শাহজাহান তন্ময় - পর্ব ২০ - নাবিলা ইষ্ক - ধারাবাহিক গল্প


তিনশো-ফিটে একটি প্রাকৃতিক খোলামেলা, রেস্তোরাঁ খোলা হয়েছে কয়েক মাস হলো। দারুণ আকর্ষণীয় ভাবে সাজানো সম্পূর্ণ রেস্তোরাঁটি! রাতের সময়টায় বেশি আরামদায়ক অনুভূতি হয়। খোলা আসমানের নিচে ধ্যান মেরে বসে থাকা যায়। শীতল বাতাসে অন্তর ঠান্ডা হতে থাকে। রাতের বেলায় চাঁদের আকাশটাও ওখানে অমায়িক দেখায়। বাতাসে দোলা হরেকরকম গাছের পাতা গুলো দেখতেও অন্যরকম লাগে।  

বান্ধবীদের সাথে শাবিহা সেখানে গিয়েছিল দুবার। খুব করে মনে ধরেছে তার এই রেস্তোরাঁ। তাই আজও ভাইয়ের কাছে সেখানেই যাওয়ার আবদার ধরল। বোনের আবদার পূরণ করতে তন্ময় সেদিকেই গাড়ি টানা টেনে চলল। মাঝরাস্তায় অবশ্য একবার গাড়ি থামিয়েছে। বাচ্চাদের কিছু খেতে ইচ্ছে হচ্ছে বলে। ওদের জন্য স্ন্যাকস কিনে দিয়ে পুনরায় গাড়ি স্টার্ট করে। গাড়িজুড়ে চিবিয়ে খাওয়ার কচমচ শব্দ শোনা যাচ্ছে।  

জানালার কাঁচ দুপাশে খোলা। তাই এসি ওফ। দিগন্ত বিকেলের সুন্দরতম আসমান গাড়ির সঙ্গে ছুটছে যেন। আরামদায়ক বাতাস ধেয়ে আসছে। অরু কাঁচ নামানো যায়গাটুকুতে ডান হাত ফেলে সেথায় থুতনি চেপে একমনে বাহিরে তাকিয়ে। 
দু'পায়ের জুতো জোড়া খুলে সিটের ওপর গুটিশুটি মেরে বসেছে সে। এভাবেই সচরাচর বসে। তার দীঘল কালো চুল উড়ছে। তন্ময় সেই দৃশ্যই অগোচরে দেখছে। চোখে কালো সানগ্লাস। তাই ধরা পড়ার একদম চান্স নেই। ড্রাইভিংয়ের ঠিক ওপরে থাকা ছোটো আয়না খানা অরুর দিকেই তাঁক করা। অরু যখন এদিকে এসে বসেছে তখনই ঘুরিয়ে নিয়েছে সে। এসময় খেয়াল করল অরু হাত বাইরে বের করেছে। একটা গাড়ি ক্রস করে গেলে কী হতে পারে ধারণা আছে নাদান মেয়েটার? কপাল কুঁচকে আসলো তন্ময়ের। ধমকানো গলায় চিন্তিত সুরে বলল, 

'হাত ভেতরে নে।'

অরু ঝটপট হাত গুটিয়ে নিলো। যেন এই ধমক শোনার আশায় সে ছিল। তন্ময়ের ইদানীং সন্দেহ হয় মেয়েটা বারংবার একই কাজ ইচ্ছেকরে করে নাকি! নাহলে একই কাজের জন্য বারবার তাকে ধমকাতে কেন হবে! সে তো ধমকাতে চায় না। তাকে জোরপূর্বক বাধ্য করে। 

রাস্তায় জ্যাম আছে ভালোই। সঙ্গে মানুষের উৎপত্তি। গিজগিজ করছে লাখো মানুষের ভীড়ে। সেসব ঠেলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা প্রায়। গাড়ি পার্কিংয়ের দারুণ সুযোগ রয়েছে। । তন্ময় গাড়ি পার্ক করল একসাইড করে। শাবিহা ইতোমধ্যে বেরিয়েছে। বড্ড খুশি সে। ভাই বোনদের ভেতরটা দেখানোর জন্য একপ্রকার অস্থির। 

অরুর বেরোতে সময় লাগল। জুতো জোড়া পরল তারপর বেরোতে ধরল। গাউন গিয়ে আটকাল দরজা সঙ্গে। নিচু হয়ে না ছুটিয়ে ও বোকার মতো টানছে। তন্ময় সেই দৃশ্য কিছুক্ষণ দেখে এগিয়ে আসলো চাবি হাতে। চাবিটা পকেটে ভরে গম্ভীর স্বরে বলে, 

'ওদিকে সরে দাঁড়া।'

অরু লেপ্টে গেল দরজার সঙ্গে। এভাবেই তন্ময়ের সামনে বড়োই ছোটো দেখতে সে। এভাবে গুটিশুটি মেরে লেপ্টে যেতেই আরও ছোটো দেখাল। তন্ময়ের আধা ঝুকে ওর আঁটকে থাকা ওড়নার আঁচলটুকু ছুটিয়ে দিল।

তন্ময় খেয়াল করেছে। ও একটু কাছাকাছি গেলেই অরু হাঁসফাঁস করে। যেন শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে পারছে না। ব্যাপার গুলো যেমন তন্ময় খেয়াল করে তেমন উপভোগ ও। তবে আজ অরু তড়িঘড়ি করে ছুটে পালিয়ে যায়নি। বরংচ ঠাঁই দাঁড়িয়ে। তন্ময় আঁড়চোখে শক্ত হয়ে দাঁড়ানো অরুর পানে চেয়ে সামনে পা বাড়ায়। পিছু অরুও ছুটে।  

ওদের ফিরতে ফিরতে রাত দশটা দশ। গাড়ি সোজা থামিয়েছে শাহজাহান বাড়ির সামনে। আকাশকে পূর্বেই কল করে এনেছে। তন্ময় গাড়ি থেকে বেরিয়ে চাবি ওর হাতে ধরিয়ে দিলো। ইশারায় অরু শাবিহা ওদের ভেতরে যেতে বলল। শাবিহা ক্লান্ত ভঙ্গিতে চলে গেছে। দীপ্ত ও হৈচৈ ফেলে ঢুকেছে। অরু দাঁড়িয়ে। অন্যদিকে আকাশ গাড়িতে ঢুকে গাড়ির বাড়ির ভেতরে ঢোকাচ্ছে। 

দুজন দাঁড়িয়ে ফাঁকা গলির মতো বড়ো রাস্তাটায়। ওঁকে ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তন্ময় বলল, 

'ভেতরে যাচ্ছিস না কেন?'
'আপনি যাচ্ছেন না কেন?'
'আমি কী তোকে বলে যাব!'
'কেন বললে কী হবে! আপনি গেলেই আমি যাব।'

দৃঢ় গলার জবাব অরুর। তন্ময়ের হাসি পেলো তবে হাসলো না। মুখশ্রী গম্ভীর রাখার চেষ্টা ধরে শুধালো, 

'কেন!'
'আপনাকে যদি কেউ কিডন্যাপ করে নেয়।'
'আমাকে কিডন্যাপ করবে?'
'তো? আজকালকার মেয়েদের নজর ভালো না।'
'তারমানে তোর নজর ও ভালো না?'
'সবাই আর আমি এক নাকি। আমি খুবই ভালো। আমার নজর ও ভালো।'
'আর মেয়েরা কিডন্যাপ করতে চাইলে করতে পারে। আমার বাঁধা নেই।'

এমন জবাব অরু মোটেও হয়তো আশা করেনি। চোখ বড়ো করে তাকালো, 

'কী!'

তন্ময় মাথা ঝুঁকিয়ে হাসলো। বলল, 

'এখনো দাঁড়িয়ে?'

অরু দৌড়ে চলে গেল। দরজার ভেতরে ঢেকে শেষবার উঁকি মেরে তবেই গিয়েছে। তন্ময় বাড়িটা একবার দেখে হাঁটা ধরল। গলির মাথায় এসে পা-জোড়া থেমে গেল। সামনে মোস্তফা সাহেব দাঁড়িয়ে গম্ভীরমুখে। হাত - জোড়া পিঠের পেছনে পেঁচানো। এখনো শরীরে লেপ্টে তন্ময়ের কিনে দেয়া পাজামা-পাঞ্জাবি। তন্ময় আনমনে হেসে এগিয়ে গেল। বাবার পাশ ঘেঁষে চা দোকানটায় গিয়ে বসলো। মোস্তফা সাহেব নরম হলেন। তিনিও এগিয়ে গেলেন ছেলের পেছন। গিয়ে বসলেন। তন্ময় দুটো চা দিতে বলে। চিনি কম। 

দুজন চুপচাপ বসে। কেউ কোনো কথাবার্তা বলছে না। মোস্তফা সাহেবই গলা ঝেড়ে গম্ভীর স্বরে কথা বলেন, 

'কেউ একজন নিজে তো আমার কেনা কিছু ব্যবহার করছে না। বোনকেও শিখিয়ে দিয়েছে ব্যবহার করতে না। নিজের টাকায় চলবে। তাহলে আমার এতো টাকাপয়সা কামানোর কী মানে দাঁড়ালো।'

তন্ময় ও একই সুরে জবাব দেয়, 

'কেউ একজনকে জানানো হলো আমার বোনকে আমি শিখিয়ে পড়িয়ে দেইনি। সে যা করছে নিজ উদ্যোগে। আর এতো চিন্তা হলে কেউ একজন নিজের ভাইজিকে আমার হাতে তুলে দিলেই পারে। তাহলে তো আর সমস্যা দাঁড়াচ্ছে না।'

'কেউ একজনের নজর আমার ভাইজির ওপর কেন থাকে। লজ্জা- শরম কিছুই নেই। বোনের চোখে যে বড়ো হয়েছে তার দিকেই নজর! ছিঃ!'

'ছোটোবেলায় আমার কানে গুঁজে দেওয়া হয়েছে ওই বোনের চোখে বড়ো হওয়া মেয়েটি হবে আমার বউ। তখন থেকে আর বোনের চোখে বড়ো করিনি। বউয়ের চোখে বড়ো করেছি, কেউ একজনকে জানানো হলো। আমি শাহজাহান তন্ময় তো আর এভাবে এভাবে পাগল হইনি। আমাকে পাগল বানানো হয়েছে। এতো সমস্যা হলে নিজের ভাইজিকে আঁটকে কেন রাখতে পারে না!'

তন্ময়ের তুলে দেওয়া চায়ের কাপ ধরে মোস্তফা সাহেব থমকে রইলেন। ছেলের সঙ্গে তর্কে তিনি কেন পেরে ওঠেন না? অতিরিক্ত ভালোবাসেন বলে নাকি! 
_______

ঈদের ছুটি কাটালো নয়দিন। নয়দিন পড় টানা পাঁচদিন অফিসে ব্যস্ত ছিল তন্ময়। সেই ব্যস্ততা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই টানা তিনদিনের জন্য কোম্পানির বসের সঙ্গে বিজনেস ট্যুরে যেতে হলো তার। যাওয়ার সময় তন্ময় শাবিহাকে বাসায় রেখে গেল। তার অনুপস্থিতিতে যেন মায়ের দেখাশোনা হয়। 

তিনদিনের ট্যুর শেষে ফিরেছে আজ রাত একটা ত্রিশে। ঘুমানোর আগ মুহুর্তে ফোন চেক করল। নিত্যদিনের মতো অরুর কিছু অদ্ভুত ম্যাসেজ আনসিন হয়ে আছে। কী রিপ্লাই দেওয়া যায় এসব ম্যাসেজের সে আজও বুঝে পেলো না। তাই ফোন রেখে শুয়ে পড়ল। ভীষণ ক্লান্ত লম্বা জার্নি করে। চোখজোড়া বুঝতেই অরুর হাস্যজ্বল মুখশ্রী ভেসে উঠল। অনেকদিন ধরেই মেয়েটাকে দেখছে না। কিছুদিন চোখের সামনে না এলেই তন্ময়ের অশান্তি লাগে। শূন্যতা অনুভব হয়।
দুদিন ছুটি আছে। তন্ময় ভেবে রাখল কাল অরুর কলেজ যাবে। ওর কলেজ ছুটি হয় যেহেতু সকাল বারোটায়। তন্ময় বারোটার আগে পৌঁছে যাবে ওঁকে পিক করতে। লাঞ্চ করাতে নিয়ে যাবে। 

___

তন্ময়ের ঘুম ভাঙে বৃষ্টির শব্দে। ঝড়ঝাপটাময় বৃষ্টি। থাই-গ্লাস ভেঁদ করে দেখা যাচ্ছে আঁধারে আকাশ। চারিপাশ মেঘলাময়। দেয়াল ঘড়িতে দশটা ত্রিশ। তন্ময় উবুড় হয়ে শুয়ে মুখ নরম বালিশে গুঁজে দিল। পাতলা কম্বল সরে তার ফর্সা শরীর দৃশ্যমান হয়। দু বাহু উঁচু হয়ে আছে নিয়মিত ওয়ার্ক আউট করায়। আঁধারে ঘরটা মোহনীয় লাগছে। শীতল আবহাওয়ায় তন্ময় আরও কিছু সময় ধরে শুয়ে থাকলো। উঠল পনেরো মিনিট পড়।

 জবেদা বেগম লিভিংরুমে বসে কাপড়চোপড় ভাজ করছেন। তন্ময়কে তিনি আজ ওঠাতে যাননি। ছেলেটা সেই মধ্যরাতে এসেছে। তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙানোর কোনো প্রয়োজন নেই। ঘুম পর্যাপ্ত হবে না ভেবে, ব্রেকফাস্ট করতেও তোলেননি। সেই মুহুর্তে তন্ময় এলো হাতে ব্রাশ নিয়ে। ওঁকে দেখেই জবেদা বলে উঠলেন, 

'বেলা হয়েছে নাস্তা আর খাওয়ার প্রয়োজন নেই আব্বা! বিরিয়ানি রেঁধেছি গরম করে দেই হু?'

তন্ময় মাথা দুলিয়ে নিজের রুমে ফিরে আসে। তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুম ঢোকে। আয়নায় মুখ দেখে মনে হলো দাঁড়ি বড়ো হয়েছে, ছাঁটা দরকার। ভাবনা আসতেই ইলেক্ট্রিক রেজার হাতে নিল। নিজেই ছাঁটাই করে ছোটো করে সাইজ করে নিল। মুখ ধুয়ে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করে বেরোলো। 

 আজ আর ফর্মাল পরল না।কালো জিন্স-প্যান্টের সাথে সাদা টিশার্ট পরে নিল। বা-হাতে ঘড়িটা জাপ্টে ফেলল। মানিব্যাগ পেছনের পকেটে ভরে বেরোলো। জবেদা বেগম ইতোমধ্যে খাবার বেড়েছেন। তন্ময় বসলো। ধীরেসুস্থে খেতে থাকলো। খাওয়ার একফাঁকে তাদের ড্রাইভারকে চাচাকে কল করল। বলল আজ অরুকে পিক করতে হবে না। সে যাবে! 

জবেদা বেগম মিটিমিটি হেসে শুধালেন, 

'অরুর কলেজ যাবি বুঝি?'
'হ্যাঁ।' ঠান্ডা গলায় জবাব দিল।
'নিয়ে ফিরিস বাসায়৷ বিরিয়ানি রান্না করেছি ওঁর পছন্দের।'
'আচ্ছা।'
'কখন বেরোবি।'
'এইতো বেরোবো এখনই।'
'বাইরে তো ঝোড়ো বৃষ্টি। এরমধ্যে যাবি? বলতি গাড়ি করে এখানে এসেই নামত।'
'ঝড়ঝাপটা নেই এখন। বৃষ্টি শুধু।'

জবেদা বেগম তবুও চিন্তিত। 
.
.
.
চলবে.............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন