দেয় সে। শত হোক মা তো। তিনি যে অনেক কষ্টে দিনযাপন করছেন তা তার চেহারায় স্পষ্ট। প্রিয়াঞ্জনা চেয়েছিলো নিজের সাথে গাজীপুর নিয়ে যাবে। তবে জোহরা এত বছরের সংসার ছেড়ে যেতে চাননি। শুকিয়ে চিকন হয়ে গেছেন, চোখের নিচে কালো দাগ। আজও প্রাপ্তিকে দেখতে পান তিনি। অভিযোগ শুনতে পান। অনুতপ্ত হোন। তার অন্তরে ব্যথা হয়। অসহনীয় ব্যথা।
রিমনকে গাজীপুরে নিজের অফিসে ভালো পজিশনে বসিয়েছে শাহবাজ। রিমন, সুফিয়া এবং রাতুল তাদের সাথেই থাকে এখন। 
.
.
.
চলবে...........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন